সিরিয়া সংকট থেকে নতুন স্নায়ুযুদ্ধ? by আসীফ রশীদ
সিরিয়ায়
সম্ভাব্য মার্কিন হামলাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া বিরোধ
স্নায়ুযুদ্ধোত্তর বিশ্বে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে- এমন আশংকা উড়িয়ে
দেয়া যায় না। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে সিরিয়ায় সামরিক হামলার অনুমোদন
সংক্রান্ত যে কোনো প্রস্তাবে ভেটো প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাশিয়া। এ
ভেটো যুক্তরাষ্ট্রকে সিরিয়ায় হামলা থেকে বিরত রাখবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে
ওয়াশিংটন। বস্তুত, সিরিয়া সংকট রাশিয়ার সঙ্গে ওবামার শাসনামলে
যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ককে সবচেয়ে খারাপ পর্যায় নিয়ে গেছে। দুই পরাশক্তির এ
বৈরী সম্পর্ক দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলবে বলে মনে করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতি
স্নায়ুযুদ্ধকালীন সোভিয়েত-মার্কিন বিরোধের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন বিশ্বে
শক্তির ভারসাম্য ছিল দ্বিমেরুকেন্দ্রিক। ১৯৪৭ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত সময়ে
সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন পূর্ব এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিম ব্লকের মধ্যে যে
রাজনৈতিক ও সামরিক উত্তেজনা বিরাজমান ছিল, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেটাই
স্নায়ুযুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৯১ সালে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর সে পরিস্থিতি
পাল্টে গেলেও যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা এবং আরও
পরমাণু অস্ত্র হ্রাসকরণে অনীহার ব্যাপারে রাশিয়া এখনও অসন্তুষ্ট। বর্তমানে
মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য ফাঁসকারী এডওয়ার্ড স্নোডেনকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে
হস্তান্তরে মস্কোর অস্বীকৃতি দুই পরাশক্তির সম্পর্ককে আরও শীতল করেছে। এ
ঘটনাকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র মস্কোর ওপর এতই ক্ষুব্ধ যে, এ মাসে
রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনের আগে মার্কিন
প্রেসিডেন্ট ওবামা রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন না বলে
জানিয়ে দিয়েছেন। আর যুক্তরাষ্ট্র সিরিয়ায় হামলা করতে চাওয়ায় রাশিয়া ওবামাকে
‘নতুন বুশ’ নামে অভিহিত করেছে। এসব কিছু রুশ-মার্কিন সম্পর্কের অবনতিই
নির্দেশ করে। অনেকে তো সিরিয়াকে কেন্দ্র করে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধেরই আশংকা
করছেন।
রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত সিরিয়ায় মার্কিন হামলার ব্যাপারে রাশিয়ার বিরোধিতার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সিরিয়া সরকারের প্রতি মস্কোর সমর্থনের অর্থ অবশ্যই এই নয় যে, রুশরা অমানবিক অথবা বাশার সরকারের প্রতি মোহাচ্ছন্ন। তবে পশ্চিমা বিশ্বের কথিত উদ্দেশ্যের ব্যাপারে রুশদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। পশ্চিমারা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে যে ওকালতি করে থাকে, রাশিয়া তাকে ভণ্ডামিপূর্ণ এবং বিশৃংখলা সৃষ্টির পাঁয়তারা বলে মনে করে। পশ্চিমাদের ভণ্ড মনে করার কারণ, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সমস্যা হলে তারা তাদের কথিত গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্য ‘স্থগিত’ রাখতেও দ্বিধান্বিত হয় না। মিসরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই তার প্রমাণ। আর বিশৃংখলা সৃষ্টির পাঁয়তারা মনে করার কারণ, পশ্চিমারা স্থিতিশীল সরকারগুলোকে অস্থিতিশীল করে কেবলই নতুন নতুন দানবের আবির্ভাব ঘটায়। যেমন- আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার পর সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে সেখানে আল কায়দার উত্থান ঘটিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার ককেশীয় অঞ্চলেও মৌলবাদীদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পেছনে পশ্চিমের ইন্ধন ছিল। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার দুই বন্ধুভাবাপন্ন সরকার- ইরাকের সাদ্দাম ও লিবিয়ার গাদ্দাফি সরকারকে উৎখাত করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। সিরিয়ার বন্ধুভাবাপন্ন সরকারের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটুক, স্বভাবতই রাশিয়া তা চায় না। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার একমাত্র নৌঘাঁটিটি সিরিয়ায় অবস্থিত। সিরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের দখলে চলে গেলে এটি নিশ্চিতভাবেই হুমকির সম্মুখীন হবে। যুক্তরাষ্ট্র যতই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে বাশার সরকারকে শাস্তি দিতে ‘সীমিত যুদ্ধ’ এবং ‘সরকার পরিবর্তনের ইচ্ছা না থাকা’র কথা বলুক, বাস্তবতা হল, পশ্চিমারা একবার সিরিয়ায় সামরিক হামলা চালালে দেশটিতে তাদের হস্তক্ষেপ আরও গভীরে প্রবিষ্ট হবে। সিরিয়ার পরিস্থিতি তখন ইরাক ও লিবিয়ার চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। রুশ বিরোধিতার আরেকটি বড় কারণ, গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যাপারে পশ্চিমা হস্তক্ষেপকে রাশিয়া নিজ সরকারের প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখে থাকে। যেমনটা দেখে থাকে সিরিয়া হামলার অপর বিরোধিতাকারী চীন।
তবে ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, সিরিয়ায় হামলা হওয়ার পর রাশিয়া যদি নীরবও থাকে তাতেও মস্কোরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সিরিয়ায় স্থল হামলা চালানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। হামলা হবে প্রথমত যুদ্ধবিমান থেকে। ইরান ও হেজবুল্লাহর সহায়তায় সিরিয়া সরকার মার্কিন বিমান হামলার জবাব দিতে থাকলে পাইলটদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে। আর পাইলটদের প্রাণহানি ঘটলে পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। সবচেয়ে সম্ভাব্য পন্থা হল ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ। এতে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সন্দেহ নেই। তবে রাশিয়া ও ইরান যে-কোনো ক্ষতি থেকে উত্তরণে সিরিয়াকে সহায়তা করতে পারবে। ফলে বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বৈরিতার অবসান ঘটাবে না। অর্থাৎ এ হামলা সিরিয়ায় কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম হবে না।
অন্যদিকে নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে সমর্থন বাশার আল আসাদের সরকারই পাবে, অন্তত উন্নয়নশীল বিশ্ব এবং নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার কাছ থেকে। সিরিয়ায় হামলার বিরুদ্ধে প্রচারণার ধরন ১০ বছর আগের ইরাক হামলার মতোই হবে। যুক্তরাষ্ট্র এ আগ্রাসনের জন্য বৈশ্বিক উৎপীড়ক হিসেবে চিত্রিত হবে। ইরান হবে উল্লসিত। আর সিরিয়ার অসংখ্য মানুষ পশ্চিমের নতুন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গড়ে তুলবে প্রতিরোধ।
এ পরিস্থিতিতে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। পশ্চিমা শক্তি যত বেশি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে, সে পরিস্থিতি একটি ‘বৈধ কর্তৃপক্ষ আক্রান্ত’ বিবেচনায় বাশার সরকারকে সহায়তা করতে রাশিয়ার জন্য তত বেশি সুবিধা এনে দেবে। যেহেতু স্থল অভিযানের সম্ভাবনা নেই, সেহেতু ঘটনার শেষে হয়তো দেখা যাবে, বাশারের সরকারই কেবল টিকে যায়নি- পশ্চিমা শক্তি, তুরস্ক ও আরব লীগের বিরুদ্ধে এ বৈশ্বিক সংঘাতে জয়ী হয়েছে রাশিয়া ও ইরান।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বোঝাতে চাইছেন, শাস্তিমূলক হামলার উদ্দেশ্য সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তন নয়, কিংবা বাশারের সঙ্গে সরকারবিরোধীদের বোঝাপড়ার একটা সুযোগ করে দেয়াও নয়। তারা বলছেন, ‘আমরা শুধু একনায়ককে শাস্তি দিতে চাই এবং তাকে একটি বার্তা দিতে চাই : আর কখনও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা যেন তারা চিন্তাও না করে।’ ধরে নেয়া গেল, বাশার আর কখনও এসব অস্ত্র ব্যবহার করবেন না। কিন্তু এর মানে কি এ যুদ্ধে তার পরাজিত হওয়া?
কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন, সিরিয়ায় পশ্চিমা হুমকি বা হামলার পর বাশার আল আসাদ ছাড় দেয়ার ব্যাপারে নমনীয় হবেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, তিনি একটি শান্তি সম্মেলনের বিষয়ে রাজি হবেন এবং সরকারবিরোধীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে তাদের সঙ্গে আলোচনা করার কর্তৃত্ব দেবেন। তবে সেক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত যে বিদ্রোহীরা, বিশেষ করে যারা আল কায়দার সঙ্গে যুক্ত, তারা কখনও এ আয়োজন মেনে নেবে না।
অনেকে জোর দিয়ে বলে আসছেন, সিরিয়া সমস্যার একমাত্র সমাধান হল বাশারকে নমনীয় পথে আনা। হতে পারে সেটা ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি করানোর জন্য ভাদিমির পুতিনকে চাপ দেয়া। তবে খুব কম লোকই বিশ্বাস করে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এ ধরনের কিছু করবেন এবং বাশার আল আসাদ তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করে সিরিয়া ছেড়ে চলে যাবেন। বরং যখন তিনি দেখবেন ইরান ও হেজবুল্লাহর কল্যাণে ভাগ্যের চাকা তার অনুকূলে, তখন তিনি আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। আসলে তিনি যথেষ্ট শক্ত অবস্থানেই রয়েছেন এবং এখন তাকে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে।
অন্যদিকে পুতিনের আপসহীনতা দেখে মনে হয়- শেষ পর্যন্ত বাশারের সরকার যদি ভেঙেও পড়ে, তাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পরাজিত হিসেবে বিবেচিত হবেন না, অন্তত নিজ দেশের জনগণের কাছে, যা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুতিন যদি কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা আপস করেন, তাতেই বরং তাকে পরাজিত মনে হবে। কারণ তখন এর ব্যাখ্যায় বলা হবে, তিনি মার্কিন চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছেন। এটা রুশ জনগণের কাছে হবে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। সিরিয়ায় মার্কিন হামলা হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হবে না। তবে তা বিশ্ব ব্যবস্থায় স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হবে স্বয়ং হামলাকারীরই। মার্কিন খবরদারি থেকে বিশ্ব কিছুটা হলেও রেহাই পাবে তখন।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে অভিযুক্ত সিরিয়ায় মার্কিন হামলার ব্যাপারে রাশিয়ার বিরোধিতার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে। সিরিয়া সরকারের প্রতি মস্কোর সমর্থনের অর্থ অবশ্যই এই নয় যে, রুশরা অমানবিক অথবা বাশার সরকারের প্রতি মোহাচ্ছন্ন। তবে পশ্চিমা বিশ্বের কথিত উদ্দেশ্যের ব্যাপারে রুশদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে। পশ্চিমারা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ব্যাপারে যে ওকালতি করে থাকে, রাশিয়া তাকে ভণ্ডামিপূর্ণ এবং বিশৃংখলা সৃষ্টির পাঁয়তারা বলে মনে করে। পশ্চিমাদের ভণ্ড মনে করার কারণ, নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে সমস্যা হলে তারা তাদের কথিত গণতান্ত্রিক উদ্দেশ্য ‘স্থগিত’ রাখতেও দ্বিধান্বিত হয় না। মিসরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলিই তার প্রমাণ। আর বিশৃংখলা সৃষ্টির পাঁয়তারা মনে করার কারণ, পশ্চিমারা স্থিতিশীল সরকারগুলোকে অস্থিতিশীল করে কেবলই নতুন নতুন দানবের আবির্ভাব ঘটায়। যেমন- আফগানিস্তান, ইরাক ও লিবিয়ার পর সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে সেখানে আল কায়দার উত্থান ঘটিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। রাশিয়ার ককেশীয় অঞ্চলেও মৌলবাদীদের মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার পেছনে পশ্চিমের ইন্ধন ছিল। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার দুই বন্ধুভাবাপন্ন সরকার- ইরাকের সাদ্দাম ও লিবিয়ার গাদ্দাফি সরকারকে উৎখাত করেছে পশ্চিমা বিশ্ব। সিরিয়ার বন্ধুভাবাপন্ন সরকারের ক্ষেত্রেও তেমনটি ঘটুক, স্বভাবতই রাশিয়া তা চায় না। মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার একমাত্র নৌঘাঁটিটি সিরিয়ায় অবস্থিত। সিরিয়া যুক্তরাষ্ট্রের দখলে চলে গেলে এটি নিশ্চিতভাবেই হুমকির সম্মুখীন হবে। যুক্তরাষ্ট্র যতই রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের অভিযোগে বাশার সরকারকে শাস্তি দিতে ‘সীমিত যুদ্ধ’ এবং ‘সরকার পরিবর্তনের ইচ্ছা না থাকা’র কথা বলুক, বাস্তবতা হল, পশ্চিমারা একবার সিরিয়ায় সামরিক হামলা চালালে দেশটিতে তাদের হস্তক্ষেপ আরও গভীরে প্রবিষ্ট হবে। সিরিয়ার পরিস্থিতি তখন ইরাক ও লিবিয়ার চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে না। রুশ বিরোধিতার আরেকটি বড় কারণ, গণতান্ত্রিক অধিকারের ব্যাপারে পশ্চিমা হস্তক্ষেপকে রাশিয়া নিজ সরকারের প্রতি সরাসরি হুমকি হিসেবে দেখে থাকে। যেমনটা দেখে থাকে সিরিয়া হামলার অপর বিরোধিতাকারী চীন।
তবে ঘটনা যা-ই ঘটুক না কেন, সিরিয়ায় হামলা হওয়ার পর রাশিয়া যদি নীরবও থাকে তাতেও মস্কোরই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ এ যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। সিরিয়ায় স্থল হামলা চালানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। হামলা হবে প্রথমত যুদ্ধবিমান থেকে। ইরান ও হেজবুল্লাহর সহায়তায় সিরিয়া সরকার মার্কিন বিমান হামলার জবাব দিতে থাকলে পাইলটদের জীবন ঝুঁকির মুখে পড়বে। আর পাইলটদের প্রাণহানি ঘটলে পশ্চিমা বিশ্বের মানুষের কাছে এটা গ্রহণযোগ্য হবে না। সবচেয়ে সম্ভাব্য পন্থা হল ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ। এতে সিরিয়ার বাশার আল আসাদের সরকার ক্ষতির সম্মুখীন হবে, সন্দেহ নেই। তবে রাশিয়া ও ইরান যে-কোনো ক্ষতি থেকে উত্তরণে সিরিয়াকে সহায়তা করতে পারবে। ফলে বাশার আল আসাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বৈরিতার অবসান ঘটাবে না। অর্থাৎ এ হামলা সিরিয়ায় কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসতে সক্ষম হবে না।
অন্যদিকে নৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে সমর্থন বাশার আল আসাদের সরকারই পাবে, অন্তত উন্নয়নশীল বিশ্ব এবং নিশ্চিতভাবেই রাশিয়ার কাছ থেকে। সিরিয়ায় হামলার বিরুদ্ধে প্রচারণার ধরন ১০ বছর আগের ইরাক হামলার মতোই হবে। যুক্তরাষ্ট্র এ আগ্রাসনের জন্য বৈশ্বিক উৎপীড়ক হিসেবে চিত্রিত হবে। ইরান হবে উল্লসিত। আর সিরিয়ার অসংখ্য মানুষ পশ্চিমের নতুন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গড়ে তুলবে প্রতিরোধ।
