খালেদা জিয়ার জামিন বহাল: ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তির নির্দেশ by হাবিবুর রহমান
জিয়া
অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম
খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন বহাল রেখেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল
বিভাগ। একই সাথে খালেদা জিয়ার জামিন বাতিল চেয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও
সরকারের আপিল আবেদন খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। গতকাল বুধবার প্রধান
বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ এ
রায় দেন। আপিল বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী,
বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।
একই সাথে রায়ে নিন্ম আদালতের সাজা বাতিল চেয়ে বেগম খালেদা জিয়ার দায়ের করা আপিল আবেদন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের সামনে এক ব্রিফিংয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, হাইকোর্টের দেয়া জামিন আপিল বিভাগ বহাল রাখায় নি¤œ আদালতে অন্যান্য মামলায় জামিন পেতে আর বাধা হবে না। আইনি পথে খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন।
আরো ছয় মামলায় জামিন নিতে হবে : আইনজীবীরা জানান, কুমিল্লা, নড়াইল ও ঢাকায় থাকা আরো ছয়টি মামলায় জামিন নেয়ার পরই বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন। এ ছয়টি মামলার মধ্যে কুমিল্লায় তিনটি, ঢাকায় দু’টি ও নড়াইলে একটি মামলা রয়েছে। বিশেষ মতা আইন ও বিস্ফোরক আইনে কুমিল্লায় তিনটি মামলা করা হয়। আর ঢাকার দু’টি এবং নড়াইলের মামলা হচ্ছে মানহানির। এসব মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
আইনজীবীরা জানান, সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা রয়েছে। তবে ওই ছয় মামলা ছাড়া অন্য মামলায় তিনি জামিনে আছেন।
এ দিকে বেলা সাড়ে ১১টায় খালেদার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী আপিল বিভাগে উপস্থিত হয়ে বলেন, খালেদার জামিন আবেদন দাখিলের জন্য আপিল বিভাগের সংপ্তি আদেশের প্রয়োজন। তাই ঘোষিত রায়ের সংপ্তি আদেশ চাচ্ছি। তখন আদালত বলেন, সংপ্তি নয়, পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি দেয়া হবে।
এ জে মোহাম্মদ আলীর আবেদনের সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে বলেন, রায় ঘোষণার পর সংপ্তি আদেশের কপি দেয়ার নজির নেই।
এরপর মোহাম্মদ আলী বলেন, রায়ের পর এক মুহূর্তও কাউকে আটকে রাখা হলে, তা হবে বেআইনি আটক। এ জন্য সংপ্তি আদেশ চাচ্ছি। এ সময় আদালত বলেন, আপনি যা বলেছেন, তা আমাদের রুলসে নেই।
তখন মোহাম্মদ আলী বলেন, কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা অন্য যেকোনো বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আদালত বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রায় পাবেন। আপনার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হলো।
রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিতে কিছুটা বাধা আছে। তিনি এই মুহূর্তে মুক্তি পাবেন না। কারণ, অন্যান্য মামলায় তাকে আসামি দেখানো হয়েছে। মওদুদ আহমদ বলেন, নি¤œ আদালতের কতগুলো মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে আসামি দেখানো হয়েছে। এ মামলাগুলোতে তার জামিন নিতে হবে। এই জামিন নিতে যতটুকু সময় লাগে, সে সময়টুকু পর্যন্ত অপো করতে হবে। চেষ্টা করব দ্রুত করার।
তিনি অভিযোগ করেন খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত করতে সরকার নানা কৌশলে চেষ্টা করছে, করবে। তিনি বলেন, আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিন বহাল রাখায় নি¤œ আদালতে বিএনপির চেয়ারপারসনের জামিন পেতে খুব বেশি অসুবিধা হবে না। তিনি বলেন, আমরা শিগগির চেষ্টা করব মামলাগুলোতে জামিন নিতে। আমাদের এটি আইনিভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সেই জামিন পাওয়ার পর খালেদা জিয়া আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। শিগগির ফিরে আসবেন।
খালেদার জিয়ার মামলায় কি মধু আছে : খন্দকার মাহবুব
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেলের মন্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, হাইকোর্ট বিভাগে প্রায় এক লাখ মামলা দীর্ঘ দিন থেকে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তার মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলা রয়েছে ২০০ এর ওপরে। তা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চায় সরকার। এ থেকে মনে হয়, বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা সরকারের মনবাসনা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া এই মামলাটিতে এমন কি মধু আছে যে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চায় সরকার।
