ঢাকা ঘুমালে জেগে ওঠে যে বাজার by পিয়াস সরকার
বাঁশ
বাজার। ঢাকার মানুষজন ঘর-দরজা বানাতে কিংবা মেরামত করতে ছুটে আসতো এ বাঁশ
বাজারে। ঢাকায় তখনও গ্রামের ছোঁয়া। টিনের ঘর। বাঁশের পালা। কোথাও কোথাও
ছনের ঘর। খুব কমই ছিল ইটের দালান। এক সময় এক মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ভারতের
বিভিন্ন এলাকা থেকে ফল এনে ওই বাঁশ বাজারে বিক্রি শুরু করেন।
তিনি পাইকারি বেচতেন। তার কাছ থেকে ফল কিনে অন্যরা খুচরা বিক্রি করতেন। ওই মাড়োয়ারির নাম কাওরান সিং। সে সময় ক্রেতারা কাওরান সিংয়ের ফল নিতে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। আস্তে আস্তে মানুষ ওই বাঁশ বাজারকে ডাকতে শুরু করেন কাওরান সিংয়ের বাজার। কালক্রমে তা ছোট হয়ে কাওরান বাজার হিসেবে খ্যাতি পায়।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকা জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানুষ। প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস এই ঢাকা শহরে। ঢাকাও বিস্তৃত হয়েছে উত্তরে গাজীপুর, দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ, পূর্বে নারায়ণগঞ্জ ও পশ্চিমে মানিকগঞ্জ সীমান্ত পর্যন্ত। এই যে এতসব মানুষের খাদ্যপণ্য বিশেষ করে সবজি, ফলমূল, মাছসহ নানা পণ্যের জোগান দেয় এই কাওরান বাজার। আর এই কাওরান বাজারকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা চলে অনায়াসে।
ইতিহাস বলে, সে সময় হাতিরঝিল ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে সংযুক্ত। আর সোনারগাঁও হোটেলের অংশে ছিল নদীর ঘাট। এই ঘাটে থামতো বাঁশ বোঝাই নৌকা। কাওরান বাজার থেকে ফার্মগেট যাবার সড়কটি ছিল ময়মনসিংহ যাবার একমাত্র সড়ক।
সমগ্র রাজধানী দিনে ব্যস্ত থাকলেও কাওরান বাজারের চিত্র তার ঠিক উল্টো। রাজধানীর ব্যস্ততা সাঙ্গ হওয়ার পরেই শুরু হয় এর গতি। আর এ গতির প্রকৃতি জানতে সরজমিন একরাত কাটানো হয় বাজারে।
রাত ৮টার দিকে কাওরান বাজার যেন কাকডাকা ভোর। ঘুমের আড়ষ্টতা ভেঙে জাগতে শুরু করে শ্রমিকরা। রাত ৯টা পর্যন্ত কিছুটা খোশ মেজাজেই থাকেন এখানকার জীবিকা খুঁজে নেয়া মানুষগুলো। বাজারের আড়তগুলোর ওপরে সাধারণত হয় শ্রমিকদের ঘুমানোর স্থান। সেই সঙ্গে মেঝেতে পাটি, কাঁথা, বস্তা বিছিয়ে ঘুমানোর স্থান রয়েছে। মাথার উপর রয়েছে ফ্যান। তবে এখন শীতকাল হওয়ায় সেই ফ্যানে জমেছে ধুলা। কিছু কিছু আড়তে ইন্টারনেট চালানোর জন্য রয়েছে রাউটার।
