রোহিঙ্গা সংকটের বোঝা বাংলাদেশের কাঁধে
সেলিমের
বয়স কম হলেও তার গলার আওয়াজে সাহসের অভাব নেই। এক সময় সে মিয়ানমারের
বাসিন্দা ছিল। সেখানে গরু চরাতে গিয়ে গান গাইতো সে। কিন্তু রাখাইন
অঙ্গরাজ্যে আগস্টে শুরু হওয়া সহিংসতায় মিয়ানমার ছেড়ে সেলিম বাংলাদেশে
পালিয়ে এসেছে। এখানে এসে অক্টোবরে নতুন একটি গান কমেপাজ করেছে এই ছোট্ট
বালক। গানটা অনেকটা এরকম- ‘ওই দুর্বৃত্তরা কি করলো?- আমাদের প্রাণপ্রিয়
মানুষদের কিভাবে হত্যা করতে পারলো?- ওই অপরাধীরা কি করলো?- সবাইকে হাঁটু
গেড়ে বসা থাকা অবস্থায় পুড়িয়ে দিলো।’ সেলিমের ধারণা তার বয়স ১০।
বড় ভাইয়ের কাছ থেকে গান গাইতে শিখেছিল সে। এক বৌদ্ধ দুর্বৃত্তের হাতে খুন হয় তার ভাই। তার পরিবার পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। বর্তমানে একটি জীর্ণ শিবিরে তাদের বসবাস। এখানে তার কিছুই করার নেই, কোথাও যাওয়ার নেই। এইখানে তার গানই তার একমাত্র সান্ত্বনা।
আগস্টের ২৫ তারিখ যখন সামপ্রতিক রোহিঙ্গা সংকটের শুরু হয়, তখন কেউ আন্দাজ করতে পারেনি এর পরিণতি এত ভয়ঙ্কর আর এত বিশাল হবে। কয়েক সপ্তাহে বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। যারা বেঁচে গেছেন তাদের সঙ্গে রয়ে গেছে নৃশংস, নির্মম স্মৃতি- প্রিয়জনদের হারানোর বেদনা। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র এই সহিংসতাকে জাতি নিধন বলে আখ্যায়িত করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি গণহত্যার সামিল। আন্তর্জাতিক নিয়মের অধীনে জাতি নিধন কোনো স্বতন্ত্র অপরাধ নয়, তবে এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শামিল। অন্যদিকে গণহত্যার সংজ্ঞা সমপূর্ণ আলাদা- একদল মানুষকে তাদের জাতীয়তা, জাত, বর্ণ বা বিশ্বাসের কারণে ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে চালানো হয় গণহত্যা। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ এটি। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি ন্যায় বিচারের কোনো ঘটনা নয়। এইখানে, বেঁচে থাকাটাই মূল বিষয়।
এখন পর্যন্ত রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। রোউয়ান্ডা গণহত্যার পর এটাই সবচেয়ে বড় শরণার্থী মুভমেন্ট। ২৫শে আগস্ট রাতে রাখাইনের সেনাবাহিনী ও পুলিশ ক্যামেপ হামলা চালায় বিদ্রোহী দল আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এরপর থেকেই সেখানে নিধনযজ্ঞ শুরু করে সামরিক বাহিনী। অনেকে সবকিছু ত্যাগ করে রাখাইন ছেড়েছে, সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে রেহাই পেতে। শিশুদের ঝুড়িতে ভরে, বৃদ্ধদের কাঁধে করে ও পশু পাখি সঙ্গে নিয়েও পালিয়েছে অনেকে। কখনো কয়েকদিন, কখনো কয়েক সপ্তাহ লেগেছে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছাতে। সেসব হেঁটে আসার রাস্তাগুলোতেও মরণফাঁদ হিসেবে সেনাবাহিনী পুঁতে রেখেছিল স্থলবোমা। কেউ কেউ সেসব ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। কাওকে সেনাবাহিনী পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছে। আবার কেউ নদীপথে আসতে গিয়ে পানিতে ডুবে মরেছে।
