রুয়ান্ডার যুদ্ধশিশুদের কথা by আশিস আচার্য
রুয়ান্ডার যুদ্ধশিশু |
মা-বাবার
কথা জিজ্ঞেস করলেই ডেভিড অস্বস্তি বোধ করে। প্রসঙ্গ এড়াতে সে আরও অনেকের
মতোই আড়াল খোঁজে। তারা হচ্ছে রুয়ান্ডার যুদ্ধশিশু। দেশটিতে গণহত্যা চলাকালে
ধর্ষণের শিকার নারীদের গর্ভে জন্ম তাদের। ১৯ বছর বয়সী ডেভিড বলে, ‘আমার
কোনো বাবা নেই।’
১৯৯৪ সালের ওই গণহত্যার সময় ঠিক কতজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, বলা অসম্ভব। তাই সেই সময়ের যুদ্ধশিশুর সংখ্যা নির্ণয় করাটাও ২০ বছর পর একই রকম কঠিন হয়ে পড়েছে। নির্যাতিত অধিকাংশ নারীকেই পরে হত্যা করা হয়েছিল। আর যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁরা ওই দুঃসহ ঘটনা সম্পর্কে চুপ থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন।
রুয়ান্ডায় ওই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে আনুমানিক আট লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। জাতিগত দ্বন্দ্বের জেরে মূলত তুতসি জাতিগোষ্ঠীর লোকজন ওই আক্রমণের শিকার হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রুয়ান্ডায় গণহত্যাকালে ধর্ষণই ছিল রীতি এবং এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এসব ঘটনার কোনো পরিসংখ্যান নেই। গণহত্যার মূল হোতারা সুপরিকল্পিতভাবে ধর্ষণকে তাদের ‘অস্ত্র’ হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
জন্ম-পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্নের মুখোমুখি ডেভিডের আচরণে ‘বিস্ময়’ এবং ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ পায়। পরে সে বলে, ধর্ষণের একটি ঘটনা থেকে তার জন্ম হয়েছে এবং এই বাস্তবতা ‘মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই’। তবে বিষয়টি সম্পর্কে সে আরও জানতে চায়।
বাবা সম্পর্কে ডেভিডের ভাষ্য, ‘আমার মায়ের গায়ের রং শ্যামলা। আর আমি বেশি কালো। আমি জানতে চাই, লোকটা দেখতে কেমন।’
ডেভিডের মা এস্টার ব্যাখ্যা করেন, তাঁর ছেলে সব ঘটনার বিস্তারিত জানে না। সে বেশি কথা বলে না। তাই সে আসলে কী ভাবছে, তা জানাটা সত্যিই কঠিন।
সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায় ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল গণহত্যা শুরু করে। তুতসি সম্প্রদায়ের নারী এস্টার তখন কিগালি শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। একদল নারীর সঙ্গে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের সীমান্ত অতিক্রমের সময় সিয়াংগুগু সীমান্ত শহর এলাকায় তাঁকে ধর্ষণ করে একজন মিলিশিয়া।
এস্টার সেদিনের বর্ণনা দেন, ‘একজন নারী আমাদের একটি বাড়িতে লুকিয়ে রাখার প্রস্তাব দেন এবং স্থানীয় মিলিশিয়াপ্রধানকে খবর দেন। সেই বাড়িতে একটি নারকীয় রাত কেটেছিল আমাদের।’
ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁদের পরিবারকে সহায়তাকারী বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) সারভাইভার ফান্ডের গবেষক স্যামুয়েল মুন্ডেরেরে বলেন, ধর্ষণ একটি নিষিদ্ধ বিষয় হলেও লোকজন এখন এ ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তবে এখনো অনেক দূর পথ পাড়ি দিতে হবে। অনেক শিশুই নিজেদের অতীত সম্পর্কে জানে না। কারণ, তাদের মায়েরা এ ব্যাপারে কিছু বলতে অনাগ্রহী।
মায়ের বিমর্ষ অবস্থা দেখে ১৯ বছর বয়সী নাইরামাউইজা এখন আর নিজের বাবা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার ভাষ্য, আট বছর আগে প্রথমবার মাকে ওই প্রশ্ন করলে তিনি কাঁদতে শুরু করেছিলেন। এক বছর পর একই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, গণহত্যা চলার সময়ই লোকটির মৃত্যু হয়।
