এরপর কী হতে পারে by আবদুল লতিফ মণ্ডল
বিএনপি
নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট আগামী ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দশম জাতীয় সংসদ
নির্বাচন বর্জন করায় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট প্রার্থীরা
সরাসরি নির্বাচনের জন্য নির্ধারিত সংসদের মোট ৩০০ আসনের অর্ধেকের বেশি আসনে
অর্থাৎ ১৫৪টি আসনে ইতিমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নজিরবিহীনভাবে জয়লাভ
করেছে। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার
বক্তব্য হল- ‘নির্বাচনে বিরোধী দল আসেনি। আমরা জানতাম, তারা আসবে। তাই আমরা
আসন ভাগাভাগি করে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছি। বিরোধী দল নির্বাচনে থাকলে
এমনটা হতো না। বিরোধী দল নির্বাচনে এলো না কেন? এটা তো আমাদের দোষ নয়।
মাঠে গোলরক্ষক না থাকলে তো গোল হবেই।’ তবে প্রধানমন্ত্রীর এ বক্তব্যের
সমালোচনা হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, ‘সমঝোতার মাধ্যমে যে সংসদ তৈরি হচ্ছে,
সেখানে যাকে খুশি ভোট দেয়ার অধিকার কীভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে?’ তাছাড়া
প্রধান বিরোধী দল বিএনপি ও দেশের সব উল্লেখযোগ্য বিরোধী দল এ নির্বাচন
বর্জন করায় অবশিষ্ট ১৪৬ আসনে ভোটাররা বঞ্চিত হচ্ছেন তাদের পছন্দের
প্রার্থীকে ভোট দিতে। অবশিষ্ট এসব আসনের ফলাফল সহজেই অনুমেয়। ধরে নেয়া যায়,
আওয়ামী লীগ এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনেই শুধু বিজয়ী হবে না, এককভাবে
দুই-তৃতীয়াংশ আসনও পাবে। সংসদ গঠিত হবে আওয়ামী লীগ ও তার শরিকদের
প্রতিনিধিদের নিয়ে।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইতিমধ্যে ‘একতরফা’, ‘পাতানো’, ‘ভোটারবিহীন’ প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত হয়েছে। এ নির্বাচন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা হয়েছে; প্রকাশিত হয়েছে উদ্বেগ। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও মিডিয়া দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও আইন-শৃংখলা নিয়ে উৎকণ্ঠিত। তাদের অনেকে মনে করেন, ‘ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন রাজনৈতিক সংকটকে আরও দীর্ঘায়িত করবে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে পুরোপুরি অন্ধকারে ঠেলে দেবে।’ আবার কারও কারও মতে, ‘দেশ এক অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করেছে। এই অনিশ্চিত যাত্রায় রক্তপাত অনিবার্য।’
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করা হয়েছে বলে ১৭ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা। একতরফা নির্বাচন বাতিলের দাবিও জানিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশীদের জীবন রক্ষার্থে জাতিসংঘের এখনই কিছু করা উচিত বলে ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিবকে এক খোলা চিঠিতে আহ্বান জানিয়েছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন।
বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির টেলিফোন এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর উদ্যোগের পরও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোনো উন্নতি না হওয়ায় সিনেট কমিটির বৈঠকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দি ইকোনমিস্টের অনলাইন সংস্করণের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা জিতলেও হারবে দেশ। ২২ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক প্রভাবশালী দৈনিক দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান বিরোধী দলসহ বেশির ভাগ দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে সরকার পক্ষ। বাকিগুলো জেতার পুরো সম্ভাবনাই তাদের পক্ষে। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার ‘অজনপ্রিয় সরকার’ ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু এ জয়ের কোনো বৈধতা নেই।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিস্থিতি না থাকায় ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ ও যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া চীন, জাপান ও কানাডাসহ অনেক দেশ চিঠি না দিলেও কোনো ধরনের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কথা মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়।
গত ১৯ ডিসেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চলছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও আলোচনা চলবে। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে প্রয়োজনে আবার নির্বাচন দেয়া হবে। তবে এর আগে বিএনপিকে অবশ্যই হরতাল-অবরোধ, মানুষ হত্যা বন্ধ এবং জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অনেক পূর্বশর্ত, যদিও প্রয়োজনের উল্লেখ থেকে স্পষ্টই বলে দেয়া যায়, এটা চলমান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনগণকে বিভ্রান্ত এবং ভোটারবিহীন ভোটরঙ্গ মনোনীত সংসদ ও সরকারকে স্থায়ী করার এক অপচেষ্টা মাত্র। তাদের এই পাতানো ফাঁদে জনগণ পা দেবে না’ (যুগান্তর, ২২ ডিসেম্বর)। প্রধানমন্ত্রী দশম সংসদ নির্বাচনের পর সংলাপের যে কথা বলেছেন তা নাকচ করে দিয়ে তিনি আরও বলেছেন, একাদশ কিংবা পরবর্তী কোনো সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনার অবকাশ কিংবা আগ্রহ বিএনপির কোনোদিন ছিল না, এখনও নেই।
আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর কঠোর অবস্থানে যাওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছে ক্ষমতাসীন জোট। এমনকি ৫ জানুয়ারির পর জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ না ছাড়লে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে মর্মে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের কোনো কোনো নেতা ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে হুমকি দিয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘সিলেকশন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ‘এ নির্বাচন প্রতিহত করতে ভোটকেন্দ্রিক সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি জেলা ও উপজেলায় সবাইকে নিয়ে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা কমিটি’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি অবশ্য ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের তফসিল বাতিল করে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অর্থবহ নির্বাচনের দাবিতে এবং ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে ‘না’ বলতে, গণতন্ত্রকে ‘হ্যাঁ’ বলতে তিনি আগামী ২৯ ডিসেম্বর রোববার সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে যাত্রার ডাক দিয়েছেন। এ অভিযাত্রার নাম দেয়া হয়েছে ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’, গণতন্ত্রের অভিযাত্রা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এরপর কী হতে পারে?