রাত ১০টা পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া, গোসলপর্ব সারেন তারা। গোসলের জন্য তাদের স্থান এই বাজারেই করা আছে। মোটরের মাধ্যমে পানি তুলে রাখা হয় একটি চৌবাচ্চাসদৃশ স্থানে। গোসলের জন্য তাদের গুনতে হয় ৫ টাকা। আর গোসল ও কাপড় কাচার জন্য কিনতে পাওয়া যায় অর্ধেক কাটা কাপড় কাচা সাবান। এই সাবান রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানেই। নাম লিখিয়ে রাখলে সেখানে সেই অবস্থাতেই রয়ে যায় সাবান।
রাত ৯টা থেকে ১০টা। এই সময়টাতে গোসল ও খাওয়ার পাশাপাশি সারি হয়ে বসে গল্প-গুজব করেন অনেকে। আলোচনায় স্থান পায় সমসাময়িক বিষয়। বর্তমানে বিপিএল নিয়ে যুদ্ধ চলে তাদের মাঝে। মোবাইল ফোনে ব্যস্ত মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
অন্য সবাই নিরাশ সময় কাটালেও ভ্যানচালকদের ব্যস্ততা বেশ নজর কাড়ে। পণ্য পরিবহনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত এই ভ্যানে কেউ দিচ্ছেন চাকায় বাতাস, আবার কেউ দিচ্ছেন মবিল। এসব ভ্যান শুধুমাত্র চাকা গড়ানোর কাজে ব্যবহার হয়। কারণ এই ভ্যানে থাকে না কোনো চেইন, প্যাডেল, বেল।
রাত ১০টার পর থেকে আড়তগুলোতে জ্বলতে শুরু করে হালকা থেকে ভারি ভারি লাইট। মহাজন আসার আগে শুরু হয় আড়ত পরিষ্কারের কাজ। অনেকেই জ্বালান ধুপকাঠি। বাড়তে থাকে রাত। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ব্যস্ততা। সবজি বোঝাই শাক-সবজি আর ফলমূলের ট্রাক এসে ভিড়ে মহাসড়ক ঘেঁষে। ভ্যানগুলো ঘিরে ধরে ওইসব ট্রাককে। মাল নামানো হয় ভ্যানে। তারপর ভ্যানগুলো বাজারের ভেতরে যার যার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে। একেকটি ভ্যান সাধারণত পেয়ে থাকেন ছোট বস্তার জন্য ১৫-২০ টাকা। বড় বস্তার জন্য ৩০-৫০ টাকা। দূরত্বভেদে এই মূল্য কমবেশিও হয়ে থাকে। সবজি-ফল, চাল ইত্যাদি বহনকারী ট্রাকগুলো নামে পেট্রোবাংলা বিল্ডিংয়ের গলিগুলোতে। আর মাছ বহনকারী ট্রাকগুলো পণ্য নামায় এফডিসি রেলক্রসিংয়ের গলিতে।
মোবাইলের স্ক্রিনে তখন তারিখ পাল্টে গেছে। রাত ১২টা। ফল, সবজি, মাছ, মুরগি ইত্যাদি পণ্যে বোঝাই হয়ে গেছে কাওরান বাজার। শীতের বাজার হওয়ার কারণে বিভিন্ন শাক-সবজির রংয়ে রঙিন। ধনে পাতার সবুজ রংয়ের সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছে মিষ্টি সুবাস। মিষ্টিকুমড়ার স্তূপ দেখে মনে হয় যেন লালমাটির পাহাড়। আবার শালগমের সুসজ্জিত স্তূপ দৃষ্টি কাড়ে সবার। লাল শাক, লাউ শাক, পুঁই শাকসহ লাউ, করলা, গাজর, টমেটো, কলা, বরই মিশে গেছে বাজারের লাল আলোর নিয়ন রূপে। আর মাছ বাজারের বেশ খানিক দূর থেকেও আসে মাছের উটকো গন্ধ। মাছের বাজারে মেলে দেশি-বিদেশিসহ সব ধরনের মাছ। আর মুরগি বাজারের নাম কিচেন মার্কেট। চিকেন মার্কেটের বিবর্তিত রূপ এই কিচেন মার্কেট। মার্কেটে মুরগি, হাঁস, রাজহাঁস, টার্কি, কবুতরের ডাকে এক শব্দের শোরগোল শুরু হয়ে যায়।
