আরবের মোহনীয় মরুভূমিতে একদিন by রবিউল ইসলাম
শুনেছি আরব মানেই মরুভূমি। কিন্তু ইট-পাথরের দুবাইয়ে মরুভূমির দেখা মেলা
ভার। মরুর বালি দেখতে যেতে হয় শহর থেকে খানিকটা দূরে। আরব দেশে এসে
মরুভূমি দেখতে না পারার অতৃপ্তি নিয়ে দেশে ফিরতে চাইনি। তাছাড়া
মধ্যপ্রাচ্যের মতো অপার্থিব সুন্দর মরুভূমি নেই আর কোথাও। দুবাইয়ের অন্যতম
পর্যটন আকর্ষণ রোমাঞ্চকর মরু সাফারি। এই অভিজ্ঞতা নেওয়ার সুযোগ হাতছাড়া করা
বোকামি!
এশিয়া কাপের কঠিন সূচির মধ্যেই ১৯ সেপ্টেম্বর বিকাল ৩টায় মরু সাফারি
ঘুরে আসার ইচ্ছেপূরণ হলো। সেই হিসাবে প্রায় মাস দুয়েক পেরিয়ে গেছে। স্মৃতির
পাতাতেও ধুলো জমেছে কিছুটা। ধুলো জমা টুকরো স্মৃতি থেকেই এই গল্প।
আমাদের
এই মরুযাত্রাকে সাহেবি ইংলিশে বলা হয় ‘ডেজার্ট সাফারি’। ডেজার্ট বা
‘মরুভূমি’র সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয় ওয়েস্টার্ন কিংবা আরব্য উপন্যাস পড়ার
সুবাদে। জীবনে এবারই প্রথম নিজের চোখে দেখে মুগ্ধ হলাম। এই ভালোলাগা কেবল
চোখে নয়, হৃদয় দিয়েও অনুভব করার মতো।
ডেজার্ট সাফারিতে যেতে বিভিন্ন ট্যুর অপারেটরের প্যাকেজ থাকে। আমি ১২০
দিরহামের প্যাকেজ নিয়েছি। এই প্যাকেজ ট্যুরের মধ্যে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত
(এসি) গাড়িতে যাওয়া-আসা, বারবিকিউ ডিনার, কোমল পানীয়, উটের পিঠে চড়া,
মেহেদি লাগানো, বেলি ড্যান্স দেখাসহ আরও কিছু সুবিধা অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের
প্যাকেজের দাম আরও বেশি। কিন্তু অফ-সিজন বলে কিছুটা কমমূল্যে এই প্যাকেজ
পেয়েছি। অন্য সময়ে একই প্যাকেজের জন্য ১৫০ থেকে ৩০০ দিরহাম পর্যন্ত গুনতে
হতে পারে।
মরুযাত্রার
দিন স্থানীয় সময় বিকাল তিনটায় হোটেলের সামনে সাদা রঙের ল্যান্ড ক্রুজার
গাড়ি হাজির। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিলাসবহুল গাড়িতে চেপে ডেজার্ট সাফারির
উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। দুবাই শহর পেরিয়ে আল আইন যাওয়ার পথ ধরে মরুভূমির দিকে
প্রায় ১২০ কিলোমিটার বেগে এগিয়ে চলছে গাড়ি। বাইরে তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রির
মতো। যদিও এসি গাড়িতে বসে বাইরের তাপমাত্রা বোঝার উপায় নেই। চালকের পাশের
আসনে জায়গা পেয়েছিলাম বলে চারপাশের সৌন্দর্য ভালোভাবে দেখতে পেরেছি।
মরুভূমির মাঝ দিয়ে সুন্দর প্রশস্ত রাস্তা। বিস্তৃত এলাকাজুড়ে সোনালি
বালুরাশি। দেখতে অনেকটা অসমতল উঁচু-নিচু পাহাড়ের মতো।
আমরা
বিকাল চারটা নাগাদ জেবেল আল সাহারা নামের সুপার মার্কেটে এসে থামলাম। এখান
থেকেই আমাদের বালির পাহাড়ের রাজ্যে ঢুকতে হবে। এখানে আমাদের মতো আরও
