বিএনপির রাজনীতি কোন দিকে মোড় নেবে by আব্দুল কাইয়ুম
বিগত নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর সরকারের ব্যাপারে বিএনপি সময় দেওয়ার কথা বলেছিল। কিন্তু গত শনিবার জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতারা বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করতে গেলে তিনি বলেন, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বর্তমান সরকারকে বিদায় নিতে হবে। তাহলে কি বিএনপির রাজনীতিতে লক্ষণীয় কোনো পরিবর্তন আসছে? শুরুতে তারা সংসদ অধিবেশনে যায়। কিন্তু দু-একবার প্রতীক বর্জনের পর শুরু করে ধারাবাহিক বর্জন। সামনের সারিতে বিএনপির সাংসদদের জন্য আসনসংখ্যা বাড়ানোর যে দাবি ছিল, এর সঙ্গে এখন আরও কয়েকটা দাবি যুক্ত হয়েছে। দাবিগুলো সরকার যে মানবে, এমন কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। তাহলে কি বিএনপি রাজপথে তপ্ত হাওয়ার রাজনীতির দিকে যাচ্ছে?
যদি সেদিকে যায়, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দুই দল ও দুই নেত্রীর মধ্যে কোনো সমঝোতার লক্ষণ এখনো নেই। কোনো তরফেই সে রকম চেষ্টা নেই। এই তো কিছুদিন আগে দারিদ্র্য বিরোধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার একমঞ্চে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। স্পিকার আবদুল হামিদ বেশ আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া যাননি। অনেকে সমালোচনা করে বলেছেন, না যাবেন যদি, রাজি হয়েছিলেন কেন? এমনকি বিএনপি সমর্থক কেউ কেউ পর্যন্ত এ প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত যাবেন না, এ রকম ধারণা অনেকেরই ছিল। অনেকেই দুই নেত্রীর একমঞ্চে উপস্থিতির ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। এত পাল্টাপাল্টির মধ্যে তাঁদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক আচরণ আশা করা যায় না। আর তা ছাড়া দুই নেত্রী এক অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসলেই যে রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে, সে সম্ভাবনা প্রায় নেই। শুধু অতি আশাবাদীরাই এমন সম্ভাবনা দেখছিলেন। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। স্পিকার অবশ্য বলেছেন, পরবর্তী কোনো অনুষ্ঠানে হয়তো দুই নেত্রীকে পাশাপাশি দেখা যাবে। ভালো কিছু আশা করতে দোষ নেই। কিন্তু বাস্তবতা একটু বেশি তেতো, তাতে সন্দেহ নেই।
আপাতত দুই নেত্রীর বিরোধ তুঙ্গে থাকবে এটা ধরে নেওয়া যায়। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি নিশ্চয়ই সরকারের বিভিন্ন কাজের ভুলত্রুটি ধরবে। সরকার কোনো অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। এটাই তো বিরোধী দলের কাজ। কিন্তু আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে যুক্তিসিদ্ধ। দলের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়াই ভালো। ৮ ডিসেম্বর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে একটি কার্যকর নেতৃত্ব গঠন করা হোক। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা বাড়লে ভবিষ্যত্ কর্মসূচিতে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।
