যৌথ পরিবারের একাল-সেকাল
আত্মকেন্দ্রিক
ও নিজেদের স্বার্থকে প্রাধান্য দেওয়ায় ভাঙছে যৌথ পরিবার। বড় পরিবার ভেঙ্গে
ছোট পরিবারে রূপ নেওয়ায় শিথিল হচ্ছে সম্পর্কের বন্ধন। সময় বদলাচ্ছে,
বদলাচ্ছে মূল্যবোধ। সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে সমাজের অনুশাসন। আগে যৌথ পরিবারগুলো
যখন এক ছিল তখন সবাই নিজেদের স্বার্থ পরিত্যাগ করে এক থাকার চেষ্টা করে
গেছেন বছরের পর বছর। পরিবারের সন্তানরা দাদা-দাদি, চাচা-চাচিদের কাছে বড়
হয়েছে। কিন্তু এখন যৌথ পরিবার থেকে বেরিয়ে আসা চাকরিজীবী বাবা-মায়ের
সন্তানরা কাজের লোক কিংবা চাইল্ড কেয়ারে বড় হচ্ছে। অনেকেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে
ওল্ড হোমে রেখে আসছেন। পেশাগত কারণেও যৌথ পরিবার পৃথক হচ্ছে। যৌথ পরিবারে
বড় পাতিলে রান্না, একসঙ্গে খাওয়ার মতো অসাধারণ ব্যাপারগুলো এখন শুধুই
স্বপ্ন। প্রতিবেদনে বাংলা ট্রিবিউনের রাজশাহী প্রতিনিধি দুলাল আবদুল্লাহ
তুলে ধরেছেন ৪৬ বছর একসঙ্গে থাকা একটি যৌথ পরিবারের কথা। চট্টগ্রাম
প্রতিবেদক হুমায়ুন মাসুদ লিখেছেন এক সময়ের ঐহিত্যবাহী দোভাষ পরিবারের জৌলুস
হারানোর গল্প। আর সিলেট প্রতিনিধি তুহিন আহমেদ বলেছেন ৩৩ সদস্যের এক যৌথ
পরিবার ভাগ হয়ে যাওয়ার গল্প।
৪৬ বছর যৌথ পরিবারে রাজশাহীর রথ বাড়ি
স্বাধীনতার পরপরই রাস বিহারী সরকারের মৃত্যু হয়। অনেক জমিজমা ও সম্পদসহ সাত ছেলের জন্য রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানা ভবনের পাশে পাঁচ কাঠা জায়গায় রেখে গেছেন একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে ৪৬ বছর ধরে এখনও এক হাঁড়িতে পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না হয়। শুধু তাই নয়, পরিবারের সবার চিন্তা ও মতামতকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। এ কারণে শহরের মধ্যে এই রথ বাড়িতে যৌথ পরিবারটি টিকে রয়েছে। কীভাবে সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে রথ বাড়ি পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান বিমল কুমার সরকার বলেন, ‘বাবা-মা ও বড় ভাই মারা যাওয়ার পরও আমরা সবাই একসঙ্গে থাকার মূলমন্ত্র হচ্ছে- ব্যক্তি শাসনতন্ত্র প্রথাকে এড়িয়ে চলেছি। কেউ বেশি আয় করে। আবার কেউ কম করে। এ নিয়ে কারও মধ্যে কোনও হিংসা-প্রতিহিংসা তৈরি করি না। বাড়ির বৌ’দের সেভাবে গড়ে তুলেছি। কারণ তারা তো অন্য পরিবারের সদস্য। তাদের মধ্যে আমাদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটতে নাও পারে। সেজন্য তাদের আমরা যৌথ পরিবারের ভালো দিকগুলো তুলে ধরে আমাদের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যদি আমরা কোনোদিন দেউলিয়া না হই, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাজে প্রভাব না পড়ে তাহলে ভবিষ্যতেও এভাবেই যৌথ পরিবার নিয়ে বসবাস করে যাবো। আমাদের পরিবারে কাজের বুয়াসহ ২৫ জনের রান্না এক সঙ্গে হয়।’ বাড়ির নামকরণ ‘রথ’ রাখা হলো কেন- এমন প্রশ্নে বিমল কুমার সরকার জানান, স্বাধীনতার পর থেকে বিনা খাজনায় আমাদের পরিবার রাজশাহীতে রথমেলা করে থাকে। এজন্য বাড়ির নামটা রাখা হয়েছে রথ বাড়ি।
