পলাতক অপুর নির্দেশেই চলছে শুটিং!
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে সবচেয়ে সুবিধাভোগী ছিলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। ভাইয়ের ছত্রছায়ায় শুটিংয়ে রামরাজত্ব কায়েম করেন অপু। ছিলেন বাংলাদেশ অলিম্পিক এসোসিয়েশনের উপ-মহাসচিবের দায়িত্বে। সবশেষ প্যারিস অলিম্পিকে বাংলাদেশ দলের শেফ দ্যা মিশন ছিলেন অপু। সব জায়গাতে মন্ত্রী ভাইয়ের ক্ষমতা দেখাতেন। সংগঠকদের ভয় দেখানো, অবৈধ অস্ত্র বিক্রি, পছন্দের শুটারদের বিদেশে নিয়ে যাওয়া এবং ফেডারেশনের কার্যালয়কে নিজের অফিস বানিয়ে রেখেছিলেন অপু। শুটিং ফেডারেশনকে এক প্রকার স্বৈরাচারী, স্বেচ্ছাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ করে তুলেছিলেন। সেই অপু দেশ ছেড়ে পালালেও শুটিংকে নিজের কব্জায় রাখতে বিদেশে বসেই নানা কৌশল ও নির্দেশনা দিতে থাকেন। অনিয়মের প্রতিবাদ করলেই শুটারদের ওপর নেমে আসতো নিষেধাজ্ঞার খড়্গ। ক্যাম্প থেকে বহিষ্কার করার সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ দেয়া ছিল বন্ধ। মিষ্টভাষী, সব অন্যায় মেনে নেয়া শুটাররা হয়ে যান অপুর আস্থাভাজন! এই আস্থাভাজন খেলোয়াড়রা ছিল বাংলাদেশ শুটিং স্পোর্টস ফেডারেশনের মহাসচিবের সব অপকর্মের সহায়তাকারী। তাদের সঙ্গে ছিলেন ফেডারেশনের দুই কর্মকর্তা।
শুটিংয়ের গুলি নিয়ে নয়ছয় করার অভিযোগ রয়েছে সহকারী কোচ গোলাম মহিউদ্দিন শিপলুর বিরুদ্ধে। অপুর যোগসাজশে বাজেটের হিসাবে গরমিল করে ম্যানেজার দেবাশীষ বিশ্বাসও ফেডারেশন থেকে টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। সরকার পতনের পর ইন্তেখাবুল হামিদ অপু পালিয়ে বিদেশে চলে গেলেও তার অনুপস্থিতিতে ফেডারেশন সামলাচ্ছেন শিপলু ও দেবাশীষের সঙ্গে কয়েকজন শুটার।
দুর্নীতি, অনিয়মের সঙ্গে অপুর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ স্বজনপ্রীতির। ২০১৮ সালে প্রতিভাবান শুটারকে বাদ দিয়ে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিজের মেয়ে আমিরা হামিদকে পাঠানো হয়েছিল বুয়েন্স আয়ার্সে যুব অলিম্পিকে। সেখানে বাছাই পর্বে মাত্র ৬০৯ স্কোর করে ১৭তম হয়ে বাদ পড়েছিলেন তার মেয়ে। শুধু তাই নয়, সর্বশেষ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ গেমসে স্কোর দৃশ্যমান বলে ১০ মিটারে তার মেয়েকে খেলাননি অপু। ৫০ মিটারে দূরে মারতে হয় আর অফিসিয়াল স্কোর গুনে এনে পরে প্রকাশ করেন। দুর্নীতি করে তার মেয়েকে প্রথম বানানোর অভিযোগ আছে অপুর বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক গেমসে নিয়মতান্ত্রিকভাবে দল গঠন না করার অভিযোগ আছে অপুর বিরুদ্ধে। এই কাজে তিনি ব্যবহার করেন সহকারী কোচ শিপলুকে।