বাস্তবসম্মত কর্মসূচি না হলে মানুষ সাড়া দেবে না, দল জনবিচ্ছিন্ন থেকে যাবে। এখানে মনে রাখতে হবে, বিগত নির্বাচনে যে মানুষ বিএনপিকে বেশি ভোট দেয়নি, এর অন্যতম কারণ ভুল রাজনৈতিক প্রচার। যেমন, তারা মানুষকে বোঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে, প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচন করছে, তাই তারা খারাপ। এ ধরনের প্রচারে মানুষ কান দেয়নি মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, মানুষ চাচ্ছিল একটি নির্বাচন হোক, সেটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হোক। মানুষ ভালোভাবেই বুঝেছিল যে সেনাসমর্থিত সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব দল যদি নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি না হয়, তাহলে তো নির্বাচনই হবে না। তাই আঁতাতের কথাটি সাধারণ মানুষের কাছে ছিল তাত্পর্যহীন। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিকেও যে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়েছে, সেটি লুকানো ব্যাপার ছিল না। সুতরাং ওইসব প্রচারকে মানুষ পাত্তা দেয়নি।
বিএনপি হয়তো ভেবেছিল, ১৯৮৬ সালে এরশাদের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচনে যাওয়ার অভিযোগ ওঠায় যেহেতু আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছিল এবং এর পরিণামে ’৯১-এর নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, তাই এবারও একই কৌশল কাজে লাগবে। অতীতের অভিজ্ঞতা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হুবহু প্রয়োগের বিপদ সম্পর্কে বিএনপি সতর্ক না থাকায় হয়তো তাদের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে। আশির দশকে এরশাদ ছিল স্বৈরাচারের প্রতীক, দেশবাসী ছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু এবারের এক-এগারোর পরিবর্তনকে মানুষ সাধারণভাবে সমর্থন দিয়েছে। দুই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, হিংসাত্মক রাজনীতি, ঘনঘন হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও প্রভৃতির অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ উদগ্রিব ছিল। কেউ সেনাশাসন চায় না, কিন্তু সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক সংস্কারমূলক পদক্ষেপই মানুষ সমর্থন করেছে। মানুষের এ মনোভাবকে গুরুত্ব না দেওয়া ছিল বিএনপির রাজনৈতিক বিভ্রান্তি, যার মূল্য তাদের দিতে হয়েছে নির্বাচনে।
এবার যখন বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে, তখন একটি বিষয়ে তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, তাদের পদক্ষেপগুলো যেন মানুষের চিন্তার বাইরে না যায়। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক পদক্ষেপ মানুষ গ্রহণ করেনি, আবার অনেক কিছু সমর্থনও করেছে। এর অন্যতম একটি হলো হিংসা হানাহানিমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ, যা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মোটামুটি বজায় ছিল। জন-চাহিদা হিসেবে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথাটি মনে রাখতে হবে। বিএনপি যখন মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরকার বিদায়ের কথা বলছে, সেটা যদি কথার কথা না হয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই আন্দোলনের কথা ভাববে। আর আন্দোলন তো আমাদের দেশে শান্তিপূর্ণ থাকে না। জনগণের কথা বলে যদি সরকারের অজনপ্রিয়তা প্রমাণের জন্য হরতাল-অবরোধের মতো হিংসাত্মক কর্মসূচি নেওয়া শুরু হয়, তাহলে তা হবে দলের জন্য আত্মঘাতী।
