রক্তাক্ত বলকানে শান্তির সন্ধানে by মোশাররফ হোসেন ভূঞা
যুদ্ধবিধ্বস্ত বলকান রাজ্যে জাতিসংঘ
শান্তি বাহিনীতে আমার অংশগ্রহণ ছিল সিভিলিয়ান পুলিশ মনিটর হিসেবে। সময়
১৯৯২-৯৩ সাল। তখন সার্ব ও ক্রোয়াটদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে সাবেক
যুগোশ্লাভিয়া ভেঙে নতুন রাষ্ট্র হিসেবে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীনতা অর্জন করেছে।
তদুপরি ক্রোয়েশিয়ার সার্ব অধ্যুষিত কয়েকটি অঞ্চলে জাতিগত দ্বন্দ্বের সূত্র
ধরে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান ছিল। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। সার্ব ও ক্রোয়াটদের
মধ্যকার জাতিগত দ্বন্দ্বের ইতিহাস বেশ পুরনো হলেও দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে যুগোস্লাভিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট মার্শাল যোশেফ ব্রোশ
টিটু জাতে ক্রোয়াট হওয়ার কারণে সার্বদের প্রতি ক্রোয়াটদের ক্ষোভের প্রকাশ
কিছুটা অবধমিত ছিল। মার্শাল টিটুর মৃত্যুর পর অর্থ ও সম্পদের অসম বণ্টন,
সামরিক বিভাগে সার্বদের একচ্ছত্র আধিপত্য ইত্যাদি পুরনো ক্ষতের যন্ত্রণা
পুনরায় মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে ১৯৯১ সালের গোড়ার দিকে সার্ব ও ক্রোয়াটদের মধ্যে
রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের সূচনা হয়। এ সংঘর্ষের লক্ষ্য ছিল জাতীয় জীবনের প্রায়
সব ক্ষেত্রে সার্বদের অনভিপ্রেত ও অশুভ নিয়ন্ত্রণমুক্ত হয়ে স্বাধীন ও
সার্বভৌম ক্রোয়েশিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। আমার অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, সার্ব ও ক্রোয়াটদের দীর্ঘদিনের জাতিগত দ্বন্দ্ব অনেকটা বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বার্থ সুরক্ষায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক চরম বৈষম্যমূলক আচরণের মতো। যতটা জানা যায়, সার্ব ও ক্রোয়াটদের জাতিগত দ্বন্দ্বের সূত্রপাতের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রোয়াটদের তুলনায় সার্বদের প্রাধিকার প্রদান। ক্রোয়াটরা দাবি করে, আড্রিয়াটিক সাগর পাড়ে অবস্থিত প্রকৃতির অপরূপ লীলাময় সাগর সৈকত হতে পর্যটন খাতে প্রতিবছর যে আয় হয় তা জাতীয় আয়ের ৮০ শতাংশ। এ আয় থেকে ক্রোয়েশিয়া প্রাদেশিক সরকারের হাতে ২০ শতাংশ রেখে বাকি সমূদয় অর্থ চলে যেত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আবার সেই অর্থের বিশাল অংশ ব্যয় হতো সামরিক খাতে। যেহেতু সামরিক বাহিনীতে সার্ব সদস্যরা ৮০ শতাংশ স্থান দখল করে আছে, তাই ওই ধরনের অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থা ক্রোয়াটদের প্রচণ্ডভাবে যন্ত্রণা দিয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে। মাঝখানে মার্শাল টিটুর শাসনকাল পর্যন্ত সময়টুকুতে তাদের সান্ত্বনা ও প্রাপ্তি ছিল তাদের প্রেসিডেন্ট ক্রোয়াট বংশোদ্ভূত- এতটুকুই। মার্শাল