বাংলাদেশে এসেও তেমন সুখে নেই তারা। সংকটের শুরুর দিকে যারা এসেছে তাদের অনেককে দিন যাপন করতে হয়েছে, খোলা আকাশের নিচে- রোদ, বৃষ্টি সহ্য করে। আগে থেকেই নির্মিত দুই শিবিরের মাঝখানে থাকা বন কেটে তাদের জন্য জায়গা করে দেয়া হয়। জাতিসংঘ এই অবস্থাকে জরুরি মানবিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছে। এখন রোহিঙ্গারা বাঁশ ও তারপুলিন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী শিবিরে অবস্থান করছে। এসব শিবিরের অবস্থা প্রায় অবাসযোগ্য। এগুলোতে নেই, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা- নেই পর্যাপ্ত খাবার, পানি, চিকিৎসা। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আগমন থামছেই না। এভাবে চললে অচিরেই নতুন আগমনকারীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভাব দেখা দেবে। এই বিশাল শিবিরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক পর্বত। সেখান থেকে যেদিকেই চোখ যায়- শুধু ছোট ছোট জীর্ণ কুটিরই নজরে পড়ে। এটা অনেকটা একটা শহরের মতো- কিন্তু এখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। কিন্তু জনসংখ্যা প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির সমান। আর এ জনসংখ্যার ৬০ ভাগই শিশু। ফরাসি এনজিও একশন এগেইন্সট হাঙ্গার (এসিএফ) এর সমপ্রতি করা এক জরিপে দেখা গেছে, এসব শিশুদের ৭.৫ শতাংশই ব্যাপক অপুষ্টিতে ভুগছে। অনাহারে থাকার ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৪০ হাজারের মতো শিশু। যাদের বয়স ৬ মাসের কম (সংখ্যায় বেশি) তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। বাকিরা রয়েছে ডায়রিয়া বা কলেরা বা হামের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে। অথবা বন্য হাতির আক্রমণেও প্রাণ হারানোর ঝুকিতো আছেই। চিকিৎসা সেবাদানিকারী বেসরকারি দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্সের(এমএসএফ) জরুরি সমন্বয়ক রবার্ট অনুসের ভাষ্য মতে, এই অবস্থাকে মূলত জটিল সংকট বলা হয়। এটা সিরিয়ার মতো, মানসিক আঘাতের প্রতিক্রিয়া নয়। এটা কোন কলেরা মহামারীও নয়, যেখানে চিকিৎসকরা অসুস্থতা সারাতে কাজ করে। এটা কোন দুর্ভিক্ষও নয়। শুধু কোনো জাতিগত বা ধর্মগত বা রাজনৈতিক নিপীড়নও নয়। এটা সবকিছু, একসঙ্গে। তিনি বলেন, আপনি যদি একটি বিষয়ের প্রতি বেশি মনোযোগ দেন, তাহলে আপনাকে অন্য বিষয়গুলোতে কম মনোযোগ দিতে হবে- এটাই সবচেয়ে বেশি জটিল অংশ। প্রত্যেক দিনই কোন না কোন নতুন উদ্বেগ দেখা দেয়। এতগুলো শিশু না খেয়ে মারা যেতে পারে- এতগুলো মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, এদের বিশেষ যত্নের দরকার আছে- কয়েকদিন পরেই কোনো ঝড় আঘাত হানবে ইত্যাদি। সবগুলোই আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ প্রধান এন্তোনিও গুতেরা এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি মানবাধিকার দুঃস্বপ্ন মোকাবিলা করছে। কক্সবাজারে নিয়োজিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরুরি সমন্বয়ক মাইকেল ডানফোর্ড বলেন, আমরা এমন একতা সংকটের শুরুর দিকে আছি, যেটা সামপ্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট হতে চলেছে। বাংলাদেশ সরকার হয়তো প্রথম দিকে তাদের আশ্রয় দেয়ার সময় বুঝতে পারেনি তারা কিসের সম্মুখীন হতে চলেছিল। তবে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে তারা দিয়েছে।