বেশকিছু জিপে চড়ে যাত্রীরা যাত্রা শুরুর জন্য অপেক্ষা করছেন। প্রায় আধঘণ্টা
আমাদের এখানে অবস্থান করতে হলো। খেজুর বাগানে সময়টা কাটাতে বেশ ভালোই
লাগছিল। এর মধ্যে সেখানে দুটি উট বাঁধা অবস্থায় দেখলাম।
এই
ছোট্ট বিরতিতে কেউ চাইলে কিছু দিরহাম খরচ করে কোয়াড বাইক নিয়ে বেড়িয়ে আসতে
পারেন। সেই সঙ্গে অ্যারাবিক পোশাকেও নিজেকে সাজিয়ে নেওয়া যাবে। অবশ্যই
এজন্য বাড়তি কিছু পয়সা খরচ করতে হবে।
সুপার মার্কেটের এককোণে এসে চালক জিপের চাকার পাম্প কিছুটা কমিয়ে নিলেন।
মরুভূমির বালিতে গাড়ি ওঠানামার জন্য গাড়ির চাকার পাম্প কমিয়ে নেওয়া খুবই
প্রয়োজন। গাড়িতে উঠে আমরা সবাই সিটবেল্ট ভালোভাবে বেঁধে নিলাম। পড়ন্ত বেলায়
গাড়ি মরুভূমির বালির মধ্য দিয়ে দ্রুতগতিতে এগিয়ে চললো।
এখানে
গাড়ি ধীরে চালানোর কোনও উপায় নেই। সাগরের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দেওয়ার সময় যেমন
জাহাজ লাফিয়ে ওঠে, তেমনি মরুভূমির ধুধু বালুচর পেরিয়ে যেতে ল্যান্ড
ক্রুজার গাড়িগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে এগোতে লাগলো। মরুময় এলাকাজুড়ে পাহাড়ের মতো
উঁচু-নিচু বালির স্তুপ। উঁচু থেকে নিচুতে আবার নিচের দিক থেকে ওপরে দ্রুত
বেগে ছুটতে থাকা সামনের গাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছিলো, বালির সঙ্গে যুদ্ধ
চলছে!
ভড়কে
গিয়ে ভাবছিলাম, এই বুঝি গাড়ি কাত হয়ে উল্টে যাবে! কিন্তু দক্ষ হাতে চালক
গাড়িকে রাখলেন নিয়ন্ত্রণেই। এই সময়ে মনে হচ্ছিল, যেন রোলার কোস্টারে উঠে
পড়েছি। ভয়, আনন্দ আর উত্তেজনায় গাড়িতে বসে চিৎকার করছিলাম সবাই। গাড়িচালক
পাকিস্তানের নাগরিক, বেশ আমুদে প্রকৃতির। তিনি গাড়িতে ফুল ভলিউমে চালিয়ে
দিলেন অ্যারাবিক গান। তাতে যেন আমরা রূপকথার ভুবনে হারিয়ে গেলাম!
কয়েক
মাইল এভাবে চলার পর পৌঁছালাম ডেজার্ট সাফারিতে। সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ে গিয়ে
চালক গাড়ি থামালেন। সেখানে আরও বেশকিছু যাত্রী জিপ গাড়ি থেকে নেমে বৈকালিক
মরুভূমির দৃশ্য উপভোগের পাশাপাশি ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আমরাও গাড়ি
থেকে নামলাম। যে গল্প এতদিন শুনে এসেছি, নিজ চোখে তা দেখছি। চারদিকে ধুধু
প্রান্তর, চিকচিকে লাল বালি। আমাদের ভাগ্য ভালো সেদিন মরুঝড় হয়নি। তবে
প্রচণ্ড বাতাসে উষ্ণ বালি উড়ে এসে পড়ছিল গায়ে। সেদিকে মন না দিয়ে চারদিকে
দিগন্ত বিস্তৃত মরুভূমিকে উপভোগ করলাম।
ডেজার্ট
সাফারিতে ১০ মিনিট অবস্থানের কথা ছিল। কিন্তু বৈকালিক মরুদৃশ্যে এসে কারই
বা মনে থাকে সেটা! পরে আমাদের অনুরোধে চালক বাড়তি ১০ মিনিট থাকার সুযোগ করে
দিলেন। সময়টা এত বেশি উপভোগ্য ছিল যে, কিছুতেই ফিরে যেতে ইচ্ছে করছিল না!