আমাদের মতো গরিব দেশে অভাব অভিযোগের শেষ নেই। সরকারের ব্যর্থতাও পদে পদে। তাই বিরোধী দলের আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হতে সময় লাগবে না। বিএনপি নিশ্চয়ই আন্দোলন করবে, তবে সেটা সবকিছু অচল করার সেই পুরোনো ধারায় না হওয়াই ভালো। আপনি সংসদে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যত খুশি বক্তৃতা দিন। সরকারকে ধুয়ে ফেলুন। মেয়াদ শেষের আগে সরকারকে ফেলতে হলে সেখানেই ফেলুন, সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী, রাজপথে নয়। যদি এভাবে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন চালানো হয়, তাহলে কারও কিছু বলার থাকবে না।
যারা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলবে, তারা নিশ্চয়ই আন্দোলনের কলাকৌশলের ক্ষেত্রে অগ্রসর চিন্তার পরিচয় দেবে। বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে কার্যকর সংসদের জন্য অনেক ভালো চিন্তার কথা বলেছিল। এর মূল কথা ছিল বিরোধী দলকে সংসদে থাকতে হবে। কোনো সাংসদ অনুমোদন ছাড়া সংসদে একটানা এক মাসের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে, ইত্যাদি। এত কথা বলে এখন তারা নিজেরাই সংসদে যাচ্ছেন না। আবার সরকার পতনের ভবিষ্যদ্বাণীও করছেন।
রাজপথে অযৌক্তিকভাবে সহিংস আন্দোলন চালাতে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোও কীভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তা সাম্প্রতিককালে থাইল্যান্ডে দেখা গেছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার পুলিশ ও সেনাসদস্য ব্যাংককের কেন্দ্রীয় এলাকা ঘিরে ফেলে। তাদের আশঙ্কা ছিল, ২০০৬ সালের ওই তারিখে যেহেতু এক সামরিক অভ্যুত্থানে থাইল্যান্ডের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তাই হয়তো সেদিন তার দল রাজপথে বড় ধরনের ঘটনা ঘটাবে। সেই অভ্যুত্থানের পর থাইল্যান্ডে সেনাশাসনের অবসান হয়েছে, এক বছরের মাথায় নির্বাচন হয়েছে। তার পরও থেমে থেমে রাজনৈতিক সহিংস আন্দোলন চলেছে। মাঝেমধ্যে সেনা-হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। আবার চাপের মুখে সরকার বদলও হয়েছে। এই ভালোমন্দের মধ্য দিয়ে চলছিল দেশটি। ১৯ সেপ্টেম্বর আশঙ্কার কারণ ছিল, কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। লাল শার্ট পরিহিত হাজার বিশেক কর্মী অভ্যুত্থানবিরোধী বক্তৃতা ও গান শুনেছে আর থাকসিন বিদেশ থেকে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে বক্তৃতা দিয়েছেন। বোমাবাজি বা নাশকতার যে আশঙ্কা ছিল, তার কিছুই হয়নি। সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ।
কিন্তু ঘটনা ঘটেছে অন্যখানে। প্রতিদ্বন্দ্বী পিপলস এলায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (পিএডি) প্রভাবিত লোকজন ওই দিন প্রতিবেশী দেশ কম্বোডিয়ার সীমান্তে গিয়ে কম্বোডিয়ার ভেতর অবস্থিত একাদশ শতাব্দীর এক প্রাচীন মন্দির এলাকায় যেতে চাইলে রায়ট পুলিশ ও গ্রামবাসী বাধা দেয়। তখন পিএডির কর্মীরা তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পিএডির অভিযোগ, কম্বোডিয়া সীমান্তের অমীমাংসিত ভূমিতে নির্মাণকাজ চালাচ্ছে। গত বছর তারা এ অভিযোগ তোলে। এরপর সীমান্তে দুই দেশের সেনাসমাবেশ ঘটে। সংঘর্ষ শুরু হয়। কয়েকজন প্রাণ হারায়। পর্যটকেরা ওই এলাকায় আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে থাই সীমান্তের গ্রামবাসী খেপে যায়। ১৯ সেপ্টেম্বর পিএডির কর্মীরা ওই সীমান্ত এলাকায় বিক্ষোভ করতে গেলে গ্রামের লোকজন বাধা দেয়। এই পিএডির কর্মীরাই সরকারের অপসারণের দাবিতে গত বছর হলুদ শার্ট পরে ব্যাংকক বিমানবন্দর অবরোধ ও অচল করে দিয়েছিল। দেশ অচলের এ ধরনের পদক্ষেপ থাই জনগণ গ্রহণ করেনি।