রাত ২টার দিকে দেখা মেলে আরেক শ্রেণির মানুষের। যারা ক্রয় করবেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এসব পণ্য। এই বাজারে শ্রমিকের মাথার টুকরি কিংবা ভ্যানের চাকা থেকে সাবধান। পা ফেলার জো নেই। কিন্তু নিজ গতিতে চলছে বাজারের কার্যক্রম। যেখানে পা ফেলা দায় সেখানে চোখের পলকে পণ্য চলে যাচ্ছে একস্থান থেকে অন্য স্থানে।
রাত তখন ৩টা। মসজিদের সামনে দেখা মেলে সদ্য কথা ও হাঁটতে শেখা আনুমানিক ৩ বছরের এক শিশুর। শীতের রাত হলেও পরনে তার অর্ধ ছেঁড়া টি-শার্ট ও ময়লা জর্জরিত প্যান্ট। হাতে একটি ছেলা কলা। নাম তার রকি। আশেপাশে কোনো অভিভাবক না থাকলেও বেশ কয়েকজন শিশু খেলায় মগ্ন। তার বাবা-মা কই জানতে চাইলে রকি জানায়, তার বাবা-মা কাজ করছে। খোঁজার পর দেখা মিললো তার মায়ের। তার মা সারা রাত এখানেই কাজ করেন। বিভিন্ন শাকের অংশ কাটতে কাটতে তার মা রাঁখি জানান, প্রতিদিন রাতেই এখানে কাজ করেন তিনি। রকির বাবাও এই বাজারে শ্রমিকের কাজ করেন। থাকেন রেল লাইনের ধারের বস্তিতে।
পরিবারের অন্য কোনো সদস্য না থাকার কারণে বাধ্য হয়ে নিয়ে আসতে হয় শিশু সন্তানকে। সারা রাত কাজ করে তিনি আয় করেন গড়ে ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। আর তার স্বামীর আয় হয় ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। এই আয়ে সুখে- শান্তিতেই চলছে তাদের সংসার। আর ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে রাখার বিষয়ে জানান, এখানে অনেকের সন্তানই এভাবে ছেড়ে দেয়া থাকে। মসজিদের সামনে ফাঁকা স্থানে খেলাধুলা করে। আবার সেখানে পাটিও বিছিয়ে দেয়া আছে। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে যায় তারা। রাত ২টা থেকে ৪টা। এই সময়টা পণ্য আসা ও স্তূপ করণ থেকে বিক্রির দৃশ্য বেশি চোখে পড়ে। রাত ২টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেছে পিকআপ, প্যাডেল-চেইন ওয়ালা ভ্যান কিংবা রিকশা। তারা ঢাকার মানুষের জন্য পণ্য নিয়ে যাবেন বিভিন্ন বাজারে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের পণ্য ক্রেতারা বাজারের টুকরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের ভাড়া করেন। তাদের ভাড়া পরিমাণ ও দূরত্ব ভেদে নির্ধারিত হয়। সাধারণত ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২শ’ টাকা হয়ে থাকে তাদের ভাড়া।
