ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বিলুপ্তির দাবি অর্থনীতিবিদদেরঃ ব্যাংক জালিয়াতি রোধ ও সুশাসনে জোর by গাযী আনোয়ার
দেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের হাতেই। তখন ব্যাংকের সার্বিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিত অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন এবং সার্বিক কাজের শ্লথগতি তৈরি হওয়ায় তখন ব্যাংক ব্যবস্থার সব ক্ষমতা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করেন তখনকার আওয়ামী লীগ সরকারের অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া। কিন্তু বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোতে সরকারি নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে ‘ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ’ নামে একটি আলাদা বিভাগই প্রতিষ্ঠা করা হয়।
আর এ সরকারের আমলেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অর্থ জালিয়াতি ও হাতানো হয়েছে ব্যাংকগুলো থেকে। কয়েকহাজার কোটি টাকার হলমার্ক ঋণ কেলেঙ্কারিসহ তুলনামূলক অল্প অংকের যেসব প্রতারণার খবর বেরিয়ে আসছে সংবাদমাধ্যমগুলোতে, তাতে সবমিলিয়ে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা লুটপাটের হিসাব পাওয়া যাচ্ছে এ পর্যন্ত।
এ ধরনের জালিয়াতি ঠেকানো এবং ব্যাংকিং খাতের বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণে ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর দ্রুত ন্যস্ত করা উচিত বলে মত দিয়েছেন তিন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ।
বার্তা২৪ ডটনেটের সঙ্গে আলাপে তারা জানান, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবে এসব ব্যাংকের ঋণমান সর্বদাই খারাপ ছিল, যার স্বীকৃতিস্বরূপ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর একটা সুস্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখা হতো। এটা ছিল খুবই কার্যকর। বর্তমান সরকার ধীরে ধীরে এ নীতি থেকে সরে এসেছে। আগে ৫ শতাংশের বেশি ঋণ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো দিতে পারত না। পরে সেটাকে বাড়িয়ে ১০ এবং এখন তা আরও বাড়ানো হয়েছে। বলতে গেলে ঋণের পরিমাণের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণের জন্য এক সময় আর্থিক বিভাগ ছিল। এই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে অনেক লুটপাট হওয়ায় এগুলো কোনো সময়ই লাভজনক হতে পারেনি। এ কারণে বিশ্বব্যাংক এবং আমাদের কঠোর প্রতিবাদের কারনে গত সরকারের আমলে ওই বিভাগ বাদ দেয়া হয়েছিল। এ সরকার আবার সেই দিকেই ধাবিত হয়েছে। এখন যা হবার তাই হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “কোনো ধরনের কালক্ষেপন না করেই এ লুটপাট বন্ধে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দ্রুত বাতিল করা উচিত। ব্যাংকিং খাতে তো এক দেশে দু’ধরনের নিয়ম চলতে পারে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই এ ব্যবস্থা নেই। সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে সব অর্থিক প্রতিষ্ঠান চলছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশই ব্যতিক্রম।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “কিছুদিন ধরে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখার তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকার অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে বেশ শোরগোল চলছে, যেখানে হলমার্ক নামের একটি অখ্যাত কোম্পানিই নিয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংকিং খাতে একসঙ্গে এত বিশাল পরিমাণ ঋণ একটি অখ্যাত কোম্পানিকে দেওয়ার আর কোনো নজির পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুপারিশ করেছে তা ঠিকই করেছে।দেশের ব্যাকিং খাতের শৃঙ্খলার স্বার্থে সব ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত।বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক গভর্নর হিসেবে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। আর অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সুপারিশের এখতিয়ার নিয়ে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য যথার্থ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের ৪৫ ও ৪৬ ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সুপারিশ করার এখতিয়ার রয়েছে। তবে ৪৬ ধারার একটি উপধারায় রাষ্ট্রের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ কোনো সুখবর নয়। বরং আমি মনে করি, এ ধারাটি পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমাবদ্ধতা দূর করা উচিত। সেটি করলে সব ব্যাংকের ওপর পুরো নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়বদ্ধতা থাকবে।”
