ভারত কি তার প্রতিবেশীদের হারাচ্ছে? by ধ্রুব জয়শঙ্কর
বাংলাদেশে
বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া দুর্নীতির দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড লাভ
করেছেন। শ্রীলঙ্কায় সাবেক প্রেসিডেন্ট মাহিন্দ্রা রাজাপাকসের দল স্থানীয়
নির্বাচনে বিরাট বিজয় পেয়েছে। নেপালে কে.পি. ওলি ভারতের সঙ্গে যার জটিল
সম্পর্কের ইতিহাস রয়েছে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনরায় ফিরে এসেছেন।
মালদ্বীপে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত একজন প্রেসিডেন্ট আবদুল্লাহ ইয়ামিন জরুরি
অবস্থা ঘোষণা করেছেন। ভুটানে স্থানীয় নির্বাচন দ্বারপ্রান্তে।
এই নির্বাচনে সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী কিছু রাজনীতিবিদ দেশটির ভারত নির্ভরশীলতা কমাতে আওয়াজ তুলেছেন। ভারতের গণমাধ্যম মুদ্রণ, টেলিভিশন এবং অনলাইন এসব অগ্রগতির ওপর নজর রাখছে। এবং তারা একটি অভিন্ন লাইন গ্রহণ করেছে। তার সারকথা হলো- ভারত তার প্রতিবেশীদের হারাতে বসেছে। আর এটা করতে গিয়ে তারা যে সুপরিচিতি ভাষ্যটি সামনে এনেছে তা হলো- চীন ক্রমশ তার প্রভাব বিস্তৃত এবং ভারত চতুর্দিকে একটি পরিবেষ্টিত, বিচ্ছিন্ন এবং অসহায় অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু কেউ যদি একটু পেছনে তাকান, যদি তিনি দূরবর্তী প্রবণতা দেখতে চান এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপের সম্পর্কের বাস্তবতা লক্ষ্য করেন, তাহলে দৃশ্যটিতে একটু ভিন্নতা প্রতীয়মান হবে।
ভারত এবং তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীগুলোর (পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মিয়ানমারকে হিসাবের বাইরে রেখে) মধ্যকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক আন্তঃনির্ভরশীলতা অনেক বেশি বিস্তৃত এবং সত্যি বলতে কি তা সুগভীর। এসব দেশগুলোর সঙ্গে সম্মতি, বিশ্বাস এবং শুভেচ্ছার মাধ্যমে অনেক ভালো কাজ করতে পারে। কিন্তু একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের প্রভাব খর্ব হওয়ার খবর বেশ অতিরঞ্জিত হয়ে উঠেছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মূল্যায়নে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনাযোগ্য।
প্রথমত. সকল প্রতিবেশীই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার রীতিনীতি অনুসরণ কিংবা তার চেতনা লালনে সক্রিয় রয়েছে। যদিও তারা তাদের অগ্রযাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বিভিন্ন উপলক্ষে হোঁচট খেয়ে চলছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্র উত্তরণে তাদের অভিপ্রায় একটি ইতিবাচক উন্নয়ন। সংক্ষিপ্ত মেয়াদে এটা নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। যদিও ভুটানের রাজা উল্লেখযোগ্য ক্ষমতার অধিকারী রয়ে গেছেন। কিন্তু তারা একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে চাইছে। নেপাল এগিয়েছে আরো কিছুটা দূর; তারা ইতিমধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ বছরের পর বছর সামরিক স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটিয়েছে; যদিও তাদের গণতান্ত্রিক শাসন ত্রুটিপূর্ণ। এবং মালদ্বীপ প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় ইয়ামিনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগে গণতান্ত্রিক শাসনে আশার আলো দেখেছিল। এমনকি শ্রীলঙ্কা অন্যদের চেয়ে যেখানে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে, তারা