রাজনীতিতে ‘ড্রাগন’
ফলাফল কি হবে তা কারও জানা নেই। তবে
রাজনীতিতে অচলাবস্থা চলতে থাকলেও সেখানে এসেছে এক নিঃশব্দ অতিথি। রাজনীতির
মাঠে ইতিমধ্যেই ঢুকে পড়েছে সে। সে এক নতুন প্লেয়ার। নতুন জার্সি।
সে
জার্সিতে ড্রাগনের ছবি আঁকা। আর দেশটির নাম চীন। অন্তত দেশের প্রধান
বিরোধী দল বিএনপি ‘দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে’ চীনের অভিষেককে সন্তুষ্টির
সঙ্গে স্বাগত জানিয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। সুতরাং, আগামী দিনের নির্বাচন ও
সরকারে থাকার প্রক্রিয়ায় চীনা রাষ্ট্রদূতের ভূমিকার প্রতি ঢাকার কৌতূহলী
পর্যবেক্ষকরা নজর রাখবেন। বর্তমান চীনা রাষ্ট্রদূত হলেন লি জুন। বাংলাদেশে
আসার আগে তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নে চীনা রাষ্ট্রদূত ছিলেন। ৫৪ বছর বয়স্ক এ
রাষ্ট্রদূতের আমলেই ঢাকার চীনা দূতাবাস এই প্রথম একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি জারি
করেছে যেখানে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে চীনা আগ্রহ সরাসরি ও
নির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা হয়েছে।
এটা কাকতালীয়, ভারতের চণ্ডীগড় সফররত নেপালি সেনাপ্রধান গৌরব শমসের জং বাহাদুর রানার একটি বিতর্কিত বক্তব্য টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ছাপা হওয়ার পাঁচ দিনের ব্যবধানে গত ৯ই অক্টোবর ঢাকার চীনা দূতাবাস ওই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলো। নেপালি সেনাপ্রধানের বরাতে গত ৪ঠা অক্টোবর চণ্ডীগড় ডেটলাইনে খবর ছাপা হয়, নেপালি সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘তিব্বত ও জিনজিয়াং অঞ্চলে বিচ্ছিন্নতাবাদ সামলাতে চীনকে এতটাই ব্যস্ত থাকতে হয়, নেপাল যুদ্ধে জড়িয়ে পড়লেও চীনের পিপল লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) নেপাল বা ভারতের ভূখণ্ডে প্রবেশে সক্ষম হবে না। ছয় দিনের সরকারি সফরে ভারতে আসা রানা আরও বলেন, কোন আক্রমণ বা যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ভারতের দ্বারাই চীনের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সাড়া দেয়া সম্ভব। যদিও এ বিষয়ে ভারতের রাজনৈতিক ইচ্ছার ঘাটতি রয়েছে।’ গত জুলাইয়ে একই ধরনের সরকারি সফরে চীনফেরত নেপালি সেনাপ্রধান বলেন, ‘ভারতের সঙ্গে নেপালের সম্পর্কের তুলনা চলে না।’ তিনি অবশ্য স্মরণ করেন, ‘নেপালের বৈদেশিক নীতি যথারীতি জোটনিরপেক্ষ আর তার মূলমন্ত্র হলো নেপাল কোন দেশকেই সামরিক সমর্থন দেবে না।’
উল্লেখ্য, এ বিবৃতি ছাপা হলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার মুখে নেপালি সেনাপ্রধান ৫ই অক্টোবরে দেশে ফিরেই একটি বিবৃতি দেন। এতে তিনি দাবি করেন, তিনি ভারত সফরকালে কোন সংবাদ মাধ্যমকেই কোন ‘আনুষ্ঠানিক সাক্ষাৎকার’ দেননি। টাইমস অব ইন্ডিয়া বলেছে, চীনা আর্মি অরুণাচল প্রদেশের শাগলাগাম এলাকার ২০ কি. মি. পর্যন্ত এলাকায় গত আগস্টের আগে একটি ‘ইনরোড’ তৈরি করেছে। রানা অভিযোগ করেছেন, ভারতের লাদাখ ও অরুণাচল প্রদেশ এলাকায় চীনা রেড আর্মির অনুপ্রবেশ একটি সাধারণ ঘটনা।
বাংলাদেশের রণকৌশলগত বিশেষজ্ঞরা সবসময় বিশ্বাস করে আসছেন, ভারত ও চীনের ঐতিহ্যগত স্নায়ুপীড়নের মধ্যে উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশ সন্নিহিত ‘চিকেন নেক’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত এলাকা হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ প্রেক্ষাপটে ভারত ও যুক্তরাষ্টের তরফে বাংলাদেশের সমুদ্র বন্দর ব্যবহারের ক্রমবর্ধমান আগ্রহের বিষয়টিকেও বিচার বিশ্লেষণ করা হয়। যদিও বাংলাদেশের দুই প্রধান দলই চীনের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে সামরিক সম্পর্ক বজায় রাখছে। গত মাসে সাম্যবাদী দল আয়োজিত এক চীনা অনুষ্ঠানে তিন মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সাহারা খাতুন এবং দিলীপ বড়ুয়া বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে দৃঢ়তা কামনা করে বক্তব্য রাখেন।