নগরীর আলুপট্টি এলাকার শফিউল ইসলাম বকুল জানান, দুই ছেলে ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আমাদের পরিবার। দুই বোন বিদেশে থাকে। তাই সংসারটা তেমন বড় নয়। তবে বর্তমানে যৌথ পরিবারের প্রথা আবার ফিরে আসছে। কারণ সবাই এখন ব্যস্ত জীবনযাপন করছে। এতে পরিবারের সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যৌথ পরিবার ভূমিকা রাখতে পারে। স্বামী-স্ত্রী দুইজন চাকরি করেন। আর সন্তানকে কাজের লোকের কাছে রেখে যান। কিন্তু যৌথ পরিবার থাকলে সন্তান দাদি, নানি, চাচির কাছে রেখে যেতে পারতো। আবার দেখা যায়, অনেকের ছেলেমেয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাকে ওল্ড হোমে রেখে আসেন। এটা হবে কেন? যৌথ পরিবার থাকলে এটা সম্ভব হতো না। তাই নিজেদের চিন্তা ও মতামতকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে যৌথ পরিবার টিকিয়ে রাখতে হবে। আর বর্তমান যুগে এটা খুব বড় প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগেও অপরাধ প্রবণতা ছিল। কিন্তু বর্তমান সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। বড়দের প্রতি সম্মানবোধ কমে গেছে। তাই এসব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। লোভ-লালসা কমিয়ে ফেলতে হবে। সমাজ ও দেশের উন্নয়নে পরিবার থেকে ভালো শিক্ষা নিয়ে আগামীর জন্য সন্তানদের গড়ে তুলতে হবে।’
গোদাগাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘নিজেদের চিন্তা ও মতামতকে যখন বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া হয় তখনই যৌথ পরিবার ভেঙে যায়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর বেড়ে যায়। আবার পেশাগত কারণেও যৌথ পরিবারে ভাঙন তৈরি হয়। এতে একে-অপরের মধ্যে সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, মূল্যবোধ, নৈতিকতার অভাব হয়। বর্তমানে যৌথ পরিবারের অভাবে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
ছয় ভাই ও চার বোনের যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছেন সহকারী অধ্যাপক মহিশাল বাড়ী এলাকার মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার চাচারা ছিলেন সাতজন। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন চাচাদের ভয়ে কোন অপরাধমূলক কাজে জড়ানোর সাহস পেতাম না। তারা যদি আমার ভুল ধরে বকা দেন। আর বর্তমানে ছোট ছোট পরিবার হওয়ার কারণে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতা বেড়ে গেছে। পরিবারের ছোট সদস্যরাও এতে করে বড়দের সামনে কথা বলার ধৃষ্টতা দেখায়। এমনকি যৌথ পরিবার প্রায় বিলুপ্তির কারণে চাচাদের কাছ থেকেও এখন পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা পায় না।’
চট্টগ্রামের দোভাষ পরিবারে নেই আগের জৌলুস
এক সময় ফিরিঙ্গি বাজারসহ পুরো চট্টগ্রামে যাদের ছিল আধিপত্য, ঐতিহ্যবাহী সেই দোভাষ পরিবার এখন হারাতে বসছে জৌলুস। খান বাহাদুর আব্দুল হক দোভাষ ছিলেন জমিদার। তার হাত ধরেই নগরীর ফিরিঙ্গি বাজারে গড়ে উঠে ঐতিহ্যবাহী দোভাষ পরিবারের গোড়াপত্তন। পরবর্তীতে এই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে আসে তৎকালীন চট্টগ্রাম নগরীর রাজনীতি। তার একমাত্র ছেলে ছিলেন নবী দোভাষ। আব্দুল হক দোভাষের মৃত্যুর দুই বছরের মাথায় মারা যান নবী দোভাষ। এরপরই