গৃহযুদ্ধ থামাতে পেরেছে। এবং তারা এমন একটি অধ্যায় পেছনে ফেলে এসেছে, যেখানে নিয়মিতভাবে বিরোধী নেতৃবৃন্দকে হত্যার রাজনীতি সংঘটিত হতো; সেটাও তারা পেছনে ফেলে এসেছে। আজ এসব রাষ্ট্রগুলোতে নতুন ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত সর্বত্রই আইডেনটিটি প্রতিষ্ঠার রাজনীতির উত্থান ঘটছে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ভারতের আয়তন এবং এই বাস্তবতা মনে রাখতে হবে যে, জাতিগত সংখ্যালঘুদের রাজনীতি সীমান্ত ছাড়িয়ে যায়। আর সেকারণে ভারতকে তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের আইডেন্টিটি পলিটিক্সের মধ্যে টেনে নেয়া হবে। এভাবে প্রত্যেক প্রতিবেশীর মধ্যে কতিপয় নির্দিষ্ট সংখ্যক রাজনৈতিক শক্তি ভারত বিরোধিতার বাগাড়ম্বর এবং তৎপরতা চালানোকে একটা অনুকূল বিষয় মনে করছে। অন্যদিকে তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা থেকে সুবিধা নিয়ে থাকে। সংখ্যালঘু গ্রুপ এবং ভিন্নমতাবলম্বীরা ভারতীয় সহায়তা চাইছে। যেমনটা মালদ্বীপের সামপ্রতিক ঘটনাবলিতে দেখা গেছে। জাতীয়তাবাদ এবং ভারতবিরোধিতা গত ৭০ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। যদিও সময়ের ধারাবাহিকতায় উপদলগুলোর চরিত্র বদলেছে এবং ‘ফল্ট লাইনগুলো’ আরো তীক্ষ্ণ হয়েছে।
তৃতীয়ত, অনেক ভারতীয় ভাষ্যকারগণ এই সত্য উপেক্ষা করেন যে, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এসব দেশের এজেন্সি রয়েছে। এবং তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। সময় সময় তাদের পছন্দসমূহ, তা সেটা রাজনৈতিক বা নীতিগত যাই হোক না কেনো, ভারতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে তার একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যান্য সময় সেটা থাকে না। ভারতের সে কারণে ফলাফল বিশেষ করে রাজনৈতিক ফলাফল নির্দিষ্ট করার সামর্থ্য সর্বদাই সীমিত থেকে যাবে। ভারতের তরফে যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপ উল্টো ফলদায়ক হিসেবে সহজে প্রমাণিত হতে পারে। নিষ্ক্রিয়তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তারা ভারতীয় হস্তক্ষেপকে হেজিমনিক এবং নৈরাজ্যিক হিসেবে সমালোচনা করে থাকেন।
চতুর্থত. ভারতের নিকট প্রতিবেশীদের উপর চীনের প্রভাব বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা রয়েছে। এর মানে এই নয় যে, চীনা প্রভাব বাড়েনি; সেটা বেড়েছে। বিগত বছরগুলোতে বেইজিং নেপালে নজিরবিহীন রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। চীন কয়েক দশকের পুরনো শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক থেকে বাংলাদেশের সুবিধা নিয়েছে। চীনা অস্ত্র গ্রহণকারী হিসেবে পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশ হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে চীন আর্থিক খাতের বড় বিনিয়োগকারীর ভূমিকায় বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। চীন তার এই ভূমিকাকে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় উত্তরণের চেষ্টা করছে।