পাইকারি ক্রেতাদের সঙ্গে থাকেন তারা। দামাদামি করে কিনেন বিভিন্ন পণ্য। বাজারে পণ্য আসে কয়েক হাত ঘুরে। চলছে আলুর মৌসুম। বগুড়া জেলার কাহালুর বাসিন্দা ফিরোজ মিয়া। কাওরান বাজারে এসেছেন প্রায় ২৫ দিন যাবৎ। এলাকা থেকে ২-৩ দিন পর পর আসে আলুর ট্রাক। সেগুলো এখানে বিক্রির কাজ করেন তিনি। প্রতি বস্তা আলু কাওরান বাজারে ঢোকার সময় গুনতে হয় ৪০ টাকা। বগুড়া থেকে প্রতি বস্তা আলু কেনেন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। সেই আলুর বস্তা রাজধানীর পাইকাররা কেনেন ৫শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকায়। অর্থাৎ বগুড়া থেকে আনা আলুর কেজি দাঁড়ায় ৭-১০ টাকা। কাওরান বাজারে ১২-১৫ টাকায়। পাইকারি বাজারে একজন ক্রেতা এই আলু ক্রয় করেন ১৮-২০ টাকায়।
রাত ৪টা। ইনসোমিনিয়ায় ভোগা ব্যক্তিটি যখন ওষুধ খেয়ে অনেক কষ্টে ঘুমিয়ে পড়েন। ঠিক সেই সময়েও ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজারে ঢোকার জন্য অপেক্ষার প্রহর গোনে বেশকিছু ট্রাক। দেখে মনে হবে কর্মব্যস্ত দিনের অফিস শুরুর সময়ের দৃশ্য এটি।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া ক্লান্ত ট্রাকচালক ও ট্রাকের সহকারীরা রাস্তার ধারে ট্রাক রাখেন। ট্রাক রেখে কিছু সময় নেন ঘুমানোর প্রস্তুতি। আবার অনেকে পণ্য নামিয়ে দিয়ে চলে যান সরাসরি। খাওয়া-দাওয়া শেষে আড়তের ওপর শোবার স্থান তাদের। রাজধানীতে অবস্থান নেয়া ট্রাকগুলোকে সকাল ৮টার আগেই ত্যাগ করতে হয় রাজধানী।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে কমছে কাওরান বাজরের আমেজ। আলো যত পড়ছে কাওরান বাজারে আসতে শুরু করছে নতুন একধরনের ক্রেতা। সারা রাত বেচা কেনার মধ্যে থেঁতলানো, পচা, কাটা পণ্য কিনতে এসেছেন কিছু ক্রেতা। তারা এগুলো নিয়ে বিক্রি করবেন তেজগাঁওয়ের ফকিন্নি বাজারে। এই বাজারের নিম্ন আয়ের মানুষরা বাজার মূল্য থেকে প্রায় অর্ধেক মূল্যে পান এসব পণ্য।
আবার মাছের বাজারে সারা রাতই আসতে থাকে বরফের ট্রাক। ফজরের আজানের ঘণ্টাখানেক পরে শুরু হয় বাজার পরিষ্কারের কাজ। এরই মাঝে বাজারে চলে এসেছে বড় বড় বেশ কয়েকটি ট্রাক। বাজার পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়েছেন প্রায় শতাধিক কর্মী।
বড় বড় ট্রাকগুলো ময়লাভর্তি করে নিয়ে যেতে থাকে। সকাল ১০টা হতেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো কাওরান বাজার। এখন আবার ব্যস্ততা বাড়ছে খুচরা বিক্রেতাদের। রাতের টাটকা সবজি-মাছ কেনার জন্য ভিড় দেখা যায় এসব বাজারে। প্রতি পিস ফুলকপি এখানে বিক্রি হয় ১০-১৫ টাকায়। কিন্তু এই ফুলকপিগুলো বাজারে এসেছে ৭-৮ টাকায়।