গণহত্যা শুরু হওয়ার অল্প কয়েক দিন আগে নাইরামাউইজার জন্ম হয়। তার বাবা একজন হুতু দোকানি এবং সাবেক সেনাসদস্য। তিনি তুতসি নারী অগাস্টিনকে ১৯৯৩ সালে এক বছরব্যাপী যৌনদাসী হিসেবে আটকে রেখেছিলেন। গণহত্যার ওই বছরে বেশ কয়েকবার গণধর্ষণের শিকার হন অগাস্টিন। তাঁর দ্বিতীয় সন্তান একটি ছেলে। নিজের ছেলেমেয়েকেও তিনি ভালোবাসতে পারতেন না। কারণ, তাদের দেখলেই তাঁর মনে পড়ে যেত সেই দুঃসহ সময়ের কথা।
অগাস্টিন পরে জানতে পারেন, তাঁর শরীরে এইচআইভি রয়েছে। তাঁর মেয়ের এইচআইভি নেই। কিন্তু তাঁর ছেলেটা রক্ত পরীক্ষা করাতে রাজি হয়নি। তাকে স্কুলে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। প্রায়ই ছেলেটা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তার আচরণও দিন দিন আগ্রাসী হয়ে যাচ্ছে।
গণহত্যাকালে ধর্ষণের পরিণামে যেসব শিশুর জন্ম, প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে তাদের অতীত মনে করিয়ে দেওয়া হয়। সেই যুদ্ধশিশুরা নিজ মায়ের বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা অথবা আশপাশের মানুষের প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি হয় নিয়মিত। চলতি মাসেই ওই গণহত্যার দুই দশক পূর্ণ হয়েছে। সেই নৃশংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে ২০০১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ের আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। আর তাই অতীত লুকিয়ে রাখাটা দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়েছে। ওই বিচারপ্রক্রিয়ায় আদালত কিছু ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন, যেগুলো এত দিন গোপন রাখা হয়েছিল।
যুদ্ধশিশুদের ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের মধ্যে গণ্য করা হয় না। কারণ, তাদের অধিকাংশই ১৯৯৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পরে জন্ম নিয়েছে। ফলে তারা সরকারি জাতীয় সহায়তা তহবিল (এফএআরজি) থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। গণহত্যার কবল থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের সংগঠন ইবুকার প্রধান জ্যঁ-পিয়ের দুসিঙ্গিজোমুঙ্গু বলেন, ‘যুদ্ধশিশুদের অনেকে মা ও বাবা উভয়ের কারও কাছেই আশ্রয় পায় না। তাদের সাহায্য করাটা এফএআরজির দায়িত্ব হওয়া উচিত। আর তারা তো আমাদেরই সন্তান।’
আশিস আচার্য, সূত্র: এএফপি
১৯৯৪ সালের ওই গণহত্যার সময় ঠিক কতজন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন, বলা অসম্ভব। তাই সেই সময়ের যুদ্ধশিশুর সংখ্যা নির্ণয় করাটাও ২০ বছর পর একই রকম কঠিন হয়ে পড়েছে। নির্যাতিত অধিকাংশ নারীকেই পরে হত্যা করা হয়েছিল। আর যাঁরা বেঁচে গিয়েছিলেন, তাঁরা ওই দুঃসহ ঘটনা সম্পর্কে চুপ থাকাটাই শ্রেয় বলে মনে করেন।
রুয়ান্ডায় ওই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডে আনুমানিক আট লাখ মানুষ প্রাণ হারায়। জাতিগত দ্বন্দ্বের জেরে মূলত তুতসি জাতিগোষ্ঠীর লোকজন ওই আক্রমণের শিকার হয়েছিল।
১৯৯৬ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, রুয়ান্ডায় গণহত্যাকালে ধর্ষণই ছিল রীতি এবং এর কোনো ব্যতিক্রম ছিল না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, এসব ঘটনার কোনো পরিসংখ্যান নেই। গণহত্যার মূল হোতারা সুপরিকল্পিতভাবে ধর্ষণকে তাদের ‘অস্ত্র’ হিসেবে বেছে নিয়েছিল।
জন্ম-পরিচয় সম্পর্কে প্রশ্নের মুখোমুখি ডেভিডের আচরণে ‘বিস্ময়’ এবং ‘ক্ষোভ’ প্রকাশ পায়। পরে সে বলে, ধর্ষণের একটি ঘটনা থেকে তার জন্ম হয়েছে এবং এই বাস্তবতা ‘মেনে নেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই’। তবে বিষয়টি সম্পর্কে সে আরও জানতে চায়।
বাবা সম্পর্কে ডেভিডের ভাষ্য, ‘আমার মায়ের গায়ের রং শ্যামলা। আর আমি বেশি কালো। আমি জানতে চাই, লোকটা দেখতে কেমন।’
ডেভিডের মা এস্টার ব্যাখ্যা করেন, তাঁর ছেলে সব ঘটনার বিস্তারিত জানে না। সে বেশি কথা বলে না। তাই সে আসলে কী ভাবছে, তা জানাটা সত্যিই কঠিন।
