রহস্যময় হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন জ্যাকব by আব্দুল কাইয়ুম
‘আমি জেনারেল নিয়াজিকে ৩০ মিনিট সময় দিয়ে বললাম, এই আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করতে রাজি কি না...।’ কথাগুলো কানে আসতেই আমি ত্বরিত বেগে ফিরে তাকাই। ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল জে এফ আর জ্যাকবকে ঘিরে তন্ময় হয়ে সবাই শুনছেন তাঁর কথা। গত ১৫ ডিসেম্বর বিকেলে রয়েল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবে সামরিক টাট্টু ও ব্যান্ড প্রদর্শনীতে আমরা গিয়েছি। সেখানে এসেছেন ৮৬ বছরের প্রাণোচ্ছল, চিরসবুজ জেনারেল জ্যাকব। একাত্তরের স্মৃতিতে হঠাত্ তিনি জ্বলে উঠলেন। মুখে এক দ্যুতিময় রহস্যের হাসি ছড়িয়ে রাখলেন।
প্রতিবছরের মতো এবারও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে কলকাতায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমাদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আইনুদ্দিন, বীর প্রতীক এবং সেনাবাহিনীতে বর্তমানে কর্মরত মেজর জেনারেল আবদুল মতিন। অপেক্ষাকৃত তরুণ ক্যাপ্টেন শাহ আসলাম পারভেজ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এ কে এম সোলায়মানও ছিলেন। নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জালাল আহমেদ সিদ্দিকী, কর্নেল বজলুল গনি পাটোয়ারী, কর্নেল আমিনুল ইসলাম, মেজর ওয়াকার হাসান, মুক্তিযুদ্ধের সময় মেলাঘর বিশ্রামগঞ্জ ফিল্ড হাসপাতালের মেডিকেল কর্মী মিনু হক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যসচিব এমদাদ হোসেনসহ আরও কয়েকজন। মূল অনুষ্ঠান ১৬ ডিসেম্বর। তার আগেই জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, ভাবিনি।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে আত্মসমর্পণ করে, সে কথা বহুবার বহু কথায় উচ্চারিত হয়েছে। জেনারেল জ্যাকবও তাঁর লেখা সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব এ নেশন বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। জেনারেল নিয়াজিকে জেনারেল জ্যাকব ৩০ মিনিট সময় দিয়েছিলেন মন স্থির করার জন্য। ফিরে এসে তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, জেনারেল সাহেব, আপনি কি এই দলিল গ্রহণ করছেন? তিনবার জিজ্ঞেস করলেন। কোনো উত্তর নেই। জেনারেল জ্যাকব দলিলটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি এটি গ্রহণ করছেন।’ জেনারেল নিয়াজির শেষ ইচ্ছা ছিল ঢাকা অফিসে আত্মসমর্পণ করার। কিন্তু জেনারেল জ্যাকব রাজি হননি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উন্মুক্ত মাঠে সবার সামনে আত্মসমর্পণ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। জনসমক্ষে আত্মসমর্পণের উদাহরণ ইতিহাসে অদ্বিতীয়। পরে পাকিস্তানে হামুদুর রহমান কমিশনের কাছে জেনারেল নিয়াজি বলেন, জেনারেল জ্যাকব ধোঁকাবাজি (ব্ল্যাকমেইল) করে তাঁকে আত্মসমর্পণে রাজি করিয়েছিলেন!