টিটুর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রে সার্বদের পুনরায় নিরঙ্কুশ প্রাধান্য সূচিত হলে পুরনো ক্ষতের যন্ত্রণা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। আমার অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, সার্ব ও ক্রোয়াটদের দীর্ঘদিনের জাতিগত দ্বন্দ্ব অনেকটা বাঙালিদের ওপর পশ্চিম পাকিস্তানিদের স্বার্থ সুরক্ষায় তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক চরম বৈষম্যমূলক আচরণের মতো। যতটা জানা যায়, সার্ব ও ক্রোয়াটদের জাতিগত দ্বন্দ্বের সূত্রপাতের প্রধান কারণ অর্থনৈতিক বৈষম্য ও সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্রোয়াটদের তুলনায় সার্বদের প্রাধিকার প্রদান। ক্রোয়াটরা দাবি করে, আড্রিয়াটিক সাগর পাড়ে অবস্থিত প্রকৃতির অপরূপ লীলাময় সাগর সৈকত হতে পর্যটন খাতে প্রতিবছর যে আয় হয় তা জাতীয় আয়ের ৮০ শতাংশ। এ আয় থেকে ক্রোয়েশিয়া প্রাদেশিক সরকারের হাতে ২০ শতাংশ রেখে বাকি সমূদয় অর্থ চলে যেত কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণে। আবার সেই অর্থের বিশাল অংশ ব্যয় হতো সামরিক খাতে। যেহেতু সামরিক বাহিনীতে সার্ব সদস্যরা ৮০ শতাংশ স্থান দখল করে আছে, তাই ওই ধরনের অর্থনৈতিক বণ্টন ব্যবস্থা ক্রোয়াটদের প্রচণ্ডভাবে যন্ত্রণা দিয়ে আসছিল যুগ যুগ ধরে। মাঝখানে মার্শাল টিটুর শাসনকাল পর্যন্ত সময়টুকুতে তাদের সান্ত্বনা ও প্রাপ্তি ছিল তাদের প্রেসিডেন্ট ক্রোয়াট বংশোদ্ভূত- এতটুকুই। মার্শাল টিটুর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় শাসনযন্ত্রে সার্বদের পুনরায় নিরঙ্কুশ প্রাধান্য সূচিত হলে পুরনো ক্ষতের যন্ত্রণা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সূচনা করে।
সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় ক্রোয়েশিয়া ব্যতিরেকে অন্যান্য প্রদেশ যেমন স্লোভেনিয়া, বসনিয়া ও হার্জেগোভেনিয়া, মন্টিনিগ্রো ও মেসেডোনিয়া ইত্যাদি জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে সার্বদের প্রতি নানাবিধ কারণে ক্ষোভ বিরাজমান থাকলেও সার্ব তথা সার্বিয়ানদের ধারাবাহিক খবরদারি প্রতিহত করার মতো শক্তি বা সার্বদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মতো শক্তি ও সামর্থ্য কোনোটাই তাদের ছিল না। তদুপরি সার্ব ও ক্রোয়াটরা যখন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত, যুগোস্লাভিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় প্রদেশ স্লোভেনিয়া অনায়াসে স্বাধীনতা ঘোষণাক্রমে বলতে গেলে বিনা রক্তপাতে তা অর্জন করে নেয়। তখন সেনাবাহিনীর ক্রোয়াট সদস্য ও জনতা মিলে সার্বদের বিরুদ্ধে অর্থাৎ সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। একপর্যায়ে ক্রোয়াটরা যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ক্রোয়েশিয়া প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হলে বসনিয়া ও হার্জেগোভেনিয়াও স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ফলে