মানতে হবে, সব সম্পর্কই রাজনৈতিক
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিভাগে জেন্ডার কোর্সের ক্লাসে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ক্লাসে নারী শিক্ষার্থীরা নারী-পুরুষের সামাজিক নির্মাণ-প্রক্রিয়ার বাইরে আর কী কী উপায়ে আবিষ্কার করতে পেরেছিল, তারা নারী। কিছুক্ষণ চুপ থাকল ক্লাসের সবাই। মেয়েরা কেউ কেউ কানাকানি করল। দু-একজন হাত দিয়ে অন্যজনকে নিষেধ করল বলতে। কিন্তু একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমার প্রতি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসা কোনো কোনো পুরুষ আত্মীয়ের আচরণের মাধ্যমে, পরে যাদেরকে আমাদের বাসায় দেখলে আমি ভয়ে দৌড়ে বাসার সবচেয়ে আড়ালের রুমটিতে যেতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাসায় কাউকে বলিনি, কিংবা কখনো বললেও তারা গুরুত্ব দেয়নি।’ হ্যাঁ। পারিবারিক পরিবেশেই পুরুষ-আত্মীয়দের কারও কারও মাধ্যমে প্রথম আবিষ্কার করতে পেরেছিল, সে মেয়ে এবং ঘরেও সে নিরাপদ নয়। বাইরে যেমন তাকে বখাটেদের ভয়ে দৌড়াতে হয়, ঘরেও। আমরা শুধু ভয়কেন্দ্রিক শারীরিক দৌড় দেখি, মনের দৌড়, ধুকপুকানি দেখি না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে একটি জরিপ চালিয়েছে। ২৩ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত সংবাদে জানা যায়, ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন গত ডিসেম্বরে প্রকাশিত হয়।
সে প্রতিবেদন অনুযায়ী, স্বামীর দ্বারা কোনো না কোনো ধরনের নির্যাতনের শিকার হন ৮৭ দশমিক ৭ শতাংশ নারী। এর মধ্যে ৮১ দশমিক ৬ শতাংশ মানসিক, ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ অর্থনৈতিক, ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ যৌন আর ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ নারী শারীরিক নির্যাতন ভোগ করেন। মধ্যবিত্ত বা উচ্চবিত্তরা অর্থনৈতিক যৌতুকের বিষয়টি দরিদ্রের দিকে ঠেলে দিলেও সাংস্কৃতিক যৌতুককে একান্ত করে রেখেছে। সুন্দরী, শিক্ষিত, সমমর্যাদার এবং বেশ কিছুটা অনুচ্চারিতভাবে থাকা ‘সতীত্ব’—এই চার বিষয় মোড়কে বন্দী করেছে এই সাংস্কৃতিক যৌতুকের বিষয়টি। আর এই প্যাকেজকে সযত্নে চকচকে রাখে নারীর দুই আপন পরিবার—বাবার বাড়ি ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। নারী তাঁর স্বামী কর্তৃক কোনোভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হতে পারেন, এটি কেউ ভাবতে পারেন না, যেখানে যৌনতাকে দাম্পত্য জীবনের শর্ত মনে করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই বিয়ের প্রথম রাতেই অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হন স্বামী দ্বারা। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বিবিএসের এ জরিপ বলেছে, শারীরিক নির্যাতনের শিকার নারীদের মাত্র অর্ধেক চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পান। এক-তৃতীয়াংশ নারীই স্বামীর ভয়ে বা স্বামী সম্মতি না দেওয়ায় চিকিৎসকের কাছ পর্যন্ত যেতেই পারেননি। যৌন নির্যাতনের ক্ষেত্রে ২৬ শতাংশ নারী ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্বামীর সঙ্গে শারীরিক মিলনের সময় আহত হয়েছেন। আর ৩০ শতাংশ স্বামীর ভয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শারীরিক মিলনে বাধ্য হন।
পৃথিবীর মাত্র ১৩টি দেশে ম্যারিট্যাল রেপ নিয়ে আইন থাকলেও যুক্তরাজ্যের মতো উন্নত গণতান্ত্রিক দেশে নেই। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু নেপালে এ নিয়ে আইন আছে। প্রায় ৮৮ শতাংশ নারী বলেছেন, তাঁরা স্বামীর সংসারে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, ৮৬ শতাংশ হন মানসিক নির্যাতনের শিকার আর যৌন নির্যাতনের শিকার হন ৫৫ শতাংশ। সাহস রেখে বলতে পেরেছেন নির্যাতিত হওয়ার কথাটি। অন্যকে এসব নির্যাতন নিয়ে কথা বলার পরিসরটি তৈরি করেছেন। পারিবারিক নির্যাতন শারীরিক, মানসিক কিংবা যৌনই হোক না কেন, এগুলো কোনোভাবেই ব্যক্তিগত বিষয় নয়। পষ্টাপষ্টিভাবে বলতে পারা, বিয়ে সম্পর্ক একটা রাজনৈতিক সম্পর্ক, তাই সব নির্যাতনের রাজনৈতিক মোকাবিলা জরুরি। জরিপে আরও কিছু বিষয় উঠে এসেছে, কর্মক্ষেত্রে এবং পাবলিক পরিসরে নারীর ওপর নির্যাতনের চিত্রও। ১৬ শতাংশ নারী কর্মক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতন, ২৬ শতাংশ মানসিক নির্যাতন আর ২৯ শতাংশ যৌন নির্যাতনের শিকার হন। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যে সংখ্যক নারী শিক্ষার্থী শিক্ষা শেষ করে বের হন এবং শ্রমবাজারে দেখে আমরা উচ্ছ্বসিত হই, কিন্তু তাঁদের অনেককেই পারিবারিক সমর্থন থাকা সত্ত্বেও শ্রমবাজার থেকে ছিটকে পড়া আমাদের শ্রমবাজারে নারীর প্রতিকূল পরিবেশের চিত্রই হাজির করায়। মজুরিবৈষম্য, যৌন হয়রানি,