ভ্যানগুলোও ঘুমিয়ে আছে স্ট্যান্ডে। স্থান সংকুলানের জন্য ভ্যানগুলো রাখা হয় দাঁড় করিয়ে। একটির গায়ে আরেকটি লাগানো এসব ভ্যান সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এখানে। মহাজনরা টাকা পয়সার হিসাব করে বাসায় ফিরতে শুরু করেছেন। সারা রাতের ধকল শেষে আবার শ্রমিকদের ফের গোসলের পালা। গোসল ও খাওয়া শেষে ঘুমাতে যান অনেকে। কারণ রাতে আবার জেগে উঠতে হবে। ফিরতে হবে চির চেনা ব্যস্ততায়।
তিনি পাইকারি বেচতেন। তার কাছ থেকে ফল কিনে অন্যরা খুচরা বিক্রি করতেন। ওই মাড়োয়ারির নাম কাওরান সিং। সে সময় ক্রেতারা কাওরান সিংয়ের ফল নিতে উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। আস্তে আস্তে মানুষ ওই বাঁশ বাজারকে ডাকতে শুরু করেন কাওরান সিংয়ের বাজার। কালক্রমে তা ছোট হয়ে কাওরান বাজার হিসেবে খ্যাতি পায়।
বর্তমানে রাজধানী ঢাকা জনসংখ্যার চাপে জর্জরিত। প্রতিনিয়ত বাড়ছে মানুষ। প্রায় দুই কোটি মানুষের বসবাস এই ঢাকা শহরে। ঢাকাও বিস্তৃত হয়েছে উত্তরে গাজীপুর, দক্ষিণে মুন্সীগঞ্জ, পূর্বে নারায়ণগঞ্জ ও পশ্চিমে মানিকগঞ্জ সীমান্ত পর্যন্ত। এই যে এতসব মানুষের খাদ্যপণ্য বিশেষ করে সবজি, ফলমূল, মাছসহ নানা পণ্যের জোগান দেয় এই কাওরান বাজার। আর এই কাওরান বাজারকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা চলে অনায়াসে।
ইতিহাস বলে, সে সময় হাতিরঝিল ছিল ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে সংযুক্ত। আর সোনারগাঁও হোটেলের অংশে ছিল নদীর ঘাট। এই ঘাটে থামতো বাঁশ বোঝাই নৌকা। কাওরান বাজার থেকে ফার্মগেট যাবার সড়কটি ছিল ময়মনসিংহ যাবার একমাত্র সড়ক।
সমগ্র রাজধানী দিনে ব্যস্ত থাকলেও কাওরান বাজারের চিত্র তার ঠিক উল্টো। রাজধানীর ব্যস্ততা সাঙ্গ হওয়ার পরেই শুরু হয় এর গতি। আর এ গতির প্রকৃতি জানতে সরজমিন একরাত কাটানো হয় বাজারে।
রাত ৮টার দিকে কাওরান বাজার যেন কাকডাকা ভোর। ঘুমের আড়ষ্টতা ভেঙে জাগতে শুরু করে শ্রমিকরা। রাত ৯টা পর্যন্ত কিছুটা খোশ মেজাজেই থাকেন এখানকার জীবিকা খুঁজে নেয়া মানুষগুলো। বাজারের আড়তগুলোর ওপরে সাধারণত হয় শ্রমিকদের ঘুমানোর স্থান। সেই সঙ্গে মেঝেতে পাটি, কাঁথা, বস্তা বিছিয়ে ঘুমানোর স্থান রয়েছে। মাথার উপর রয়েছে ফ্যান। তবে এখন শীতকাল হওয়ায় সেই ফ্যানে জমেছে ধুলা। কিছু কিছু আড়তে ইন্টারনেট চালানোর জন্য রয়েছে রাউটার।
রাত ১০টা পর্যন্ত খাওয়া-দাওয়া, গোসলপর্ব সারেন তারা। গোসলের জন্য তাদের স্থান এই বাজারেই করা আছে। মোটরের মাধ্যমে পানি তুলে রাখা হয় একটি চৌবাচ্চাসদৃশ স্থানে। গোসলের জন্য তাদের গুনতে হয় ৫ টাকা। আর গোসল ও কাপড় কাচার জন্য কিনতে পাওয়া যায় অর্ধেক কাটা কাপড় কাচা সাবান। এই সাবান রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে সেখানেই। নাম লিখিয়ে রাখলে সেখানে সেই অবস্থাতেই রয়ে যায় সাবান।