কিন্তু এসব দেশগুলোতে চীনকে ধরে ফেলতে ভারত খেলছে কিংবা চীন ভারতকে সরিয়ে নিজকে মুখ্য বহিঃস্থ কুশীলব হিসেবে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করছে বলে যে ধারণা করা হয়, তা বহুলাংশে বিভ্রান্তিকর। চীনের সামরিক উপস্থিতি আগের মতোই সীমিত রয়ে গেছে। যদিও তার প্রভাব বলয় বিস্তারের পরীক্ষাটা অব্যাহতভাবে চলমান রয়েছে। এদিকে ভারতীয় নিরাপত্তা ভূমিকা প্রায়শ ওভারলুক করা হচ্ছে। আর সেক্ষেত্রগুলো হলো শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের সঙ্গে ট্রাইলেটারাল মেরিটাইম কো-অপারেশন ইনিশেয়েটিভ এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে তাদের অনন্য সম্পর্ক। যদিও এসব দেশগুলোতে (যেমনটা ভারতের মতোই) চীন উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগকারী এবং রপ্তানিকারক। কিন্তু তাদের কেউই চীনের শীর্ষ পাঁচ আমদানিকারক দেশের মধ্যে নেই। অথচ ভারত ভুটানে ৯৪ শতাংশ এবং নেপালে ৬৩ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে।
অন্য কিছু বাস্তবতা বিবেচনায় নেয়া উচিত। বিশেষ করে এটা নেপাল ও ভুটানের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। গত কিছু বছরগুলোতে অনেক মতপার্থক্য সত্ত্বেও নেপাল এখনো পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে একটি উন্মুক্ত সীমান্ত সুবিধা ভোগ করছে এবং দশ লাখের বেশি নেপালি (সম্ভবত আরো বেশি) কোনো পারমিট ছাড়াই ভারতে কাজ করছেন। নেপালি নাগরিকদের সাতটি রেজিমেন্ট হলো গোর্খা। আর তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশ। এবং ভারতীয় সরকার এখনো পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ২৭ হাজার নেপালি সাবেক সৈনিককে পেনশন দিচ্ছে। এসব এমন কিছু বিষয় নয়, যা চীন পূরণ করতে পারে। ভারতীয় সেনাবাহিনী রাজকীয় ভুটান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্ব পালন করে থাকে। ভুটানি আর্মি ভারতীয় বিমানবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছে। ভুটান সর্বোচ্চ ভারতীয় সাহায্য গ্রহণকারী দেশ। তারা ভারতের সাহায্যের মোট ৫৭ ভাগ, অর্থাৎ ২০১৭-১৮ সালে ছিল তিন হাজার সাতশ’ কোটি রুপির বেশি। এর বিপরীতে ভুটান এখনো পর্যন্ত চীনের সঙ্গে সরকারিভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। যদিও ধরন ভিন্নতর। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের আন্তনির্ভরশীলতা রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে স্থলসীমান্ত নিষ্পত্তি করেছে। এরপর ভারত ক্রমবর্ধমানভাবে সেখানে বিনিয়োগ করছে। ২০০৩ সাল থেকে অনুমোদিত লাইন অব ক্রেডিটের পরিমাণ সাত দশমিক আট বিলিয়ন ডলার, যা ভারতের মোট লাইন অব ক্রেডিটের এক তৃতীয়াংশের সমান। গত পাঁচ বছরে (ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানের পরে) শ্রীলঙ্কা কেবলই ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম সাহায্য গ্রহীতা দেশ নয়, দেশটি উল্লেখযোগ্যভাবে ভারতের জন্য একটি ট্রানজিট হাবে পরিণত হয়েছে। দুর্যোগের সময় এই পাঁচটি দেশের সবগুলোতে ভারত মানবিক সহায়তা দিয়েছে। সেটা শ্রীলঙ্কার ঘূর্ণিঝড়, নেপালের ভূমিকম্প কিংবা মালদ্বীপের পানি সংকটে দেখা গেছে।
গত বছরগুলোতে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে, শ্রীলঙ্কার রেলওয়ে গড়ে তুলতে একটি রেল ব্যবস্থা সৃষ্টি করা, ভারত কর্তৃক গত বছর একটি সাউথ এশিয়ান সেটেলাইটস ফর কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড মেটরোলজি এবং নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে বৈদ্যুতিক গ্রিড কানেক্টিভিটি ক্রমশ বৃদ্ধি করা।
