নরেন্দ্র মোদির পাকিস্তান সফর ও ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক by বদরুদ্দীন উমর
মাউন্টব্যাটেন ও জওহরলাল নেহরু যৌথভাবে ১৯৪৭ সালে যে কাশ্মীর সমস্যা তৈরি করেছিলেন, তার জের ধরে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত কোনো স্বাভাবিক প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি। উপরন্তু প্রথম থেকেই ব্রিটিশ-ভারতে হিন্দু-মুসলমান দ্বন্দ্বের প্রেতাত্মার মতো ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষ লেগেই আছে। ব্রিটিশ শাসন যেভাবে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সামাজিক ও ধর্মীয় পার্থক্য এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যকে ব্যবহার করে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা ও পুষ্ট করেছিল সেই একইভাবে তারা নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসন গুটিয়ে নেয়ার সময় কথিত সমস্যা তৈরি করে নিজেদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করেছিল। আর এ চক্রান্তের অংশীদার ছিলেন ভারতের ‘পূজনীয়’ প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু। কাশ্মীর সমস্যা যে জওহরলাল নেহরুই তৈরি করেছিলেন এ নিয়ে সম্প্রতি ভারতের রাজনৈতিক মহলে নতুন করে তর্কবিতর্ক ও আলোচনার সূত্রপাত দেখা যাচ্ছে।
১৯৪৭ সালের পর থেকে কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের জনগণের মধ্যে, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রাখার যে শর্ত তৈরি হয়েছিল, সেই অনুযায়ী ব্রিটিশ আমলের সাম্প্রদায়িকতার ধারাবাহিকতা এ অঞ্চলে রক্ষিত হয়ে আসছে। কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে যেভাবে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পরিস্থিতি চলে আসছে তার থেকে মনে হয়, এ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অন্য কোনো সম্পর্কের গুরুত্ব নেই। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, পর্যটন, সংস্কৃতি এবং আঞ্চলিক স্বার্থ বিষয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলার কোনো প্রয়োজন ও মূল্য নেই! ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ সম্পর্ক প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে জায়মান থাকা ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের বড় রকম সাফল্য ছাড়া আর কী? শুধু ব্রিটিশ নয়, তাদের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের ফায়দা তারাও লুণ্ঠন করেছে। এ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন এখনও হয়নি।
লক্ষ করার বিষয়, যখনই এ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় তখনই এ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারত ও পাকিস্তানে নিজেদের এজেন্টদের মাধ্যমে দুই দেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটায় যাতে সে সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে দুই দেশই আবার শত্রুতায় পরস্পরের মুখোমুখি হয়। দুই দেশেই সাম্প্রদায়িকতা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে নিজেদের বিভিন্ন স্বার্থের তাগিদে সম্প্রীতি ও সমঝোতার প্রয়োজনে পরস্পরের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। দুই দেশের এ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের দ্বারা তাদের উভয়েরই ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয় না। এ ক্ষতির একটা বড় দিক হচ্ছে, পরস্পরকে মোকাবেলা করার জন্য সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে এতদিন পর্যন্ত জনগণ যেভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে আছেন, তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সামরিক খাতে এদের অবিশ্বাস্য পরিমাণ ব্যয়। এ ব্যয়ের একটা অংশও যদি তারা জনগণের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় করত তাহলে জনগণের দুর্দশা এত ব্যাপক ও গভীর হতো না।
লক্ষ্য করার বিষয়, মাউন্টব্যাটেন ও জওহরলাল নেহরু কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতার যে নতুন ভিত্তি তৈরি করেছিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতের কংগ্রেস সরকার তার ওপর দাঁড়িয়েই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতির চেষ্টা করেনি। পাকিস্তান সরকারও এ সম্পর্ক পরিবর্তনের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে সাম্প্রদায়িক নীতির ওপরই দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও কংগ্রেসের থেকেও বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের যে চেষ্টা করেছে, সেটা কংগ্রেস আমলে কোনো সরকারের সময়েই দেখা যায়নি। এর কারণ, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের যে প্রয়োজন আছে, বাণিজ্য, পর্যটন, অন্যান্য আঞ্চলিক স্বার্থ বিষয়ে সহযোগিতার যে প্রয়োজন আছে, তার তাগিদে নেহরুর সৃষ্ট ঐতিহ্যের বাইরে দাঁড়িয়ে বিজেপি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক পরিবর্তনের একটা চেষ্টা, যত দুর্বল প্রচেষ্টাই হোক না কেন, করেছে। বিজেপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী এ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। একদিকে বিজেপির আদর্শিক প্রভু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং অন্যদিকে পাকিস্তানের কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত সেখানকার সামরিক শাসকরা তার বিরোধিতা করেছিল। কীভাবে তা ঘটেছিল, সেটা ওয়াকিবহাল মহলে ভালোভাবেই জানা আছে।