রাত ৯টা থেকে ১০টা। এই সময়টাতে গোসল ও খাওয়ার পাশাপাশি সারি হয়ে বসে গল্প-গুজব করেন অনেকে। আলোচনায় স্থান পায় সমসাময়িক বিষয়। বর্তমানে বিপিএল নিয়ে যুদ্ধ চলে তাদের মাঝে। মোবাইল ফোনে ব্যস্ত মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়।
অন্য সবাই নিরাশ সময় কাটালেও ভ্যানচালকদের ব্যস্ততা বেশ নজর কাড়ে। পণ্য পরিবহনের উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত এই ভ্যানে কেউ দিচ্ছেন চাকায় বাতাস, আবার কেউ দিচ্ছেন মবিল। এসব ভ্যান শুধুমাত্র চাকা গড়ানোর কাজে ব্যবহার হয়। কারণ এই ভ্যানে থাকে না কোনো চেইন, প্যাডেল, বেল।
রাত ১০টার পর থেকে আড়তগুলোতে জ্বলতে শুরু করে হালকা থেকে ভারি ভারি লাইট। মহাজন আসার আগে শুরু হয় আড়ত পরিষ্কারের কাজ। অনেকেই জ্বালান ধুপকাঠি। বাড়তে থাকে রাত। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ব্যস্ততা। সবজি বোঝাই শাক-সবজি আর ফলমূলের ট্রাক এসে ভিড়ে মহাসড়ক ঘেঁষে। ভ্যানগুলো ঘিরে ধরে ওইসব ট্রাককে। মাল নামানো হয় ভ্যানে। তারপর ভ্যানগুলো বাজারের ভেতরে যার যার নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে। একেকটি ভ্যান সাধারণত পেয়ে থাকেন ছোট বস্তার জন্য ১৫-২০ টাকা। বড় বস্তার জন্য ৩০-৫০ টাকা। দূরত্বভেদে এই মূল্য কমবেশিও হয়ে থাকে। সবজি-ফল, চাল ইত্যাদি বহনকারী ট্রাকগুলো নামে পেট্রোবাংলা বিল্ডিংয়ের গলিগুলোতে। আর মাছ বহনকারী ট্রাকগুলো পণ্য নামায় এফডিসি রেলক্রসিংয়ের গলিতে।
মোবাইলের স্ক্রিনে তখন তারিখ পাল্টে গেছে। রাত ১২টা। ফল, সবজি, মাছ, মুরগি ইত্যাদি পণ্যে বোঝাই হয়ে গেছে কাওরান বাজার। শীতের বাজার হওয়ার কারণে বিভিন্ন শাক-সবজির রংয়ে রঙিন। ধনে পাতার সবুজ রংয়ের সঙ্গে ছড়িয়ে দিচ্ছে মিষ্টি সুবাস। মিষ্টিকুমড়ার স্তূপ দেখে মনে হয় যেন লালমাটির পাহাড়। আবার শালগমের সুসজ্জিত স্তূপ দৃষ্টি কাড়ে সবার। লাল শাক, লাউ শাক, পুঁই শাকসহ লাউ, করলা, গাজর, টমেটো, কলা, বরই মিশে গেছে বাজারের লাল আলোর নিয়ন রূপে। আর মাছ বাজারের বেশ খানিক দূর থেকেও আসে মাছের উটকো গন্ধ। মাছের বাজারে মেলে দেশি-বিদেশিসহ সব ধরনের মাছ। আর মুরগি বাজারের নাম কিচেন মার্কেট। চিকেন মার্কেটের বিবর্তিত রূপ এই কিচেন মার্কেট। মার্কেটে মুরগি, হাঁস, রাজহাঁস, টার্কি, কবুতরের ডাকে এক শব্দের শোরগোল শুরু হয়ে যায়।
