এপিং ফরেস্ট নিয়ে রহস্য by ইশরাক পারভীন খুশি
আমি
যখন তড়িঘড়ি ঘুম থেকে উঠে কাজে যাবার জন্য বের হই তখন তোর দিন গড়িয়ে বিকেল।
আমি তখন অমায়িক হাসি হেসে ক্রেতাদের খুশি করবার চেষ্টাই জ্বী সালাম জ্বী
সালাম করছি। আমি একটা বড় রিটেল শপে কাজ করি। সেখানে জিনিসপত্রের দাম অন্য
যেকোনো জায়গার থেকে কম হবার কারণে ঢাকার গাউছিয়ার মতো ভিড়। এরা তাদের
কাপড়গুলো বাংলাদেশ ও ইন্ডিয়া থেকে সেলাই করে আনে। জানিস তো এসব দেশে সময়
হিসাব করে পারিশ্রমিক দেয়। নয় ঘণ্টা কাজে থাকতাম, পারিশ্রমিক পেতাম আট
ঘণ্টার। একঘণ্টা গেল কোথায়? ওই যে লাঞ্চ ব্রেক, সেটা তোমাকে নিতেই হবে আর এ
জন্য তুমি টাকা পাবে না।
এক মিনিট লেট হলে লাল কালি। তিনদিন লেট একটা কাউন্সিলিং, তিনটি কাউন্সিলিং জব চলে যাবার নোটিস।
তবু লন্ডনে কাজে অনেক সুবিধা আছে। বাৎসরিক পেইড হলি ডে পাওয়া যায় দু’এক সপ্তাহ, তিনদিন পর্যন্ত সিক কল দেয়া যায়, ম্যাটারনিটি ছুটি নয় মাস পেইড ও তিন মাস আনপেইড। তারমানে পুরো এক বছর। প্যাটারনিটি ছুটি দু’সপ্তাহ আর বিনা নোটিসে ওরা চাকরিচ্যুত করে না। কিন্তু আমেরিকায় বিপরীত। লন্ডনে সরকার কর্তৃক মিনিমাম পে-বলে একটা বাধা পারিশ্রমিক আছে যার নিচে কোনো মালিক কাজ করাতে পারবে না। যে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোর কাজের চুক্তি তার একমিনিটও বেশি তারা তোকে কাজ করাবে না। প্রয়োজন হলে অনুরোধ করতে পারে। দিন শেষে তুই যা বেতন পাবি সরকার সেখানে ট্যাক্স বসাবে। যদি এক হাজার টাকা উপার্জন হয় তাহলে তিনশ’ টাকা ট্যাক্স। শুধু উপার্জনের ক্ষেত্রে এটি এমন নয়, যা কিনবি একটা কুকিজ হলেও তার সঙ্গে একটা ট্যাক্স জুড়ে দেয়া আছে। আর যে কয় ঘণ্টা কাজ তার পুরো সময় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে। এমন কি ম্যানেজারদেরও একই অবস্থা। জানিস তো এসব দেশে পিয়ন বলে কিছু নেই। ডাক্তাররাও নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে রুগিকে ডেকে নিয়ে আসেন।
একটা নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া মানে শুধু জায়গাটা দেখা নয়, সে জায়গাটির পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে উপযুক্ত গাছটির বেড়ে উঠাতেও আছে চমক। আর একটা অচিন দেশে যেখানে শুরুতে খাপ খাইয়ে নেয়াটা সহজ নয় সেখানে পরিচিত অপরিচিত কথা নয় দেশের মানুষের দেখা মিললে যেন হাতে চাঁদ পাওয়া হয়। হাজারটা ভিন্ন দেশি মানুষের মাঝে দেশের মানুষকে দেখলে মন আকুপাকু করে উঠে। আরে মিয়া বাংলা না বলতে পেরে ক’দিন মনটা কি যে ছটফট করছে। মানুষহীন কোনো জায়গাই সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা পায় না। লন্ডনে চলার পথে এমন কিছু দেশি মানুষের সাহচার্য পাবার সৌভাগ্য হয়েছে তাদের কথা না বললেই নয়। বিদেশ বিভূঁইয়ে শতবর্ণের শতভাষার মানুষের মাঝে দেশের মানুষের দেখা পেলে এক অন্যরকম অনুভূতি হয়। তখন নোয়াখালী কুমিল্লা বলে কোন তফাৎ থাকে না। তখন বাংলাদেশের সব আঞ্চলিক ভাষা এক হয়ে, হয়ে যায় বাংলা।
এক মিনিট লেট হলে লাল কালি। তিনদিন লেট একটা কাউন্সিলিং, তিনটি কাউন্সিলিং জব চলে যাবার নোটিস।