বাজপেয়ীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চরম সাম্প্রদায়িক বিজেপি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন করে আবার ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের একটা চেষ্টা করছেন। তার এ চেষ্টা কোনো অসাম্প্রদায়িক চেতনা সৃষ্ট নয়। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের তাগিদের। এ তাগিদ একইভাবে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর একাংশের মধ্যে আছে একই কারণে। শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে নরেন্দ্র মোদিরও এই শিক্ষা হয়েছে যে, তিনি যতই সাম্প্রদায়িক হোন, সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ স্বার্থ এগিয়ে নেয়া এবং দুনিয়ায় ভারতের ভাবমূর্তির উন্নতি সম্ভব নয়। এ কারণে ক্ষমতায় বসার ঠিক পরই কাঠমান্ডুর সার্ক সম্মেলনে যে নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একবার করমর্দন ছাড়া কোনো বাক্যবিনিময় পর্যন্ত করেননি, তিনি বিদেশ সফরে গিয়ে কয়েকদিন আগে কাবুল থেকে দেশে ফেরার পথে আকস্মিকভাবে লাহোরে অবতরণ করে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন!
তার এ পাকিস্তান সফর নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক মহলে এখন হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু কংগ্রেস এর সমালোচনা করলেও ভারতের শাসক শ্রেণীর একটা প্রভাবশালী অংশ এবং সংবাদমাধ্যম এ সফরকে স্বাগত জানিয়েছে। যারা এর সপক্ষে, তাদের ধারণা এ সফরের ফলে দুই দেশের সম্পর্ক একটা ইতিবাচক মোড় নেবে এবং তাতে ভারত লাভবানই হবে। তাছাড়া যে কাশ্মীর সমস্যা দুই দেশের সম্পর্ক পর্যন্ত বিষাক্ত করে রেখেছে, সেই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের একটা পথও এই পরিবর্তনের মাধ্যমেই বের করা সম্ভব হবে।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদির এ চেষ্টা কতদূর অগ্রসর হবে এবং এর পরিণতি বাজপেয়ীর প্রচেষ্টার মতোই দাঁড়াবে কিনা, এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ নরেন্দ্র মোদিরও আদর্শিক প্রভু আরএসএস এখন অযোধ্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের জায়গার ওপর রাম মন্দির নির্মাণের কর্মসূচি কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সেখানে বিশাল আকারে পাথর জমা করতে শুরু করেছে। এ কাজ যে ভারতের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িকতা আরও চাঙ্গা করবে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানেও যে সাম্প্রদায়িকতা নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরোধিতা জোরদার করবে এ সম্ভাবনা ষোল আনা। এ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তাদের কথা হল- নরেন্দ্র মোদির উচিত কাজ হচ্ছে বিজেপির ওপর খবরদারি করনেওয়ালা আরএসএস নেতৃত্বের সঙ্গে এ নিয়ে কথাবার্তা বলা। কিন্তু আরএসএসই নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে তারা এক নির্ধারক শক্তি। কাজেই নরেন্দ্র মোদি যে অযোধ্যায় তাদের রাম মন্দির নির্মাণের কর্মসূচি স্থগিত বা বন্ধ করতে সক্ষম হবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
এ বিষয়কে কেন্দ্র করে নরেন্দ্র মোদি ও আরএসএসের সম্পর্ক যতই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ুক, শেষ পর্যন্ত আরএসএসে তাদের সংঘ পরিবারভুক্ত অন্যান্য সংগঠন- বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, শিবসেনা এবং হিন্দু করসেবকের দলকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে থাকা সত্ত্বেও যে নরেন্দ্র মোদির হবে না, এটা ধরে নেয়াই সঙ্গত। কাজেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতির পরিবর্তে এ যাত্রাতেও অবস্থা দাঁড়াবে যথা পূর্বং তথা পরং।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