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে গণতান্ত্রিক উন্নতির ধারণাটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাল্টে দিয়েছে। মিয়ানমারের কার্যত নেত্রী হওয়ার আগে অং সান সুচি বহু বছর গৃহবন্দি হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন। পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। এরপর ২০১৬ সালে তিনি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর নির্বাচিত হন। তবে এই সংকট তার পেছনের সকল অর্জনকে মূল্যহীন করে তুলেছে। তার চোখের সামনে রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হলেও, হত্যা করা হলেও তিনি এই ধ্বংসযজ্ঞ থামানোর চেষ্টা করেননি- এমনকি রোহিঙ্গারা যে অত্যাচারের শিকার তা-ও শিকার করেননি। তবে তার নিশ্চুপতার মধ্যে দিয়ে জেগে উঠেছেন আর এক নেত্রী- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ কোনো ধনী দেশ নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি এটি। প্রায় ১৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষের এই দেশটির আয়তন প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সমান। বাংলাদেশিরা রোহিঙ্গাদের সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে এই আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। তাদের অপ্রতুল সমপদ অন্য কোনো জাতীয়তার মানুষদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে- এই বিষয় রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের সহানুভূতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৫ই নভেম্বর শেখ হাসিনা আইনপ্রণেতাদের বলেন, বাংলাদেশ এক অতুলনীয় সংকটের সম্মুখীন। এই সমস্যার জন্য দায়ী মিয়ানমার। আর মিয়ানমারই এর সমাধান করবে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিবেনা এমন সম্ভাবনা রয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চায়। অন্যদিকে সুচি বলেছেন, তিনি আশা করেন খুব দ্রুতই ঢাকার সঙ্গে একটি স্মারকলিপিতে সম্মত হতে পারবেন- যে স্মারকলিপি অনুসারে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের যতদ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম শুরু করা যায়। তবে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা দুই সরকারের এমন সমঝোতা পছন্দ করছেন না। তাদের মতে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যেরকম সমঝোতায় পৌঁছেছিল আবারও তেমনটিই ঘটতে চলেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংগঠন এমন সমঝোতার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছে। এইবার নিয়ে চতুর্থবারের মতো বিশাল সংখ্যার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছে। তবে এর আগের কোন পলায়নই এত দ্রুত বা এত বিশাল আকারে ঘটেনি। বাংলাদেশে কুতুপালং শিবির নির্মিত হয় ১৯৭৮ সালে, সামপ্রতিক রোহিঙ্গা ঢলের মতো তৎকালীন সময়ে ঘটা এক ঢলে। এরপর ৯০ এর দশকে ওপর এক ঢলে আরো রোহিঙ্গা এসে জমা হয় সেখানে। ধীরে ধীরে বালুখালি, লেদা ও নয়াপয়াড়ার মতো শিবির স্থাপিত হয়। আগস্টে রাখাইনের সেনাবাহিনী ও পুলিশ ক্যামেপ হামলার পর থেকে অঞ্চলটিতে মানবাধিকার সহায়তা প্রায় পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আইসিআরসি হচ্ছে একমাত্র সংগঠন যেটির রাখাইনে প্রবেশাধিকার রয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা ধারণা করছেন সেখানে অচিরেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। এমনতি হলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আরো একটি ঢল নামতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার মুখে যা-ই বলুক না কেন, কর্মকর্তারা উপলব্ধি করেছেন যে, এই সংকট দ্রুত শেষ হচ্ছে না। বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, আমাদেরকে দীর্ঘ সময়ের জন্য (এই সংকট মোকাবিলা করতে) প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, আর যতদিনই লাগুক না কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
