সিইসি’র সামর্থ্য: নানা প্রশ্ন
পুলিশের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি কী, সেই বিষয়ে তার একটি মন্তব্য রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে বেশ আলোচিত হচ্ছে।
১৫ ডিসেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘ড. কামালের বিষয়টি দুঃখজনক। তিনি একজন সিনিয়র সিটিজেন (জ্যেষ্ঠ নাগরিক) এবং প্রখ্যাত লোক। এটি কাম্য নয়। তাঁর ওপর হামলার ঘটনায় ফৌজদারি অপরাধ হয়েছে। যেভাবে ব্যবস্থা হয়, সেটা হবে। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাঁরাও একটি আবেদন করেছেন। আমরা নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাছে বিষয়টি পাঠাব।
তারা যেভাবে রিপোর্ট দেবে, সেভাবে ব্যবস্থা নেব।’
সিইসি নিজেই জাতিকে জানাচ্ছেন, “হামলা একটি ফৌজদারি অপরাধ।” আর হামলাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি একটি ‘আবেদন’ করেছেন। অনেক পর্যবেক্ষক বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, সিইসি কেন এতটা বিনয়ী? তার এই বিনয় সার্বিক বিচারে মাঠ সমতল করতে ইসি’র দায়দায়িত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ৯টার ড. কামাল হোসেনের ওপর হামলা হয়। এতে জেএসডি’র সভাপতি আ স ম আবদুর রবের গাড়িচালকসহ প্রায় ৩০ জন আহত হন। পরের দিন এ নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে বলেন সিইসি।
উল্লেখ্য, আইনে ছিল নির্বাচনের তফসিল জারির দিন থেকে বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিটি কাজ করবে। অথচ এই কমিটি গঠনের জন্য ইসি সরকারকে চিঠি দেন তফসিল ঘোষণার এক সপ্তাহ পরে। এরপর সেটি গঠিত হতে আরো এক সপ্তাহের বেশি সময় লাগে। এরপর যখন কমিটি কাজ শুরু করল, তখন এ পর্যন্ত একদিন তিনি কমিটির অকার্যকরতা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলেন।
এখন জানা গেল, তিনি ড. কামাল হোসেনের ওপর হামলার বিষয়ে একটি আবেদন করেছেন এবং নির্বাচনী তদন্ত কমিটিকে দিয়ে তদন্ত করাবেন।
আইন বিশেষজ্ঞদের অনেকে অবশ্য বেশ একটা পুলক অনুভব করছেন। কারণ নির্বাচনী তদন্ত কমিটির কাজ হলো আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ খতিয়ে দেখা। নির্বাহী হাকিমদের ক্ষমতা আবার যুগ্ম জেলা জজের নেতৃত্বাধীন কমিটির চেয়ে বেশি। কারণ তারা সামারি ট্রায়াল বা সংক্ষিপ্ত বিচার করে তাৎক্ষণিক শাস্তি দিতে পারেন। জজ সাহেবরা পারেন না। আচরণবিধি লঙ্ঘন করলে অনধিক ৬ মাস জেল ও অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা। এটা হলো বিধি লঙ্ঘন। কিন্তু ড. কামাল হোসেনসহ আরো যাদের ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, সেগুলো তো দ-নীয় অপরাধ। এটা তো আচরণবিধি লঙ্ঘনের চেয়ে আরো মারাত্মক অপরাধ।
কিন্তু সচেতন মহল বলছেন, ড. কামাল হোসেনের ওপর হামলার বিষয়ে সিইসি গতকাল আইজিপিকে একটি চিঠি দিয়েছেন, এটা আপাতদৃষ্টিতে একটি ভালো কাজ। সরকারি দল ও তার মিত্ররা উঠতে বসতে তার শাপান্ত করছে, তার নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টকে শুরুতে সরকার প্রধান অভিবাদন জানিয়েছিল, সেটা তারা ভুলে গেছে। সেখানে সিইসির চিঠি একটি অগ্রগতি। কিন্তু ড. কামাল হোসেন নিজে তার ওপর হামলার জন্য ব্যক্তিগতভাবেই উদ্বিগ্ন, সেটা তো সত্য নয়। অনেকের মতে, সিইসি’র উদ্যাগে একটি গ্যালারি শোয়ের বিষয় নাকচ করা যাবে না। কারণ সিইসি হয়তো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্বেগ বিবেচনায় নিয়েছেন। এই বিষয়ে তাকে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। সুতরাং তার একটি হোমওয়ার্ক করা থাকল। কিন্তু জ্বলন্ত প্রশ্ন দাঁড়ালো কি দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করতে চলেছেন?
ড. কামাল হোসেনের এজাহারে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করা হয়নি। বলা হয়েছে, মামলায় আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের ১৪ জন নেতা-কর্মীকে আসামি করেছেন। তাহলে প্রশ্ন হলো সিইসি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে কি বার্তা দিলেন?