সেদিন টার্ফ ক্লাবে জেনারেল জ্যাকবের কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ল তাঁর বইয়ের ঐতিহাসিক বিবরণীগুলো। আমি এগিয়ে যাই তাঁর দিকে। বাংলাদেশের সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় পেয়ে তিনি আনন্দে উদ্ভাসিত হলেন। জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৩৮ বছর পর আপনার অনুভূতি কী? তিনি বললেন, ‘আমি বাংলাদেশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি। বাংলাদেশের উন্নয়ন দ্রুততর হোক। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি।’
পরদিন ১৬ ডিসেম্বর সকালে ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের বিজয় স্মারক প্রাঙ্গণে বিজয়োত্সবের মূল অনুষ্ঠান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি-ইন-চিফ লে. জেনারেল ভি কে সিংয়ের আমন্ত্রণে আমরা সেখানে যাই। বাইবেল, পবিত্র কোরআন শরিফ, গীতা ও ত্রিপিটক ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। স্মারকস্তম্ভে প্রথমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে মাল্যদান করা হয়, এরপর অন্যরা। দুপুরে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে জেনারেল ভি কে সিং ও জেনারেল জ্যাকব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধিদলের সদস্যদের হাতে উপহারসামগ্রী তুলে দেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকেও তাঁদের হাত তুলে দেওয়া হয় বন্ধুত্বের আবেগসিক্ত উপহার।
আমরা যখন কলকাতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামছি, তখন থেকেই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জালালউদ্দিন বারবার আমাকে বলছিলেন, একটু ভালোভাবে লক্ষ করে দেখবেন একটি গণতান্ত্রিক দেশের সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্যগুলো। বিমানবন্দরেই তার কিছুটা প্রমাণ পেলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার গৌতম দেবসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁরা কিন্তু খুব সাধারণ, সাদাসিধে ধরনের মানুষ। বিমানবন্দরে সাধারণ যাত্রীরা যেমন, আমাদের প্রতিনিধিদলও প্রায় তেমনিভাবেই যাই। সেখানে অভ্যর্থনার বাড়তি লোক দেখানো আয়োজন যেমন নেই, তেমনি নেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার ঘাটতি।
গণতান্ত্রিক সেনাসংস্কৃতির আরও পরিচয় পেলাম ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আর্মি অফিসার্স ইনস্টিটিউটে আয়োজিত মিলিটারি ব্যান্ড কনসার্ট ও অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে। একাত্তরে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনী হিসেবে যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর যে সদস্যরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই সেখানে ছিলেন। এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ও মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অবাক লাগল এ জন্য যে আর কোনো মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে সেখানে দেখিনি। এ ব্যাপারে আমি ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি-ইন-চিফ লে. জেনারেল ভি কে সিংকে জিজ্ঞেস করি, মন্ত্রীরা কেন নেই। আমাদের দেশে তো এ ধরনের অনুষ্ঠানে সবাই আসেন। তিনি বললেন, সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তবে সাধারণত গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া অন্যরা আসেন না। তিনি জানান, এ ধরনের অনুষ্ঠানের পুরো কর্মসূচি প্রণয়ন ও অনুষ্ঠান পরিচালনার খুঁটিনাটি ইস্টার্ন কমান্ড নিজেরাই করে থাকে। সেখানে সরকার বা অন্য কোনো অংশের সংশ্লিষ্টতা থাকে না। তিনি অবশ্য বলেন, যদি মন্ত্রী ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারা আসতেন, তাহলে ভালোই হতো। তাঁরাও বিজয় উত্সবের এই মহান আয়োজনের অংশীদার হতে পারতেন। কিন্তু প্রথাগতভাবেই তাঁরা সামরিক সংশ্লিষ্টতা থেকে দূরে থাকেন।
রাজনৈতিক সরকার বা দলীয় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাহীন সশস্ত্র বাহিনীই একটি গণতান্ত্রিক দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ভারতে এ প্রথাটি খুব যত্নের সঙ্গে অনুসরণ করা হয় বলেই দীর্ঘ ৬২ বছরের ইতিহাসে ভারতের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটেনি। অনেক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে ঘটেছে ঠিক তার উল্টো ঘটনা। একের পর এক সেনা হস্তক্ষেপে পাকিস্তানে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। নানা রকম সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তত্পরতায় জর্জরিত দেশটির অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। বাংলাদেশেও প্রথম দিকে রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে। দুবার সামরিক শাসন চেপে বসেছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে অবশ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারা ফিরে এসেছে। একে স্থায়ী রূপ দিতে পারলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র পরিপুষ্ট হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
সন্ধ্যার সেই অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে কথা হলো ব্রিগেডিয়ার এ এস ব্রার-এর সঙ্গে। তিনি একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লার লালমাই ঘাঁটি দখলে নেতৃত্ব দেন। সেই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করছিলেন তিনি। ত্রিপুরা থেকে লালমাই পার হয়ে চিটাগাং-ঢাকা রোড ধরে দাউদকান্দি পর্যন্ত যান। পরে আবার ফিরে আসেন কুমিল্লায়। লালমাই দখলের যুদ্ধে অনেক ভারতীয় সেনাসদস্য প্রাণ দান করেন। তাঁদের স্মৃতিতে তিনি অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। কর্নেল এস আর ভট্টাচার্যের সঙ্গেও কথা হলো। একাত্তরে ছিলেন ক্যাপ্টেন। মূলত গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতেন। তিনি ৯০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট সীমান্ত পার হয়ে তিনি বাংলাদেশে ঢোকেন। দুবার বালুচ রেজিমেন্ট সদস্যদের হাতে ধরা পড়লেও উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তিনি তাদের হাত গলে বেরিয়ে আসেন। ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গে তিনিও উপস্থিত ছিলেন।
কর্নেল সন্তোষ সরকার এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার কথা বললেন। তিনি ও কর্নেল দাস ১৩ ডিসেম্বর একটি বাহিনী নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হন। আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে নরসিংদী। ১৮ ডিসেম্বর রাতে তাঁরা পৌঁছান ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) হোটেলে। পেট চোঁ চোঁ করছে। দুই দিন প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি। খাবারের খোঁজে তাঁরা বেরোলেন। হোটেল সাকুরার পাশের গলিতে একটু এগিয়ে তাঁদের চোখে পড়ল একটি সাইনবোর্ড: ‘শনিবারের বিশেষ আকর্ষণ—ভুনা খিচুড়ি ও হাঁসের মাংস!’ সেদিনের সেই উপাদেয় খাবারের স্বাদ আজও তিনি ভোলেননি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর এক হাজার ৪২১ জন আত্মদান করেন। আহত হন চার হাজার ৫৮ জন। অবশ্য বিভিন্ন গবেষণায় ভারতীয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। এই বিজয়ের মাসে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
প্রতিবছরের মতো এবারও ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে কলকাতায় ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের একটি প্রতিনিধিদলকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমাদের দলের নেতৃত্বে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল মুহাম্মদ আইনুদ্দিন, বীর প্রতীক এবং সেনাবাহিনীতে বর্তমানে কর্মরত মেজর জেনারেল আবদুল মতিন। অপেক্ষাকৃত তরুণ ক্যাপ্টেন শাহ আসলাম পারভেজ ও ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এ কে এম সোলায়মানও ছিলেন। নেতৃস্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এজাজ আহমেদ চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ জালাল আহমেদ সিদ্দিকী, কর্নেল বজলুল গনি পাটোয়ারী, কর্নেল আমিনুল ইসলাম, মেজর ওয়াকার হাসান, মুক্তিযুদ্ধের সময় মেলাঘর বিশ্রামগঞ্জ ফিল্ড হাসপাতালের মেডিকেল কর্মী মিনু হক, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কমান্ড কাউন্সিলের সদস্যসচিব এমদাদ হোসেনসহ আরও কয়েকজন। মূল অনুষ্ঠান ১৬ ডিসেম্বর। তার আগেই জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে, ভাবিনি।
একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ময়দানে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তানি বাহিনী কীভাবে আত্মসমর্পণ করে, সে কথা বহুবার বহু কথায় উচ্চারিত হয়েছে। জেনারেল জ্যাকবও তাঁর লেখা সারেন্ডার অ্যাট ঢাকা: বার্থ অব এ নেশন বইয়ে বিস্তারিত লিখেছেন। জেনারেল নিয়াজিকে জেনারেল জ্যাকব ৩০ মিনিট সময় দিয়েছিলেন মন স্থির করার জন্য। ফিরে এসে তাঁকে চুপ করে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, জেনারেল সাহেব, আপনি কি এই দলিল গ্রহণ করছেন? তিনবার জিজ্ঞেস করলেন। কোনো উত্তর নেই। জেনারেল জ্যাকব দলিলটি হাতে নিয়ে বললেন, ‘আমি ধরে নিচ্ছি, আপনি এটি গ্রহণ করছেন।’ জেনারেল নিয়াজির শেষ ইচ্ছা ছিল ঢাকা অফিসে আত্মসমর্পণ করার। কিন্তু জেনারেল জ্যাকব রাজি হননি। তিনি জোর দিয়ে বলেন, রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) উন্মুক্ত মাঠে সবার সামনে আত্মসমর্পণ করতে হবে। শেষ পর্যন্ত তা-ই হলো। জনসমক্ষে আত্মসমর্পণের উদাহরণ ইতিহাসে অদ্বিতীয়। পরে পাকিস্তানে হামুদুর রহমান কমিশনের কাছে জেনারেল নিয়াজি বলেন, জেনারেল জ্যাকব ধোঁকাবাজি (ব্ল্যাকমেইল) করে তাঁকে আত্মসমর্পণে রাজি করিয়েছিলেন!