এ পরিস্থিতিতে বেশি লাভবান হবে রাশিয়া। পশ্চিমা শক্তি যত বেশি এ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে, সে পরিস্থিতি একটি ‘বৈধ কর্তৃপক্ষ আক্রান্ত’ বিবেচনায় বাশার সরকারকে সহায়তা করতে রাশিয়ার জন্য তত বেশি সুবিধা এনে দেবে। যেহেতু স্থল অভিযানের সম্ভাবনা নেই, সেহেতু ঘটনার শেষে হয়তো দেখা যাবে, বাশারের সরকারই কেবল টিকে যায়নি- পশ্চিমা শক্তি, তুরস্ক ও আরব লীগের বিরুদ্ধে এ বৈশ্বিক সংঘাতে জয়ী হয়েছে রাশিয়া ও ইরান।
পশ্চিমা কর্মকর্তারা বোঝাতে চাইছেন, শাস্তিমূলক হামলার উদ্দেশ্য সিরিয়ায় সরকার পরিবর্তন নয়, কিংবা বাশারের সঙ্গে সরকারবিরোধীদের বোঝাপড়ার একটা সুযোগ করে দেয়াও নয়। তারা বলছেন, ‘আমরা শুধু একনায়ককে শাস্তি দিতে চাই এবং তাকে একটি বার্তা দিতে চাই : আর কখনও রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা যেন তারা চিন্তাও না করে।’ ধরে নেয়া গেল, বাশার আর কখনও এসব অস্ত্র ব্যবহার করবেন না। কিন্তু এর মানে কি এ যুদ্ধে তার পরাজিত হওয়া?
কোনো কোনো পর্যবেক্ষক মনে করেন, সিরিয়ায় পশ্চিমা হুমকি বা হামলার পর বাশার আল আসাদ ছাড় দেয়ার ব্যাপারে নমনীয় হবেন। এ দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী, তিনি একটি শান্তি সম্মেলনের বিষয়ে রাজি হবেন এবং সরকারবিরোধীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে তাদের সঙ্গে আলোচনা করার কর্তৃত্ব দেবেন। তবে সেক্ষেত্রে এটা নিশ্চিত যে বিদ্রোহীরা, বিশেষ করে যারা আল কায়দার সঙ্গে যুক্ত, তারা কখনও এ আয়োজন মেনে নেবে না।
অনেকে জোর দিয়ে বলে আসছেন, সিরিয়া সমস্যার একমাত্র সমাধান হল বাশারকে নমনীয় পথে আনা। হতে পারে সেটা ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে রাজি করানোর জন্য ভাদিমির পুতিনকে চাপ দেয়া। তবে খুব কম লোকই বিশ্বাস করে, রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট এ ধরনের কিছু করবেন এবং বাশার আল আসাদ তৎক্ষণাৎ পদত্যাগ করে সিরিয়া ছেড়ে চলে যাবেন। বরং যখন তিনি দেখবেন ইরান ও হেজবুল্লাহর কল্যাণে ভাগ্যের চাকা তার অনুকূলে, তখন তিনি আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। আসলে তিনি যথেষ্ট শক্ত অবস্থানেই রয়েছেন এবং এখন তাকে যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি আত্মবিশ্বাসী দেখাচ্ছে।
অন্যদিকে পুতিনের আপসহীনতা দেখে মনে হয়- শেষ পর্যন্ত বাশারের সরকার যদি ভেঙেও পড়ে, তাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পরাজিত হিসেবে বিবেচিত হবেন না, অন্তত নিজ দেশের জনগণের কাছে, যা তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পুতিন যদি কোনো ক্ষেত্রে কিছুটা আপস করেন, তাতেই বরং তাকে পরাজিত মনে হবে। কারণ তখন এর ব্যাখ্যায় বলা হবে, তিনি মার্কিন চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছেন। এটা রুশ জনগণের কাছে হবে সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। সিরিয়ায় মার্কিন হামলা হয়তো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ হবে না। তবে তা বিশ্ব ব্যবস্থায় স্নায়ুযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি ফিরিয়ে আনলে বিস্ময়ের কিছু থাকবে না। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা হবে স্বয়ং হামলাকারীরই। মার্কিন খবরদারি থেকে বিশ্ব কিছুটা হলেও রেহাই পাবে তখন।
আসিফ রশীদ : সাংবাদিক ও লেখক
No comments