গতকাল বুধবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের নিজ কক্ষে নয়া দিগন্তকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় খন্দকার মাহবুব হোসেন এ সব কথা বলেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, সরকার তো সব সময় বাধা দেয়। এখন তার বিরুদ্ধে অন্য যেসব মামলা আছে সেগুলোতে দ্রুত হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়ার চেষ্টা করব। আইনি প্রক্রিয়ায় সব বাধা দূর করা হবে। অন্য দিকে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নি¤œ আদালতের সাজা বাতিল চেয়ে খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তি করতে আপিল বিভাগের আদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরাও চাই দ্রুত শুনানি হোক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় নি¤œ আদালত সাজা দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আপিলে সুপ্রিম কোর্টে আমরা বিচার পাবো। তিনি বলেন, নি¤œ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, এতিমের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অথচ টাকা আত্মসাৎ তো হয়নি, বরং তিন গুণ টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে জমা আছে। সে হিসেবে টাকা আত্মসাৎ না হলে দুদক আইনে মামলাই হয় না। এ ক্ষেত্রে আমরা উচ্চ আদালতে বিচার পাবো।
এখানে আর বিচারকে বিলম্বিত করতে পারবেন না : অ্যাটর্নি জেনারেল
রায় ঘোষণার পর নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার আপিল আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এখন আপিল শুনানির জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি আরো বলেন, খালেদা জিয়া নি¤œ আদালতে এই মামলার বিচার ৯ বছর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। আপিল বিভাগের এ আদেশের ফলে এখানে আর বিচার তিনি বিলম্বিত করতে পারবেন না বলে আশা করা যায়।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কয়টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে, কয়টি মামলায় জামিন নিতে হবে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এ তথ্য দিতে পারবেন। অন্য দিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, আমরা হাইকোর্ট বিভাগে এ মামলার আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের এ রায় পাওয়ার পর আমরা হাইকোর্ট বিভাগে যাব। সেখানে বলব, সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করতে। আমরা আপিল শুনানি করতে প্রস্তুত আছি।
আদালতে গতকাল খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী ছিলেনÑ মওদুদ আহমদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, আমিনুল হক, আবদুর রেজাক খান, জয়নুল আবেদীন, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, নিতাই রায় চৌধুরী, মাহবুবউদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার, বদরুদ্দোজা বাদল, কায়সার কামাল, নওশাদ জমির, রাগীব রউফ চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, সগীর হোসেন লিওন, জাকির হোসেন ভূঁইয়া, মো: আলী, মির্জা আল মাহমুদ, সালমা সুলতানা সোমা প্রমুখ।
এর আগে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে গত ৯ মে আপিল বিভাগ রায়ের জন্য ১৫ মে দিন নির্ধারণ করেন।
তবে ওই দিন রায় ঘোষণার আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দাঁড়িয়ে বলেন, আমি গত দিনে সব সাবমিশন করতে পারিনি। আমাকে আবার কিছু সাবমিশন করতে হবে। আদালত তাকে অনুমতি দিয়ে শুনানি গ্রহণ করেন এবং ১৬ মে রায়ের নতুন তারিখ ধার্য করেন।
গত ১৯ মার্চ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সাথে খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপকে আপিলের অনুমতি দেন আদালত।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত এ রায় দেন। রায় ঘোষণার পরপরই বেগম খালেদা জিয়াকে আদালত থেকে গ্রেফতার করে পুরান ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি এখন সেখানেই আছেন। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর চারজনকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এরপর গত ২০ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় নি¤œ আদালতের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার খালাস চেয়ে আপিল দায়ের করা হয়। আপিলের গ্রহণযোগ্যতার শুনানি করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২২ ফেব্রুয়ারি তা শুনানির জন্য গ্রহণ করে নি¤œ আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন।