এরপরেও কি ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের জটিলতা থেকে গেল? হ্যাঁ, এবং সেটা নিরঙ্কুশভাবে থাকছে। ভারতকে হস্তক্ষেপের ইতিহাসকে (নির্দিষ্টভাবে ১৯৭১ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যবর্তী) পেছনে ফেলে আসতে হবে। এবং তাকে প্রতিবেশীদের দীর্ঘ অবহেলার অধ্যায় শেষ করতে হবে। কিন্তু বৈরিতার জন্য ভ্রান্তিকর মতপার্থক্য এবং উষ্মা কোনোটিই সঠিক কিংবা উপকারী নয়। আজ মাইথেরিপালা শ্রীসেনা, শেখ হাসিনা, অলি এবং ইয়ামিন যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল ও মালদ্বীপে ক্ষমতায় রয়েছেন। প্রথম দুজন অত্যন্ত ক্রুডলি ভারতপন্থি হিসেবে পরিচিত। এর পরের দুজন প্রায়শ ভারতবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত। বাস্তবতা প্রায়শ এ ধরনের কেরিকেচারের চেয়ে অনেক বেশি সূক্ষ্ম।
এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক ভারতীয় এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে প্রতিবেশীরা ভারতের প্রতি বৈরী। এখন যদি রাজাপাকসে, খালেদা জিয়া, শের বাহাদুর দিউবা এবং মো. নাশিদ উল্লিখিতদের প্রতিস্থাপন করে তাহলে অনেক ভাষ্যকার ওই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন। আর সেটাই নিশ্চিত করে যে, অনুরূপ মূল্যায়ন (ভারতের প্রতি কারা বৈরী, কারা বৈরী নয়) আসলে কতটা অর্থহীন।
একটি শেষ পয়েন্ট। কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে ১৮৪০ ও ১৮৫০ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করেছিল, সেটা সম্ভবত একটা ব্যতিক্রম। কারণ কোনো বিশ্বশক্তি ব্যাপকভিত্তিক লক্ষ্য স্থির করা ছাড়া তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করেনি। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কোনোটিই তা করেনি। এমনকি বৃটেন স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে বিদ্রোহ দেখেছিল। যদিও তারা নিজেদেরকে একটি বিশ্ব শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা জাপান বা চীন কেউ তা করেনি। যারা বিশ্বাস করেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেকের সঙ্গে তার আঞ্চলিক মতপার্থক্য নিষ্পত্তি না হয়, ততোক্ষণ ভারতের কোনো উচ্চাভিলাষ থাকতে পারে না, তারা এই ইতিহাসের দিকে নজর রাখতে পারেন।
ধ্রুব জয়শঙ্কর: মার্কিন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ভারতীয় চ্যাপ্টারের দিল্লিভিত্তিক ফরেন পলিসি বিষয়ক ফেলো। ২০শে ফেব্রুয়ারির ভারতীয় ওয়েবসাইট দি প্রিন্টের সৌজন্যে। ইংরেজি থেকে অনূদিত
এই নির্বাচনে সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারী কিছু রাজনীতিবিদ দেশটির ভারত নির্ভরশীলতা কমাতে আওয়াজ তুলেছেন। ভারতের গণমাধ্যম মুদ্রণ, টেলিভিশন এবং অনলাইন এসব অগ্রগতির ওপর নজর রাখছে। এবং তারা একটি অভিন্ন লাইন গ্রহণ করেছে। তার সারকথা হলো- ভারত তার প্রতিবেশীদের হারাতে বসেছে। আর এটা করতে গিয়ে তারা যে সুপরিচিতি ভাষ্যটি সামনে এনেছে তা হলো- চীন ক্রমশ তার প্রভাব বিস্তৃত এবং ভারত চতুর্দিকে একটি পরিবেষ্টিত, বিচ্ছিন্ন এবং অসহায় অবস্থায় পড়েছে। কিন্তু কেউ যদি একটু পেছনে তাকান, যদি তিনি দূরবর্তী প্রবণতা দেখতে চান এবং ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান এবং মালদ্বীপের সম্পর্কের বাস্তবতা লক্ষ্য করেন, তাহলে দৃশ্যটিতে একটু ভিন্নতা প্রতীয়মান হবে।
ভারত এবং তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীগুলোর (পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মিয়ানমারকে হিসাবের বাইরে রেখে) মধ্যকার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক আন্তঃনির্ভরশীলতা অনেক বেশি বিস্তৃত এবং সত্যি বলতে কি তা সুগভীর। এসব দেশগুলোর সঙ্গে সম্মতি, বিশ্বাস এবং শুভেচ্ছার মাধ্যমে অনেক ভালো কাজ করতে পারে। কিন্তু একটি আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে ভারতের প্রভাব খর্ব হওয়ার খবর বেশ অতিরঞ্জিত হয়ে উঠেছে।