রাত ২টার দিকে দেখা মেলে আরেক শ্রেণির মানুষের। যারা ক্রয় করবেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা এসব পণ্য। এই বাজারে শ্রমিকের মাথার টুকরি কিংবা ভ্যানের চাকা থেকে সাবধান। পা ফেলার জো নেই। কিন্তু নিজ গতিতে চলছে বাজারের কার্যক্রম। যেখানে পা ফেলা দায় সেখানে চোখের পলকে পণ্য চলে যাচ্ছে একস্থান থেকে অন্য স্থানে।
রাত তখন ৩টা। মসজিদের সামনে দেখা মেলে সদ্য কথা ও হাঁটতে শেখা আনুমানিক ৩ বছরের এক শিশুর। শীতের রাত হলেও পরনে তার অর্ধ ছেঁড়া টি-শার্ট ও ময়লা জর্জরিত প্যান্ট। হাতে একটি ছেলা কলা। নাম তার রকি। আশেপাশে কোনো অভিভাবক না থাকলেও বেশ কয়েকজন শিশু খেলায় মগ্ন। তার বাবা-মা কই জানতে চাইলে রকি জানায়, তার বাবা-মা কাজ করছে। খোঁজার পর দেখা মিললো তার মায়ের। তার মা সারা রাত এখানেই কাজ করেন। বিভিন্ন শাকের অংশ কাটতে কাটতে তার মা রাঁখি জানান, প্রতিদিন রাতেই এখানে কাজ করেন তিনি। রকির বাবাও এই বাজারে শ্রমিকের কাজ করেন। থাকেন রেল লাইনের ধারের বস্তিতে।
পরিবারের অন্য কোনো সদস্য না থাকার কারণে বাধ্য হয়ে নিয়ে আসতে হয় শিশু সন্তানকে। সারা রাত কাজ করে তিনি আয় করেন গড়ে ২শ’ থেকে ৩শ’ টাকা। আর তার স্বামীর আয় হয় ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা। এই আয়ে সুখে- শান্তিতেই চলছে তাদের সংসার। আর ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে রাখার বিষয়ে জানান, এখানে অনেকের সন্তানই এভাবে ছেড়ে দেয়া থাকে। মসজিদের সামনে ফাঁকা স্থানে খেলাধুলা করে। আবার সেখানে পাটিও বিছিয়ে দেয়া আছে। ঘুম পেলে ঘুমিয়ে যায় তারা। রাত ২টা থেকে ৪টা। এই সময়টা পণ্য আসা ও স্তূপ করণ থেকে বিক্রির দৃশ্য বেশি চোখে পড়ে। রাত ২টা থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে আসতে শুরু করেছে পিকআপ, প্যাডেল-চেইন ওয়ালা ভ্যান কিংবা রিকশা। তারা ঢাকার মানুষের জন্য পণ্য নিয়ে যাবেন বিভিন্ন বাজারে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারের পণ্য ক্রেতারা বাজারের টুকরি হাতে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের ভাড়া করেন। তাদের ভাড়া পরিমাণ ও দূরত্ব ভেদে নির্ধারিত হয়। সাধারণত ৫০ টাকা থেকে শুরু করে ২শ’ টাকা হয়ে থাকে তাদের ভাড়া।
পাইকারি ক্রেতাদের সঙ্গে থাকেন তারা। দামাদামি করে কিনেন বিভিন্ন পণ্য। বাজারে পণ্য আসে কয়েক হাত ঘুরে। চলছে আলুর মৌসুম। বগুড়া জেলার কাহালুর বাসিন্দা ফিরোজ মিয়া। কাওরান বাজারে এসেছেন প্রায় ২৫ দিন যাবৎ। এলাকা থেকে ২-৩ দিন পর পর আসে আলুর ট্রাক। সেগুলো এখানে বিক্রির কাজ করেন তিনি। প্রতি বস্তা আলু কাওরান বাজারে ঢোকার সময় গুনতে হয় ৪০ টাকা। বগুড়া থেকে প্রতি বস্তা আলু কেনেন ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায়। সেই আলুর বস্তা রাজধানীর পাইকাররা কেনেন ৫শ’ থেকে সাড়ে ৬শ’ টাকায়। অর্থাৎ বগুড়া থেকে আনা আলুর কেজি দাঁড়ায় ৭-১০ টাকা। কাওরান বাজারে ১২-১৫ টাকায়। পাইকারি বাজারে একজন ক্রেতা এই আলু ক্রয় করেন ১৮-২০ টাকায়।