মূলত ছোট পরিবারে রূপ নেয় দোভাষ পরিবার। বাবার মৃত্যুর পর নবী দোভাষের তিন ছেলে শাহ আলম দোভাষ, জানে আলম দোভাষ ও বদিউল আলম দোভাষ আলাদা হয়ে যান। তখন ঐতিহ্যবাহী দোভাষ পরিবার ঝিমিয়ে পড়ে। অবশ্য পরে আবার জৌলুস ফিরিয়ে আনেন জানে আলম দোভাষ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতি শুরু করেন জানে আলম দোভাষ। তার হাত ধরে জৌলুস ফিরে আসে দোভাষ পরিবারে। সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতি শুরুর পর ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হয়ে উঠেন জানে আলম। আর তখন থেকে নগরীর রাজনীতির আঁতুড় ঘরে পরিণত হতে থাকে দোভাষ পরিবার।
জানে আলম দোভাষ মারা যাওয়ার পর দোভাষ পরিবারের সেই জৌলুস আবার কমতে শুরু করে। পরে এই পরিবারের ভাই বোনদের মাঝে সম্পদ ভাগাভাগির কারণে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে তৈরি হয় ছোট পরিবার। জানে আলম দোভাষের বাবা নবী দোভাষের মৃত্যুর পর দোভাষ পরিবার ভেঙ্গে রূপ নেয় চারভাগে। তিন ভাই ও এক বোন আলাদা হয়ে যান। জানে আলম দোভাষ এক ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে যান।
পরবর্তীতে জানে আলম দোভাষের পরিবার ভেঙ্গে রূপ নেয় চার পরিবারে। অন্যদিকে তার দুই ভাইয়ের একজন শাহ আলম দোভাষ রেখে যান দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। শাহ আলমের মৃত্যুর পর তার পরিবার ভেঙ্গে রূপ নেয় ৮ পরিবারে। জানে আলমের আরেক ভাই বদিউল আলম দোভাষ এখনও বেঁচে আছেন। তার দুই ছেলে রয়েছে। এক সময়কার দোভাষ পরিবার এখন ১৩ পরিবারে পরিণত হয়েছে।
সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত
সিলেট নগরের সাদারপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম চৌধুরীর পরিবারে ছয় ভাই-বোনসহ সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৩ জন। এছাড়া কৃষিসহ গৃহস্থালি দেখাশোনার জন্য নারী-পুরুষসহ ছিলেন আরও সাতজন। নিজস্ব কৃষি জমিতে ধান চাষ করে তাতেই চলতো পুরো বছর। জমিতে চাষ হতো নানা ফসল। কিন্তু সেই যৌথ পরিবার এখন আর নেই। যৌথ পরিবারে বড় হওয়া নজরুল ইসলামরা প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যার যার মতো করে বাসা তৈরি করে আলাদা হয়ে গেছেন। এখন সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। একই দেয়ালের ভেতরে সবাই বসবাস করলেও সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া একে-অন্যের সঙ্গে তেমনভাবে দেখা হয় না।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আসলে যৌথ পরিবার বড় হতে থাকলে আলাদা হওয়াটা উত্তম। এতে পরিবারের কর্তাদের উপর অনেক চাপ কমার পাশাপাশি ব্যয়ও কমে যায়। দাদা-বাবাদের রেখে যাওয়া যৌথ পরিবারটি এক রাখার নিরন্তর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সময়ের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে যৌথ পরিবারের মধ্যে থাকাটা খুবই আনন্দের যা বলে শেষ করা যায় না। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘যৌথ পরিবারে গৃহবধূরা একসঙ্গে বড় বড় পাতিলে রান্না করতেন। সবাই একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়াটা ছিল অসাধারণ ব্যাপার। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এগুলো আর নেই। এসব বিষয় এখন অনেকটা স্বপ্নের মতো। এককথায় যৌথ পরিবারের মধ্যে আনন্দের মাখামাখি ছিল খুব বেশি।’
