মেয়ররা কতটুকু সফল হবেন? by হারুন-আর-রশিদ

গত ২৮ এপ্রিল তিন সিটি নির্বাচন নিয়ে প্রতিদিন কোনো-না-কোনো টিভি চ্যানেলে ঢাকা ও চট্টগ্রামের দেড় শতাধিক ওয়ার্ডের ওপর নানা সমস্যা নিয়ে প্রতিবেদন প্রচারিত হয়েছিল। কেমন আছেন দেশের বড় দু’টি শহরের প্রায় তিন কোটি মানুষ? মেয়র ও কমিশনার প্রার্থীরা মানুষের কাছে গিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন- নির্বাচিত হলে এলাকার চেহারা পাল্টে দেবেন। নির্বাচন এলেই ভোটের প্রয়োজনে দেয়া এসব প্রতিশ্রুতির কথা প্রার্থীরা কেউ আর মনে রাখেন না। এলাকায় কোনো অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির আসনে বসে দু-একটি কথা বলে দায় সারেন বছরে দু-একবার এসে। নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক ব্যালান্স, আপনজনের ফরমায়েশি কাজে তাদের সময় কেটে যায়। নির্বাচন ও লোক দেখানো অনুষ্ঠানে যোগদান করা ছাড়া জনগণের দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা বলতে গেলে নগণ্য।
ঢাকা মহানগরীর প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষ যে কত কষ্টে আছে, সেসব লিখতে গেলে তা একটি বড় গ্রন্থে রূপ নেবে। ১৯৪টি রাষ্ট্রের রাজধানী শহরের মধ্যে ঢাকার অবস্থান প্রায় সর্বনিম্নে। জাতিসঙ্ঘ এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়নচিত্রে এসব কথা উঠে এসেছে। তার পরও দেশের নীতিনির্ধারকদের টনক নড়ছে না। একসময়ে বিশ্বে পঞ্চম স্থান অধিকারী ঢাকার অবস্থান স্বাধীনতার ৪৫ বছরের দ্বারপ্রান্তে এসে এত দুর্বল অবকাঠামো ও বর্জ্যরে শহর হিসেবে আন্তর্জাতিক লজ্জা অর্জন করার কথা ছিল না। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নিয়ে টকশো, নানা বিবৃতি ও আলোচনা সভা ছাড়া চেতনার আসল বিষয়গুলো নিয়ে কেউ ভাবছেন বলে মনে হয় না। প্রকৃত চেতনার সুফল হলো- উৎকর্ষ।
আমরা এক অসুস্থ সমাজে বাস করছি। ঢাকার বাতাসে বিষ, খাদ্যে বিষ, এমনকি পানিও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত। স্কয়ার হাসপাতালের একজন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বলতে গিয়ে এসব কথা শুনতে হয়েছে। জিজ্ঞেস করেছিলাম- হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে কেন? তখন তিনি ওই উত্তরটি দিলেন। আরো বললেন, ‘ঢাকাকে যদি ডিসেন্ট্রালাইজড করা না হয়, তাহলে রোগব্যাধি আরো বহুমুখী রূপ নেবে। বসবাসের অযোগ্য হবে ঢাকা।’ তাই বলছিলাম- নির্বাচনের সময় এলেই জনপ্রতিনিধিরা জনগণের কাছে একটি ভোটের জন্য যেভাবে বিনম্রচিত্তে আসেন, সেই ধার সারা বছর চালু রাখতে পারলে স্থানীয় সরকারের দায়িত্বটি পালনের যোগ্য বলে বিবেচিত হতেন। মানুষ চায় তাদের দুঃখদুর্দশার বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে। জনপ্রতিনিধিরা উপলব্ধি করুক তারা কিভাবে নগরীতে দিন অতিবাহিত করছে। আজ লোকাল গভর্নমেন্টকেও দলীয় খাঁচায় বন্দী করা হয়েছে। জনগণের ভোটের অধিকার গত বছর ৫ জানুয়ারি যেভাবে হরণ করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই এখন জনগণের নাগরিক অধিকারগুলোও খর্ব করা হচ্ছে। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের সময় যে মনোভাব নিয়ে মানুষের কাছে ধরনা দেন, সেটা পরবর্তী সময়ে আর দেখা যায় না। নির্বাচনকালে প্রতিটি ওয়ার্ডে টিভি চ্যানেলের ক্যামেরার ছড়াছড়ি, প্রার্থীদের আনাগোনা এবং এলাকাবাসীর সাথে ডায়ালগ- এসব দেখলে মনে হয়, এরা কত দেশদরদি। মনে হয়েছিল, ঢাকাকে যত শিগগির সম্ভব তিলোত্তমা নগরীতে পরিণত করে ফেলবেন। কিন্তু ঢাকা শ্বাসরুদ্ধকর একটি নগরীতে পরিণত হয়েছে। কোথাও বিশুদ্ধ বাতাস নেই। ঢাকা মহানগরী ঘিরে চারটি নদী এখন ‘মৃত্যুকূপে’ রূপ নিয়েছে। পানি যেমন দূষিত, তেমনি দখলি রাজত্বে নদী এখন মৃতপ্রায়। নদীর যদি বাকশক্তি থাকত, তাহলে জোরগলায় এর প্রতিবাদ করত। সেচ, মৎস্য ও যাতায়াতে নদী দিচ্ছে সেবা, আর আমরা করছি দূষণ ও দখল। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীকে শুধু বাংলাদেশের মানুষ নয়, বিশ্বের পর্যটকেরাও জানেন ও চেনেন সিটিদ্বয় বর্তমানে যান, জন ও জলজটের শহর। অল্প বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা বিশ্বের কোনো শহরে হয় না- যেটা ঢাকা ও চট্টগ্রামে অবলোকন করা যায়। ঢাকা শহরে শুধু নতুন এয়ারপোর্ট থেকে গণভবন ও বঙ্গভবন সংলগ্ন সড়ক দু’টি মোটামুটি চলনসই। বহির্বিশ্ব থেকে আগত মেহমানদের যাতে দুর্ভোগে পড়তে না হয়, সে জন্য ভিআইপি খ্যাত সড়ক দু’টি টেকসই করে তৈরি করা হয়েছে। বাকি সড়কগুলোর কোনোটির অবস্থা মানুষের নিরাপদ চলাচলের উপযোগী নয়। রাস্তায় ময়লাবাহী কনটেইনার পড়ে থাকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। প্রায় সব ওয়ার্ডে এই দৃশ্য দেখা যাবে। বায়ুদূষণের মূল কারণ যথাসময়ে, অর্থাৎ কাকডাকা ভোরে ময়লা-আবর্জনা অপসারণ না করা। প্রতিটি ওয়ার্ডে থাকছে বছরে কয়েকবার খোঁড়াখুঁড়ির চরম অব্যবস্থা। স্থায়ী সড়ক নির্মাণের যে নিয়ম উন্নত বিশ্বে চালু রয়েছে, সেটি ২১ শতকেও বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারেনি। অবৈধ অর্থ আয়ের পথটি যাতে সারা বছর চালু থাকে, সে কারণেই সরকারি ইচ্ছায় কাজটি দলীয় লোকজনদের অবৈধ ভরণপোষণের জন্য চালু রাখা হয়েছে। এর ফলে যে নাগরিক সুবিধা চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে, সেটা সরকারের সুনজরে আসেনি। ভোগান্তি বাড়ছে এসব কারণে। প্রায় ওয়ার্ডেই রাস্তা ভাঙা নি¤œমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহারের কারণে। আবর্জনা সড়কপথের দুই পাশে পড়ে থাকে। পানি যা পাওয়া যায়, তাও ময়লামিশ্রিত থাকার কারণে পানযোগ্য নয়। বিদ্যুতের যন্ত্রণা ছাড়াও যানজটে স্বাস্থ্যহানি ও বিপুল কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়। নিয়মিত ছিনতাই, ডাকাতি, রাহাজানি, ধর্ষণ, ইভটিজিং ও সন্ত্রাসী দানবদের খুনখারাবি নগরীকে গ্রাস করেছে। অপরিকল্পিত নির্মাণ, অবৈধ স্থাপনা, নিম্নমানের স্যুয়ারেজ পাইপের দুর্গন্ধযুক্ত ময়লা পানি উপচে পড়া। মহানগরীর প্রায় এলাকাবাসীর অভিমত, নগরীর প্রধান সমস্যা এই পয়ঃব্যবস্থা। বর্তমানে বুড়িগঙ্গা নদীর দূষিত পানির সাথে যোগ হয়েছে স্তূপীকৃত আবর্জনা ও ট্যানারি বর্জ্য। সদরঘাট বা ওয়াইজঘাটে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীদের মুখে রুমাল দিয়ে লঞ্চে উঠতে হয়। বিশ্বের কোনো রাজধানী শহরে এ রকম দূষিত নদী আছে বলে আমাদের জানা নেই। আমরা বসবাস করছি বর্তমান ডিজিটাল সরকারের পশ্চাৎপদ চরম অ্যানালগ মহানগরীতে।
কিভাবে বলি ডিজিটাল সরকার? এখনো ডিজিটাল শব্দটির অর্থ আমরা জানি না। এশিয়ায় ডিজিটাল দেশ বলতে গেলে চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়াকে বোঝায়। বাকিগুলো এখনো ডিজিটাল পূর্ণমাত্রায় অর্জন করতে পারেনি। ঢাকাকে দ্বিখণ্ডিত করা হলো- উত্তর ও দক্ষিণের নামে। মানুষ খণ্ডিত ঢাকা দেখতে চায়নি। এ দিকে দুর্নীতির রাস্তা আরো প্রসারিত হলো। ঢাকায় যে গণপরিবহনগুলো চলে, এমন যান বিশ্বের কোনো রাজধানী শহরে আছে বলে জানা নেই। ৪৫ বছর সময় একটি দেশের জন্য কম নয়। ঢাকা শহরটিকেই এখনো আধুনিক ছিমছাম শহরে আমরা পরিণত করতে পারিনি। এই ব্যর্থতার দায় সরকারকে নিতে হবে। স্থানীয় সরকারকে যারা দলীয় সরকারে রূপ দিয়েছেন, তারা চরম ভুল করেছেন। কারণ, স্থানীয় সরকার বলতে আমরা বুঝি- এলাকার মানুষদের সাথে সরাসরি সংশ্লিষ্টতার সরকার। সেটা এখন আর নেই দলীয় খাঁচায় বন্দী হওয়ার কারণে। দলীয় লোকদের ‘সেবাদান’ করেই তাদের সময় কেটে যাবে। জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা শোনারও সময় পাবেন না দলীয় খাঁচায় বন্দী হওয়া মেয়র ও ওয়ার্ড কমিশনাররা। অনেকেই তাই ভাবছেন ভোট দিয়ে লাভ কী?