বড় ভাইয়ের কাছ থেকে গান গাইতে শিখেছিল সে। এক বৌদ্ধ দুর্বৃত্তের হাতে খুন হয় তার ভাই। তার পরিবার পালিয়ে বাংলাদেশে আসে। বর্তমানে একটি জীর্ণ শিবিরে তাদের বসবাস। এখানে তার কিছুই করার নেই, কোথাও যাওয়ার নেই। এইখানে তার গানই তার একমাত্র সান্ত্বনা।
আগস্টের ২৫ তারিখ যখন সামপ্রতিক রোহিঙ্গা সংকটের শুরু হয়, তখন কেউ আন্দাজ করতে পারেনি এর পরিণতি এত ভয়ঙ্কর আর এত বিশাল হবে। কয়েক সপ্তাহে বাস্তুচ্যুত হয়েছে লাখ লাখ মানুষ। যারা বেঁচে গেছেন তাদের সঙ্গে রয়ে গেছে নৃশংস, নির্মম স্মৃতি- প্রিয়জনদের হারানোর বেদনা। জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্র এই সহিংসতাকে জাতি নিধন বলে আখ্যায়িত করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি গণহত্যার সামিল। আন্তর্জাতিক নিয়মের অধীনে জাতি নিধন কোনো স্বতন্ত্র অপরাধ নয়, তবে এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের শামিল। অন্যদিকে গণহত্যার সংজ্ঞা সমপূর্ণ আলাদা- একদল মানুষকে তাদের জাতীয়তা, জাত, বর্ণ বা বিশ্বাসের কারণে ধ্বংস করে দেয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে চালানো হয় গণহত্যা। বিশ্বের সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ এটি। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি ন্যায় বিচারের কোনো ঘটনা নয়। এইখানে, বেঁচে থাকাটাই মূল বিষয়।
এখন পর্যন্ত রাখাইন থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬ লাখ ২০ হাজার ছাড়িয়েছে। রোউয়ান্ডা গণহত্যার পর এটাই সবচেয়ে বড় শরণার্থী মুভমেন্ট। ২৫শে আগস্ট রাতে রাখাইনের সেনাবাহিনী ও পুলিশ ক্যামেপ হামলা চালায় বিদ্রোহী দল আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা)। এরপর থেকেই সেখানে নিধনযজ্ঞ শুরু করে সামরিক বাহিনী। অনেকে সবকিছু ত্যাগ করে রাখাইন ছেড়েছে, সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে রেহাই পেতে। শিশুদের ঝুড়িতে ভরে, বৃদ্ধদের কাঁধে করে ও পশু পাখি সঙ্গে নিয়েও পালিয়েছে অনেকে। কখনো কয়েকদিন, কখনো কয়েক সপ্তাহ লেগেছে বাংলাদেশের সীমান্তে পৌঁছাতে। সেসব হেঁটে আসার রাস্তাগুলোতেও মরণফাঁদ হিসেবে সেনাবাহিনী পুঁতে রেখেছিল স্থলবোমা। কেউ কেউ সেসব ফাঁদে পড়ে প্রাণ হারিয়েছে। কাওকে সেনাবাহিনী পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছে। আবার কেউ নদীপথে আসতে গিয়ে পানিতে ডুবে মরেছে।
বাংলাদেশে এসেও তেমন সুখে নেই তারা। সংকটের শুরুর দিকে যারা এসেছে তাদের অনেককে দিন যাপন করতে হয়েছে, খোলা আকাশের নিচে- রোদ, বৃষ্টি সহ্য করে। আগে থেকেই নির্মিত দুই শিবিরের মাঝখানে থাকা বন কেটে তাদের জন্য জায়গা করে দেয়া হয়। জাতিসংঘ এই অবস্থাকে জরুরি মানবিক সংকট হিসেবে উল্লেখ করেছে। এখন রোহিঙ্গারা বাঁশ ও তারপুলিন দিয়ে তৈরি অস্থায়ী শিবিরে অবস্থান করছে। এসব শিবিরের অবস্থা প্রায় অবাসযোগ্য। এগুলোতে নেই, স্বাস্থ্যসম্মত ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা- নেই পর্যাপ্ত খাবার, পানি, চিকিৎসা। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আগমন থামছেই না। এভাবে চললে অচিরেই নতুন আগমনকারীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত জায়গার অভাব দেখা দেবে। এই বিশাল শিবিরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে এক পর্বত। সেখান থেকে যেদিকেই চোখ যায়- শুধু ছোট ছোট জীর্ণ কুটিরই নজরে পড়ে। এটা অনেকটা একটা শহরের মতো- কিন্তু এখানে পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। কিন্তু জনসংখ্যা প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসির সমান। আর এ জনসংখ্যার ৬০ ভাগই শিশু। ফরাসি এনজিও একশন এগেইন্সট হাঙ্গার (এসিএফ) এর সমপ্রতি করা এক জরিপে দেখা গেছে, এসব শিশুদের ৭.৫ শতাংশই ব্যাপক অপুষ্টিতে ভুগছে। অনাহারে থাকার ঝুঁকিতে রয়েছে প্রায় ৪০ হাজারের মতো শিশু। যাদের বয়স ৬ মাসের কম (সংখ্যায় বেশি) তাদের মৃত্যুর আশঙ্কা সবচেয়ে বেশি। বাকিরা রয়েছে ডায়রিয়া বা কলেরা বা হামের মতো রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে। অথবা বন্য হাতির আক্রমণেও প্রাণ হারানোর ঝুকিতো আছেই। চিকিৎসা সেবাদানিকারী বেসরকারি দাতব্য সংস্থা ডক্টরস উইদাউট বর্ডার্সের(এমএসএফ) জরুরি সমন্বয়ক রবার্ট অনুসের ভাষ্য মতে, এই অবস্থাকে মূলত জটিল সংকট বলা হয়। এটা সিরিয়ার মতো, মানসিক আঘাতের প্রতিক্রিয়া নয়। এটা কোন কলেরা মহামারীও নয়, যেখানে চিকিৎসকরা অসুস্থতা সারাতে কাজ করে। এটা কোন দুর্ভিক্ষও নয়। শুধু কোনো জাতিগত বা ধর্মগত বা রাজনৈতিক নিপীড়নও নয়। এটা সবকিছু, একসঙ্গে। তিনি বলেন, আপনি যদি একটি বিষয়ের প্রতি বেশি মনোযোগ দেন, তাহলে আপনাকে অন্য বিষয়গুলোতে কম মনোযোগ দিতে হবে- এটাই সবচেয়ে বেশি জটিল অংশ। প্রত্যেক দিনই কোন না কোন নতুন উদ্বেগ দেখা দেয়। এতগুলো শিশু না খেয়ে মারা যেতে পারে- এতগুলো মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল, এদের বিশেষ যত্নের দরকার আছে- কয়েকদিন পরেই কোনো ঝড় আঘাত হানবে ইত্যাদি। সবগুলোই আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ। জাতিসংঘ প্রধান এন্তোনিও গুতেরা এ বিষয়ে সতর্ক করে বলেছিলেন, বাংলাদেশ একটি মানবাধিকার দুঃস্বপ্ন মোকাবিলা করছে। কক্সবাজারে নিয়োজিত বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরুরি সমন্বয়ক মাইকেল ডানফোর্ড বলেন, আমরা এমন একতা সংকটের শুরুর দিকে আছি, যেটা সামপ্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বড় শরণার্থী সংকট হতে চলেছে। বাংলাদেশ সরকার হয়তো প্রথম দিকে তাদের আশ্রয় দেয়ার সময় বুঝতে পারেনি তারা কিসের সম্মুখীন হতে চলেছিল। তবে সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ যে তারা দিয়েছে।
রোহিঙ্গা পরিস্থিতি আঞ্চলিক দৃষ্টিকোণ থেকে গণতান্ত্রিক উন্নতির ধারণাটা তাৎপর্যপূর্ণভাবে পাল্টে দিয়েছে। মিয়ানমারের কার্যত নেত্রী হওয়ার আগে অং সান সুচি বহু বছর গৃহবন্দি হিসেবে জীবন কাটিয়েছেন। পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। এরপর ২০১৬ সালে তিনি মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর নির্বাচিত হন। তবে এই সংকট তার পেছনের সকল অর্জনকে মূল্যহীন করে তুলেছে। তার চোখের সামনে রোহিঙ্গাদের ঘর-বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হলেও, হত্যা করা হলেও তিনি এই ধ্বংসযজ্ঞ থামানোর চেষ্টা করেননি- এমনকি রোহিঙ্গারা যে অত্যাচারের শিকার তা-ও শিকার করেননি। তবে তার নিশ্চুপতার মধ্যে দিয়ে জেগে উঠেছেন