ওই পরিবারের গৃহিণী সেলিনা চৌধুরী জানান, যৌথ পরিবারের মধ্যে বসবাস করা যেমনটি আনন্দের তেমনি পরিবার যখন বড় হয়ে যায় তখন এর দায়িত্ব বহন করা এবং পরিচালনা অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। এছাড়া যৌথ পরিবারের মধ্যে থাকতে হলে প্রথমেই পরিবারের সদস্যদের একই মন মানসিকতা থাকতে হবে। সবাইকে ছোট-বড় ভুলগুলো ছাড় দেওয়ার উদারতা থাকতে হবে। তবে যৌথ পরিবার বড় হয়ে গেলে আলাদা হওয়াটা অনেক ক্ষেত্রে উত্তম বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এসএম শওকত আমিন তৌহিদ বলেন, ‘যৌথ পরিবার ভাঙার পেছনে নগরায়ন একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সবচেয়ে মারাত্মক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশি চ্যানেলগুলো যেমন স্টার জলসা, জি বাংলা। এসব কারণেই যৌথ পরিবারগুলোর এক থাকা খুবই কষ্টকর। এসব চ্যানেল শুধু পরিবার ভাঙা দেখায় যৌথ থাকতে দেখায় না। এই চ্যানেলগুলোতে যা কিছু প্রচার করা হয় সবই পরিবারকেন্দ্রিক। এসব চ্যানেল যখন ছিল না তখন আমাদের দেশের পরিবারগুলোর মধ্যে খুবই আন্তরিকতা আর সহমর্মিতা ছিল। আমাদের দাদা-বাবারা যেভাবে যৌথ পরিবার দুঃখ দুর্দশার মধ্যে টেনে নিয়েছেন বছরের পর বছর- এখন আর সেটা নেই। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। মনে করেন আলাদা হলেই জীবনব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। আমি মনে করি এটা সর্ম্পণ ভুল ধারণা।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এখন একই পরিবারের মধ্যে বসবাস করেও কেউ কারও ভালো চায় না। সন্তানদের পড়ালেখাসহ নানা বিষয়ের অজুহাতে এখন যৌথ পরিবার তেমন দেখা যায় না। সবাই মিলেমিশে থাকাটা এখন স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে। এজন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে পরিবার দিবস উদযাপন করে।’ তিনি আরও বলেন, মুল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে সন্তানরা বৃদ্ধাশ্রমে রাখছেন। যদি যৌথ পরিবারগুলো একই ছাদের নিচে থাকতো তাহলে এই সমস্যা প্রকট হতো না। সবাই মিলেমিশে থাকার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে তা আলাদা হয়ে গেলে আর থাকে না। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যৌথ পরিবার এক থাকলে তা কতটুকু শক্তি সঞ্চার করে তা বলে শেষ করা যাবে না।’
৪৬ বছর যৌথ পরিবারে রাজশাহীর রথ বাড়ি
স্বাধীনতার পরপরই রাস বিহারী সরকারের মৃত্যু হয়। অনেক জমিজমা ও সম্পদসহ সাত ছেলের জন্য রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানা ভবনের পাশে পাঁচ কাঠা জায়গায় রেখে গেছেন একটি বাড়ি। সেই বাড়িতে ৪৬ বছর ধরে এখনও এক হাঁড়িতে পরিবারের সদস্যদের জন্য রান্না হয়। শুধু তাই নয়, পরিবারের সবার চিন্তা ও মতামতকে সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়ে থাকে। এ কারণে শহরের মধ্যে এই রথ বাড়িতে যৌথ পরিবারটি টিকে রয়েছে। কীভাবে সম্ভব হয়েছে জানতে চাইলে রথ বাড়ি পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান বিমল কুমার সরকার বলেন, ‘বাবা-মা ও বড় ভাই মারা যাওয়ার পরও আমরা সবাই একসঙ্গে থাকার মূলমন্ত্র হচ্ছে- ব্যক্তি শাসনতন্ত্র প্রথাকে এড়িয়ে চলেছি। কেউ বেশি আয় করে। আবার কেউ কম করে। এ নিয়ে কারও মধ্যে কোনও হিংসা-প্রতিহিংসা তৈরি করি না। বাড়ির বৌ’দের সেভাবে গড়ে তুলেছি। কারণ তারা তো অন্য পরিবারের সদস্য। তাদের মধ্যে আমাদের চিন্তার প্রতিফলন ঘটতে নাও পারে। সেজন্য তাদের আমরা যৌথ পরিবারের ভালো দিকগুলো তুলে ধরে আমাদের মতো করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যদি আমরা কোনোদিন দেউলিয়া না হই, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাজে প্রভাব না পড়ে তাহলে ভবিষ্যতেও এভাবেই যৌথ পরিবার নিয়ে বসবাস করে যাবো। আমাদের পরিবারে কাজের বুয়াসহ ২৫ জনের রান্না এক সঙ্গে হয়।’ বাড়ির নামকরণ ‘রথ’ রাখা হলো কেন- এমন প্রশ্নে বিমল কুমার সরকার জানান, স্বাধীনতার পর থেকে বিনা খাজনায় আমাদের পরিবার রাজশাহীতে রথমেলা করে থাকে। এজন্য বাড়ির নামটা রাখা হয়েছে রথ বাড়ি।
নগরীর আলুপট্টি এলাকার শফিউল ইসলাম বকুল জানান, দুই ছেলে ও বৃদ্ধ মাকে নিয়ে আমাদের পরিবার। দুই বোন বিদেশে থাকে। তাই সংসারটা তেমন বড় নয়। তবে বর্তমানে যৌথ পরিবারের প্রথা আবার ফিরে আসছে। কারণ সবাই এখন ব্যস্ত জীবনযাপন করছে। এতে পরিবারের সন্তানদের মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য যৌথ পরিবার ভূমিকা রাখতে পারে। স্বামী-স্ত্রী দুইজন চাকরি করেন। আর সন্তানকে কাজের লোকের কাছে রেখে যান। কিন্তু যৌথ পরিবার থাকলে সন্তান দাদি, নানি, চাচির কাছে রেখে যেতে পারতো। আবার দেখা যায়, অনেকের ছেলেমেয়ে বৃদ্ধ মা-বাবাকে ওল্ড হোমে রেখে আসেন। এটা হবে কেন? যৌথ পরিবার থাকলে এটা সম্ভব হতো না। তাই নিজেদের চিন্তা ও মতামতকে বেশি গুরুত্ব না দিয়ে আত্মত্যাগের মাধ্যমে সবাইকে নিয়ে যৌথ পরিবার টিকিয়ে রাখতে হবে। আর বর্তমান যুগে এটা খুব বড় প্রয়োজন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগেও অপরাধ প্রবণতা ছিল। কিন্তু বর্তমান সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে অপরাধ প্রবণতা বেড়েছে। বড়দের প্রতি সম্মানবোধ কমে গেছে। তাই এসব থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। লোভ-লালসা কমিয়ে ফেলতে হবে। সমাজ ও দেশের উন্নয়নে পরিবার থেকে ভালো শিক্ষা নিয়ে আগামীর জন্য সন্তানদের গড়ে তুলতে হবে।’
গোদাগাড়ী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মুশফিকুর রহমান বলেন, ‘নিজেদের চিন্তা ও মতামতকে যখন বেশি করে গুরুত্ব দেওয়া হয় তখনই যৌথ পরিবার ভেঙে যায়। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর বেড়ে যায়। আবার পেশাগত কারণেও যৌথ পরিবারে ভাঙন তৈরি হয়। এতে একে-অপরের মধ্যে সহযোগিতা, ভ্রাতৃত্ববোধ, মূল্যবোধ, নৈতিকতার অভাব হয়। বর্তমানে যৌথ পরিবারের অভাবে অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