এরপর গত ১২ মার্চ চারটি যুক্তি আমলে নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেন।
এরপর গত ১৪ মার্চ দুদক ও সরকার জামিন স্থগিত চেয়ে আপিল আবেদন করলে সর্বোচ্চ আদালত জামিন স্থগিত করে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলেন। ১৯ মার্চ দুদক ও রাষ্ট্রপকে আপিলের অনুমতি দিয়ে ৮ মে শুনানির দিন ঠিক করে দেন আপিল বিভাগ। ওই আপিল শুনানি শেষে গতকাল জামিন বহাল রেখে সরকার ও দুদকের আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
খালেদা জিয়ার জামিননামা দাখিল
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল থাকায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে জামিননামা দাখিল করেছেন তার আইনজীবীরা।
গতকাল দুপুরে এ জামিননামা দাখিল করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া ও অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার। এ বিষয়ে মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, জামিননামা সিএমএম আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এখন সেখান থেকে তা কারাগারে যাবে। এছাড়া আপিল বিভাগের রায়ের কপি প্রকাশ হওয়ার পর তা কারাগারে যাবে। এ বিষয়ে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, হাইকোর্ট জামিন মঞ্জুর করলে তখন আমরা জামিননামা দাখিল করেছি। এখন আপিল বিভাগের রায় প্রকাশ হলে তা সরাসরি কারাগারে যাবে এবং বেগম খালেদা জিয়া জামিন পাবেন।
জাতীয় পতাকা অবমাননা ও জন্মদিন পালনের মামলার জামিনের বিষয়ে আদেশ আজ : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননা এবং ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে দায়ের করা পৃথক দুই মামলায় জামিন আবেদনের শুনানির বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার আদেশের দিন ধার্য রয়েছে। রাজধানীর বকশিবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত আদালতে পৃথক দু’জন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট খুরশীদ আলম ও আহসান হাবীব গত ২৫ এপ্রিল দুই মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যুসহ জামিন শুনানির এ দিন ধার্য করেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানান, আজ বেলা ১১টায় ওই দুই মামলায় জামিনের বিষয়ে আদেশের কথা রয়েছে।
একই সাথে রায়ে নিন্ম আদালতের সাজা বাতিল চেয়ে বেগম খালেদা জিয়ার দায়ের করা আপিল আবেদন বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রায় ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের সামনে এক ব্রিফিংয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, হাইকোর্টের দেয়া জামিন আপিল বিভাগ বহাল রাখায় নি¤œ আদালতে অন্যান্য মামলায় জামিন পেতে আর বাধা হবে না। আইনি পথে খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়ে আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন।
আরো ছয় মামলায় জামিন নিতে হবে : আইনজীবীরা জানান, কুমিল্লা, নড়াইল ও ঢাকায় থাকা আরো ছয়টি মামলায় জামিন নেয়ার পরই বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পাবেন। এ ছয়টি মামলার মধ্যে কুমিল্লায় তিনটি, ঢাকায় দু’টি ও নড়াইলে একটি মামলা রয়েছে। বিশেষ মতা আইন ও বিস্ফোরক আইনে কুমিল্লায় তিনটি মামলা করা হয়। আর ঢাকার দু’টি এবং নড়াইলের মামলা হচ্ছে মানহানির। এসব মামলায় তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে।
আইনজীবীরা জানান, সব মিলিয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ৩৬টি মামলা রয়েছে। তবে ওই ছয় মামলা ছাড়া অন্য মামলায় তিনি জামিনে আছেন।
এ দিকে বেলা সাড়ে ১১টায় খালেদার আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী আপিল বিভাগে উপস্থিত হয়ে বলেন, খালেদার জামিন আবেদন দাখিলের জন্য আপিল বিভাগের সংপ্তি আদেশের প্রয়োজন। তাই ঘোষিত রায়ের সংপ্তি আদেশ চাচ্ছি। তখন আদালত বলেন, সংপ্তি নয়, পূর্ণাঙ্গ রায়ের অনুলিপি দেয়া হবে।
এ জে মোহাম্মদ আলীর আবেদনের সময় অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম আদালতে বলেন, রায় ঘোষণার পর সংপ্তি আদেশের কপি দেয়ার নজির নেই।
এরপর মোহাম্মদ আলী বলেন, রায়ের পর এক মুহূর্তও কাউকে আটকে রাখা হলে, তা হবে বেআইনি আটক। এ জন্য সংপ্তি আদেশ চাচ্ছি। এ সময় আদালত বলেন, আপনি যা বলেছেন, তা আমাদের রুলসে নেই।
তখন মোহাম্মদ আলী বলেন, কোনো ব্যক্তির স্বাধীনতা অন্য যেকোনো বিষয়ের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
আদালত বলেন, দ্রুত সময়ের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ রায় পাবেন। আপনার আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হলো।
রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়ার আইনজীবী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিতে কিছুটা বাধা আছে। তিনি এই মুহূর্তে মুক্তি পাবেন না। কারণ, অন্যান্য মামলায় তাকে আসামি দেখানো হয়েছে। মওদুদ আহমদ বলেন, নি¤œ আদালতের কতগুলো মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে আসামি দেখানো হয়েছে। এ মামলাগুলোতে তার জামিন নিতে হবে। এই জামিন নিতে যতটুকু সময় লাগে, সে সময়টুকু পর্যন্ত অপো করতে হবে। চেষ্টা করব দ্রুত করার।
তিনি অভিযোগ করেন খালেদা জিয়ার মুক্তি বিলম্বিত করতে সরকার নানা কৌশলে চেষ্টা করছে, করবে। তিনি বলেন, আপিল বিভাগ খালেদা জিয়ার জামিন বহাল রাখায় নি¤œ আদালতে বিএনপির চেয়ারপারসনের জামিন পেতে খুব বেশি অসুবিধা হবে না। তিনি বলেন, আমরা শিগগির চেষ্টা করব মামলাগুলোতে জামিন নিতে। আমাদের এটি আইনিভাবে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। সেই জামিন পাওয়ার পর খালেদা জিয়া আমাদের মধ্যে ফিরে আসবেন। শিগগির ফিরে আসবেন।
খালেদার জিয়ার মামলায় কি মধু আছে : খন্দকার মাহবুব
মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যাপারে অ্যাটর্নি জেনারেলের মন্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেছেন, হাইকোর্ট বিভাগে প্রায় এক লাখ মামলা দীর্ঘ দিন থেকে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তার মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মামলা রয়েছে ২০০ এর ওপরে। তা সত্ত্বেও বেগম খালেদা জিয়ার মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চায় সরকার। এ থেকে মনে হয়, বেগম খালেদা জিয়াকে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার কারণে রাজনীতি থেকে দূরে রাখা সরকারের মনবাসনা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসা ছাড়া এই মামলাটিতে এমন কি মধু আছে যে দ্রুত নিষ্পত্তি করতে চায় সরকার।
গতকাল বুধবার জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেয়া জামিন বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায় ঘোষণার পর সুপ্রিম কোর্ট বার ভবনের নিজ কক্ষে নয়া দিগন্তকে দেয়া প্রতিক্রিয়ায় খন্দকার মাহবুব হোসেন এ সব কথা বলেন।
খালেদা জিয়ার আইনজীবী ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন বলেন, সরকার তো সব সময় বাধা দেয়। এখন তার বিরুদ্ধে অন্য যেসব মামলা আছে সেগুলোতে দ্রুত হাইকোর্ট থেকে জামিন নেয়ার চেষ্টা করব। আইনি প্রক্রিয়ায় সব বাধা দূর করা হবে। অন্য দিকে আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নি¤œ আদালতের সাজা বাতিল চেয়ে খালেদা জিয়ার আপিল নিষ্পত্তি করতে আপিল বিভাগের আদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমরাও চাই দ্রুত শুনানি হোক। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলায় নি¤œ আদালত সাজা দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে আপিলে সুপ্রিম কোর্টে আমরা বিচার পাবো। তিনি বলেন, নি¤œ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, এতিমের টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। অথচ টাকা আত্মসাৎ তো হয়নি, বরং তিন গুণ টাকা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টের অ্যাকাউন্টে জমা আছে। সে হিসেবে টাকা আত্মসাৎ না হলে দুদক আইনে মামলাই হয় না। এ ক্ষেত্রে আমরা উচ্চ আদালতে বিচার পাবো।
এখানে আর বিচারকে বিলম্বিত করতে পারবেন না : অ্যাটর্নি জেনারেল
রায় ঘোষণার পর নিজ কার্যালয়ে এক ব্রিফিংয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, হাইকোর্টে খালেদা জিয়ার আপিল আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। এখন আপিল শুনানির জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি আরো বলেন, খালেদা জিয়া নি¤œ আদালতে এই মামলার বিচার ৯ বছর ঝুলিয়ে রেখেছিলেন। আপিল বিভাগের এ আদেশের ফলে এখানে আর বিচার তিনি বিলম্বিত করতে পারবেন না বলে আশা করা যায়।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে কয়টি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা আছে, কয়টি মামলায় জামিন নিতে হবে। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মাহবুবে আলম বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা এ তথ্য দিতে পারবেন। অন্য দিকে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, আমরা হাইকোর্ট বিভাগে এ মামলার আপিল শুনানির জন্য প্রস্তুত আছি। তিনি বলেন, আপিল বিভাগের এ রায় পাওয়ার পর আমরা হাইকোর্ট বিভাগে যাব। সেখানে বলব, সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আপিল নিষ্পত্তি করতে। আমরা আপিল শুনানি করতে প্রস্তুত আছি।