তবু লন্ডনে কাজে অনেক সুবিধা আছে। বাৎসরিক পেইড হলি ডে পাওয়া যায় দু’এক সপ্তাহ, তিনদিন পর্যন্ত সিক কল দেয়া যায়, ম্যাটারনিটি ছুটি নয় মাস পেইড ও তিন মাস আনপেইড। তারমানে পুরো এক বছর। প্যাটারনিটি ছুটি দু’সপ্তাহ আর বিনা নোটিসে ওরা চাকরিচ্যুত করে না। কিন্তু আমেরিকায় বিপরীত। লন্ডনে সরকার কর্তৃক মিনিমাম পে-বলে একটা বাধা পারিশ্রমিক আছে যার নিচে কোনো মালিক কাজ করাতে পারবে না। যে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তোর কাজের চুক্তি তার একমিনিটও বেশি তারা তোকে কাজ করাবে না। প্রয়োজন হলে অনুরোধ করতে পারে। দিন শেষে তুই যা বেতন পাবি সরকার সেখানে ট্যাক্স বসাবে। যদি এক হাজার টাকা উপার্জন হয় তাহলে তিনশ’ টাকা ট্যাক্স। শুধু উপার্জনের ক্ষেত্রে এটি এমন নয়, যা কিনবি একটা কুকিজ হলেও তার সঙ্গে একটা ট্যাক্স জুড়ে দেয়া আছে। আর যে কয় ঘণ্টা কাজ তার পুরো সময় দাঁড়িয়ে কাজ করতে হবে। এমন কি ম্যানেজারদেরও একই অবস্থা। জানিস তো এসব দেশে পিয়ন বলে কিছু নেই। ডাক্তাররাও নিজেই চেয়ার ছেড়ে উঠে রুগিকে ডেকে নিয়ে আসেন।
একটা নতুন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া মানে শুধু জায়গাটা দেখা নয়, সে জায়গাটির পরিবেশের সঙ্গে মিলিয়ে উপযুক্ত গাছটির বেড়ে উঠাতেও আছে চমক। আর একটা অচিন দেশে যেখানে শুরুতে খাপ খাইয়ে নেয়াটা সহজ নয় সেখানে পরিচিত অপরিচিত কথা নয় দেশের মানুষের দেখা মিললে যেন হাতে চাঁদ পাওয়া হয়। হাজারটা ভিন্ন দেশি মানুষের মাঝে দেশের মানুষকে দেখলে মন আকুপাকু করে উঠে। আরে মিয়া বাংলা না বলতে পেরে ক’দিন মনটা কি যে ছটফট করছে। মানুষহীন কোনো জায়গাই সৌন্দর্যের পরিপূর্ণতা পায় না। লন্ডনে চলার পথে এমন কিছু দেশি মানুষের সাহচার্য পাবার সৌভাগ্য হয়েছে তাদের কথা না বললেই নয়। বিদেশ বিভূঁইয়ে শতবর্ণের শতভাষার মানুষের মাঝে দেশের মানুষের দেখা পেলে এক অন্যরকম অনুভূতি হয়। তখন নোয়াখালী কুমিল্লা বলে কোন তফাৎ থাকে না। তখন বাংলাদেশের সব আঞ্চলিক ভাষা এক হয়ে, হয়ে যায় বাংলা।
ফ্রেনচার্চ স্ট্রিট স্টেশনে বার্গার কিং ফাস্ট ফুডের দোকানে গেলে অবাক দৃশ্য চোখে পরে।
একদল বাঙালি ছেলেমেয়ের বাংলা কথায় মুখর বার্গার কিং-এর রান্নাঘর। বাংলা গানও বাজছে মৃদু স্বরে। ঝটপট গরম গরম বার্গার তৈরি হচ্ছে। বিশাল লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষের খাবার অর্ডার নেয়া হচ্ছে। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মচমচে হচ্ছে অন্যদিকে। লাইলা, ইসলাম, সাইদ, আফসানা, ফাতেমা, সনি, লোপা, শফিক, বাদল আরো অনেকেই যেন একেকটা নাম নয়, যেন বাংলাদেশের এক এক অঞ্চল থেকে আসা একেকজন প্রতিনিধি যারা এখানে নতুন একটা পরিবার তৈরি করেছে। মানুষকে ভালোবাসার, আগলে রাখার অমায়িক আঁধার।
এই মানুষগুলোর প্রত্যেকের ভিন্ন দেশে এসে টিকে থাকার, স্বপ্ন পূরণ করার আলাদা আলাদা সংগ্রামের গল্প আছে। আছে নিজস্ব পাওয়া না পাওয়ার হিসাব। তবু এরা পরিবার না হয়েও, রক্তের সম্পর্কের কেউ না হয়েও এক বাংলাদেশের পরিবার হয়ে একে অন্যকে যেভাবে আগলে রাখে তা সারাজীবনেও ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। রুনা-সৌমেন, সামি-মাসুদ, হিমন-নার্গিস, তনু-বাসার, শুভ-আছিয়া, চৈতি, সাগর, স্বাগত, জুননুন, কামরুল-জেসমিন, ইশতিয়াক আরো অনেকেই এরা সবাই এক পরিবারের অংশÑ যে পরিবারের নাম বাংলাদেশ।