সপ্তাহখানেক আগে ব্যাংকক বিমানবন্দর প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর দেখে এসেছি। সেখানে কারও চোখেমুখে উদ্বেগের চিহ্নটুকুও নেই। অথচ বছরখানেক আগেও লাগাতার অবরোধের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিমানবন্দরটি পরিত্যক্ত হতে চলেছিল।
বাংলাদেশও এ রকম এক উত্তরণ পর্বের মধ্য দিয়ে চলেছে। রাজনীতিতে সহিংস কর্মসূচিকে ‘গুডবাই’ জানানোর সময় এসে গেছে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
যদি সেদিকে যায়, অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। দুই দল ও দুই নেত্রীর মধ্যে কোনো সমঝোতার লক্ষণ এখনো নেই। কোনো তরফেই সে রকম চেষ্টা নেই। এই তো কিছুদিন আগে দারিদ্র্য বিরোধী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার একমঞ্চে উপস্থিত থাকার কথা ছিল। স্পিকার আবদুল হামিদ বেশ আশাবাদী ছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া যাননি। অনেকে সমালোচনা করে বলেছেন, না যাবেন যদি, রাজি হয়েছিলেন কেন? এমনকি বিএনপি সমর্থক কেউ কেউ পর্যন্ত এ প্রশ্ন তুলেছেন। কিন্তু খালেদা জিয়া রাজি হলেও শেষ পর্যন্ত যাবেন না, এ রকম ধারণা অনেকেরই ছিল। অনেকেই দুই নেত্রীর একমঞ্চে উপস্থিতির ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন। এত পাল্টাপাল্টির মধ্যে তাঁদের স্বাভাবিক রাজনৈতিক আচরণ আশা করা যায় না। আর তা ছাড়া দুই নেত্রী এক অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসলেই যে রাজনীতিতে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আসবে, সে সম্ভাবনা প্রায় নেই। শুধু অতি আশাবাদীরাই এমন সম্ভাবনা দেখছিলেন। শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। স্পিকার অবশ্য বলেছেন, পরবর্তী কোনো অনুষ্ঠানে হয়তো দুই নেত্রীকে পাশাপাশি দেখা যাবে। ভালো কিছু আশা করতে দোষ নেই। কিন্তু বাস্তবতা একটু বেশি তেতো, তাতে সন্দেহ নেই।
আপাতত দুই নেত্রীর বিরোধ তুঙ্গে থাকবে এটা ধরে নেওয়া যায়। বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি নিশ্চয়ই সরকারের বিভিন্ন কাজের ভুলত্রুটি ধরবে। সরকার কোনো অন্যায় করলে তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করবে। এটাই তো বিরোধী দলের কাজ। কিন্তু আন্দোলনের প্রতিটি পদক্ষেপ হতে হবে যুক্তিসিদ্ধ। দলের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা করে পদক্ষেপ নেওয়াই ভালো। ৮ ডিসেম্বর বিএনপির জাতীয় কাউন্সিলের মধ্য দিয়ে একটি কার্যকর নেতৃত্ব গঠন করা হোক। সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলের মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতির চর্চা বাড়লে ভবিষ্যত্ কর্মসূচিতে মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে।
বাস্তবসম্মত কর্মসূচি না হলে মানুষ সাড়া দেবে না, দল জনবিচ্ছিন্ন থেকে যাবে। এখানে মনে রাখতে হবে, বিগত নির্বাচনে যে মানুষ বিএনপিকে বেশি ভোট দেয়নি, এর অন্যতম কারণ ভুল রাজনৈতিক প্রচার। যেমন, তারা মানুষকে বোঝাতে আপ্রাণ চেষ্টা করে, প্রতিপক্ষ আওয়ামী লীগ সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচন করছে, তাই তারা খারাপ। এ ধরনের প্রচারে মানুষ কান দেয়নি মূলত দুটি কারণে। প্রথমত, মানুষ চাচ্ছিল একটি নির্বাচন হোক, সেটি সুন্দর, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হোক। মানুষ ভালোভাবেই বুঝেছিল যে সেনাসমর্থিত সরকারের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সব দল যদি নির্বাচনে অংশ নিতে রাজি না হয়, তাহলে তো নির্বাচনই হবে না। তাই আঁতাতের কথাটি সাধারণ মানুষের কাছে ছিল তাত্পর্যহীন। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিকেও যে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে হয়েছে, সেটি লুকানো ব্যাপার ছিল না। সুতরাং ওইসব প্রচারকে মানুষ পাত্তা দেয়নি।