সার্ব বা সরকারি বাহিনী রক্তক্ষয়ী আক্রমণ করে দুর্বল বসনিয়া ও হার্জেগোভেনিয়ার জনসাধারণের ওপর নির্বিচারে হত্যা, জ্বালাও-পোড়াওসহ নারীদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে সে অঞ্চলকে এক ধ্বংসপুরীতে রূপান্তরিত করে। উল্লেখ্য, বসনিয়া ও হার্জেগোভেনিয়ার অধিকাংশ জনগণ মুসলিম হওয়ার কারণে সেনাবাহিনীতে তাদের অংশগ্রহণের অধিকার ছিল খুবই সীমিত। তা ছাড়া সে অঞ্চলের জনগণের একটা বিরাট অংশ ছিল যাযাবর জাতি। যে কারণে যুদ্ধের শুরুতে সে অঞ্চলের জনগণের মৃত্যু ও পলায়নকে মেনে নেয়া ছাড়া উপায় ছিল না। পরবর্তীতে তারা মাথা উঁচু করে আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তি ও সাহস অর্জন করে এবং এক সময় তারাও স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হয়।
কেনিনে আমার অবস্থানকালে গোটা বসনিয়া ও হার্জেগোভেনিয়ায় সার্বদের সঙ্গে মুসলমানদের প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছিল। কেনিনে আমরা যে বাড়িতে থাকতাম, তাদের রেডিওযোগে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদে প্রতিনিয়তই ওখানকার ঘটে যাওয়া ঘটনার বিবরণ আমরা জানতে পারতাম। এদিকে ক্রোয়েশিয়া স্বাধীনতা অর্জন করলেও এর অভ্যন্তরে কেনিন, টুপোস্কো ও ব্যালিমানাস্তিসহ চারটি সার্ব অধ্যুষিক্ত অঞ্চল ক্রোয়াটদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রয়ে যায়। ক্রোয়েশিয়া থেকে সার্বরা অর্থাৎ সার্বিয়ান বাহিনী পশ্চাৎ গমনকালে বর্ণিত সার্ব অধ্যুষিত অঞ্চলে তারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও যুদ্ধসামগ্রী রেখে যায়। এসব অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান হয়ে বর্ণিত চারটি অঞ্চলের সার্বরা ‘সার্বস্কা ক্রাইনা’ নামে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে, যা পরবর্তী বছরের অর্থাৎ ১৯৯৩ সালের জানুয়ারির মধ্যে ক্রোয়াট বাহিনী অনায়াসে দখল করে ক্রোয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। যুদ্ধকালীন ওই সব স্থানে মানব ঢাল হিসেবে ব্যবহৃত জাতিসংঘ বাহিনীকে অস্থায়ীভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়।
ওই সময় পর্যন্ত সার্ব অধ্যুষিত এলাকা কেনিনস্থ সেক্টর সাউথ এ চার মাস পুলিশ লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে কর্ম সম্পাদন করি। আমার দায়িত্ব ছিল রেডক্রস সোসাইটি এবং জাতিসংঘ উদ্বাস্তু কমিশনের সঙ্গে সম্মিলিতভাবে দুই অঞ্চলের বন্দিবিনিময় কাজে সহযোগিতা করা। বন্দিবিনিময় কাজটি মূলত আমাদের মধ্যস্থতায় দুই দেশের সরকারি পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সম্পন্ন করা হতো। তবে বন্দিদের তালিকা ও নির্ধারিত ফরমে বন্দির আত্মীয়স্বজনের পক্ষ থেকে প্রাপ্ত আবেদনপত্র আমার তত্ত্বাবধানে প্রেরণ করা হতো। দ্বিপক্ষীয় আলোচনার সিদ্ধান্ত মোতাবেক বন্দিবিনিময়ের দিন আমাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বন্দির একজন আত্মীয় বর্ডার এলাকায় যেতে