তারা বেঁচে থাকবে শত কোটি বিবেকবানদের মনে, হাহাকার হয়ে by সামসুন নাহার মুক্তা
২৫
ফেব্রুয়ারি আজকের এই দিনে কি হয়েছিল এটা সবারই জানা। কিন্তু যাদের
পরিবারের সাথে এই ঘটনাগুলো ঘটেছিল তাদের মনের খবর ক'জন জানেন। ২০০৯ সাল
সবেমাত্র ক্লাস ৮-এ পড়ি। পিলখানার ভিতরেই। বীরশ্রেষ্ঠ আব্দুর রউফ স্কুল
এন্ড কলেজে। প্রতিবারের মতো বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে স্কুল ৩ দিনের ছুটি ছিল।
সকালে আরামের ঘুম দিচ্ছিলাম। ঘুম ভাঙলো অনেক শব্দে।
মাথার উপর আর্মিদের হেলিকপ্টার যাচ্ছে, গোলাগুলি হচ্ছে, বাসায় ফোন আসা শুরু হয়েছে। সবাই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে আমি স্কুলে কিনা।
আমি তখনো বুঝতেই পারি নাই হচ্ছে কি হচ্ছে পিলখানায়! টিভি চালু করলাম। ব্রেকিং নিউজ দেখে আমি নিজেই হতবাক! বয়স নিতান্ত কম। এতো অল্প বয়সে মাথায় এত কিছু ঢুকলো না। শুধু বুঝলাম ছাদে যাওয়া যাবেনা, বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। দুই দিন পর দেখলাম আমাদের এলাকায় ম্যানহোল থেকে আর্মিদের লাশ বের করছে। তারপর একে একে সেই লাশ বেড়িবাঁধের ওপার থেকেও বের হচ্ছে। চারদিন ধরে শুধু টিভিতে এগুলোই দেখি। টিভি চালু করলেই গলে পচে যাওয়া লাশ, মানুষের হাহাকার, কান্না দেখে খুব খারাপ লাগত তখন.... যখন দেখলাম সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এক মাস পার হয়ে গেলো তারপরও স্কুল খুলে না তখন খুব খারাপ লাগত।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ যখন দেড় মাসের মাথায় খুলে গেলো তখন মনে করলাম আমাদেরটাও খুলে যাবে কিন্তু আরো এক মাস পার হয়ে গেলো তারপরেও স্কুল খুলে না। সারাদিন বাসায় বসে থাকতাম শুধু। স্কুলে যাওয়ার জন্যে মন আকুপাকু করত। শুধু বসে বসে ভাবতাম আর যদি স্কুল না খুলে আমি কোথায় যাব, আমার ফ্রেন্ড দের সাথে কি আর দেখ করতে পারব না, মাথায় সারাদিন এইসব ঘুরঘুর করতো! স্কুলকে কতটা ভালোবাসতাম তখনই বুঝতে পারছিলাম। আমরা মনে করছিলাম আমাদের স্কুল বুঝি আর খুলবেই না, আব্বু আম্মুকে প্রতিদিনই বলতো ওকে অন্য স্কুল এ ভর্তি করিয়ে দেই। কিন্তু আম্মু বলতো আর কয়টা দিন দেখি! হঠাৎ দেখলাম ব্রেকিং নিউজ: কাল থেকে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্কুল & কলেজ এ ক্লাস শুরু হবে। পরদিন সকাল সকাল উঠে ব্যাগ নিয়ে রেডি হয়ে ৫ নং গেট এ গেলাম। কিন্তু জানলাম ওই গেট বন্ধ করে দিছে।
তারপর বিডিআর ১ নং গেট এ গেলাম। যেয়ে দেখি হাজার হাজার স্টুডেন্টস লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে ভিতরে যাওয়ার অপেক্ষায়। আমরা লাইন ধরে ভিতরে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে আমাদের ব্যাগ, টিফিন বক্স সব চেক করা হল। বিডিআর হাসপাতাল পেরোতেই দেখলাম হাসপাতালের পিছনে খালি মাঠটায় ২০-২৫ টা পোড়ানো গাড়ি। যেগুলো ওই ঘটনায় মৃত্যুবরণ করা আর্মি অফিসার দের গাড়ি ছিল। পিলখানার ভিতরে আকাশে বাতাসে শুধু নিস্তব্ধতা কাজ করত। আমাদের প্রতিদিন ব্যাগ চেক করেই ভিতর এ যেতে দিতো। আমরা সবাই পিঁপড়ের মত লাইন ধরে স্কুল যেতাম। ছুটি শেষে লাইন ধরে বের হতাম। এই রুটিন প্রায় অনেকদিন চললো।
এই পিলখানা আগের পিলখানা ছিল না। আমাদের চলাচলের রাস্তা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। আগের মতো আমরা পুকুর পাড়ে ঘুরতে পারতাম না। সকাল বেলায় আম গাছ থেকে ঢিল ছুড়ে আম পাড়তে পারতাম না। মন চাইলে রাস্তায় হাসতে হাসতে বান্ধবীদের সাথে লুটিয়ে পড়তেতে পারতাম না। সবখানে একটা সীমাহীন নিস্তব্ধতা। যেন একটা মৃত্যুপুরীতে আমরা প্রতিদিন আসি স্কুল ড্রেস পরে। আচ্ছা, ঐ আত্মাগুলো কি আমাদের দেখতে পেত? ওরা কি বুঝতে পারত, এই শিশুমনও কত ভারাক্রান্ত ছিল ওদের হাহাকারে! কত তীব্র ঘৃনা জমেছিল ঘাতকদের প্রতি।
আমরা তো পিলখানাতে আসতাম বিদ্যা অর্জন করতে। এখানে আমাদের বিদ্যালয়। আমাদের খেলার জায়গা। আমাদের আনন্দের জায়গা। রুদ্ধশ্বাসে বন্ধুদের সাথে ছুটে বেড়ানোর জায়গা। কিন্তু হায়! সব কিছু যেন এক নিমিষেই হারিয়ে গেল। কিছু ঘাতক চিরদিনের জন্য ছিনতাই করে নিল। দেশ হারালো তার সূর্য সন্তানদের। আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। বিডিয়ার থেকে বিজিবি হয়। কিন্তু এখনো সেই আগের অবস্থাতে আর পিলখানা ফিরে যেতে পারে নাই। পারবেও না কোনদিন। পিলখানা বেঁচে আছে। হারিয়ে ফেলেছে সেই সজীবতাটুকু। হারায়নি শুধু সেই চৌকস সেনা অফিসাররা। তারা বেঁচে থাকবে শত কোটি বিবেকবানদের মনে, হাহাকার হয়ে। তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: মেডিক্যাল শিক্ষার্থী
মাথার উপর আর্মিদের হেলিকপ্টার যাচ্ছে, গোলাগুলি হচ্ছে, বাসায় ফোন আসা শুরু হয়েছে। সবাই ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করছে আমি স্কুলে কিনা।
আমি তখনো বুঝতেই পারি নাই হচ্ছে কি হচ্ছে পিলখানায়! টিভি চালু করলাম। ব্রেকিং নিউজ দেখে আমি নিজেই হতবাক! বয়স নিতান্ত কম। এতো অল্প বয়সে মাথায় এত কিছু ঢুকলো না। শুধু বুঝলাম ছাদে যাওয়া যাবেনা, বাসা থেকে বের হওয়া যাবে না। দুই দিন পর দেখলাম আমাদের এলাকায় ম্যানহোল থেকে আর্মিদের লাশ বের করছে। তারপর একে একে সেই লাশ বেড়িবাঁধের ওপার থেকেও বের হচ্ছে। চারদিন ধরে শুধু টিভিতে এগুলোই দেখি। টিভি চালু করলেই গলে পচে যাওয়া লাশ, মানুষের হাহাকার, কান্না দেখে খুব খারাপ লাগত তখন.... যখন দেখলাম সপ্তাহের পর সপ্তাহ, এক মাস পার হয়ে গেলো তারপরও স্কুল খুলে না তখন খুব খারাপ লাগত।
বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ যখন দেড় মাসের মাথায় খুলে গেলো তখন মনে করলাম আমাদেরটাও খুলে যাবে কিন্তু আরো এক মাস পার হয়ে গেলো তারপরেও স্কুল খুলে না। সারাদিন বাসায় বসে থাকতাম শুধু। স্কুলে যাওয়ার জন্যে মন আকুপাকু করত। শুধু বসে বসে ভাবতাম আর যদি স্কুল না খুলে আমি কোথায় যাব, আমার ফ্রেন্ড দের সাথে কি আর দেখ করতে পারব না, মাথায় সারাদিন এইসব ঘুরঘুর করতো! স্কুলকে কতটা ভালোবাসতাম তখনই বুঝতে পারছিলাম। আমরা মনে করছিলাম আমাদের স্কুল বুঝি আর খুলবেই না, আব্বু আম্মুকে প্রতিদিনই বলতো ওকে অন্য স্কুল এ ভর্তি করিয়ে দেই। কিন্তু আম্মু বলতো আর কয়টা দিন দেখি! হঠাৎ দেখলাম ব্রেকিং নিউজ: কাল থেকে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ স্কুল & কলেজ এ ক্লাস শুরু হবে। পরদিন সকাল সকাল উঠে ব্যাগ নিয়ে রেডি হয়ে ৫ নং গেট এ গেলাম। কিন্তু জানলাম ওই গেট বন্ধ করে দিছে।
তারপর বিডিআর ১ নং গেট এ গেলাম। যেয়ে দেখি হাজার হাজার স্টুডেন্টস লাইন ধরে দাড়িয়ে আছে ভিতরে যাওয়ার অপেক্ষায়। আমরা লাইন ধরে ভিতরে যাচ্ছি। যাওয়ার আগে আমাদের ব্যাগ, টিফিন বক্স সব চেক করা হল। বিডিআর হাসপাতাল পেরোতেই দেখলাম হাসপাতালের পিছনে খালি মাঠটায় ২০-২৫ টা পোড়ানো গাড়ি। যেগুলো ওই ঘটনায় মৃত্যুবরণ করা আর্মি অফিসার দের গাড়ি ছিল। পিলখানার ভিতরে আকাশে বাতাসে শুধু নিস্তব্ধতা কাজ করত। আমাদের প্রতিদিন ব্যাগ চেক করেই ভিতর এ যেতে দিতো। আমরা সবাই পিঁপড়ের মত লাইন ধরে স্কুল যেতাম। ছুটি শেষে লাইন ধরে বের হতাম। এই রুটিন প্রায় অনেকদিন চললো।
এই পিলখানা আগের পিলখানা ছিল না। আমাদের চলাচলের রাস্তা পরিবর্তন হয়ে গিয়েছিল। আগের মতো আমরা পুকুর পাড়ে ঘুরতে পারতাম না। সকাল বেলায় আম গাছ থেকে ঢিল ছুড়ে আম পাড়তে পারতাম না। মন চাইলে রাস্তায় হাসতে হাসতে বান্ধবীদের সাথে লুটিয়ে পড়তেতে পারতাম না। সবখানে একটা সীমাহীন নিস্তব্ধতা। যেন একটা মৃত্যুপুরীতে আমরা প্রতিদিন আসি স্কুল ড্রেস পরে। আচ্ছা, ঐ আত্মাগুলো কি আমাদের দেখতে পেত? ওরা কি বুঝতে পারত, এই শিশুমনও কত ভারাক্রান্ত ছিল ওদের হাহাকারে! কত তীব্র ঘৃনা জমেছিল ঘাতকদের প্রতি।
আমরা তো পিলখানাতে আসতাম বিদ্যা অর্জন করতে। এখানে আমাদের বিদ্যালয়। আমাদের খেলার জায়গা। আমাদের আনন্দের জায়গা। রুদ্ধশ্বাসে বন্ধুদের সাথে ছুটে বেড়ানোর জায়গা। কিন্তু হায়! সব কিছু যেন এক নিমিষেই হারিয়ে গেল। কিছু ঘাতক চিরদিনের জন্য ছিনতাই করে নিল। দেশ হারালো তার সূর্য সন্তানদের। আস্তে আস্তে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যায়। বিডিয়ার থেকে বিজিবি হয়। কিন্তু এখনো সেই আগের অবস্থাতে আর পিলখানা ফিরে যেতে পারে নাই। পারবেও না কোনদিন। পিলখানা বেঁচে আছে। হারিয়ে ফেলেছে সেই সজীবতাটুকু। হারায়নি শুধু সেই চৌকস সেনা অফিসাররা। তারা বেঁচে থাকবে শত কোটি বিবেকবানদের মনে, হাহাকার হয়ে। তাদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।
লেখক: মেডিক্যাল শিক্ষার্থী
No comments