প্রসঙ্গত, ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে, “যদি কোন ব্যাংক-কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক, ম্যানেজার, বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, যে নামেই অভিহিত হউন, সম্পর্কে কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনি কোন আইনের বিধান লঙ্ঘন করিয়াছেন, এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এইরূপ অভিমত পোষণ করে যে, উক্তরূপ লঙ্ঘন এতই গুরুতর যে, ব্যাংক-কোম্পানির সহিত উক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট থাকা ব্যাংক-কোম্পানি বা উহার আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী বা অন্য কোনভাবে অবাঞ্চিত হইবে, তাহা হইলে বাংলাদেশ ব্যাংক এই মর্মে আদেশ প্রদান করিতে পারিবে যে, আদেশে উল্লেখিত তারিখ হইতে, উক্ত ব্যক্তি তাঁহার পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন না, এবং এইরূপ আদেশ প্রদান করা হইলে, উক্ত তারিখ হইতে তাঁহার উক্ত পদ শূন্য হইবে৷”
হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমেছে কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, “সোনালী ব্যাংকের এই ধরনের অর্থ কেলেঙ্কারিকে সাধারণ মানুষ নিজেদের আমানত রাখা টাকার জন্য ভীতিকর মনে করবেন। আবার অনেকে পুঁজিবাজারের মতো এ খাতেও বিরাট ধসের আশঙ্কায় নিজেদের গচ্ছিত টাকা ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। এতে দেশের ব্যাংকিং খাতসহ আর্থিক অন্যান্য খাত, যেমন: বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সাধারণ জনগণ যদি ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আমানতকারীর সঞ্চয়ের টাকা থেকে আগে যেমন শিল্পমালিকেরা ঋণ নিয়ে উৎপাদনশীল কাজে লাগাতেন, এখন তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুর বলেন, “একটি দেশের অর্থনীতি কত শক্তিশালী, তা অনেকাংশে নির্ভর করে তার আর্থিক ব্যবস্থা কতটা সুদৃঢ় তার ওপর। আমাদের আর্থিক খাতের সুব্যবস্থাপনা নিয়ে আর কালক্ষেপণ করা ঠিক নয়। ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, স্টক মার্কেটে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, নন-ব্যাংক ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস (এনবিএফআই) প্রভৃতি। এদের ব্যবস্থাপনা পুরোটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীন হওয়া উচিত। গত তিন বছরে নিয়মবহির্ভূত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ১০ হাজার কোটি টাকার ওপর ঋণ দেয়ার যে খবর বেরিয়েছে বড় বিপর্যয়কর খবর। এ অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনা কম। এটি নতুন কোনো সমস্যা নয়, অতীতেও ছিল। তবে গত এক দশক এ সমস্যা অনেকাংশে সংকুচিত ও স্থিতিশীল ছিল। বর্তমানে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সরকার মাঝে মধ্যে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে এগুলো রিক্যাপিটালাইজ করার চেষ্টা হয়েছে মাত্র, কিন্তু পুনর্গঠন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মূলত ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে এ সমস্যা।''
