মায়ের লাশ মর্গে দুই সন্তান খুঁজছে আশ্রয় by শর্মী চক্রবর্তী
আমার আম্মু কোথায়? আম্মু আসছে না কেন?
আমাকে আম্মুর কাছে নিয়ে যাও। আমার আম্মু-আব্বুকে কে নিয়ে গেল? আমি তাদের
সঙ্গে বেড়াতে যাবো। এভাবেই ভাঙা ভাঙা গলায় কথাগুলো বলে চার বছরের শিশু মীম।
পাশে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ছোট বোন দু’বছরের আলিফ। তাদের নিষ্পাপ চোখ
খুঁজে বেড়াচ্ছে বাবা-মাকে। অথচ তারা জানে না তাদের বাবা-মা কেউ বেঁচে নেই।
আর কখনও মায়ের হাতে খেতে পারবে না। বাবার সঙ্গে বেড়াতে পারবে না। তাদের
ধারণা, বাবা-মা একদিন ফিরে আসবে। মা-বাবা হারানো এই দুই শিশু এখন তেজগাঁয়ের
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। তাদের মায়ের নিথর দেহ এখনও পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল
কলেজ হাসপাতালের হিমঘরে। কেউ জানে না শিশু দু’টির ভবিষ্যৎ। কোথায় জায়গা
হবে তাদের। একমাস আগে সড়ক দুর্ঘটনায় পিতাকে হারিয়েছে তারা। আর দু’দিন আগে
দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মা নাজমাও চলে গেছেন না ফেরার দেশে।
তেজগাঁয় ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, শিশু দু’টি খেলা করছে।
তাদের পাশে বসা পুলিশ কর্মকর্তা রেহানা। খেলায় মত্ত ছোট্ট দুই শিশু।
দুপুরের খাবার নিয়ে আসা হলো। তখনই মীম মা মা বলে ডাকতে শুরু করলো। ভাঙা
ভাঙা শব্দে পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করলো, মা কোথায়? মায়ের হাতে ভাত খাবো।
পাশে বসে থাকা আলিফেরও একই প্রশ্ন। পুলিশ কর্মকর্তা সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,
তোমাদের মা ডাক্তার দেখাতে গেছে একটু পরেই চলে আসবে। এখন তোমরা খেয়ে নাও।
কর্মকর্তার সান্ত্বনায় খাবার খেয়ে আবারও খেলায় মেতে ওঠে তারা। এদিকে তাদের
দত্তক নিতে অনেকে যোগাযোগও করেছেন ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে। তবে তারা
কাউকেই স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে সন্তানহীন এক
পিতা মীমকে দত্তক নেয়ার জন্য আবেদন করেছেন। শিশুটিকে দেখতে চাইলে পুলিশ
কর্মকর্তা মীমকে তাদের সামনে নিয়ে আসেন। তার নাম জিজ্ঞেস করলে ভাঙা গলায়
উত্তর দেয় ‘আমার নাম মীম।’ তিনি মীমের কাছে জানতে চাইলেন, তুমি যাবে আমাদের
সঙ্গে? সঙ্গে সঙ্গে মীম বলে ওঠে না। আমি আমার মা-বাবার সঙ্গে থাকবো। মীম
এখনও অপেক্ষায় আছে তার মা ডাক্তার দেখানোর পর তাদের নিতে আসবে। এ বিষয়ে
ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের সিনিয়র সহ-পুলিশ কমিশনার আসমা বেগম রিটা বলেন,
আলিফ ও মীম সম্পর্কে জানার পর অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন শিশু
দু’টিকে দত্তক নেয়ার জন্য। এক্ষেত্রে দত্তক যারা নিতে চান তাদের আবেদন
করতে হবে আদালতে। আদালত তদন্ত করে সিদ্ধান্ত নেবেন কাদের কাছে তাদেরকে দেয়া
যায়। তবে সমস্যা হচ্ছে শিশু দু’টি এখনও বাবা-মায়ের অপেক্ষায় আছে। তাদের
কাছেই ফিরে যেতে চাইছে। ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের কর্মকর্তারা যত্নসহকারে
তাদের রাখার চেষ্টা করছেন বলেও তিনি জানান। তিনি আরও বলেন, শিশু দু’টি ঢাকা
মেডিকেলের বেডে শুয়ে থাকা মায়ের কথা বারবার বলছে। তারা এখনও মনে করছে
তাদের মা ডাক্তার দেখাতে গেছে আর বাবা বাইরে কাজে গেছে। গত ২রা জুলাই পেটের
ব্যথা সহ্য করতে না পেরে মা নাজমা বেগম ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালে। ১০৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউনিট-৫ এ চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সেই
ওয়ার্ডে থাকা অন্য এক রোগীর স্বজন মোর্শেদা জানান, দু’সন্তান নিয়ে গুরুতর
অবস্থায় তিনি ভর্তি হয়েছিলেন। তিনি বলেন মাসখানেক আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা
যান নাজমার স্বামী। তাদের গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুরে। বিস্তারিত কিছুই বলতে
পারেননি তিনি। গত ৪ঠা আগস্ট ভোরে মারা যান নাজমা। তিনি মারা যাওয়ার পর
আত্মীয়স্বজন কেউ খোঁজ নেয়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ
হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। স্বজন না আসায় লাশটি মর্গেই রয়েছে। হাসপাতাল
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে যদি কেউ লাশ নিতে না আসে তাহলে লাশটি আঞ্জুমানে মফিদুল
ইসলামে দিয়ে দেয়া হবে। শিশু দু’টির কোন স্বজন না পাওয়ায় কর্তৃপক্ষ শাহাবাগ
থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করে। পরে শিশু দু’টিকে পুলিশ হেফাজতে ভিকটিম
সাপোর্ট সেন্টারে নেয়া হয়।
No comments