আর এক নেত্রী- বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশ কোনো ধনী দেশ নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশগুলোর একটি এটি। প্রায় ১৬ কোটি ৩০ লাখ মানুষের এই দেশটির আয়তন প্রায় যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের সমান। বাংলাদেশিরা রোহিঙ্গাদের সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছে। তবে সময়ের সঙ্গে এই আচরণে পরিবর্তন আসতে পারে। তাদের অপ্রতুল সমপদ অন্য কোনো জাতীয়তার মানুষদের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে- এই বিষয় রোহিঙ্গাদের প্রতি তাদের সহানুভূতিতে পরিবর্তন আনতে পারে। দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৫ই নভেম্বর শেখ হাসিনা আইনপ্রণেতাদের বলেন, বাংলাদেশ এক অতুলনীয় সংকটের সম্মুখীন। এই সমস্যার জন্য দায়ী মিয়ানমার। আর মিয়ানমারই এর সমাধান করবে। বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিবেনা এমন সম্ভাবনা রয়েছে। তারা রোহিঙ্গাদের ১৮ থেকে ২৪ মাসের মধ্যে মিয়ানমারে ফেরত পাঠাতে চায়। অন্যদিকে সুচি বলেছেন, তিনি আশা করেন খুব দ্রুতই ঢাকার সঙ্গে একটি স্মারকলিপিতে সম্মত হতে পারবেন- যে স্মারকলিপি অনুসারে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের যতদ্রুত সম্ভব মিয়ানমারে ফিরিয়ে নেয়ার কার্যক্রম শুরু করা যায়। তবে মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা দুই সরকারের এমন সমঝোতা পছন্দ করছেন না। তাদের মতে, মিয়ানমার-বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে যেরকম সমঝোতায় পৌঁছেছিল আবারও তেমনটিই ঘটতে চলেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংগঠন এমন সমঝোতার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানিয়েছে। এইবার নিয়ে চতুর্থবারের মতো বিশাল সংখ্যার রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে পালিয়েছে। তবে এর আগের কোন পলায়নই এত দ্রুত বা এত বিশাল আকারে ঘটেনি। বাংলাদেশে কুতুপালং শিবির নির্মিত হয় ১৯৭৮ সালে, সামপ্রতিক রোহিঙ্গা ঢলের মতো তৎকালীন সময়ে ঘটা এক ঢলে। এরপর ৯০ এর দশকে ওপর এক ঢলে আরো রোহিঙ্গা এসে জমা হয় সেখানে। ধীরে ধীরে বালুখালি, লেদা ও নয়াপয়াড়ার মতো শিবির স্থাপিত হয়। আগস্টে রাখাইনের সেনাবাহিনী ও পুলিশ ক্যামেপ হামলার পর থেকে অঞ্চলটিতে মানবাধিকার সহায়তা প্রায় পুরোপুরিভাবে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। আইসিআরসি হচ্ছে একমাত্র সংগঠন যেটির রাখাইনে প্রবেশাধিকার রয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা ধারণা করছেন সেখানে অচিরেই দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। এমনতি হলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আরো একটি ঢল নামতে পারে।
বাংলাদেশ সরকার মুখে যা-ই বলুক না কেন, কর্মকর্তারা উপলব্ধি করেছেন যে, এই সংকট দ্রুত শেষ হচ্ছে না। বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিশনের যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম বলেন, আমাদেরকে দীর্ঘ সময়ের জন্য (এই সংকট মোকাবিলা করতে) প্রস্তুত থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, আর যতদিনই লাগুক না কেন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নৈতিক দায়িত্ববোধ থেকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানো উচিত।
No comments