প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক মূল্যায়নে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিবেচনাযোগ্য।
প্রথমত. সকল প্রতিবেশীই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার রীতিনীতি অনুসরণ কিংবা তার চেতনা লালনে সক্রিয় রয়েছে। যদিও তারা তাদের অগ্রযাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ে এবং বিভিন্ন উপলক্ষে হোঁচট খেয়ে চলছে। তবে দীর্ঘ মেয়াদে গণতন্ত্র উত্তরণে তাদের অভিপ্রায় একটি ইতিবাচক উন্নয়ন। সংক্ষিপ্ত মেয়াদে এটা নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে। যদিও ভুটানের রাজা উল্লেখযোগ্য ক্ষমতার অধিকারী রয়ে গেছেন। কিন্তু তারা একটি সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে যেতে চাইছে। নেপাল এগিয়েছে আরো কিছুটা দূর; তারা ইতিমধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ বছরের পর বছর সামরিক স্বৈরতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটিয়েছে; যদিও তাদের গণতান্ত্রিক শাসন ত্রুটিপূর্ণ। এবং মালদ্বীপ প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় ইয়ামিনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার আগে গণতান্ত্রিক শাসনে আশার আলো দেখেছিল। এমনকি শ্রীলঙ্কা অন্যদের চেয়ে যেখানে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য রয়েছে, তারা গৃহযুদ্ধ থামাতে পেরেছে। এবং তারা এমন একটি অধ্যায় পেছনে ফেলে এসেছে, যেখানে নিয়মিতভাবে বিরোধী নেতৃবৃন্দকে হত্যার রাজনীতি সংঘটিত হতো; সেটাও তারা পেছনে ফেলে এসেছে। আজ এসব রাষ্ট্রগুলোতে নতুন ভিন্নমতাবলম্বীদের কণ্ঠ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।
দ্বিতীয়ত সর্বত্রই আইডেনটিটি প্রতিষ্ঠার রাজনীতির উত্থান ঘটছে। এটা খুবই স্বাভাবিক যে, ভারতের আয়তন এবং এই বাস্তবতা মনে রাখতে হবে যে, জাতিগত সংখ্যালঘুদের রাজনীতি সীমান্ত ছাড়িয়ে যায়। আর সেকারণে ভারতকে তার ক্ষুদ্র প্রতিবেশীদের আইডেন্টিটি পলিটিক্সের মধ্যে টেনে নেয়া হবে। এভাবে প্রত্যেক প্রতিবেশীর মধ্যে কতিপয় নির্দিষ্ট সংখ্যক রাজনৈতিক শক্তি ভারত বিরোধিতার বাগাড়ম্বর এবং তৎপরতা চালানোকে একটা অনুকূল বিষয় মনে করছে। অন্যদিকে তাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীরা ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখা থেকে সুবিধা নিয়ে থাকে। সংখ্যালঘু গ্রুপ এবং ভিন্নমতাবলম্বীরা ভারতীয় সহায়তা চাইছে। যেমনটা মালদ্বীপের সামপ্রতিক ঘটনাবলিতে দেখা গেছে। জাতীয়তাবাদ এবং ভারতবিরোধিতা গত ৭০ বছর ধরে অব্যাহত রয়েছে। যদিও সময়ের ধারাবাহিকতায় উপদলগুলোর চরিত্র বদলেছে এবং ‘ফল্ট লাইনগুলো’ আরো তীক্ষ্ণ হয়েছে।
তৃতীয়ত, অনেক ভারতীয় ভাষ্যকারগণ এই সত্য উপেক্ষা করেন যে, সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে এসব দেশের এজেন্সি রয়েছে। এবং তারা তাদের নিজেদের স্বার্থে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। সময় সময় তাদের পছন্দসমূহ, তা সেটা রাজনৈতিক বা নীতিগত যাই হোক না কেনো, ভারতীয় অগ্রাধিকারের সঙ্গে তার একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। অন্যান্য সময় সেটা থাকে না। ভারতের সে কারণে ফলাফল বিশেষ করে রাজনৈতিক ফলাফল নির্দিষ্ট করার সামর্থ্য সর্বদাই সীমিত থেকে যাবে। ভারতের তরফে যেকোনো ধরনের হস্তক্ষেপ উল্টো ফলদায়ক হিসেবে সহজে প্রমাণিত হতে পারে। নিষ্ক্রিয়তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তারা ভারতীয় হস্তক্ষেপকে হেজিমনিক এবং নৈরাজ্যিক হিসেবে সমালোচনা করে থাকেন।