পারতেন। বিষয়টি খুবই আবেগাশ্র“ত থাকায় বন্দিদের আত্মীয়স্বজন তাকে গ্রহণের উদ্দেশ্যে হাতে করে শোভনীয় ফুলের তোড়া নিয়ে উপস্থিত হতো। অনেক সময় দেখা যেত ১০-১২ জন আত্মীয় বন্দিকে গ্রহণ করার জন্য আমাদের সঙ্গে সমসংখ্যক আত্মীয়স্বজন যেত। সে ক্ষেত্রে প্রায় সময়ই হঠাৎ করে উড়ে আসা রাজনৈতিক অনাকাক্সিক্ষত অশুভ সিদ্ধান্তের পালাবদলের কারণে বন্দি বিনিময় কম হতো। এমন কি কখনো কখনো দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হঠাৎ করে ভেস্তে যাওয়ার কারণে বন্দিবিনিময় স্থগিত করা হয়ে যেত। তখন আত্মীয়স্বজনের কান্না, বিলাপ, আহাজারী এবং বুকে ও কপালে হাত চাপড়ানো ইত্যাদি হৃদয়বিদারক দৃশ্য দেখে চোখের জল সম্বরণ করতে পারতাম না। আবার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বন্দির আত্মীয়স্বজনরা অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যেত। কোনো কোনো সময়ে সে রকম পরিস্থিতিতে যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কার উদ্ভব হলে তাদেরকে অজ্ঞান অবস্থাতেই গাড়িতে করে নিয়ে এসে বাড়িতে পৌঁছে দিতাম। গাড়িতে তুলে চোখে-মুখে ঠাণ্ডা পানির ছিটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনার কাজটি আমিই করতাম। আমার এ চিকিৎসা পদ্ধটির কারণে আমি সেখানে কিছুটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলাম। খুব মনে পড়ে দ্রাগা নামের এক সপ্তাদশী ওই সংঘর্ষকালে বাবা-মা ও একমাত্র ভাইকে হারিয়ে সে একদম একা হয়ে যায়। তার প্রেমিক ক্রোয়েশিয়ার রাজধানী জাগরেভে তখন অধ্যয়নরত ছিল। ওই মেয়েটির প্রেমিককে ফিরিয়ে আনার জন্য আমি চারবার আবেদনপত্র প্রেরণ করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে চারবারই গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া গেলেও প্রতিবারই দ্রাগাকে অজ্ঞান অবস্থায় নিয়ে আসতে হয়েছিল।
দ্রাগাদের বাড়ি কেনিন শহরের উত্তর-পূর্ব সন্নিকটে ভারপলি গ্রামে। গ্রামটি ক্রোয়াট অধ্যুষিত। যতটুকু মনে পড়ে গোটা বিশেক সার্ব পরিবারের বসতি সেখানে ছিল। প্রথমদিকে ওদের মধ্যে নির্ভরশীল সহাবস্থান থাকলেও ’৯১ সালের শেষের দিকে ক্রোয়েশিয়ার বন্দর নগরী স্পিট থেকে গোরান অবোটাসহ ৬-৭ জন যুবক কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে ভারপলি আসতে সক্ষম হয়। ওরা প্রত্যেকেই স্বজনহারা। দুঃখজনক ঘটনা ছিল গোরান অবোটার দুই বোনকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় সে প্রায় উন্মাদ হয়ে যায়। তারা ফিরে এসে গ্রামের ও এলাকার লোকজনদের ওসব বলে ক্ষেপিয়ে তুললে ওই গ্রামের সার্ব ও ক্রোয়াটদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষ চলাকালে গ্রামের প্রায় সবাই আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। ফলে অনেক প্রাণহানি সংঘটিত হয়। যেহেতু গ্রামটি বিশাল এবং ক্রোয়াট অধ্যুষিত, তাই ক্রোয়াটদের কাছে তারা পরাজিত হয়ে গ্রাম ত্যাগ করে। ফলে গ্রামের প্রত্যেকটি সার্ব পরিবারের বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। সেই ধ্বংসযজ্ঞে দ্রাগার বাবা ও ছোট ভাইকে হত্যা করা হয় এবং তার মাকে অপহরণ করে কোথায় নিয়ে যায় তার সন্ধান তারা কোনো দিন পায়নি। তারা অনুমান করছে হয়তো তাকে ধর্ষণ করে লাশ গুম করে ফেলা হয়েছে।