আদালতে গতকাল খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী ছিলেনÑ মওদুদ আহমদ, খন্দকার মাহবুব হোসেন, এ জে মোহাম্মদ আলী, আমিনুল হক, আবদুর রেজাক খান, জয়নুল আবেদীন, মীর মোহাম্মদ নাছির উদ্দিন, নিতাই রায় চৌধুরী, মাহবুবউদ্দিন খোকন, সানাউল্লাহ মিয়া, অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার, বদরুদ্দোজা বাদল, কায়সার কামাল, নওশাদ জমির, রাগীব রউফ চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ হেলাল উদ্দীন, সগীর হোসেন লিওন, জাকির হোসেন ভূঁইয়া, মো: আলী, মির্জা আল মাহমুদ, সালমা সুলতানা সোমা প্রমুখ।
এর আগে উভয়পক্ষের শুনানি শেষে গত ৯ মে আপিল বিভাগ রায়ের জন্য ১৫ মে দিন নির্ধারণ করেন।
তবে ওই দিন রায় ঘোষণার আগে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম দাঁড়িয়ে বলেন, আমি গত দিনে সব সাবমিশন করতে পারিনি। আমাকে আবার কিছু সাবমিশন করতে হবে। আদালত তাকে অনুমতি দিয়ে শুনানি গ্রহণ করেন এবং ১৬ মে রায়ের নতুন তারিখ ধার্য করেন।
গত ১৯ মার্চ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার জামিন স্থগিত করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। একই সাথে খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন আদেশের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও রাষ্ট্রপকে আপিলের অনুমতি দেন আদালত।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি বেগম খালেদা জিয়াকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়। ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত এ রায় দেন। রায় ঘোষণার পরপরই বেগম খালেদা জিয়াকে আদালত থেকে গ্রেফতার করে পুরান ঢাকার সাবেক কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। তিনি এখন সেখানেই আছেন। এ মামলায় খালেদা জিয়ার বড় ছেলে ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ অপর চারজনকে ১০ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং দুই কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়।
এরপর গত ২০ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় নি¤œ আদালতের সাজার রায়ের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার খালাস চেয়ে আপিল দায়ের করা হয়। আপিলের গ্রহণযোগ্যতার শুনানি করে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২২ ফেব্রুয়ারি তা শুনানির জন্য গ্রহণ করে নি¤œ আদালতের দেওয়া অর্থদণ্ড আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত করেন।
এরপর গত ১২ মার্চ চারটি যুক্তি আমলে নিয়ে বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের হাইকোর্ট বেঞ্চ জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়াকে চার মাসের জামিন দেন।
এরপর গত ১৪ মার্চ দুদক ও সরকার জামিন স্থগিত চেয়ে আপিল আবেদন করলে সর্বোচ্চ আদালত জামিন স্থগিত করে নিয়মিত লিভ টু আপিল করতে বলেন। ১৯ মার্চ দুদক ও রাষ্ট্রপকে আপিলের অনুমতি দিয়ে ৮ মে শুনানির দিন ঠিক করে দেন আপিল বিভাগ। ওই আপিল শুনানি শেষে গতকাল জামিন বহাল রেখে সরকার ও দুদকের আপিল খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ।
খালেদা জিয়ার জামিননামা দাখিল
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বেগম খালেদা জিয়াকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল থাকায় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে জামিননামা দাখিল করেছেন তার আইনজীবীরা।
গতকাল দুপুরে এ জামিননামা দাখিল করেন তার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া ও অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার। এ বিষয়ে মাসুদ আহমেদ তালুকদার বলেন, জামিননামা সিএমএম আদালতে দাখিল করা হয়েছে। এখন সেখান থেকে তা কারাগারে যাবে। এছাড়া আপিল বিভাগের রায়ের কপি প্রকাশ হওয়ার পর তা কারাগারে যাবে। এ বিষয়ে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, হাইকোর্ট জামিন মঞ্জুর করলে তখন আমরা জামিননামা দাখিল করেছি। এখন আপিল বিভাগের রায় প্রকাশ হলে তা সরাসরি কারাগারে যাবে এবং বেগম খালেদা জিয়া জামিন পাবেন।
জাতীয় পতাকা অবমাননা ও জন্মদিন পালনের মামলার জামিনের বিষয়ে আদেশ আজ : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা অবমাননা এবং ভুয়া জন্মদিন পালনের অভিযোগে দায়ের করা পৃথক দুই মামলায় জামিন আবেদনের শুনানির বিষয়ে আজ বৃহস্পতিবার আদেশের দিন ধার্য রয়েছে। রাজধানীর বকশিবাজার আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত আদালতে পৃথক দু’জন মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট খুরশীদ আলম ও আহসান হাবীব গত ২৫ এপ্রিল দুই মামলায় প্রোডাকশন ওয়ারেন্ট ইস্যুসহ জামিন শুনানির এ দিন ধার্য করেন। খালেদা জিয়ার আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানান, আজ বেলা ১১টায় ওই দুই মামলায় জামিনের বিষয়ে আদেশের কথা রয়েছে।
No comments