সন্ত্রাসী হামলা যে নির্বাচন পূর্ব কোনো অনিয়ম নয়, সেটা কি তার অজানা ছিল? আবার ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে গতকাল তিনি সম্ভবত তার ভুল বুঝতে পেরেছেন। সে কারণে তিনদিনের মধ্যে তদন্তের ফল জানতে চেয়েছেন। সন্ত্রাসী হামলার ৭২ ঘণ্টা পরে চিঠি দিলেন আইজিপিকে।
এখনও এই প্রশ্ন থাকল, একই বিষয়ে আইজিপি’র চিঠি কি তিনি বিচারবিভাগীয় তদন্ত কিমিটিকে দেবেন নাকি দেবেন না?
অবশ্য এই ঘটনা একটি মাইলফলক তৈরি করেছে। ড. কামাল হোসেনের গাড়িবহরে হামলার পর যদি ৭২ ঘণ্টা লাগে চিঠি লিখতে, তাহলে সারা দেশে ঐক্যফ্রন্টের শত শত কর্মী যেভাবে দৌড়ের ওপর আছে, তাদের কি হবে? ৩০শে ডিসেম্বর নির্বাচনী এজন্ট পাওয়া যাবে কি না, সেটা হালকা প্রশ্ন নয়।
ড. কামাল হোসেন গতকাল ইসি’র সঙ্গে সভায় অভিযোগ করেছেন, ১০ই ডিসেম্বর থেকে তাঁদের জোটের নেতাকর্মীদের ওপর হয়রানির মাত্রা বেড়ে গেছে। এই আটদিনে ঐক্যফ্রন্টের বিরুদ্ধে ৯৫টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় তাঁদের ২ হাজার ২৪১ জন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ইসিকে জানানো হয়, প্রতীক বরাদ্দের পর তাঁদের ২৪ নেতাকর্মী দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্যাতিত হয়েছেন এবং ৪ জন মারা গেছেন।
উল্লেখ্য, সিইসি এর আগে প্রতীক বরাদ্দের পরে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দু’জন নিহত হওয়ার পরে ২০১৪ সালের আলোকে কৌশল নিতে পুলিশকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল নবনিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মি. মিলারের সঙ্গে আলোচনায় বলেছেন, দলের দু’জন নিহত হওয়ার পরে তিনি তার দলীয় নেতা-কর্মীদের ধৈর্য্য ধারণ করতে বলেছেন। খবরে বলা হয়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত নির্বাচনী প্রচারে হামলা হচ্ছে বলে বিরোধী রাজনৈতিক দলের অভিযোগের প্রসঙ্গটি তুললে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সন্ত্রাসের শিকার হয়ে আমার দলের দু’জন কর্মী প্রাণ হারিয়েছেন। দলীয় নেতা-কর্মীদের ধৈর্য ধরতে বলেছি।’ কেউ কেউ বলছেন, সিইসি নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিতে চাইলে বিরোধীদলীয় নেতা কর্মীদের ওপর হামলা এবং সিনিয়র নেতাদের গাড়িবহরে হামলার বিষয়ে তার অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।
প্রতীক বরাদ্দের পর প্রতিদিন বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা মার খাচ্ছে, নারী প্রার্থী রাবার বুলেট বিদ্ধ (ইকবাল মাহমুদ টুকুর স্ত্রী) হয়েছেন। আর দেশের উল্লেখযোগ্য স্থানে সম্ভাব্য সংঘাত এড়াতে ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় লো-প্রোফাইল বজায় রাখছে। বহু এলাকায় ধানের শীষের পোস্টার ও প্রচারণা একেবারেই চোখে পড়ে না। কিন্তু এসব রূঢ় বাস্তবতা সত্ত্বেও সিইসি ঘোষণা দিয়েছন যে, মাঠসমতল হওয়ার বিষয়ে বিরাট উন্নতি হয়েছে। তিনি সন্তোষ ব্যক্ত করেছেন।
এদিকে নির্বাচন কমিশন যাদের মনোনায়ন টিকেছিলো এবং যে জন্য বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইসিকে তার ‘ন্যায়ানুগ’ ভূমিকার জন্য ধন্যবাদ দিয়েছিলেন, কিন্তু গত কয়কেদিনে তাদের অনেকেই প্রার্থিতা হারিয়েছেন। কিন্তু সেগুলো যাতে টিকে থাকে. সে বিষয়ে ইসিকে তার আইনি লড়াইয়ে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। গতকালও তিনজন উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান তাদের প্রার্থিতা হারালেন। কিন্তু সচেতন পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ইসিকে আমরা উদ্বিগ্ন হতে দেখিনি।
সিইসি এর আগে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, গায়েবি মামলায় কারো গ্রেপ্তার তারা নিয়ন্ত্রণ করবেন। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, অবস্থার অবনতি ঘটছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এখন ইসি’র অধীনে সেটা কার্যকরভাবে প্রমাণের সুযোগ থাকলেও সিইসি তা এড়িয়ে চলছেন।
গত বছর ২৪শে জুলাই নির্বাচনের রোডম্যাপ দিতে গিয়ে সিইসি বলেছিলেন, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব।
No comments