সম্প্রতি সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. মাহবুবুর রহমান অবশ্য বলেন, প্রধানমন্ত্রী তার সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকার সমরাস্ত্র কিনেছেন। এসব অস্ত্র চীনের কাছ থেকে আরও কম দামে কেনা যেতো। চীন এ ঘটনাকে সুনজরে দেখতে পারে না বলে ইঙ্গিত দেন তিনি। এদিকে বিএনপির একজন উচ্চ পর্যায়ের নেতা বলেছেন, মিয়ানমার থেকে চীন শিক্ষা নিয়েছে। তাই তাদের এখন থেকে হয়তো বাংলাদেশ রাজনীতিতে অধিকতর আগ্রহী পর্যবেক্ষক হিসেবে দেখা যাবে। মিয়ানমারের শাসক জান্তার সঙ্গে চীন দীর্ঘকাল ধরে সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে। তারা কখনও অং সান সুচি বা অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহ দেখায়নি। এর ফলে পরিবর্তন যখন এলো তখন তার প্রতিদ্বন্দ্বী যুক্তরাষ্ট্র থেকে তারাই পিছিয়ে পড়লো।
চীন অবশ্য বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও ইদানীং অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। গত মাসেই কম্বোডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রকে বিব্রত করেছে চীন। ক্ষমতাসীন দলের দ্বারা নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠায় যুক্তরাষ্ট্র সে ফলাফলের প্রতি নীরব থাকে। কিন্তু চীন আগ বাড়িয়ে ফলাফল সন্তোষজনক আখ্যা দিয়ে বিবৃতি দেয়। বাংলাদেশে তাদের ভূমিকার দিকে এখন অনেকেই নজর রাখতে শুরু করেছেন। তারা বাংলাদেশ রাজনীতি এতকাল সতর্কতার সঙ্গে হ্যান্ডেল করছিল। দুই নেত্রীকে তারা সবসময় হিসাব করেই নিমন্ত্রণ জানিয়েছে বেইজিংয়ে।
দেশীয় রাজনীতিতে বিদেশী কূটনীতি বাংলাদেশে একেবারেই নতুন ঘটনা নয়। নির্বাচন ও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে কমবেশি টানাপড়েন বাংলাদেশ রাজনীতিতে গা সওয়া ঘটনা। ‘টুয়েসডে গ্রুপ’ তো বহুল আলোচিত। ঈশান কোণে মেঘ জমলেই হলো। টুয়েসডে গ্রুপ সক্রিয় হতো। এখন আর এটা সেভাবে নেই। তবে এটা ছিল বস্তুত পশ্চিমা কূটনীতিকদেরই একটি সম্মিলনী। সরকার পরিবর্তন কেন্দ্রিক অঘটন কিংবা ডামাডোল একটা কিছু হলেই হলো। সবার আগে যে নামটি ভেসে আসে সেটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। স্নায়ুযুদ্ধকালে বৃটেন আর আমেরিকা ছিল সমার্থক। এরপর বৃটেন আড়ালে চলে যায়। তার পরিবর্তে আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশেষ করে এক-এগারোতে ইউএনডিপি জোরালো ভূমিকা রাখে। আর এবারে এলো ড্রাগনের দেশ চীন।
লক্ষ্যণীয় যে, গত ৯ই অক্টোবরের চীনা বিবৃতিতে স্পষ্টতই বিএনপির অবস্থানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়েছে। চীনা রাষ্ট্রদূত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, সাম্প্রতিককালে বিএনপি তার কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালন করছে বলে তাঁর নজরে এসেছে। তিনি বলেন, ২৫শে অক্টোবরের পরে বিএনপি বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে যাবে বলেই আমি ধারণা করি। আমি বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতের কর্মসূচিও শান্তিপূর্ণ হবে। বিএনপি সম্পর্কে তিনি আরও বলেন, ‘একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপি সামাজিক স্থিতি, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং দেশের জাতীয় ঐক্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে।’ আর সমঝোতা সম্পর্কে বলেন, চীন আশা করে, উভয় পক্ষ পরস্পরের প্রতি শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে চলবে। কারণ, আসন্ন নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও ন্যায্য হয় সে বিষয়ে তাদের মধ্যে ঐকমত্য রয়েছে।
No comments