নির্বাচন যেভাবে হচ্ছে তাতে এ নির্বাচন নিয়ে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। এ ছাড়া, অবশিষ্ট ১৪৬টি আসনের অনেক আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপরীতে মনোনয়ন জমাদানকারী বেশকিছু প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার চেষ্টা করেও সফল হননি বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রার্থীর কোনো রকম নির্বাচনী কার্যক্রম নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সংখ্যা যাতে আর বেড়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন দলের এ কারসাজি। ভোটারের সংখ্যা যত কমই হোক, তাতে নির্বাচনের ফল প্রকাশ আটকাবে না। কাজেই বিএনপির নির্বাচন ‘প্রতিহত’ করার কর্মসূচি সফল হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পর শর্ত সাপেক্ষে দশম সংসদ ভেঙে দেয়ার ইঙ্গিত দিলেও কাজটি তার পক্ষে সহজ হবে না। নির্বাচিত এমপিদের প্রবল চাপ থাকবে সংসদ ভেঙে না দেয়ার জন্য। তাছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হওয়ায় কিছু ভালো কাজ করার উদ্যোগ নিয়ে আস্থা ফিরে পেতে সচেষ্ট হবে নতুন সরকার।
তবে একতরফা নির্বাচন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব মাহমুদ হাসানের মতে, একতরফা নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, যার ফল হতে পারে- এক. নির্বাচনের ফলাফল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। দুই. কমনওয়েলথ বাংলাদেশের সদস্যপদ স্থগিত করতে পারে। উল্লেখ্য, ২০০২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কারচুপি, সহিংসতা ও মানবাধিকার লংঘনের জন্য সংস্থাটি জিম্বাবুয়ের সদস্যপদ স্থগিত করেছিল।
তিন. নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে দায়ী করতে পারে। ২০০৭ সালের নির্বাচনে মানবাধিকার লংঘনের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কেনিয়ার নেতাদের অভিযুক্ত করেছিল। চার. যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও আরও অনেকে বাংলাদেশে আর্থিক ও বাণিজ্যিক সুবিধাদি স্থগিত করতে পারে। এরূপ কিছু ঘটলে তা বাংলাদেশের জন্য চরম সংকট সৃষ্টি করবে।
তাই এখনও সময় আছে, সরকার ও বিরোধী দল আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিক। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দেয়া প্রতিশ্র“তি মোতাবেক নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদের নির্দেশনার আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিয়ে দেশকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারেন। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন যা প্রয়োজন তা হল অবিলম্বে সংসদ ভেঙে দেয়া। এটা করা হলে পুনঃতফসিলিকরণের বাধা দূর হবে এবং ২০১৪ সালের মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় পাওয়া যাবে। বিরোধী জোটের অংশগ্রহণ ছাড়া এবং সংসদের অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না, যা সরকারি দলেরও অনেকে স্বীকার করেন। অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত এ সত্যটি অকপটে স্বীকার করেছেন। গত ২২ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ‘ভোটার ছাড়া এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ পঞ্চাশ শতাংশের বেশি আসনে গ্রার্থী নির্বাচন হয়ে গেছে। বড় দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এটা কোনো নির্বাচনই নয়।’
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইতিমধ্যে ‘একতরফা’, ‘পাতানো’, ‘ভোটারবিহীন’ প্রভৃতি বিশেষণে ভূষিত হয়েছে। এ নির্বাচন নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মহলে সমালোচনা হয়েছে; প্রকাশিত হয়েছে উদ্বেগ। রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও মিডিয়া দেশের গণতন্ত্র, অর্থনীতি ও আইন-শৃংখলা নিয়ে উৎকণ্ঠিত। তাদের অনেকে মনে করেন, ‘ভোটারবিহীন একতরফা নির্বাচন রাজনৈতিক সংকটকে আরও দীর্ঘায়িত করবে। দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎকে পুরোপুরি অন্ধকারে ঠেলে দেবে।’ আবার কারও কারও মতে, ‘দেশ এক অনিশ্চিত পথে যাত্রা শুরু করেছে। এই অনিশ্চিত যাত্রায় রক্তপাত অনিবার্য।’
বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ১৫৪ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভোটাধিকার খর্ব করা হয়েছে বলে ১৭ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে মন্তব্য করেছে বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা। একতরফা নির্বাচন বাতিলের দাবিও জানিয়েছে সংস্থাটি। বাংলাদেশীদের জীবন রক্ষার্থে জাতিসংঘের এখনই কিছু করা উচিত বলে ১৮ ডিসেম্বর জাতিসংঘের মহাসচিবকে এক খোলা চিঠিতে আহ্বান জানিয়েছে এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন।
বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রবিষয়ক সিনেট কমিটি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরির টেলিফোন এবং জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর উদ্যোগের পরও দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির দৃশ্যমান কোনো উন্নতি না হওয়ায় সিনেট কমিটির বৈঠকে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে।
গত ১৯ ডিসেম্বর প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা দি ইকোনমিস্টের অনলাইন সংস্করণের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ৫ জানুয়ারির সাধারণ নির্বাচনে ক্ষমতাসীনরা জিতলেও হারবে দেশ। ২২ ডিসেম্বর অস্ট্রেলিয়াভিত্তিক প্রভাবশালী দৈনিক দ্য সিডনি মর্নিং হেরাল্ডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান বিরোধী দলসহ বেশির ভাগ দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪ আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতেছে সরকার পক্ষ। বাকিগুলো জেতার পুরো সম্ভাবনাই তাদের পক্ষে। এর মাধ্যমে শেখ হাসিনার ‘অজনপ্রিয় সরকার’ ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু এ জয়ের কোনো বৈধতা নেই।
পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পরিস্থিতি না থাকায় ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে জানিয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কমনওয়েলথ ও যুক্তরাষ্ট্র। এ ছাড়া চীন, জাপান ও কানাডাসহ অনেক দেশ চিঠি না দিলেও কোনো ধরনের পর্যবেক্ষক না পাঠানোর কথা মৌখিকভাবে জানিয়ে দিয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়।
গত ১৯ ডিসেম্বর গণভবনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির বৈঠকের সূচনা বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আলোচনা চলছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও আলোচনা চলবে। আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতা হলে দশম সংসদ ভেঙে প্রয়োজনে আবার নির্বাচন দেয়া হবে। তবে এর আগে বিএনপিকে অবশ্যই হরতাল-অবরোধ, মানুষ হত্যা বন্ধ এবং জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অনেক পূর্বশর্ত, যদিও প্রয়োজনের উল্লেখ থেকে স্পষ্টই বলে দেয়া যায়, এটা চলমান আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জনগণকে বিভ্রান্ত এবং ভোটারবিহীন ভোটরঙ্গ মনোনীত সংসদ ও সরকারকে স্থায়ী করার এক অপচেষ্টা মাত্র। তাদের এই পাতানো ফাঁদে জনগণ পা দেবে না’ (যুগান্তর, ২২ ডিসেম্বর)। প্রধানমন্ত্রী দশম সংসদ নির্বাচনের পর সংলাপের যে কথা বলেছেন তা নাকচ করে দিয়ে তিনি আরও বলেছেন, একাদশ কিংবা পরবর্তী কোনো সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনার অবকাশ কিংবা আগ্রহ বিএনপির কোনোদিন ছিল না, এখনও নেই।
আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর কঠোর অবস্থানে যাওয়ার হুশিয়ারি দিয়েছে ক্ষমতাসীন জোট। এমনকি ৫ জানুয়ারির পর জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গ না ছাড়লে বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হবে মর্মে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় জোটের কোনো কোনো নেতা ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক অনুষ্ঠানে হুমকি দিয়েছেন বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে।
এদিকে ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীতে এক সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে ‘সিলেকশন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে ‘এ নির্বাচন প্রতিহত করতে ভোটকেন্দ্রিক সংগ্রাম কমিটির পাশাপাশি জেলা ও উপজেলায় সবাইকে নিয়ে সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র রক্ষা কমিটি’ গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি অবশ্য ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের তফসিল বাতিল করে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের জন্য সরকারকে আহ্বান জানিয়েছেন। নির্দলীয় সরকারের অধীনে অর্থবহ নির্বাচনের দাবিতে এবং ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনকে ‘না’ বলতে, গণতন্ত্রকে ‘হ্যাঁ’ বলতে তিনি আগামী ২৯ ডিসেম্বর রোববার সারা দেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে যাত্রার ডাক দিয়েছেন। এ অভিযাত্রার নাম দেয়া হয়েছে ‘মার্চ ফর ডেমোক্র্যাসি’, গণতন্ত্রের অভিযাত্রা।
প্রশ্ন উঠতে পারে, এরপর কী হতে পারে?