সংখ্যাগুরু হুতু সম্প্রদায় ১৯৯৪ সালের ৭ এপ্রিল গণহত্যা শুরু করে। তুতসি সম্প্রদায়ের নারী এস্টার তখন কিগালি শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। একদল নারীর সঙ্গে গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের সীমান্ত অতিক্রমের সময় সিয়াংগুগু সীমান্ত শহর এলাকায় তাঁকে ধর্ষণ করে একজন মিলিশিয়া।
এস্টার সেদিনের বর্ণনা দেন, ‘একজন নারী আমাদের একটি বাড়িতে লুকিয়ে রাখার প্রস্তাব দেন এবং স্থানীয় মিলিশিয়াপ্রধানকে খবর দেন। সেই বাড়িতে একটি নারকীয় রাত কেটেছিল আমাদের।’
ধর্ষণের শিকার নারী ও তাঁদের পরিবারকে সহায়তাকারী বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) সারভাইভার ফান্ডের গবেষক স্যামুয়েল মুন্ডেরেরে বলেন, ধর্ষণ একটি নিষিদ্ধ বিষয় হলেও লোকজন এখন এ ব্যাপারে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তবে এখনো অনেক দূর পথ পাড়ি দিতে হবে। অনেক শিশুই নিজেদের অতীত সম্পর্কে জানে না। কারণ, তাদের মায়েরা এ ব্যাপারে কিছু বলতে অনাগ্রহী।
মায়ের বিমর্ষ অবস্থা দেখে ১৯ বছর বয়সী নাইরামাউইজা এখন আর নিজের বাবা সম্পর্কে কোনো প্রশ্ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার ভাষ্য, আট বছর আগে প্রথমবার মাকে ওই প্রশ্ন করলে তিনি কাঁদতে শুরু করেছিলেন। এক বছর পর একই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, গণহত্যা চলার সময়ই লোকটির মৃত্যু হয়।
গণহত্যা শুরু হওয়ার অল্প কয়েক দিন আগে নাইরামাউইজার জন্ম হয়। তার বাবা একজন হুতু দোকানি এবং সাবেক সেনাসদস্য। তিনি তুতসি নারী অগাস্টিনকে ১৯৯৩ সালে এক বছরব্যাপী যৌনদাসী হিসেবে আটকে রেখেছিলেন। গণহত্যার ওই বছরে বেশ কয়েকবার গণধর্ষণের শিকার হন অগাস্টিন। তাঁর দ্বিতীয় সন্তান একটি ছেলে। নিজের ছেলেমেয়েকেও তিনি ভালোবাসতে পারতেন না। কারণ, তাদের দেখলেই তাঁর মনে পড়ে যেত সেই দুঃসহ সময়ের কথা।
অগাস্টিন পরে জানতে পারেন, তাঁর শরীরে এইচআইভি রয়েছে। তাঁর মেয়ের এইচআইভি নেই। কিন্তু তাঁর ছেলেটা রক্ত পরীক্ষা করাতে রাজি হয়নি। তাকে স্কুলে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়। প্রায়ই ছেলেটা বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। তার আচরণও দিন দিন আগ্রাসী হয়ে যাচ্ছে।
গণহত্যাকালে ধর্ষণের পরিণামে যেসব শিশুর জন্ম, প্রতিদিনই কোনো না কোনোভাবে তাদের অতীত মনে করিয়ে দেওয়া হয়। সেই যুদ্ধশিশুরা নিজ মায়ের বিপর্যস্ত মানসিক অবস্থা অথবা আশপাশের মানুষের প্রত্যাখ্যানের মুখোমুখি হয় নিয়মিত। চলতি মাসেই ওই গণহত্যার দুই দশক পূর্ণ হয়েছে। সেই নৃশংসতায় জড়িত থাকার অভিযোগে প্রায় ২০ লাখ মানুষকে ২০০১ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে তৃণমূল পর্যায়ের আদালতে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। আর তাই অতীত লুকিয়ে রাখাটা দিনে দিনে কঠিন হয়ে পড়েছে। ওই বিচারপ্রক্রিয়ায় আদালত কিছু ঘটনা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছেন, যেগুলো এত দিন গোপন রাখা হয়েছিল।
যুদ্ধশিশুদের ওই গণহত্যা থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের মধ্যে গণ্য করা হয় না। কারণ, তাদের অধিকাংশই ১৯৯৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের পরে জন্ম নিয়েছে। ফলে তারা সরকারি জাতীয় সহায়তা তহবিল (এফএআরজি) থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পাওয়া থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। গণহত্যার কবল থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের সংগঠন ইবুকার প্রধান জ্যঁ-পিয়ের দুসিঙ্গিজোমুঙ্গু বলেন, ‘যুদ্ধশিশুদের অনেকে মা ও বাবা উভয়ের কারও কাছেই আশ্রয় পায় না। তাদের সাহায্য করাটা এফএআরজির দায়িত্ব হওয়া উচিত। আর তারা তো আমাদেরই সন্তান।’
আশিস আচার্য, সূত্র: এএফপি
No comments