তবুও আরেক গন্তব্যের উদ্দেশে সাফারিকে বিদায় জানাতে হলো।
পরবর্তী
গন্তব্য জান্নাত ট্যুরস নামের একটি মরু রেস্তোরাঁ। মরুভূমি থেকে বেরিয়ে
এসে সহজ পথেই সেখানে পৌঁছালাম। তাও সন্ধ্যা নামার আগে। ভাগ্য সহায় ছিল বলেই
মরুভূমির ‘জাহাজ’খ্যাত উটের পিঠে চড়ার সৌভাগ্য হলো। সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে
না পারলে সেই সুযোগ হারাতে হতো। সেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত হতে হয়নি। মরুর বুকে
উটের পিঠে বসে সূর্যাস্ত দেখার অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম। এ সময় আকাশ যেন
অদ্ভুত এক রূপ নেয়।
উটের
পিঠে চড়া শেষ হতেই আমাদের দলে থাকা একদল নারী হাতে মেহেদী লাগানোর খোঁজ
করতে লাগলেন। একটু এগিয়ে যেতেই বিশাল জায়গাজুড়ে প্যান্ডেল চোখে পড়লো।
সেখানে ঢুকেই দেখি হালকা খাবার দেওয়া হচ্ছে। ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, ড্রিঙ্কসসহ
বেশকিছু আইটেম নিয়ে নাশতা সারলাম।
প্যান্ডেল ছাড়াও এখানে বিভিন্ন ধরনের দোকান বসানো হয়েছে। এর মধ্যে আছে
কফি শপ ও জুস বার। ঠাণ্ডা পানীয় ও কোল্ড ড্রিঙ্কসের পসরা নিয়েও বসেছে
আরবরা। অবশ্য আমাদের প্যাকেজে কফি, ঠাণ্ডা পানি ও কোল্ড ড্রিঙ্কস ছিল
বিনামূল্যে। তবে হট ড্রিঙ্কস পেতে কিছু দিরহাম খরচ করতে হবে। পুরো আরব ঘুরে
এখানেই সবচেয়ে সস্তায় হট ড্রিঙ্কস পান করতে পারেন পর্যটকরা। এছাড়া আছে
আরবীয় কায়দায় সীসা (হুক্কা) পান করার ব্যবস্থা।
ক্যাম্পের
মাঝখানে মঞ্চ। চারপাশে আরবীয় কায়দায় বসার ব্যবস্থা। বিছানা-বালিশ ও
বালিশের সমান উচ্চতার প্রশস্ত টেবিল রাখা। সবার সামনের সারিতে আরবীয় কায়দায়
আসন নিলাম। রাত্রিকালীন আঁধারের মনোমুগ্ধতা আর মনমাতানো নাচ-গানের উৎসব
চলছে। আমরা দলবেঁধে মঞ্চের পাশে উল্লাসে মাতলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হলো
তানুরা ড্যান্স। ঘড়ির কাঁটার উল্টো দিকে টানা ঘুরতে থাকেন নৃত্যশিল্পী।
চলছে তার বিভিন্ন কসরত। তার পোশাক রঙ-বেরঙের। এই নাচের সময় বন্ধ হয়ে যায়
মঞ্চের বাতি। অন্ধকারে পোশাকের লাইট নৃত্যশিল্পীর ঘূর্ণনের সঙ্গে চমৎকার
আলোর নকশা তৈরি করে।
খানিক
বিরতি দিয়ে বুফে ডিনার পরিবেশন করা হলো। বারবিকিউ, রুটি, রাইস, চাওমিন ও
অন্যান্য কারি। খাবার নিয়ে আবারও ফিরে এলাম মঞ্চের কাছে। শুরু হলো ফায়ার
ড্যান্স। দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে সবাইকে মাতিয়ে গেলেন এক তরুণ।
খাওয়া বাদ দিয়ে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তার কসরত দেখছিলাম আমরা।
ডেজার্ট সাফারির প্রধান আকর্ষণ বেলি ড্যান্সের ঘোষণা আসতেই সবার
সম্মিলিত হর্ষধ্বনি শোনা গেলো। আগে কেবল ইউটিউবে দেখলেও এবার চোখের সামনে
নৃত্যশিল্পীদের কসরত দেখলাম। ভীষণ দৃষ্টিনন্দন নৃত্যকৌশল। চোখ ফেরানো যায়
না। অ্যারাবিক সুরের ঝঙ্কারে শিল্পীরা যেন হাওয়ায় ভেসে ভেসে নাচেন। গানের
তালে তালে অপূর্ব ভঙ্গিমায় দুই হাত দু’দিকে প্রসারিত করে প্রজাপতির মতো
তাদের নাচ সত্যিই মোহনীয়।
নাচ
উপভোগ শেষে রাত সাড়ে ৮টায় রওনা হয়ে দেড় ঘণ্টা পর হোটেলে ফিরলাম। মরুভূমি
নিয়ে আমার অনেক কৌতূহল ছিল। সব কৌতূহল যেন মিটলো। ডেজার্ট সাফারি দেখতে ১২০
দিরহাম খরচ করতে গিয়ে কষ্ট হচ্ছিল। মনে মনে ভাবছিলাম, কতগুলো টাকা জলে
যাচ্ছে! কিন্তু ট্যুর শেষে ওই টাকাকে মনে হলো খুবই নগন্য।
No comments