সিঙ্গাপুর প্রবাসী শ্রমিকদের মনে শান্তি নেই
সাত
বছর আগের কথা। তখনই প্রথম সিঙ্গাপুরের মাটিতে পা রাখেন বাংলাদেশের
মোহাম্মদ আবদুল কাদির। উন্নত ভবিষ্যতের জন্য সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমালেও প্রথম
রাতগুলো তার কেটেছে কেঁদে কেঁদে। তখন কাদিরের বয়স ২৬ বছর। যুবক মানুষ। দেশে
ফেলে এসেছেন স্ত্রী, সন্তান, পরিবার। রাতেই তাদেরকে ফোন করেন। কিন্তু
নিজের ভিতরে যে ক্ষত, কষ্ট তা কারো কাছে প্রকাশ করেন নি তিনি। সেই ফোনকল
যখনই শেষ হয় তখনই কাদিরেরর গণ্ড বেয়ে অঝোরে ঝরতে থাকে অশ্রু। তখন নিজের
কাছে নিজেই প্রশ্ন করতে থাকেন- কেন আমি সিঙ্গাপুরে এসেছি? সিঙ্গাপুরে
রয়েছেন হাজার হাজার অভিবাসী শ্রমিক। প্রতি বছর নতুন নতুন শ্রমিক যোগ হচ্ছেন
তাদের সঙ্গে। কিন্তু নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাজকে যতটা স্বাচ্ছন্দ্যময় বলে
মনে করেছিলেন তিনি বা তারা আসলে তা নয়। কাদির যখন দেশ ছেড়ে যান তখন তার
বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়রা তাকে এক স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন,
সিঙ্গাপুর এমন একটি দেশ যা চকচকে পরিষ্কার। মানুষগুলো বন্ধুপ্রতীম। সবাই
আইন মেনে চলে। সর্বোপরি তারা ভালো বেতন দেয়। তা দিয়ে উন্নত জীবন যাপন করা
যায়। এসব কথার অনেকটাই সত্যি। তবে ব্যত্যয় রয়েছে কোনো কোনো ক্ষেত্রে। কাদির
বলেছেন, সিঙ্গাপুর আসলেই এক স্বপ্নের দেশ। কিন্তু শ্রমিকদের জন্য তা কঠিন।
শ্রমিকরা ভোর ৬টায় ঘুম থেকে ওঠেন কাজে যাওয়ার জন্য। আর ফিরে আসেন রাত
১১টায়। তারপর গোসল করে নামাজ আদায়, খাবার খেতে খেতে মধ্যরাত। এর অর্থ হলো
বিশ্রামের জন্য সময় ৬ ঘণ্টা। এ জন্যই আমরা স্বপ্নের ছোঁয়া পাচ্ছি না- বললেন
কাদির। দীর্ঘ সময় কাজ করে ক্লান্ত হয়ে যান কাদির। তিনি ইসলামিক স্টাডিজে
অর্জন করেছেন মাস্টার্স ডিগ্রি। তবু তাকে এই কাজ বেছে নিতে হয়েছে। তিনি এখন
কাজে যেতে ভয় পান। কারণ, অনেক সুপারভাইজারের কথা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না।
ফলে তারা তার ওপর ক্ষেপে যান। তাদের কথা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না কাদির। তিনি
নিজেই বলেন, এর আগে আমি যেখানে কাজ করেছি তা ছিল একটি চীনা কোম্পানি। আমি
ইংরেজি এবং বাংলায় কথা বলেছি। কিন্তু তারা আমার কথা বুঝতে পারে না। আবার
তারা যখন চীনা ভাষায় কথা বলেন, তখন আমি তাদের কথা বুঝতে পারি না। এতে
সুপারভাইজাররা মাঝেমাঝেই রেগে আগুন হয়ে যান। তাই আমার জীবন হয়ে ওঠে
মারাত্মক কঠিন। নতুন যেসব শ্রমিক আসেন সিঙ্গাপুরে তাদের সবারই এই ভাষাগত
সমস্যায় পড়তে হয়। এমন এক কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে কাদির সিদ্ধান্ত নেন বাড়ি