দ্রাগাদের বাড়িটি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। সে তখন বাড়িতে ছিল না বলে প্রাণে বেঁচে গেছে। সেখানে তার মাতৃপক্ষীয় কেউ না থাকায় ওই ঘটনার পর সে আর বাড়ি ফেরেনি। দ্রাগা প্রথমে গির্জায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেখানে এক রাত কাটিয়ে চলে যায় তার বয়ফ্রেন্ড ইভানস্কোভিসের বাবা-মার কাছে। দ্রাগার কাছে শুনেছি, তার মা তুর্কি বংশোদ্ভূত অনন্য সাধারণ এক সুন্দরী রমণী। তার মা-বাবা বেলগ্রেডে একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে চাকরি করতেন। সেখান থেকে তার মাকে নিয়ে তার বাবা পালিয়ে কেনিন এসে বিয়ে করে। বিয়ের সময় তার মায়ের বয়স ছিল ১৮ বছর। তিনি ছিলেন অত্যন্ত সুন্দরী। তার ছিল ঘন কালো লম্বা চুল। তার মাকে প্রথম কেউ দেখলে ২০ বছরের বেশি বয়স হয়েছে মনেই করতে পারবে না। দ্রাগা তার মায়ের চেহারা, টিয়া পাখির ঠোঁটের মতো বাঁকা নাক, দুধে আলতা রঙের শরীর ও ঘন কালো চুল পুরোটাই পেয়েছে। তার ভাই ঈগরের চেহারা ও শারীরিক গড়ন তার বাবার মতো। তাদের কথা দ্রাগা প্রায়ই বলত আর অজোর ধারায় চোখের জল ফেলত। আমি নিজে থেকে প্রথম একবার ছাড়া কেনিন অবস্থানকালীন পরবর্তী চার মাসে ওর বাবা-মার প্রসঙ্গে কোনো কথা বলিনি। ক্রোয়েশিয়ার ভেতরের সার্ব অধ্যুষিত অঞ্চলগুলো ক্রোয়েশিয়ার দখলে চলে যাওয়ার পর দ্রাগা ও ইভানস্কোভিসের মিলন দুরাশায় পরিণত হয়। কেনিন থেকে জাগরেভ আসার বিভিন্ন সময়ে দ্রাগা আমাকে জেলখানায় খোঁজখবর নিয়ে ইভানস্কোভিসের সন্ধান করতে বলত। কিন্তু কাজটা খুবই দুরূহ এবং সন্দেহজনক ছিল বলে আমি চেষ্টা করিনি। কিন্তু পরবর্তীতে জাগরেভে বদলি হয়ে আসার পর ইভানস্কোভিসের সন্ধান আমি পেয়েছিলাম। কিন্তু ছবিতে যে ইভানস্কোভিসকে আমি দেখেছিলাম তার সঙ্গে বন্দি ইভানস্কোভিসের তফাৎ ছিল আকাশ-পাতাল। দ্রাগার প্রসঙ্গ তুললে তার চোখ বেয়ে অজোর ধারায় পানি বেয়ে পড়তে দেখেছিলাম। সে কোনো কথা বলতে পারেনি। শুধু জানিয়েছিলাম তার বাবা-মার সঙ্গে দ্রাগা অবস্থান করছে। তারপর ইচ্ছা করে দ্রুত চলে আসি। এ ব্যাপারে দ্রাগাকে কোনো কিছু জানাতে বা যোগাযোগের কোনো চেষ্টা আমি করিনি।
এত বছর পর দ্রাগার পরিপূর্ণ অবয়ব আমার পরিষ্কার মনে নেই। লেখার প্রয়োজনে স্মৃতির পাথর খুঁড়ে খুঁড়ে টুকরো টুকরো কথা বের করার চেষ্টা করছি। সত্যি কথা বলতে কি, চেহারা, গায়ের বর্ণ ও শারীরিক দর্শনীয় শৈলী মিলিয়ে দ্রাগার মতো মেয়ে দ্বিতীয়টি আমার চোখে পড়েনি। দ্রাগা নামটি ওদের কোনো পৌরাণিক চরিত্রের রূপকার্থক কিনা জানা নেই। তবে তার নামের অর্থের চেয়েও সে বেশি অপরূপ ও মোহনীয়। সে যখন কাঁদত, মনে হতো তার কান্নার সময়, নিজে কেঁদে তাকে সমবেদনা জানাতে পারলে হয়তো যথার্থ হতো।
No comments