রাত ৪টা। ইনসোমিনিয়ায় ভোগা ব্যক্তিটি যখন ওষুধ খেয়ে অনেক কষ্টে ঘুমিয়ে পড়েন। ঠিক সেই সময়েও ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজারে ঢোকার জন্য অপেক্ষার প্রহর গোনে বেশকিছু ট্রাক। দেখে মনে হবে কর্মব্যস্ত দিনের অফিস শুরুর সময়ের দৃশ্য এটি।
দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়া ক্লান্ত ট্রাকচালক ও ট্রাকের সহকারীরা রাস্তার ধারে ট্রাক রাখেন। ট্রাক রেখে কিছু সময় নেন ঘুমানোর প্রস্তুতি। আবার অনেকে পণ্য নামিয়ে দিয়ে চলে যান সরাসরি। খাওয়া-দাওয়া শেষে আড়তের ওপর শোবার স্থান তাদের। রাজধানীতে অবস্থান নেয়া ট্রাকগুলোকে সকাল ৮টার আগেই ত্যাগ করতে হয় রাজধানী।
ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। ধীরে ধীরে কমছে কাওরান বাজরের আমেজ। আলো যত পড়ছে কাওরান বাজারে আসতে শুরু করছে নতুন একধরনের ক্রেতা। সারা রাত বেচা কেনার মধ্যে থেঁতলানো, পচা, কাটা পণ্য কিনতে এসেছেন কিছু ক্রেতা। তারা এগুলো নিয়ে বিক্রি করবেন তেজগাঁওয়ের ফকিন্নি বাজারে। এই বাজারের নিম্ন আয়ের মানুষরা বাজার মূল্য থেকে প্রায় অর্ধেক মূল্যে পান এসব পণ্য।
আবার মাছের বাজারে সারা রাতই আসতে থাকে বরফের ট্রাক। ফজরের আজানের ঘণ্টাখানেক পরে শুরু হয় বাজার পরিষ্কারের কাজ। এরই মাঝে বাজারে চলে এসেছে বড় বড় বেশ কয়েকটি ট্রাক। বাজার পরিষ্কারের কাজে লেগে পড়েছেন প্রায় শতাধিক কর্মী।
বড় বড় ট্রাকগুলো ময়লাভর্তি করে নিয়ে যেতে থাকে। সকাল ১০টা হতেই ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো কাওরান বাজার। এখন আবার ব্যস্ততা বাড়ছে খুচরা বিক্রেতাদের। রাতের টাটকা সবজি-মাছ কেনার জন্য ভিড় দেখা যায় এসব বাজারে। প্রতি পিস ফুলকপি এখানে বিক্রি হয় ১০-১৫ টাকায়। কিন্তু এই ফুলকপিগুলো বাজারে এসেছে ৭-৮ টাকায়।
ভ্যানগুলোও ঘুমিয়ে আছে স্ট্যান্ডে। স্থান সংকুলানের জন্য ভ্যানগুলো রাখা হয় দাঁড় করিয়ে। একটির গায়ে আরেকটি লাগানো এসব ভ্যান সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে থাকে এখানে। মহাজনরা টাকা পয়সার হিসাব করে বাসায় ফিরতে শুরু করেছেন। সারা রাতের ধকল শেষে আবার শ্রমিকদের ফের গোসলের পালা। গোসল ও খাওয়া শেষে ঘুমাতে যান অনেকে। কারণ রাতে আবার জেগে উঠতে হবে। ফিরতে হবে চির চেনা ব্যস্ততায়।
No comments