সেদিন টার্ফ ক্লাবে জেনারেল জ্যাকবের কথা শুনতে শুনতে মনে পড়ল তাঁর বইয়ের ঐতিহাসিক বিবরণীগুলো। আমি এগিয়ে যাই তাঁর দিকে। বাংলাদেশের সাংবাদিক ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় পেয়ে তিনি আনন্দে উদ্ভাসিত হলেন। জিজ্ঞেস করলাম, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের ৩৮ বছর পর আপনার অনুভূতি কী? তিনি বললেন, ‘আমি বাংলাদেশের উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি কামনা করি। বাংলাদেশের উন্নয়ন দ্রুততর হোক। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ভারতের সঙ্গে সহযোগিতার সম্পর্ক বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করি।’
পরদিন ১৬ ডিসেম্বর সকালে ছিল ফোর্ট উইলিয়ামের বিজয় স্মারক প্রাঙ্গণে বিজয়োত্সবের মূল অনুষ্ঠান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি-ইন-চিফ লে. জেনারেল ভি কে সিংয়ের আমন্ত্রণে আমরা সেখানে যাই। বাইবেল, পবিত্র কোরআন শরিফ, গীতা ও ত্রিপিটক ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠ করে অনুষ্ঠানের সূচনা হয়। স্মারকস্তম্ভে প্রথমে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে মাল্যদান করা হয়, এরপর অন্যরা। দুপুরে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে জেনারেল ভি কে সিং ও জেনারেল জ্যাকব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা প্রতিনিধিদলের সদস্যদের হাতে উপহারসামগ্রী তুলে দেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকেও তাঁদের হাত তুলে দেওয়া হয় বন্ধুত্বের আবেগসিক্ত উপহার।
আমরা যখন কলকাতা নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বোস আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামছি, তখন থেকেই ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জালালউদ্দিন বারবার আমাকে বলছিলেন, একটু ভালোভাবে লক্ষ করে দেখবেন একটি গণতান্ত্রিক দেশের সেনাবাহিনীর বৈশিষ্ট্যগুলো। বিমানবন্দরেই তার কিছুটা প্রমাণ পেলাম। আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার গৌতম দেবসহ কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। তাঁরা কিন্তু খুব সাধারণ, সাদাসিধে ধরনের মানুষ। বিমানবন্দরে সাধারণ যাত্রীরা যেমন, আমাদের প্রতিনিধিদলও প্রায় তেমনিভাবেই যাই। সেখানে অভ্যর্থনার বাড়তি লোক দেখানো আয়োজন যেমন নেই, তেমনি নেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাপনার ঘাটতি।
গণতান্ত্রিক সেনাসংস্কৃতির আরও পরিচয় পেলাম ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আর্মি অফিসার্স ইনস্টিটিউটে আয়োজিত মিলিটারি ব্যান্ড কনসার্ট ও অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে। একাত্তরে বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে মিত্রবাহিনী হিসেবে যুদ্ধে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর যে সদস্যরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই সেখানে ছিলেন। এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের গভর্নর গোপালকৃষ্ণ গান্ধী ও মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অবাক লাগল এ জন্য যে আর কোনো মন্ত্রী বা উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে সেখানে দেখিনি। এ ব্যাপারে আমি ইস্টার্ন কমান্ডের জিওসি-ইন-চিফ লে. জেনারেল ভি কে সিংকে জিজ্ঞেস করি, মন্ত্রীরা কেন নেই। আমাদের দেশে তো এ ধরনের অনুষ্ঠানে সবাই আসেন। তিনি বললেন, সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো হয়, তবে সাধারণত গভর্নর ও মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া অন্যরা আসেন না। তিনি জানান, এ ধরনের অনুষ্ঠানের পুরো কর্মসূচি প্রণয়ন ও অনুষ্ঠান পরিচালনার খুঁটিনাটি ইস্টার্ন কমান্ড নিজেরাই করে থাকে। সেখানে সরকার বা অন্য কোনো অংশের সংশ্লিষ্টতা থাকে না। তিনি অবশ্য বলেন, যদি মন্ত্রী ও অন্য সরকারি কর্মকর্তারা আসতেন, তাহলে ভালোই হতো। তাঁরাও বিজয় উত্সবের এই মহান আয়োজনের অংশীদার হতে পারতেন। কিন্তু প্রথাগতভাবেই তাঁরা সামরিক সংশ্লিষ্টতা থেকে দূরে থাকেন।