ছয় ভাই ও চার বোনের যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছেন সহকারী অধ্যাপক মহিশাল বাড়ী এলাকার মুশফিকুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমার চাচারা ছিলেন সাতজন। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন চাচাদের ভয়ে কোন অপরাধমূলক কাজে জড়ানোর সাহস পেতাম না। তারা যদি আমার ভুল ধরে বকা দেন। আর বর্তমানে ছোট ছোট পরিবার হওয়ার কারণে ছেলেমেয়েদের মধ্যে ব্যক্তি স্বাধীনতা বেড়ে গেছে। পরিবারের ছোট সদস্যরাও এতে করে বড়দের সামনে কথা বলার ধৃষ্টতা দেখায়। এমনকি যৌথ পরিবার প্রায় বিলুপ্তির কারণে চাচাদের কাছ থেকেও এখন পরিবারের সদস্যরা সহযোগিতা পায় না।’
চট্টগ্রামের দোভাষ পরিবারে নেই আগের জৌলুস
এক সময় ফিরিঙ্গি বাজারসহ পুরো চট্টগ্রামে যাদের ছিল আধিপত্য, ঐতিহ্যবাহী সেই দোভাষ পরিবার এখন হারাতে বসছে জৌলুস। খান বাহাদুর আব্দুল হক দোভাষ ছিলেন জমিদার। তার হাত ধরেই নগরীর ফিরিঙ্গি বাজারে গড়ে উঠে ঐতিহ্যবাহী দোভাষ পরিবারের গোড়াপত্তন। পরবর্তীতে এই পরিবারের নিয়ন্ত্রণে আসে তৎকালীন চট্টগ্রাম নগরীর রাজনীতি। তার একমাত্র ছেলে ছিলেন নবী দোভাষ। আব্দুল হক দোভাষের মৃত্যুর দুই বছরের মাথায় মারা যান নবী দোভাষ। এরপরই মূলত ছোট পরিবারে রূপ নেয় দোভাষ পরিবার। বাবার মৃত্যুর পর নবী দোভাষের তিন ছেলে শাহ আলম দোভাষ, জানে আলম দোভাষ ও বদিউল আলম দোভাষ আলাদা হয়ে যান। তখন ঐতিহ্যবাহী দোভাষ পরিবার ঝিমিয়ে পড়ে। অবশ্য পরে আবার জৌলুস ফিরিয়ে আনেন জানে আলম দোভাষ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতি শুরু করেন জানে আলম দোভাষ। তার হাত ধরে জৌলুস ফিরে আসে দোভাষ পরিবারে। সোহরাওয়ার্দীর হাত ধরে রাজনীতি শুরুর পর ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন হয়ে উঠেন জানে আলম। আর তখন থেকে নগরীর রাজনীতির আঁতুড় ঘরে পরিণত হতে থাকে দোভাষ পরিবার।
জানে আলম দোভাষ মারা যাওয়ার পর দোভাষ পরিবারের সেই জৌলুস আবার কমতে শুরু করে। পরে এই পরিবারের ভাই বোনদের মাঝে সম্পদ ভাগাভাগির কারণে যৌথ পরিবার ভেঙ্গে তৈরি হয় ছোট পরিবার। জানে আলম দোভাষের বাবা নবী দোভাষের মৃত্যুর পর দোভাষ পরিবার ভেঙ্গে রূপ নেয় চারভাগে। তিন ভাই ও এক বোন আলাদা হয়ে যান। জানে আলম দোভাষ এক ছেলে ও তিন মেয়ে রেখে যান।
পরবর্তীতে জানে আলম দোভাষের পরিবার ভেঙ্গে রূপ নেয় চার পরিবারে। অন্যদিকে তার দুই ভাইয়ের একজন শাহ আলম দোভাষ রেখে যান দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ে। শাহ আলমের মৃত্যুর পর তার পরিবার ভেঙ্গে রূপ নেয় ৮ পরিবারে। জানে আলমের আরেক ভাই বদিউল আলম দোভাষ এখনও বেঁচে আছেন। তার দুই ছেলে রয়েছে। এক সময়কার দোভাষ পরিবার এখন ১৩ পরিবারে পরিণত হয়েছে।
সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত
সিলেট নগরের সাদারপাড়ার বাসিন্দা ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম চৌধুরীর পরিবারে ছয় ভাই-বোনসহ সদস্য সংখ্যা ছিল ৩৩ জন। এছাড়া কৃষিসহ গৃহস্থালি দেখাশোনার জন্য নারী-পুরুষসহ ছিলেন আরও সাতজন। নিজস্ব কৃষি জমিতে ধান চাষ করে তাতেই চলতো পুরো বছর। জমিতে চাষ হতো নানা ফসল। কিন্তু সেই যৌথ পরিবার এখন আর নেই। যৌথ পরিবারে বড় হওয়া নজরুল ইসলামরা প্রায় সাড়ে পাঁচ বছর থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। যার যার মতো করে বাসা তৈরি করে আলাদা হয়ে গেছেন। এখন সবাই যার যার সংসার নিয়ে ব্যস্ত। একই দেয়ালের ভেতরে সবাই বসবাস করলেও সাপ্তাহিক ছুটি ছাড়া একে-অন্যের সঙ্গে তেমনভাবে দেখা হয় না।
এ বিষয়ে ব্যবসায়ী নজরুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আসলে যৌথ পরিবার বড় হতে থাকলে আলাদা হওয়াটা উত্তম। এতে পরিবারের কর্তাদের উপর অনেক চাপ কমার পাশাপাশি ব্যয়ও কমে যায়। দাদা-বাবাদের রেখে যাওয়া যৌথ পরিবারটি এক রাখার নিরন্তর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু সময়ের কারণে তা সম্ভব হয়নি। তবে যৌথ পরিবারের মধ্যে থাকাটা খুবই আনন্দের যা বলে শেষ করা যায় না। স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘যৌথ পরিবারে গৃহবধূরা একসঙ্গে বড় বড় পাতিলে রান্না করতেন। সবাই একসঙ্গে বসে খাবার খাওয়াটা ছিল অসাধারণ ব্যাপার। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে এগুলো আর নেই। এসব বিষয় এখন অনেকটা স্বপ্নের মতো। এককথায় যৌথ পরিবারের মধ্যে আনন্দের মাখামাখি ছিল খুব বেশি।’
ওই পরিবারের গৃহিণী সেলিনা চৌধুরী জানান, যৌথ পরিবারের মধ্যে বসবাস করা যেমনটি আনন্দের তেমনি পরিবার যখন বড় হয়ে যায় তখন এর দায়িত্ব বহন করা এবং পরিচালনা অনেক কষ্টকর হয়ে যায়। এছাড়া যৌথ পরিবারের মধ্যে থাকতে হলে প্রথমেই পরিবারের সদস্যদের একই মন মানসিকতা থাকতে হবে। সবাইকে ছোট-বড় ভুলগুলো ছাড় দেওয়ার উদারতা থাকতে হবে। তবে যৌথ পরিবার বড় হয়ে গেলে আলাদা হওয়াটা অনেক ক্ষেত্রে উত্তম বলে মন্তব্য করেন তিনি।
সিলেট সিটি করপোরেশনের ১৯ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর এসএম শওকত আমিন তৌহিদ বলেন, ‘যৌথ পরিবার ভাঙার পেছনে নগরায়ন একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সবচেয়ে মারাত্মক কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদেশি চ্যানেলগুলো যেমন স্টার জলসা, জি বাংলা। এসব কারণেই যৌথ পরিবারগুলোর এক থাকা খুবই কষ্টকর। এসব চ্যানেল শুধু পরিবার ভাঙা দেখায় যৌথ থাকতে দেখায় না। এই চ্যানেলগুলোতে যা কিছু প্রচার করা হয় সবই পরিবারকেন্দ্রিক। এসব চ্যানেল যখন ছিল না তখন আমাদের দেশের পরিবারগুলোর মধ্যে খুবই আন্তরিকতা আর সহমর্মিতা ছিল। আমাদের দাদা-বাবারা যেভাবে যৌথ পরিবার দুঃখ দুর্দশার মধ্যে টেনে নিয়েছেন বছরের পর বছর- এখন আর সেটা নেই। সবাই যার যার স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত। মনে করেন আলাদা হলেই জীবনব্যবস্থা আরও উন্নত হবে। আমি মনে করি এটা সর্ম্পণ ভুল ধারণা।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, এখন একই পরিবারের মধ্যে বসবাস করেও কেউ কারও ভালো চায় না। সন্তানদের পড়ালেখাসহ নানা বিষয়ের অজুহাতে এখন যৌথ পরিবার তেমন দেখা যায় না। সবাই মিলেমিশে থাকাটা এখন স্বপ্নের মতো হয়ে গেছে। এজন্য জাতিসংঘ আন্তর্জাতিকভাবে পরিবার দিবস উদযাপন করে।’ তিনি আরও বলেন, মুল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণেই বৃদ্ধ মা-বাবাকে সন্তানরা বৃদ্ধাশ্রমে রাখছেন। যদি যৌথ পরিবারগুলো একই ছাদের নিচে থাকতো তাহলে এই সমস্যা প্রকট হতো না। সবাই মিলেমিশে থাকার মধ্যে যে আনন্দ রয়েছে তা আলাদা হয়ে গেলে আর থাকে না। সবাই নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যৌথ পরিবার এক থাকলে তা কতটুকু শক্তি সঞ্চার করে তা বলে শেষ করা যাবে না।’
No comments