চলে আসবেন। যদিও তিনি বুঝতে পারেন এটা কোনো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
কাদিরের বাড়ি কুমিল্লা। সেখানে কৃষিকাজ করতেন। ফার্ম করতেন। তা থেকে যা আয়
হতো তা পরিবার চালানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। তাই তাকে ঋণের ওপর থাকতে হতো।
এমন অবস্থায় কাদিরের মতো যেসব শ্রমিক সিঙ্গাপুরে গিয়েছেন তারা সবই
বাংলাদেশের লোক নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। এক একজন শ্রমিক
সিঙ্গাপুরে পাঠাতে এসব প্রতিষ্ঠান ৫০০০ থেকে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত হাতিয়ে
নেয়। এই অর্থ শোধ করতে বিদেশগমনেচ্ছু শ্রমিকদেরকে ব্যাংকের কাছ থেকে বা
আত্মীয়দের কাছ থেকে বড় অঙ্কের অর্থ ধার করতে হয়। ফলে সিঙ্গাপুরে পৌঁছানোর
পরের এক বা দু’বছরের বেতন যায় ওই ঋণ শোধে। কর্মক্ষেত্রে ভাষাগত সমস্যা যখন
বড় হয়ে দেখা দেয় তখন একদিন একজন ম্যানেজারের কাছে যান কাদির। ওই ম্যানেজার
ভালো ইংরেজি জানেন। তার কাছে কাদির বলেন- এখানে ভাষা বোঝা আমার জন্য খুব
সমস্যার। কিভাবে মান্দারিন বলতে হয় আমাকে শিখিয়ে দেবেন। তারপর আমি তা অন্য
শ্রমিকদের বুঝিয়ে দেবো। কাদির এরই মধ্যে আস্থা অর্জন করে নিয়েছেন। তিনি
কর্মদক্ষ। তার ওপর ম্যানেজার ও সহকর্মীরা খুব আস্থাশীল। ফলে তিনি পদোন্নতি
পেতে থাকেন। বর্তমানে তিনি সেখানে একজন সিনিয়র শ্রমিকের মর্যাদা পেয়েছেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তার বুকজুড়ে আছে দেশে ফেলে যাওয়া পরিবারের কথা। ২০১২
সালে দেশ ছেড়ে গিয়েছেন কাদির। রেখে গেছেন তিন বছর বয়সী এক ছেলে ও এক বছর
বয়সী এক মেয়ে। তিনি সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমানোর ৬ মাস পরে জন্ম হয়েছে তার তৃতীয়
সন্তান। বর্তমানে তার তিন সন্তানের বয়স যথাক্রমে ১০, ৮ ও ৬ বছর। প্রতিদিন
তাদের খবর নিতে বাড়ি ফোন করেন। তখন সবকিছু ছেড়ে বাড়ি চলে আসতে ইচ্ছে করে।
বিশেষ করে পবিত্র রমজানে এমনটা বেশি মনে হয়। এখন থেকে ৬ বছর আগে তিনি
পরিবারের সঙ্গে শেষ রোজা পালন করেছেন। আবার সামনে পবিত্র ইদুল ফিতর। এবারও
পরিবার ছেড়ে তাকে থাকতে হবে সিঙ্গাপুরে। স্ত্রী ও সন্তানদের থেকে অনেক
দূরে। এজন্য কান্নায় বুক ভেঙে আসে। সেই কষ্ট চাপা দিয়ে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত
জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে হয় তাকে। একবার সন্তানের মুখ দেখার আকুতি বুকে
চেপে চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। বুকের ভিতরে কষ্ট লালন করে তিনি সামনে তাকান।
অনেক কাজ বাকি। সব শেষ করতে হবে। ঈদে বাড়ির সবার জন্য টাকা পাঠাতে হবে।
সেজন্য অনেক তাড়া তার।
No comments