রাজনৈতিক সরকার বা দলীয় রাজনৈতিক সম্পৃক্ততাহীন সশস্ত্র বাহিনীই একটি গণতান্ত্রিক দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। ভারতে এ প্রথাটি খুব যত্নের সঙ্গে অনুসরণ করা হয় বলেই দীর্ঘ ৬২ বছরের ইতিহাসে ভারতের রাজনীতিতে সেনা হস্তক্ষেপ ঘটেনি। অনেক বাধা-বিপত্তি সত্ত্বেও গণতন্ত্রের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানে ঘটেছে ঠিক তার উল্টো ঘটনা। একের পর এক সেনা হস্তক্ষেপে পাকিস্তানে গণতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে। নানা রকম সন্ত্রাসী ও জঙ্গি তত্পরতায় জর্জরিত দেশটির অস্তিত্বই আজ বিপন্ন। বাংলাদেশেও প্রথম দিকে রাজনীতিতে সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটেছে। দুবার সামরিক শাসন চেপে বসেছে। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর থেকে অবশ্য নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারা ফিরে এসেছে। একে স্থায়ী রূপ দিতে পারলে আমাদের দেশে গণতন্ত্র পরিপুষ্ট হয়ে ওঠার সুযোগ পাবে।
সন্ধ্যার সেই অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে কথা হলো ব্রিগেডিয়ার এ এস ব্রার-এর সঙ্গে। তিনি একাত্তরের ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লার লালমাই ঘাঁটি দখলে নেতৃত্ব দেন। সেই বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের স্মৃতিচারণা করছিলেন তিনি। ত্রিপুরা থেকে লালমাই পার হয়ে চিটাগাং-ঢাকা রোড ধরে দাউদকান্দি পর্যন্ত যান। পরে আবার ফিরে আসেন কুমিল্লায়। লালমাই দখলের যুদ্ধে অনেক ভারতীয় সেনাসদস্য প্রাণ দান করেন। তাঁদের স্মৃতিতে তিনি অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন। কর্নেল এস আর ভট্টাচার্যের সঙ্গেও কথা হলো। একাত্তরে ছিলেন ক্যাপ্টেন। মূলত গোয়েন্দা বিভাগে কাজ করতেন। তিনি ৯০০ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পাঠানো হয়। পশ্চিমবঙ্গের বালুরঘাট সীমান্ত পার হয়ে তিনি বাংলাদেশে ঢোকেন। দুবার বালুচ রেজিমেন্ট সদস্যদের হাতে ধরা পড়লেও উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তিনি তাদের হাত গলে বেরিয়ে আসেন। ঢাকায় আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গে তিনিও উপস্থিত ছিলেন।
কর্নেল সন্তোষ সরকার এক চমকপ্রদ অভিজ্ঞতার কথা বললেন। তিনি ও কর্নেল দাস ১৩ ডিসেম্বর একটি বাহিনী নিয়ে ঢাকার দিকে রওনা হন। আখাউড়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে নরসিংদী। ১৮ ডিসেম্বর রাতে তাঁরা পৌঁছান ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল (বর্তমানে শেরাটন) হোটেলে। পেট চোঁ চোঁ করছে। দুই দিন প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি। খাবারের খোঁজে তাঁরা বেরোলেন। হোটেল সাকুরার পাশের গলিতে একটু এগিয়ে তাঁদের চোখে পড়ল একটি সাইনবোর্ড: ‘শনিবারের বিশেষ আকর্ষণ—ভুনা খিচুড়ি ও হাঁসের মাংস!’ সেদিনের সেই উপাদেয় খাবারের স্বাদ আজও তিনি ভোলেননি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মিত্রবাহিনীর সদস্য হিসেবে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর এক হাজার ৪২১ জন আত্মদান করেন। আহত হন চার হাজার ৫৮ জন। অবশ্য বিভিন্ন গবেষণায় ভারতীয় পক্ষের হতাহতের সংখ্যা আরও বেশি বলে ধারণা করা হয়। এই বিজয়ের মাসে আমরা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক।
No comments