বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে গভীর
বাংলাদেশে এবারের সংকট অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন এবং আরো গভীর মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক আলী রীয়াজ। অতীতে বাংলাদেশ যত ধরনের রাজনৈতিক সংকট বা অনিশ্চয়তার মোকাবিলা করেছে এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির আপাতত মিল থাকলেও এবারের সংকট আরও গভীর। গত ৬ জুলাই শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিরাজুল ইসলাম লেকচার হলে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ গতিপ্রকৃতি’- শীর্ষক গণবক্তৃতায় এসব কথা বলেন তিনি। রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট ও জ্ঞানতাপস আবদুর রাজ্জাক ফাউন্ডেশন যৌথভাবে এ বক্তৃতার আয়োজন করে। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে তা আসলে হাইব্রিড রেজিম বা দো-আঁশলা ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থায় দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদান থাকলেও সেগুলো প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভর করে। ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাঁদেরকে একধরনের দায়মুক্তি দেয়া হয়। তিনি বলেন, বর্তমানে পৃথিবীর ১৬৭টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশের অবস্থাই এই রকম। ১৯৯০-এর দশকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে কিছু দেশ এই ধরনের ব্যবস্থায় উপনীত হলে অনেকেই মনে করেছিলেন যে এই ধরনের দেশগুলো সম্ভবত আস্তে আস্তে গণতন্ত্রের দিকেই অগ্রসর হবে। কিন্তু গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, হাইব্রিড রেজিমের পরিবর্তনের পথরেখা গণতন্ত্র অভিমুখী নয়, বরঞ্চ কর্তৃত্ববাদের দিকেই। তিনি আরো বলেন, যে কোনো হাইব্রিড রেজিমকে টিকে থাকার জন্যে নির্বাচন, নির্বাহী ও আইন সভা এবং বিচার ব্যবস্থার ওপরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দরকার হয়। শেষ তিনটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র তৈরি হয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দলের উপস্থিতি এবং ক্ষমতার হাত বদলের মধ্য দিয়ে নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই কারণে যে ক্ষমতাসীনদের কাজের বৈধতা তৈরি হয় একমাত্র নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়েই, সেই নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হলো কিনা সেটা আর বিবেচ্য থাকে না। অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, যেহেতু নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেহেতু আর সব ধরনের জবাবদিহির ব্যবস্থা চূর্ণ করে ফেলাই হচ্ছে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উপায়। বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, সহিংসতার ব্যাপক বিস্তারের যে সব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তি এখানেই। তিনি বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের কারণ এবং রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা চিহ্নিত করতে গিয়ে বক্তা বিরাজমান শাসনের ধরন নিরূপণের পাশাপাশি সমাজ-রাজনীতিতে নতুন শ্রেণিবিন্যাসের প্রতিক্রিয়া, ইসলামপন্থিদের প্রভাব এবং ভারতের ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেন, গত কয়েক দশকে যে সব দেশে এই ধরণের হাইব্রিড রেজিম তৈরি হয়েছে সেখানে এক ধরনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই ‘উন্নয়নে’র ফলে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির সৃষ্টি হয়েছে যাদের মধ্যে অতীতের মধ্যবিত্ত শ্রেণির মতো গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং অংশগ্রহণমূলক সমাজের স্বপ্ন অনুপস্থিত। এই শ্রেণিী যে বিরাজমান হাইব্রিড রেজিমের রাজনৈতিক এজেন্ডার পক্ষে থাকবেন সেটাই স্বাভাবিক, কারণ তাঁদের অস্তিত্ব কার্যত নির্ভর করছে এই ব্যবস্থা অব্যাহত থাকার সঙ্গে। এ নতুন শ্রেণি দেশের অর্থনীতিতে বিরাজমান দুর্নীতি এবং লুণ্ঠনের প্রক্রিয়াকে ভবিষ্যতে বৈধতা প্রদানের হাতিয়ার হবে। অনুষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধান সমস্যা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানের অভাব। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি এবং তা ব্যক্তিনির্ভর। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সহায়ক না হয়ে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে দেশের মানুষ নিরাপত্তাহীনতা, অধিকারহীনতায় ভুগছেন। এ সমস্যার প্রতিকারের উপায় অনুসন্ধান করা জরুরি এবং তা করতে হবে তরুণদের।
No comments