তিনি আরো বলেন, “বর্তমান ‘হলমার্ক’ কেলেঙ্কারি হয়েছে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোর কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক এখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এ পরিচালনা কোনোমতেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা উচিত নয়। বিগত সরকারের সময় ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করা হয়েছিল এবং সেটাই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। অতিদ্রুত বেসরকারি খাতের অনুরূপ সরকারি ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পরিচালনার নীতি নিতে হবে। ব্যাংকিং বিভাগের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় ব্যাংকগুলোর কার্যকরী পরিষদেও দলীয়করণ পোক্ত হচ্ছে। ঋণদানে দলীয় হস্তক্ষেপ ও প্রশ্রয়ের কারণে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেরিয়ে আসতে তো পারছেই না, বরং আরও ডুবতে চলেছে।”
এ ধরনের জালিয়াতি ঠেকানো এবং ব্যাংকিং খাতের বর্তমান বিশৃঙ্খল অবস্থা থেকে উত্তরণে ব্যাংকসহ সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওপর দ্রুত ন্যস্ত করা উচিত বলে মত দিয়েছেন তিন শীর্ষ অর্থনীতিবিদ।
বার্তা২৪ ডটনেটের সঙ্গে আলাপে তারা জানান, রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাবে এসব ব্যাংকের ঋণমান সর্বদাই খারাপ ছিল, যার স্বীকৃতিস্বরূপ ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ওপর একটা সুস্পষ্ট নিয়ন্ত্রণ রাখা হতো। এটা ছিল খুবই কার্যকর। বর্তমান সরকার ধীরে ধীরে এ নীতি থেকে সরে এসেছে। আগে ৫ শতাংশের বেশি ঋণ রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো দিতে পারত না। পরে সেটাকে বাড়িয়ে ১০ এবং এখন তা আরও বাড়ানো হয়েছে। বলতে গেলে ঋণের পরিমাণের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, “রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণের জন্য এক সময় আর্থিক বিভাগ ছিল। এই ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে অনেক লুটপাট হওয়ায় এগুলো কোনো সময়ই লাভজনক হতে পারেনি। এ কারণে বিশ্বব্যাংক এবং আমাদের কঠোর প্রতিবাদের কারনে গত সরকারের আমলে ওই বিভাগ বাদ দেয়া হয়েছিল। এ সরকার আবার সেই দিকেই ধাবিত হয়েছে। এখন যা হবার তাই হচ্ছে।”
তিনি আরো বলেন, “কোনো ধরনের কালক্ষেপন না করেই এ লুটপাট বন্ধে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ দ্রুত বাতিল করা উচিত। ব্যাংকিং খাতে তো এক দেশে দু’ধরনের নিয়ম চলতে পারে না। পৃথিবীর কোনো দেশেই এ ব্যবস্থা নেই। সব দেশেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীনে সব অর্থিক প্রতিষ্ঠান চলছে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশই ব্যতিক্রম।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, “কিছুদিন ধরে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখার তিন হাজার ৫৪৭ কোটি টাকার অর্থ কেলেঙ্কারি নিয়ে বেশ শোরগোল চলছে, যেখানে হলমার্ক নামের একটি অখ্যাত কোম্পানিই নিয়েছে প্রায় দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দেশের ব্যাংকিং খাতে একসঙ্গে এত বিশাল পরিমাণ ঋণ একটি অখ্যাত কোম্পানিকে দেওয়ার আর কোনো নজির পাওয়া যায়নি। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে সুপারিশ করেছে তা ঠিকই করেছে।দেশের ব্যাকিং খাতের শৃঙ্খলার স্বার্থে সব ব্যাংকের ওপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত।বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক গভর্নর হিসেবে আমি বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই। আর অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সুপারিশের এখতিয়ার নিয়ে অর্থমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্য যথার্থ নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক আইনের ৪৫ ও ৪৬ ধারা অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সুপারিশ করার এখতিয়ার রয়েছে। তবে ৪৬ ধারার একটি উপধারায় রাষ্ট্রের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ক্ষমতাকে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। এটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বিশেষ কোনো সুখবর নয়। বরং আমি মনে করি, এ ধারাটি পরিবর্তন করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সীমাবদ্ধতা দূর করা উচিত। সেটি করলে সব ব্যাংকের ওপর পুরো নজরদারি, নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়বদ্ধতা থাকবে।”