১৯৪৭ সালের পর থেকে কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশের জনগণের মধ্যে, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা জিইয়ে রাখার যে শর্ত তৈরি হয়েছিল, সেই অনুযায়ী ব্রিটিশ আমলের সাম্প্রদায়িকতার ধারাবাহিকতা এ অঞ্চলে রক্ষিত হয়ে আসছে। কাশ্মীর সমস্যা নিয়ে যেভাবে দুই দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের পরিস্থিতি চলে আসছে তার থেকে মনে হয়, এ দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অন্য কোনো সম্পর্কের গুরুত্ব নেই। দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক, পর্যটন, সংস্কৃতি এবং আঞ্চলিক স্বার্থ বিষয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলার কোনো প্রয়োজন ও মূল্য নেই! ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ সম্পর্ক প্রথম থেকে আজ পর্যন্ত দীর্ঘদিন ধরে জায়মান থাকা ব্রিটিশ সরকারের সাম্রাজ্যবাদী কৌশলের বড় রকম সাফল্য ছাড়া আর কী? শুধু ব্রিটিশ নয়, তাদের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের ফায়দা তারাও লুণ্ঠন করেছে। এ পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন এখনও হয়নি।
লক্ষ করার বিষয়, যখনই এ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হয় তখনই এ সাম্রাজ্যবাদীরা ভারত ও পাকিস্তানে নিজেদের এজেন্টদের মাধ্যমে দুই দেশে এমন কিছু ঘটনা ঘটায় যাতে সে সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়ে দুই দেশই আবার শত্রুতায় পরস্পরের মুখোমুখি হয়। দুই দেশেই সাম্প্রদায়িকতা চাঙ্গা হয়ে ওঠে। এর ফলে দুই দেশের মধ্যে নিজেদের বিভিন্ন স্বার্থের তাগিদে সম্প্রীতি ও সমঝোতার প্রয়োজনে পরস্পরের কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা বিনষ্ট হয়। দুই দেশের এ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-সংঘর্ষের দ্বারা তাদের উভয়েরই ক্ষতি ছাড়া কোনো লাভ হয় না। এ ক্ষতির একটা বড় দিক হচ্ছে, পরস্পরকে মোকাবেলা করার জন্য সামরিক ব্যয় বৃদ্ধি। ভারত ও পাকিস্তানের মতো দেশে এতদিন পর্যন্ত জনগণ যেভাবে দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে আছেন, তার অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে সামরিক খাতে এদের অবিশ্বাস্য পরিমাণ ব্যয়। এ ব্যয়ের একটা অংশও যদি তারা জনগণের জন্য, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য ব্যয় করত তাহলে জনগণের দুর্দশা এত ব্যাপক ও গভীর হতো না।
লক্ষ্য করার বিষয়, মাউন্টব্যাটেন ও জওহরলাল নেহরু কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ায় সাম্প্রদায়িকতার যে নতুন ভিত্তি তৈরি করেছিলেন ১৯৪৭ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারতের কংগ্রেস সরকার তার ওপর দাঁড়িয়েই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতির চেষ্টা করেনি। পাকিস্তান সরকারও এ সম্পর্ক পরিবর্তনের জন্য কোনো কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ না করে সাম্প্রদায়িক নীতির ওপরই দাঁড়িয়ে থেকেছে। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে বিস্ময়কর হলেও কংগ্রেসের থেকেও বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের যে চেষ্টা করেছে, সেটা কংগ্রেস আমলে কোনো সরকারের সময়েই দেখা যায়নি। এর কারণ, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের যে প্রয়োজন আছে, বাণিজ্য, পর্যটন, অন্যান্য আঞ্চলিক স্বার্থ বিষয়ে সহযোগিতার যে প্রয়োজন আছে, তার তাগিদে নেহরুর সৃষ্ট ঐতিহ্যের বাইরে দাঁড়িয়ে বিজেপি দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক পরিবর্তনের একটা চেষ্টা, যত দুর্বল প্রচেষ্টাই হোক না কেন, করেছে। বিজেপির প্রথম প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী এ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার চেষ্টা সফল হয়নি। একদিকে বিজেপির আদর্শিক প্রভু রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং অন্যদিকে পাকিস্তানের কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত সেখানকার সামরিক শাসকরা তার বিরোধিতা করেছিল। কীভাবে তা ঘটেছিল, সেটা ওয়াকিবহাল মহলে ভালোভাবেই জানা আছে।
বাজপেয়ীর পদাঙ্ক অনুসরণ করে চরম সাম্প্রদায়িক বিজেপি নেতা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নতুন করে আবার ভারত ও পাকিস্তানের পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়নের একটা চেষ্টা করছেন। তার এ চেষ্টা কোনো অসাম্প্রদায়িক চেতনা সৃষ্ট নয়। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থে দুই দেশের সম্পর্ক উন্নয়নের তাগিদের। এ তাগিদ একইভাবে পাকিস্তানের শাসক শ্রেণীর একাংশের মধ্যে আছে একই কারণে। শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থেকে নরেন্দ্র মোদিরও এই শিক্ষা হয়েছে যে, তিনি যতই সাম্প্রদায়িক হোন, সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে ভারতের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ স্বার্থ এগিয়ে নেয়া এবং দুনিয়ায় ভারতের ভাবমূর্তির উন্নতি সম্ভব নয়। এ কারণে ক্ষমতায় বসার ঠিক পরই কাঠমান্ডুর সার্ক সম্মেলনে যে নরেন্দ্র মোদি পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একবার করমর্দন ছাড়া কোনো বাক্যবিনিময় পর্যন্ত করেননি, তিনি বিদেশ সফরে গিয়ে কয়েকদিন আগে কাবুল থেকে দেশে ফেরার পথে আকস্মিকভাবে লাহোরে অবতরণ করে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের বাড়িতে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন!