অনিরাপত্তা, নির্যাতন, নারীর প্রতি অশ্রদ্ধাশীল মনোভাব অনেক নারীকেই শ্রমবাজারে টিকতে দেয় না। রোজগেরে নারী হলেও সংসারের বিভিন্ন বিষয়ে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভূমিকা কিংবা রাজনৈতিকভাবে মত প্রকাশের সুযোগ অনেকটাই কম। জরিপটি থেকে আরও জানা যায়, ১৯ দশমিক ১ শতাংশের নিজের ইচ্ছায় ভোট দিতে পারেন না। আমার বাসায় কাজ করতে আসা খালার সঙ্গে কাটানো আমার অর্ধযুগের যাপিত জীবনে দেখেছি, মাসের শেষে খালার স্বামীটি এসে হাজির হতেন খালার বেতনের টাকাটি নেওয়ার জন্য। শুধু অর্থনৈতিকভাবে দরিদ্র নারীই নয়, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত অনেক নারীর সঙ্গে জীবনভাগে জেনেছি, রোজগার করলেও, সেই টাকা তিনি কখনো নিজের পছন্দে খরচ করতে পারেন না। সব টাকা তুলে দেন স্বামীর হাতে। অর্থনৈতিক মুক্তি কখনো মানুষ হিসেবে নারীর মনের দাম দিতে পারেনি। ‘মন খারাপ করো না, প্রথম সন্তান মেয়ে হলে বাবার ভাগ্য ভালো হয়’ এভাবেই এখনো সামাজিক চাহিদার ক্ষতে মলম লাগানোর মধ্য দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় একটি নারীকে। ব্যতিক্রম যে নেই তা বলব না। নিশ্চয়ই আছে। তারপর সেই মেয়েটি যখন আস্তে আস্তে বড় হয়, তখন সমাজ-সংসারের চোখে ঘুম নেই, মেয়ের বিয়ে হচ্ছে না কেন? তারপর বিয়ে যখন, তার পরের প্রশ্ন। আবার ঘুমহীন সমাজ। বাচ্চা হচ্ছে না কেন? বাচ্চা হলো, আবারও ইনসোমনিয়ায় আক্রান্ত সমাজ। ছেলে নেই? কিংবা মাত্র একটা বাচ্চা? ছেলে হলো তো... কিন্তু সমাজ সজাগ, সংসার সজাগ, ছেলে মানুষ হচ্ছে না কেন? মা কী করে? এই এত্ত এত্ত ‘কেন’-এর লাঠি নারীর প্রতি পড়তে থাকে জীবনজুড়েই
আর এই এটিকে সঙ্গে নিয়েই প্রতিনিয়তই কখনো শারীরিক নির্যাতন, কখনো মানসিক নির্যাতন থেকে রেহাই কিংবা এগুলো গ্রহণ করেই নারী মন নিয়ে নয়, মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে ভালো থাকার চেষ্টা করেন। তার পরও কি মুক্তি মেলে? না, মেলে না। মেলার কথা নয়। বিপদ ঘনিয়েই আসে, কেননা নারী যে বলছেন রোকে ডাল্টনের মতো করে, ‘যৌনতা হচ্ছে রাজনৈতিক শর্ত’। আর তাই সব নির্যাতনের রাজনৈতিক সমীকরণ মেলানো আগে জরুরি। কার সঙ্গে মেলাব এই সমীকরণ? আমরা যে বাবা-মাকে সবচেয়ে আপন ভাবি, সময় এলেই নারী বুঝতে পারি, তাঁদের সঙ্গেই রয়েছে মেয়েটির সবচেয়ে ভয়ের সম্পর্ক। মেয়েটি যখন তার নির্যাতনের অভিজ্ঞতা বাবা-মাকে বলে, তখন তাঁদের অধিকাংশই বলেন, এত মেয়ে থাকতে তোমাকে কেন? নিশ্চয়ই তুমি কিছু করেছ। মেয়েটি আরও ভয় পেয়ে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন একজন জ্যেষ্ঠ পুরুষ শিক্ষক আমাদের একজন নারী সহকর্মীকে যৌন হয়রানিমূলক মেসেজ পাঠিয়েছিলেন, তখন আমরা সেই সহকর্মীকে প্রতিবাদ করার সাহস জোগাচ্ছিলাম। কিন্তু এগোনো যায়নি, সহকর্মী সেই মেসেজগুলো মুছে ফেলেছেন। কারণ হিসেবে জানালেন, তাঁর স্বামী তাঁর মোবাইল চেক করেন এবং এই মেসেজগুলো দেখলে বলবেন, ‘তোমাকেই কেন? অন্য কাউকে না কেন? নিশ্চয়ই তোমার সমস্যা আছে।’ বাবা-মায়ের সঙ্গে আমাদের ভয়ের সম্পর্ক, ভয়ের সম্পর্ক পুরো জীবন কাটানোর স্বপ্ন নিয়ে আমরা যার সঙ্গে একসঙ্গে থাকি, তার সঙ্গেও। তাই যত দিন সম্পর্ক ভয়ের থাকবে, অবুঝ থাকবে, তত দিনই আসলে অসম সম্পর্কের ক্ষমতার ধারালো ঝাঁজ নারীকে মুক্ত নয়, অসুস্থই করে তুলবে।
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
zobaidanasreen@gmail.com
জোবাইদা নাসরীন: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পিএইচডি গবেষক, ডারহাম বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাজ্য।
zobaidanasreen@gmail.com
No comments