প্রসঙ্গত, ব্যাংক কোম্পানি আইনে বলা আছে, “যদি কোন ব্যাংক-কোম্পানির চেয়ারম্যান, পরিচালক, ম্যানেজার, বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, যে নামেই অভিহিত হউন, সম্পর্কে কোন আদালত বা ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোন কর্তৃপক্ষ এইরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, তিনি কোন আইনের বিধান লঙ্ঘন করিয়াছেন, এবং বাংলাদেশ ব্যাংক যদি এইরূপ অভিমত পোষণ করে যে, উক্তরূপ লঙ্ঘন এতই গুরুতর যে, ব্যাংক-কোম্পানির সহিত উক্ত ব্যক্তির সংশ্লিষ্ট থাকা ব্যাংক-কোম্পানি বা উহার আমানতকারীদের স্বার্থবিরোধী বা অন্য কোনভাবে অবাঞ্চিত হইবে, তাহা হইলে বাংলাদেশ ব্যাংক এই মর্মে আদেশ প্রদান করিতে পারিবে যে, আদেশে উল্লেখিত তারিখ হইতে, উক্ত ব্যক্তি তাঁহার পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন না, এবং এইরূপ আদেশ প্রদান করা হইলে, উক্ত তারিখ হইতে তাঁহার উক্ত পদ শূন্য হইবে৷”
হলমার্ক কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকিং খাতের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা কমেছে কিনা এ বিষয়ে তিনি বলেন, “সোনালী ব্যাংকের এই ধরনের অর্থ কেলেঙ্কারিকে সাধারণ মানুষ নিজেদের আমানত রাখা টাকার জন্য ভীতিকর মনে করবেন। আবার অনেকে পুঁজিবাজারের মতো এ খাতেও বিরাট ধসের আশঙ্কায় নিজেদের গচ্ছিত টাকা ফিরিয়ে নিতে চাইছেন। এতে দেশের ব্যাংকিং খাতসহ আর্থিক অন্যান্য খাত, যেমন: বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্যে অর্থের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। সাধারণ জনগণ যদি ব্যাংক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে আমানতকারীর সঞ্চয়ের টাকা থেকে আগে যেমন শিল্পমালিকেরা ঋণ নিয়ে উৎপাদনশীল কাজে লাগাতেন, এখন তা বন্ধ হয়ে যেতে পারে।”
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক, অর্থনীতিবিদ ড. আহসান মনসুর বলেন, “একটি দেশের অর্থনীতি কত শক্তিশালী, তা অনেকাংশে নির্ভর করে তার আর্থিক ব্যবস্থা কতটা সুদৃঢ় তার ওপর। আমাদের আর্থিক খাতের সুব্যবস্থাপনা নিয়ে আর কালক্ষেপণ করা ঠিক নয়। ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি, স্টক মার্কেটে নিয়োজিত প্রতিষ্ঠান, নন-ব্যাংক ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনস (এনবিএফআই) প্রভৃতি। এদের ব্যবস্থাপনা পুরোটাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অধীন হওয়া উচিত। গত তিন বছরে নিয়মবহির্ভূত রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর ১০ হাজার কোটি টাকার ওপর ঋণ দেয়ার যে খবর বেরিয়েছে বড় বিপর্যয়কর খবর। এ অর্থ ফেরত আসার সম্ভাবনা কম। এটি নতুন কোনো সমস্যা নয়, অতীতেও ছিল। তবে গত এক দশক এ সমস্যা অনেকাংশে সংকুচিত ও স্থিতিশীল ছিল। বর্তমানে তা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। সরকার মাঝে মধ্যে নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে এগুলো রিক্যাপিটালাইজ করার চেষ্টা হয়েছে মাত্র, কিন্তু পুনর্গঠন ও সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়নি। মূলত ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণেই বারবার ঘুরে ফিরে আসছে এ সমস্যা।''
তিনি আরো বলেন, “বর্তমান ‘হলমার্ক’ কেলেঙ্কারি হয়েছে শুধু রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের ব্যাংকগুলোর কাঠামোগত দুর্বলতার কারণেই। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংক এখনো অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এ পরিচালনা কোনোমতেই অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা উচিত নয়। বিগত সরকারের সময় ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করা হয়েছিল এবং সেটাই ছিল সঠিক সিদ্ধান্ত। অতিদ্রুত বেসরকারি খাতের অনুরূপ সরকারি ব্যাংকগুলোকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে পরিচালনার নীতি নিতে হবে। ব্যাংকিং বিভাগের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় ব্যাংকগুলোর কার্যকরী পরিষদেও দলীয়করণ পোক্ত হচ্ছে। ঋণদানে দলীয় হস্তক্ষেপ ও প্রশ্রয়ের কারণে খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি থেকে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো বেরিয়ে আসতে তো পারছেই না, বরং আরও ডুবতে চলেছে।”
No comments