পপলার সিটির লুবক হাইজের নাম হয়ে গেল স্পতবাসান যেখানে বাংলাদেশের সাতটি অঞ্চলের সাতটি ছেলে একটা পরিবার গড়ে তুলেছে। ওরা সারাদিন কাজ, স্কুল ও পড়াশোনা শেষে রুটিন করে সাতজনেই ভাগাভাগি করে ঘরের কাজ করে। একেকজন একেক দিন রান্না করে। বিপদে-আপদে, অসুখে-বিসুখে কাঁধে কাঁধ মিলায়। রাজিব, সনি, আজম, কানন, রসি, আদনান, সুব্রত এই সাতে স্পতবাসান কোলাহলে মুখর। কারো জন্মদিন হলে কেক মাখামাখি চলে, ঈদে পাতিল ভরে বিরিয়ানী রান্না হয়। দিনের মাঝে কাজের ফাঁকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দেশে প্রিয়জনের সঙ্গে কথা বলেই মনকে শান্ত করে ওরা। একজন বিয়ে করে স্পতবাসান ছাড়লে আরেকজন ওই শূন্যস্থান পূরণ করে। আমি আমার এই ভ্রমণকালীন সময়ে এ পর্যন্ত নোয়াখালী কুমিল্লা বরিশাল শুধু নয় সব এলাকার মানুষের দেখা পেয়েছি।
একদিন মুনমুন মস্কো থেকে তার পরিবার নিয়ে এলো লন্ডন ঘুরতে, একদিন বিশ্বজিৎ স্যার, আকাশ স্যার এলেন লন্ডন ঘুরতে। দিনগুলো পাখির ডানায় ভর করে উড়ে গেল স্মৃতির খাঁচায় জমা হতে। একদিন আকরাম এলো বাংলাদেশ থেকে লন্ডনে সেমিনারে অংশ নিতে। দেশের গর্ব আমাদের প্রাণের উচ্ছ্বাস। আকরামকে নিয়ে এপিং ফরেস্টে ঘুরতে গেলাম। গেলাম কিউ গার্ডেনে। কিউ গার্ডেন অসম্ভব সুন্দর একটি জায়গা। প্রতিটি মহাদেশীয় গাছপালা ফুল ফল নিয়ে তৈরি করেছে অঞ্চলভিত্তিক সংগ্রহশালা। কত ধরনের ক্যাকটাস যে আছে। কত ছোট আর কত বিশাল আকৃতির ক্যাকটাস যে দেখলাম। দেখলাম গ্রিনহাউসের মধ্য সব মহাদেশীয় বৃক্ষরাজি। এশিয়ার অংশে পেলাম নারকেল আম কলাসহ আরও অনেক বৃক্ষমালা। ফুল ফল লতা এমন কি মানুষখেকো গাছ। শাপলা, পদ্ম, বিশালাকৃতির পদ্ম পাতাও। সাজানো গোছানো সবুজ, সবুজের মাঝে রংবেরঙের সমাহার।
আকরামকে নিয়ে আরো গেলাম এপিং ফরেস্টে। সবুজ ঘন বন। হাঁটতে হাঁটতে ঢুকে পড়লাম বনের ভেতর। গা ছমছমে ভাব। তার ওপর আসার আগে লোকমুখে শুনেছিলাম এপিং ফরেস্টের একটা রাস্তাই গাড়ি পার্ক করে রাখলে সেটা নাকি একা একাই চলতে থাকে। আমরা অবশ্য পাতাল রেলেই গিয়েছিলাম। গাড়ি রাখবার ঝামেলা ছিল না। আমার আবার পাহাড়ে গেলে, বনে বা খোলা প্রান্তরে গেলেই দু’হাত ছড়িয়ে প্রাণ খুলে চিৎকার দিতে ভালো লাগে। এত সবুজ আর নির্জন বনের মধ্য ঢুকে প্রাণ খুলে দিলাম এক চিৎকার। সে চিৎকার বনের নীরবতা ভঙ্গ করে প্রতিধ্বনিত হয়ে ঝঙ্কার দিয়ে উঠল। আমরা তিনজন হাঁটতে থাকলাম। হাঁটতে হাঁটতে এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা হলো সে মুখটা কাঁচমাঁচু করে ভয় পাওয়া স্বরে আমাদের জিজ্ঞাসা করল তোমরা কি কিছুক্ষণ আগে একটা চিৎকার শুনেছো? আমরা একে অন্যের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বললাম কই না তো। সে আরো ভয় পেয়ে বলল আগেই শুনেছিলাম এখানে এমন চিৎকার শুনতে পাওয়া যায়, এখন দেখছি এটা সত্যি। দ্রুত পায়ে সে প্রস্থান করতেই আমরা হাসিতে ফেটে পড়লাম।
(লেখকঃ টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী)
No comments