বিএনপি হয়তো ভেবেছিল, ১৯৮৬ সালে এরশাদের সঙ্গে আঁতাত করে নির্বাচনে যাওয়ার অভিযোগ ওঠায় যেহেতু আওয়ামী লীগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছিল এবং এর পরিণামে ’৯১-এর নির্বাচনে তাদের ভরাডুবি হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়, তাই এবারও একই কৌশল কাজে লাগবে। অতীতের অভিজ্ঞতা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে হুবহু প্রয়োগের বিপদ সম্পর্কে বিএনপি সতর্ক না থাকায় হয়তো তাদের বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হয়েছে। আশির দশকে এরশাদ ছিল স্বৈরাচারের প্রতীক, দেশবাসী ছিল তার বিরুদ্ধে। কিন্তু এবারের এক-এগারোর পরিবর্তনকে মানুষ সাধারণভাবে সমর্থন দিয়েছে। দুই প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের মধ্যে অসহিষ্ণুতা, হিংসাত্মক রাজনীতি, ঘনঘন হরতাল-অবরোধ, জ্বালাও-পোড়াও প্রভৃতির অভিশাপ থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানুষ উদগ্রিব ছিল। কেউ সেনাশাসন চায় না, কিন্তু সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক সংস্কারমূলক পদক্ষেপই মানুষ সমর্থন করেছে। মানুষের এ মনোভাবকে গুরুত্ব না দেওয়া ছিল বিএনপির রাজনৈতিক বিভ্রান্তি, যার মূল্য তাদের দিতে হয়েছে নির্বাচনে।
এবার যখন বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামবে, তখন একটি বিষয়ে তাদের গুরুত্ব দিতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে, তাদের পদক্ষেপগুলো যেন মানুষের চিন্তার বাইরে না যায়। সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অনেক পদক্ষেপ মানুষ গ্রহণ করেনি, আবার অনেক কিছু সমর্থনও করেছে। এর অন্যতম একটি হলো হিংসা হানাহানিমুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ, যা সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় মোটামুটি বজায় ছিল। জন-চাহিদা হিসেবে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথাটি মনে রাখতে হবে। বিএনপি যখন মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই সরকার বিদায়ের কথা বলছে, সেটা যদি কথার কথা না হয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই আন্দোলনের কথা ভাববে। আর আন্দোলন তো আমাদের দেশে শান্তিপূর্ণ থাকে না। জনগণের কথা বলে যদি সরকারের অজনপ্রিয়তা প্রমাণের জন্য হরতাল-অবরোধের মতো হিংসাত্মক কর্মসূচি নেওয়া শুরু হয়, তাহলে তা হবে দলের জন্য আত্মঘাতী।
আমাদের মতো গরিব দেশে অভাব অভিযোগের শেষ নেই। সরকারের ব্যর্থতাও পদে পদে। তাই বিরোধী দলের আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হতে সময় লাগবে না। বিএনপি নিশ্চয়ই আন্দোলন করবে, তবে সেটা সবকিছু অচল করার সেই পুরোনো ধারায় না হওয়াই ভালো। আপনি সংসদে গিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যত খুশি বক্তৃতা দিন। সরকারকে ধুয়ে ফেলুন। মেয়াদ শেষের আগে সরকারকে ফেলতে হলে সেখানেই ফেলুন, সংসদীয় গণতন্ত্রের বিধান অনুযায়ী, রাজপথে নয়। যদি এভাবে সরকারবিরোধী কঠোর আন্দোলন চালানো হয়, তাহলে কারও কিছু বলার থাকবে না।