নির্বাচন যেভাবে হচ্ছে তাতে এ নির্বাচন নিয়ে জনগণের কোনো আগ্রহ নেই। এ ছাড়া, অবশিষ্ট ১৪৬টি আসনের অনেক আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর বিপরীতে মনোনয়ন জমাদানকারী বেশকিছু প্রার্থী মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করার চেষ্টা করেও সফল হননি বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এসব প্রার্থীর কোনো রকম নির্বাচনী কার্যক্রম নেই। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিতদের সংখ্যা যাতে আর বেড়ে না যায়, তা নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন দলের এ কারসাজি। ভোটারের সংখ্যা যত কমই হোক, তাতে নির্বাচনের ফল প্রকাশ আটকাবে না। কাজেই বিএনপির নির্বাচন ‘প্রতিহত’ করার কর্মসূচি সফল হওয়ার সুযোগ ও সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের পর শর্ত সাপেক্ষে দশম সংসদ ভেঙে দেয়ার ইঙ্গিত দিলেও কাজটি তার পক্ষে সহজ হবে না। নির্বাচিত এমপিদের প্রবল চাপ থাকবে সংসদ ভেঙে না দেয়ার জন্য। তাছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হওয়ায় কিছু ভালো কাজ করার উদ্যোগ নিয়ে আস্থা ফিরে পেতে সচেষ্ট হবে নতুন সরকার।
তবে একতরফা নির্বাচন থেকে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বাংলাদেশ। সাবেক রাষ্ট্রদূত ও সচিব মাহমুদ হাসানের মতে, একতরফা নির্বাচন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে, যার ফল হতে পারে- এক. নির্বাচনের ফলাফল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। দুই. কমনওয়েলথ বাংলাদেশের সদস্যপদ স্থগিত করতে পারে। উল্লেখ্য, ২০০২ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কারচুপি, সহিংসতা ও মানবাধিকার লংঘনের জন্য সংস্থাটি জিম্বাবুয়ের সদস্যপদ স্থগিত করেছিল।
তিন. নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সহিংসতায় নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির জন্য মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশকে দায়ী করতে পারে। ২০০৭ সালের নির্বাচনে মানবাধিকার লংঘনের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত কেনিয়ার নেতাদের অভিযুক্ত করেছিল। চার. যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়াও আরও অনেকে বাংলাদেশে আর্থিক ও বাণিজ্যিক সুবিধাদি স্থগিত করতে পারে। এরূপ কিছু ঘটলে তা বাংলাদেশের জন্য চরম সংকট সৃষ্টি করবে।
তাই এখনও সময় আছে, সরকার ও বিরোধী দল আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছে দশম সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিক। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় সংসদে দেয়া প্রতিশ্র“তি মোতাবেক নির্বাচনের আগে সংসদ ভেঙে দিয়ে সংবিধানের ১২৩(৩) অনুচ্ছেদের নির্দেশনার আলোকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা নিয়ে দেশকে সংকট থেকে রক্ষা করতে পারেন। এ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী মেয়াদ অবসান ব্যতীত অন্য কোনো কারণে সংসদ ভেঙে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়ার পরবর্তী নব্বই দিনের মধ্যে সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এখন যা প্রয়োজন তা হল অবিলম্বে সংসদ ভেঙে দেয়া। এটা করা হলে পুনঃতফসিলিকরণের বাধা দূর হবে এবং ২০১৪ সালের মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময় পাওয়া যাবে। বিরোধী জোটের অংশগ্রহণ ছাড়া এবং সংসদের অর্ধেকের বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য হবে না, যা সরকারি দলেরও অনেকে স্বীকার করেন। অর্থমন্ত্রী এএমএ মুহিত এ সত্যটি অকপটে স্বীকার করেছেন। গত ২২ ডিসেম্বর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ‘ভোটার ছাড়া এ নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না। কারণ পঞ্চাশ শতাংশের বেশি আসনে গ্রার্থী নির্বাচন হয়ে গেছে। বড় দলগুলো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না। এটা কোনো নির্বাচনই নয়।’
আবদুল লতিফ মণ্ডল : সাবেক সচিব, কলাম লেখক
No comments