প্যারিস অলিম্পিকের বাছাইয়ের জন্য ব্রাজিল, স্পেন এবং জার্মানিতে হয়েছিল শুটিংয়ের বাছাই পর্ব। মূলত অলিম্পিকের স্কলারশিপে যাদের নাম থাকে, যেকোনো ফেডারেশন ওই অ্যাথলেটকে পাঠাতে বাধ্য থাকে। কিন্তু শুটিং ফেডারেশনের মধ্যে স্কলারশিপে শায়েরা আরেফিন এবং কামরুন নাহার কলির নাম ছিল। অথচ শায়েরাকে এই তিনটি গেমসে পাঠালেও কলিকে পাঠানো হয়নি। কিন্তু কেউই সরাসরি অলিম্পিকের টিকিট কাটতে পারেননি।
বিষয়টি নজরে আনলে সহকারী কোচ শিপলুর দাবি, যার স্কোর বেশি তাকেই প্রতিযোগিতায় পাঠানো হয়েছে। অথচ জ্যোতি এবং জিদানের স্কোর কলির চেয়েও খারাপ ছিল, তার পরও তাদের পাঠানো হয়েছে নতুন শুটার তৈরির লক্ষ্যে। শুধু তাই নয়, উঠতি শুটাররা যেন আরও বড় তারকা হয়ে উঠতে না পারেন, সেজন্য অনুশীলনের সময় দুই সিনিয়র খেলোয়াড়কে লেলিয়ে দিতেন শিপলু। মনোবল ভেঙে দিতে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতেন কোচ শিপলু এবং দুই সিনিয়র শুটার। কোনো কোচিং জ্ঞান না থাকলেও শিপলুই যেন রেঞ্জে শুটিংয়ের সর্বেসর্বা। আন্তর্জাতিক শুটাররা সারাদিন ক্যাম্প করেন ডিজিটাল মনিটরে। কিন্তু অ্যানালগ রেঞ্জের প্রায় ২০টি লেইন সারা বছর খালি থাকা সত্ত্বেও যেসব ক্লাব নিজ খরচে প্র্যাকটিস করতে ইচ্ছুক, তাদেরও অনুশীলন করতে দেয়া হয় না। বারবার ক্লাবগুলো থেকে চিঠি দিলেও মহাসচিব এসবের কোনো তোয়াক্কা করেননি বলে অভিযোগ আছে। বাংলাদেশ নেভির নিজস্ব রেঞ্জ নেই। তারা শুটিং ফেডারেশনের এই রেঞ্জ ব্যবহার করতে চাইলেও দেননি অপু। এমনও অভিযোগ আছে, শুটারদের ভালো মানের খাবার দিতো না ফেডারেশন। যখন কোনো মিডিয়া যেত, সেই সময়ে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করে অপু বোঝাতে চাইতেন তিনি মানসম্মত খাবার দিতেন শুটারদের। অপুর আস্থাভাজন শিপলু গুলি নিয়ে করতেন নয়ছয়। শিপলুর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তার পছন্দের শুটারদের বেশি দামে গুলি দিতেন। অপছন্দের শুটারদের খারাপ গুলিটা ধরিয়ে দিতেন। এসব অপকর্ম মহাসচিব অপু, সহকারী কোচ শিপলু এবং ম্যানেজার দেবাশীষ চক্র করতো বলে অভিযোগ উঠেছে। বিদেশ সফর নিয়েও সক্রিয় ছিল অপুর এই চক্রটি। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় কোনো বাহিনীর শুটার বিদেশে খেলতে গেলে পুরো খরচ বহন করে ওই সার্ভিসেস সংস্থাটি। বাহিনীর দেয়া অর্থ দিয়ে ফেডারেশনের কর্মকর্তাদেরও পাঠাতেন। নির্বাহী কমিটিতে ৭০ থেকে ৮০ বছরের মতো এমন অনেক ব্যক্তিকে ঢুকিয়েছেন অপু, যাদের শুটিংয়ের জ্ঞান নেই বললেই চলে। সম্প্রতি শুটিং ফেডারেশনে অপুর অনিয়ম এবং স্বেচ্ছাচারিতা তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন বঞ্চিত সাবেক শুটাররা। তারা এই কমিটি ভেঙে দেয়ার দাবি জানিয়েছিলেন। তবে বর্তমানে খেলা অনেক শুটার এই কমিটির সমালোচনাকারী এসব সাবেক শুটারকেও ফেডারেশনে চাচ্ছেন না। বরং শুটিংয়ের উন্নয়নে নিঃস্বার্থভাবে যারা কাজ করবেন, তাদের চাচ্ছেন তারা।
No comments