যারা দেশকে এগিয়ে নেওয়ার কথা বলবে, তারা নিশ্চয়ই আন্দোলনের কলাকৌশলের ক্ষেত্রে অগ্রসর চিন্তার পরিচয় দেবে। বিএনপি তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে কার্যকর সংসদের জন্য অনেক ভালো চিন্তার কথা বলেছিল। এর মূল কথা ছিল বিরোধী দলকে সংসদে থাকতে হবে। কোনো সাংসদ অনুমোদন ছাড়া সংসদে একটানা এক মাসের বেশি অনুপস্থিত থাকলে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে, ইত্যাদি। এত কথা বলে এখন তারা নিজেরাই সংসদে যাচ্ছেন না। আবার সরকার পতনের ভবিষ্যদ্বাণীও করছেন।
রাজপথে অযৌক্তিকভাবে সহিংস আন্দোলন চালাতে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলগুলোও কীভাবে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, তা সাম্প্রতিককালে থাইল্যান্ডে দেখা গেছে। গত ১৯ সেপ্টেম্বর হাজার হাজার পুলিশ ও সেনাসদস্য ব্যাংককের কেন্দ্রীয় এলাকা ঘিরে ফেলে। তাদের আশঙ্কা ছিল, ২০০৬ সালের ওই তারিখে যেহেতু এক সামরিক অভ্যুত্থানে থাইল্যান্ডের তত্কালীন প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, তাই হয়তো সেদিন তার দল রাজপথে বড় ধরনের ঘটনা ঘটাবে। সেই অভ্যুত্থানের পর থাইল্যান্ডে সেনাশাসনের অবসান হয়েছে, এক বছরের মাথায় নির্বাচন হয়েছে। তার পরও থেমে থেমে রাজনৈতিক সহিংস আন্দোলন চলেছে। মাঝেমধ্যে সেনা-হস্তক্ষেপের আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে। আবার চাপের মুখে সরকার বদলও হয়েছে। এই ভালোমন্দের মধ্য দিয়ে চলছিল দেশটি। ১৯ সেপ্টেম্বর আশঙ্কার কারণ ছিল, কিন্তু তেমন কিছুই হয়নি। লাল শার্ট পরিহিত হাজার বিশেক কর্মী অভ্যুত্থানবিরোধী বক্তৃতা ও গান শুনেছে আর থাকসিন বিদেশ থেকে ভিডিও লিংকের মাধ্যমে বক্তৃতা দিয়েছেন। বোমাবাজি বা নাশকতার যে আশঙ্কা ছিল, তার কিছুই হয়নি। সমাবেশ ছিল শান্তিপূর্ণ।
কিন্তু ঘটনা ঘটেছে অন্যখানে। প্রতিদ্বন্দ্বী পিপলস এলায়েন্স ফর ডেমোক্রেসি (পিএডি) প্রভাবিত লোকজন ওই দিন প্রতিবেশী দেশ কম্বোডিয়ার সীমান্তে গিয়ে কম্বোডিয়ার ভেতর অবস্থিত একাদশ শতাব্দীর এক প্রাচীন মন্দির এলাকায় যেতে চাইলে রায়ট পুলিশ ও গ্রামবাসী বাধা দেয়। তখন পিএডির কর্মীরা তাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পিএডির অভিযোগ, কম্বোডিয়া সীমান্তের অমীমাংসিত ভূমিতে নির্মাণকাজ চালাচ্ছে। গত বছর তারা এ অভিযোগ তোলে। এরপর সীমান্তে দুই দেশের সেনাসমাবেশ ঘটে। সংঘর্ষ শুরু হয়। কয়েকজন প্রাণ হারায়। পর্যটকেরা ওই এলাকায় আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে থাই সীমান্তের গ্রামবাসী খেপে যায়। ১৯ সেপ্টেম্বর পিএডির কর্মীরা ওই সীমান্ত এলাকায় বিক্ষোভ করতে গেলে গ্রামের লোকজন বাধা দেয়। এই পিএডির কর্মীরাই সরকারের অপসারণের দাবিতে গত বছর হলুদ শার্ট পরে ব্যাংকক বিমানবন্দর অবরোধ ও অচল করে দিয়েছিল। দেশ অচলের এ ধরনের পদক্ষেপ থাই জনগণ গ্রহণ করেনি।
সপ্তাহখানেক আগে ব্যাংকক বিমানবন্দর প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর দেখে এসেছি। সেখানে কারও চোখেমুখে উদ্বেগের চিহ্নটুকুও নেই। অথচ বছরখানেক আগেও লাগাতার অবরোধের কারণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে বিমানবন্দরটি পরিত্যক্ত হতে চলেছিল।
বাংলাদেশও এ রকম এক উত্তরণ পর্বের মধ্য দিয়ে চলেছে। রাজনীতিতে সহিংস কর্মসূচিকে ‘গুডবাই’ জানানোর সময় এসে গেছে।
আব্দুল কাইয়ুম: সাংবাদিক
No comments