দলীয় মোড়কে আবদ্ধ নগরীর জনপ্রতিনিধিদের পরিচয় একটিÑ তারা বিশেষ দলের লোক। তাই দলীয় চরিত্রের বাইরে ভূমিকা পালন করা অসম্ভব। স্থানীয় সরকার ও জাতীয় সরকারের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকছে না বিধায় জনগণের কল্যাণসাধন অনেকটাই কঠিন করে তোলা হয়েছে।
‘পরিবর্তন সম্ভব, পরিবর্তন চাই’- এটা বাস্তবে রূপ নেবে না বর্তমান পরিস্থিতিতে। দলীয় নেতাদের মনোনীত প্রার্থীরা অনেকটাই ধার করা প্রার্থীর মতো। জনগণের পছন্দের প্রার্থী এবং দলের পছন্দের প্রার্থী এক না-ও হতে পারে। তিন সিটি করপোরেশনের প্রার্থীদের জবাবদিহিতার বিষয়টিও প্রকারান্তরে ছিনতাই করা হলো। মূল কথা হলো- তিন সিটি করপোরেশনের প্রার্থীরা যেসব চমক লাগানো ব্যানারে নগরবাসীর কাছে ভোটের জন্য হাজির হয়েছিলেন এবং ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন- তা কতটুকু বাস্তবায়ন হবে, সেটা বিরাট প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে থাকছে। আগামী পাঁচ বছরে এসব প্রশ্নের জবাব জনগণ খুঁজে নেবে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আ’লীগের প্রার্থী আনিসুল হক (ব্যবসায়ী নেতা) ১১ এপ্রিল ইশতেহার ঘোষণাপত্রে উল্লেখ করেছিলেন পরিচ্ছন্ন সবুজ, আলোকিত ও মানবিক ঢাকা গড়ে তোলার কথা। সে কথা তার মনে আছে কি?
১১ এপ্রিল নিজের মালিকানাধীন জাদুটিভির কার্যালয়ে আনিসুল হক নির্বাচিত হলে পাঁচ বছরের মধ্যে ঢাকা উত্তর ‘নির্দিষ্ট একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে নাগরিকদের সামনে দৃশ্যমান’ হবে বলে ইশতেহারে উল্লেখ করেন। এ রকম চমক লাগানো ইশতেহার মেয়র হানিফ, মেয়র সাদেক হোসেন খোকাও ঘোষণা করেছিলেন ঢাকাকে সত্যিকার তিলোত্তমা নগরী হিসেবে জনগণকে উপহার দেবেন বলে। কার্যত আমরা উপহার পেলাম ইট-পাথরের বস্তির নগরী। খেলার মাঠও দখল হয়ে গেছে। দখল হয়ে গেছে ঢাকার ঐতিহ্য, শতাধিক খাল। যানজট ও জলাবদ্ধতায় নাকাল হয়ে গেছে গোটা শহর। দখল হয়েছে ফুটপাথও। মাদক ব্যবসায়ীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে পুরো মহানগরী। দলীয় সরকারের মেয়ররা জনগণের খেদমত বেশি করতে পারেন না, তার প্রমাণ বিগত আমলের দুই দলের প্রভাবশালী মেয়রদ্বয়। মেয়ররা জনগণের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করলে ঢাকা বসবাসের অযোগ্য শহর হিসেবে পরিচিতি পেত না। কবে এ দেশের নেতৃত্বদাতারা মানবিক মূল্যবোধে পূর্ণ মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনে সক্ষম হবেন? তা হলেই নগর-বন্দর-শহর, গ্রামগঞ্জ, জেলা, উপজেলা তথা গোটা বাংলাদেশ প্রকৃত অর্থে বিশ্বের দরবারে সুশৃঙ্খল জাতি আর উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদায় সমাসীন হবে।
লেখক : গ্রন্থকার ও গবেষক
Em.harunrashid@g.mail.com

No comments

Powered by Blogger.