চতুর্থত. ভারতের নিকট প্রতিবেশীদের উপর চীনের প্রভাব বাড়িয়ে দেখানোর একটা প্রবণতা রয়েছে। এর মানে এই নয় যে, চীনা প্রভাব বাড়েনি; সেটা বেড়েছে। বিগত বছরগুলোতে বেইজিং নেপালে নজিরবিহীন রাজনৈতিক ভূমিকা পালন করেছে। চীন কয়েক দশকের পুরনো শক্তিশালী সামরিক সম্পর্ক থেকে বাংলাদেশের সুবিধা নিয়েছে। চীনা অস্ত্র গ্রহণকারী হিসেবে পাকিস্তানের পরে বাংলাদেশ হলো দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপে চীন আর্থিক খাতের বড় বিনিয়োগকারীর ভূমিকায় বিশেষ করে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। চীন তার এই ভূমিকাকে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততায় উত্তরণের চেষ্টা করছে।
কিন্তু এসব দেশগুলোতে চীনকে ধরে ফেলতে ভারত খেলছে কিংবা চীন ভারতকে সরিয়ে নিজকে মুখ্য বহিঃস্থ কুশীলব হিসেবে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করছে বলে যে ধারণা করা হয়, তা বহুলাংশে বিভ্রান্তিকর। চীনের সামরিক উপস্থিতি আগের মতোই সীমিত রয়ে গেছে। যদিও তার প্রভাব বলয় বিস্তারের পরীক্ষাটা অব্যাহতভাবে চলমান রয়েছে। এদিকে ভারতীয় নিরাপত্তা ভূমিকা প্রায়শ ওভারলুক করা হচ্ছে। আর সেক্ষেত্রগুলো হলো শ্রীলঙ্কা এবং মালদ্বীপের সঙ্গে ট্রাইলেটারাল মেরিটাইম কো-অপারেশন ইনিশেয়েটিভ এবং নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে তাদের অনন্য সম্পর্ক। যদিও এসব দেশগুলোতে (যেমনটা ভারতের মতোই) চীন উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগকারী এবং রপ্তানিকারক। কিন্তু তাদের কেউই চীনের শীর্ষ পাঁচ আমদানিকারক দেশের মধ্যে নেই। অথচ ভারত ভুটানে ৯৪ শতাংশ এবং নেপালে ৬৩ শতাংশ রপ্তানি করে থাকে।
অন্য কিছু বাস্তবতা বিবেচনায় নেয়া উচিত। বিশেষ করে এটা নেপাল ও ভুটানের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। গত কিছু বছরগুলোতে অনেক মতপার্থক্য সত্ত্বেও নেপাল এখনো পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে একটি উন্মুক্ত সীমান্ত সুবিধা ভোগ করছে এবং দশ লাখের বেশি নেপালি (সম্ভবত আরো বেশি) কোনো পারমিট ছাড়াই ভারতে কাজ করছেন। নেপালি নাগরিকদের সাতটি রেজিমেন্ট হলো গোর্খা। আর তারা ভারতীয় সেনাবাহিনীর অংশ। এবং ভারতীয় সরকার এখনো পর্যন্ত প্রায় এক লাখ ২৭ হাজার নেপালি সাবেক সৈনিককে পেনশন দিচ্ছে। এসব এমন কিছু বিষয় নয়, যা চীন পূরণ করতে পারে। ভারতীয় সেনাবাহিনী রাজকীয় ভুটান সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্ব পালন করে থাকে। ভুটানি আর্মি ভারতীয় বিমানবাহিনীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে আসছে। ভুটান সর্বোচ্চ ভারতীয় সাহায্য গ্রহণকারী দেশ। তারা ভারতের সাহায্যের মোট ৫৭ ভাগ, অর্থাৎ ২০১৭-১৮ সালে ছিল তিন হাজার সাতশ’ কোটি রুপির বেশি। এর বিপরীতে ভুটান এখনো পর্যন্ত চীনের সঙ্গে সরকারিভাবে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। যদিও ধরন ভিন্নতর। কিন্তু ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপের আন্তনির্ভরশীলতা রয়েছে। ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে চূড়ান্তভাবে স্থলসীমান্ত নিষ্পত্তি করেছে। এরপর ভারত ক্রমবর্ধমানভাবে সেখানে বিনিয়োগ করছে। ২০০৩ সাল থেকে অনুমোদিত লাইন অব ক্রেডিটের পরিমাণ সাত দশমিক আট বিলিয়ন ডলার, যা ভারতের মোট লাইন অব ক্রেডিটের এক তৃতীয়াংশের সমান। গত পাঁচ বছরে (ভুটান, নেপাল ও আফগানিস্তানের পরে) শ্রীলঙ্কা কেবলই ভারতের চতুর্থ বৃহত্তম সাহায্য গ্রহীতা দেশ নয়, দেশটি উল্লেখযোগ্যভাবে ভারতের জন্য একটি ট্রানজিট হাবে পরিণত হয়েছে। দুর্যোগের সময় এই পাঁচটি দেশের সবগুলোতে ভারত মানবিক সহায়তা দিয়েছে। সেটা শ্রীলঙ্কার ঘূর্ণিঝড়, নেপালের ভূমিকম্প কিংবা মালদ্বীপের পানি সংকটে দেখা গেছে।
গত বছরগুলোতে অন্যান্য উল্লেখযোগ্য অগ্রগতির মধ্যে রয়েছে, শ্রীলঙ্কার রেলওয়ে গড়ে তুলতে একটি রেল ব্যবস্থা সৃষ্টি করা, ভারত কর্তৃক গত বছর একটি সাউথ এশিয়ান সেটেলাইটস ফর কমিউনিকেশন্স অ্যান্ড মেটরোলজি এবং নেপাল ও বাংলাদেশের সঙ্গে বৈদ্যুতিক গ্রিড কানেক্টিভিটি ক্রমশ বৃদ্ধি করা।
এরপরেও কি ভারতের প্রতিবেশীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের জটিলতা থেকে গেল? হ্যাঁ, এবং সেটা নিরঙ্কুশভাবে থাকছে। ভারতকে হস্তক্ষেপের ইতিহাসকে (নির্দিষ্টভাবে ১৯৭১ থেকে ১৯৯০-এর মধ্যবর্তী) পেছনে ফেলে আসতে হবে। এবং তাকে প্রতিবেশীদের দীর্ঘ অবহেলার অধ্যায় শেষ করতে হবে। কিন্তু বৈরিতার জন্য ভ্রান্তিকর মতপার্থক্য এবং উষ্মা কোনোটিই সঠিক কিংবা উপকারী নয়। আজ মাইথেরিপালা শ্রীসেনা, শেখ হাসিনা, অলি এবং ইয়ামিন যথাক্রমে শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল ও মালদ্বীপে ক্ষমতায় রয়েছেন। প্রথম দুজন অত্যন্ত ক্রুডলি ভারতপন্থি হিসেবে পরিচিত। এর পরের দুজন প্রায়শ ভারতবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত। বাস্তবতা প্রায়শ এ ধরনের কেরিকেচারের চেয়ে অনেক বেশি সূক্ষ্ম।
এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে অনেক ভারতীয় এই উপসংহারে পৌঁছেছেন যে প্রতিবেশীরা ভারতের প্রতি বৈরী। এখন যদি রাজাপাকসে, খালেদা জিয়া, শের বাহাদুর দিউবা এবং মো. নাশিদ উল্লিখিতদের প্রতিস্থাপন করে তাহলে অনেক ভাষ্যকার ওই একই সিদ্ধান্তে পৌঁছবেন। আর সেটাই নিশ্চিত করে যে, অনুরূপ মূল্যায়ন (ভারতের প্রতি কারা বৈরী, কারা বৈরী নয়) আসলে কতটা অর্থহীন।
একটি শেষ পয়েন্ট। কানাডা ও মেক্সিকোর সঙ্গে ১৮৪০ ও ১৮৫০ সালের দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করেছিল, সেটা সম্ভবত একটা ব্যতিক্রম। কারণ কোনো বিশ্বশক্তি ব্যাপকভিত্তিক লক্ষ্য স্থির করা ছাড়া তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করেনি। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর কোনোটিই তা করেনি। এমনকি বৃটেন স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডে বিদ্রোহ দেখেছিল। যদিও তারা নিজেদেরকে একটি বিশ্ব শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছিল। একইভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা জাপান বা চীন কেউ তা করেনি। যারা বিশ্বাস করেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত প্রত্যেকের সঙ্গে তার আঞ্চলিক মতপার্থক্য নিষ্পত্তি না হয়, ততোক্ষণ ভারতের কোনো উচ্চাভিলাষ থাকতে পারে না, তারা এই ইতিহাসের দিকে নজর রাখতে পারেন।
ধ্রুব জয়শঙ্কর: মার্কিন ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের ভারতীয় চ্যাপ্টারের দিল্লিভিত্তিক ফরেন পলিসি বিষয়ক ফেলো। ২০শে ফেব্রুয়ারির ভারতীয় ওয়েবসাইট দি প্রিন্টের সৌজন্যে। ইংরেজি থেকে অনূদিত
No comments