তার এ পাকিস্তান সফর নিয়ে ভারতের রাজনৈতিক মহলে এখন হৈ চৈ হচ্ছে। কিন্তু কংগ্রেস এর সমালোচনা করলেও ভারতের শাসক শ্রেণীর একটা প্রভাবশালী অংশ এবং সংবাদমাধ্যম এ সফরকে স্বাগত জানিয়েছে। যারা এর সপক্ষে, তাদের ধারণা এ সফরের ফলে দুই দেশের সম্পর্ক একটা ইতিবাচক মোড় নেবে এবং তাতে ভারত লাভবানই হবে। তাছাড়া যে কাশ্মীর সমস্যা দুই দেশের সম্পর্ক পর্যন্ত বিষাক্ত করে রেখেছে, সেই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানের একটা পথও এই পরিবর্তনের মাধ্যমেই বের করা সম্ভব হবে।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদির এ চেষ্টা কতদূর অগ্রসর হবে এবং এর পরিণতি বাজপেয়ীর প্রচেষ্টার মতোই দাঁড়াবে কিনা, এ নিয়ে ইতিমধ্যেই সংশয় দেখা দিয়েছে। কারণ নরেন্দ্র মোদিরও আদর্শিক প্রভু আরএসএস এখন অযোধ্যায় ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের জায়গার ওপর রাম মন্দির নির্মাণের কর্মসূচি কার্যকর করার উদ্দেশ্যে সেখানে বিশাল আকারে পাথর জমা করতে শুরু করেছে। এ কাজ যে ভারতের অভ্যন্তরে সাম্প্রদায়িকতা আরও চাঙ্গা করবে এবং এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানেও যে সাম্প্রদায়িকতা নতুনভাবে মাথাচাড়া দিয়ে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিরোধিতা জোরদার করবে এ সম্ভাবনা ষোল আনা। এ নিয়ে ভারতের বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তাদের কথা হল- নরেন্দ্র মোদির উচিত কাজ হচ্ছে বিজেপির ওপর খবরদারি করনেওয়ালা আরএসএস নেতৃত্বের সঙ্গে এ নিয়ে কথাবার্তা বলা। কিন্তু আরএসএসই নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক লাইন নির্ধারণ করে। এ ক্ষেত্রে তারা এক নির্ধারক শক্তি। কাজেই নরেন্দ্র মোদি যে অযোধ্যায় তাদের রাম মন্দির নির্মাণের কর্মসূচি স্থগিত বা বন্ধ করতে সক্ষম হবেন, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই।
এ বিষয়কে কেন্দ্র করে নরেন্দ্র মোদি ও আরএসএসের সম্পর্ক যতই টানাপোড়েনের মধ্যে পড়ুক, শেষ পর্যন্ত আরএসএসে তাদের সংঘ পরিবারভুক্ত অন্যান্য সংগঠন- বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, শিবসেনা এবং হিন্দু করসেবকের দলকে ঠেকিয়ে রাখার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর গদিতে বসে থাকা সত্ত্বেও যে নরেন্দ্র মোদির হবে না, এটা ধরে নেয়াই সঙ্গত। কাজেই ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের উন্নতির পরিবর্তে এ যাত্রাতেও অবস্থা দাঁড়াবে যথা পূর্বং তথা পরং।
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments