কর্তৃত্ববাদ নাকি উগ্রবাদ- কোনটি বেছে নেবে বাংলাদেশ by কে. আনিস আহমেদ
বাংলাদেশে
নির্বাচন কখনোই নিস্তেজ নয়। ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ জাতীয় সংসদ
নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি এবং ভোটের দিনে সহিংসতায় প্রায় ২০ জন নিহত
হয়েছিলেন। এর আগে ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচন উল্লেখ করার মতো।
ওই নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২০০৭ সালের জানুয়ারিতে। রাজপথের রণে দেশ অচল
হয়ে পড়ে। ফলে সেনা সমর্থিত অভ্যুত্থান ঘটে। তাতে ২০০৭ সালে নির্ধারিত ওই
নির্বাচন স্থগিত হয়।
আগামী রোববার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
এই নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও প্রধান দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতা দেখা দিয়েছে। অতীতের তুলনায় হতাহতের সংখ্যা এখনও খুব কম। কিন্তু এই নির্বাচনী লড়াইয়ের উত্তাপ কোনো অংশেই কম নয়। বস্তুতপক্ষে এই নির্বাচন হচ্ছে কর্তৃত্বপরায়ণ দুটি আদর্শের লড়াই। তার মধ্যে একপক্ষের চেয়ে অন্যপক্ষ অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
বিশ্বে সর্ববৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। বড় বড় খাতে দেশটি ভাল করেছে। কয়েক বছর ধরে এখানে অর্থনৈতিক গড় প্রবৃদ্ধি শতকরা প্রায় ৭ ভাগ। লিঙ্গ সমতা ও শিশুদের স্কুলে পাঠানোর মতো উন্নয়নসূচকে বৃহত্তর প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভাল করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে ক্রমাগত মৌলিক অধিকার ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের আবির্ভাবের পর থেকে দেশ শাসনে পর্যায়ক্রমে এসেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। উন্নয়নের রেকর্ড ও ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে ব্যবহার করে আবার ক্ষমতায় ফেরার আশা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। (ঘোষণা: আমার এক ভাই জাতীয় সংসদের সদস্য এবং দলীয় টিকেটে নির্বাচনে লড়াই করছে)। কিন্তু দলটি এক দশক এবং পরপর দু’বার ক্ষমতায় থাকার পরও ক্ষমতাসীন-বিরোধী মারাত্মক ভাবাবেগের মুখে পড়েছে তারা। এ বছরের শুরুতে কড়া হাতে ছাত্রবিক্ষোভ দমন করেছে দলটি। ভিন্নমতকে দমন করেছে। আর এসবই ওই উদ্বেগকে তীব্র থেকে তীব্র করেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা, গ্রেপ্তার এমন কি বিচারবহির্ভূত গুম ও হত্যাকা-ের মাধ্যমে ২০০৯ সাল থেকে বিরোধীদের ধ্বংস করে দিয়েছে তারা। আওয়ামী লীগকে যদি টানা তৃতীয় মেয়াদে অনুমোদন দেয়া হয়, তাহলে তাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ভয়াবহভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। এতে কেউ কেউ বিস্মিত হতে পারেন। তবে কি বিএনপিকে আরেকটি সুযোগ দেয়ার সময় এখন?
ধর্মীয় উগ্রতাকে পুঁজি করার অন্ধকার রেকর্ড আছে বিএনপির। দীর্ঘদিন তারা সহিংসতায় লিপ্ত ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মিত্রতায় রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শেষ মেয়াদে ইসলামপন্থিদের বোমাবাজি বহুগুন বেড়ে যায়। ২০০৪ সালে দলটির সঙ্গে যোগসূত্র থাকা উগ্রবাদীরা আওয়ামী লীগের এক র্যালিতে হামলা চালায় গ্রেনেড দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। (এতে কমপক্ষে ২০ জন মানুষ নিহত হন। আহত হন কয়েক শত)। পরের বছরেই আওয়ামী লীগের সাবেক এক অর্থমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ এবং হরকাতুল জিহাদ আল বাংলাদেশের মতো সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বিস্তার ঘটে।
এ কথা সত্য যে, রাজপথের আন্দোলন ও হরতালের (শাটডাউন) আশ্রয় নিয়েছে আওয়ামী লীগও, বিশেষ করে যখন বিএনপি ক্ষমতা থেকে সরে যেতে অস্বীকার করছিল। ওই সব কর্মসূচির অনেকটা সহিংস সংঘাতে রূপ নিয়েছে অনেক সময়। তবে তাতে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সাধারণ নাগরিককে টার্গেট করা হয় নি। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। আহত করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বাসে পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়েছে। তারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও বিশৃংখলার মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি বিরোধী দলীয় জোট- জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন ৮২ বছর বয়সী বিখ্যাত আইনজীবী ও আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। ওই জোটে যোগ দেয়ার পর বিএনপি দৃশ্যত সম্প্রতি দায়িত্বশীলের মতো কথা বলছে। এ দলটির জন্য একটি অসম্ভাব্য অংশীদার ড. কামাল হোসেন। কারণ, তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের খসড়া করেছিলেন এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি যদি বিএনপির সঙ্গে যোগ দেন তাতে হয়তো দলটির মেজাজ বা মর্যাদা বাড়তে পারে। কিন্তু এতে তিনি নিজে বিজয়ী নাও হতে পারেন। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ২৫ আসনে মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। তাই এটা বিশ্বাস করার সামান্যই কারণ আছে যে, বিএনপির ন্যক্কারজনক প্রবণতা পরিবর্তন হয়েছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট অর্থনীতিতে সুবিধা করতে পারবে এমনটা বিশ্বাস করারও কোন কারণ নেই বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু একটি উদাহরণ: বিগত মেয়াদে বিএনপি দেশের বিদ্যুত উৎপাদন একেবারে নগন্য মাত্রায় নামিয়ে আনে। গত এক দশকে আওয়ামী লীগ তা তিনগুন বৃদ্ধি করেছে। এ সপ্তাহের শেষে ভোটারদেরকে অবশ্যই যে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে তাহলো, শুধুই কি পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন গণতন্ত্রের জন্য শুভ হবে? রোববার বাংলাদেশের ভোটারদেরকে দুটি অত্যন্ত অসম্পূর্ণ অপশনের মুখে একটিকে বেছে নিতে হবে। যদিও সেই পছন্দ কি হবে তা পরিস্কার।
(কে আনিস আহমেদ বাংলাদেশী লেখক ও ঢাকা ট্রিবিউনের প্রকাশক। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসে)
আগামী রোববার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন।
এই নির্বাচনকে সামনে রেখে আবারও প্রধান দুই দল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী বিএনপির সমর্থকদের মধ্যে সহিংসতা দেখা দিয়েছে। অতীতের তুলনায় হতাহতের সংখ্যা এখনও খুব কম। কিন্তু এই নির্বাচনী লড়াইয়ের উত্তাপ কোনো অংশেই কম নয়। বস্তুতপক্ষে এই নির্বাচন হচ্ছে কর্তৃত্বপরায়ণ দুটি আদর্শের লড়াই। তার মধ্যে একপক্ষের চেয়ে অন্যপক্ষ অনেক বেশি ভয়ঙ্কর।
বিশ্বে সর্ববৃহৎ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ। বড় বড় খাতে দেশটি ভাল করেছে। কয়েক বছর ধরে এখানে অর্থনৈতিক গড় প্রবৃদ্ধি শতকরা প্রায় ৭ ভাগ। লিঙ্গ সমতা ও শিশুদের স্কুলে পাঠানোর মতো উন্নয়নসূচকে বৃহত্তর প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে ভাল করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে ক্রমাগত মৌলিক অধিকার ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
১৯৯১ সালে গণতন্ত্রের আবির্ভাবের পর থেকে দেশ শাসনে পর্যায়ক্রমে এসেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। উন্নয়নের রেকর্ড ও ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থানকে ব্যবহার করে আবার ক্ষমতায় ফেরার আশা করছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। (ঘোষণা: আমার এক ভাই জাতীয় সংসদের সদস্য এবং দলীয় টিকেটে নির্বাচনে লড়াই করছে)। কিন্তু দলটি এক দশক এবং পরপর দু’বার ক্ষমতায় থাকার পরও ক্ষমতাসীন-বিরোধী মারাত্মক ভাবাবেগের মুখে পড়েছে তারা। এ বছরের শুরুতে কড়া হাতে ছাত্রবিক্ষোভ দমন করেছে দলটি। ভিন্নমতকে দমন করেছে। আর এসবই ওই উদ্বেগকে তীব্র থেকে তীব্র করেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলা, গ্রেপ্তার এমন কি বিচারবহির্ভূত গুম ও হত্যাকা-ের মাধ্যমে ২০০৯ সাল থেকে বিরোধীদের ধ্বংস করে দিয়েছে তারা। আওয়ামী লীগকে যদি টানা তৃতীয় মেয়াদে অনুমোদন দেয়া হয়, তাহলে তাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ভয়াবহভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে। এতে কেউ কেউ বিস্মিত হতে পারেন। তবে কি বিএনপিকে আরেকটি সুযোগ দেয়ার সময় এখন?
ধর্মীয় উগ্রতাকে পুঁজি করার অন্ধকার রেকর্ড আছে বিএনপির। দীর্ঘদিন তারা সহিংসতায় লিপ্ত ইসলামপন্থি দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে মিত্রতায় রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিএনপির শেষ মেয়াদে ইসলামপন্থিদের বোমাবাজি বহুগুন বেড়ে যায়। ২০০৪ সালে দলটির সঙ্গে যোগসূত্র থাকা উগ্রবাদীরা আওয়ামী লীগের এক র্যালিতে হামলা চালায় গ্রেনেড দিয়ে। উদ্দেশ্য ছিল তখনকার বিরোধী দলীয় নেত্রী, বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করা। (এতে কমপক্ষে ২০ জন মানুষ নিহত হন। আহত হন কয়েক শত)। পরের বছরেই আওয়ামী লীগের সাবেক এক অর্থমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে। বিএনপির রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ এবং হরকাতুল জিহাদ আল বাংলাদেশের মতো সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর বিস্তার ঘটে।
এ কথা সত্য যে, রাজপথের আন্দোলন ও হরতালের (শাটডাউন) আশ্রয় নিয়েছে আওয়ামী লীগও, বিশেষ করে যখন বিএনপি ক্ষমতা থেকে সরে যেতে অস্বীকার করছিল। ওই সব কর্মসূচির অনেকটা সহিংস সংঘাতে রূপ নিয়েছে অনেক সময়। তবে তাতে ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো সাধারণ নাগরিককে টার্গেট করা হয় নি। অন্যদিকে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করেছে। আহত করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বাসে পেট্রোল বোমা হামলা চালিয়েছে। তারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ও বিশৃংখলার মাধ্যমে সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছিল।
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে একটি বিরোধী দলীয় জোট- জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করেছেন ৮২ বছর বয়সী বিখ্যাত আইনজীবী ও আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী ড. কামাল হোসেন। ওই জোটে যোগ দেয়ার পর বিএনপি দৃশ্যত সম্প্রতি দায়িত্বশীলের মতো কথা বলছে। এ দলটির জন্য একটি অসম্ভাব্য অংশীদার ড. কামাল হোসেন। কারণ, তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের খসড়া করেছিলেন এবং জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি যদি বিএনপির সঙ্গে যোগ দেন তাতে হয়তো দলটির মেজাজ বা মর্যাদা বাড়তে পারে। কিন্তু এতে তিনি নিজে বিজয়ী নাও হতে পারেন। জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের ২৫ আসনে মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। তাই এটা বিশ্বাস করার সামান্যই কারণ আছে যে, বিএনপির ন্যক্কারজনক প্রবণতা পরিবর্তন হয়েছে।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট অর্থনীতিতে সুবিধা করতে পারবে এমনটা বিশ্বাস করারও কোন কারণ নেই বলা যেতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু একটি উদাহরণ: বিগত মেয়াদে বিএনপি দেশের বিদ্যুত উৎপাদন একেবারে নগন্য মাত্রায় নামিয়ে আনে। গত এক দশকে আওয়ামী লীগ তা তিনগুন বৃদ্ধি করেছে। এ সপ্তাহের শেষে ভোটারদেরকে অবশ্যই যে প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে তাহলো, শুধুই কি পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন গণতন্ত্রের জন্য শুভ হবে? রোববার বাংলাদেশের ভোটারদেরকে দুটি অত্যন্ত অসম্পূর্ণ অপশনের মুখে একটিকে বেছে নিতে হবে। যদিও সেই পছন্দ কি হবে তা পরিস্কার।
(কে আনিস আহমেদ বাংলাদেশী লেখক ও ঢাকা ট্রিবিউনের প্রকাশক। তার এ লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে নিউ ইয়র্ক টাইমসে)
No comments