বাংলাদেশে এবার নতুন রাজনৈতিক সংকট by ড. আলী রীয়াজ
বাংলাদেশ
এখন এমন এক রাজনৈতিক সংকট মোকাবেলা করছে যে সংকট অতীতের যে কোন ধরণের
সংকটের চেয়ে ভিন্ন এবং গভীর। এই নিবন্ধে সেই সংকটের গভীরতা ব্যাখা করা
হয়েছে এবং বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা চিহ্নিত করার জন্য চারটি
বিষয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়েছে; সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশে বিরাজমান শাসনের
রূপ, বাংলাদেশের সমাজে নতুন শ্রেণী বিন্যাসের প্রতিক্রিয়া, সমাজ ও
রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের প্রভাব এবং ভারতের ভূমিকা। বাংলাদেশের বিরাজমান
শাসন ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দৃশ্যত গণতান্ত্রিক উপাদানের পাশাপাশি
শক্তিশালী কর্তৃত্ববাদী প্রবণতার উপস্থিতি এবং শাসন পরিচালনার জন্য শক্তি
প্রয়োগের ওপরে নির্ভরতা। একে এই নিবন্ধে হাইব্রিড রেজিম বা দো-আঁশলা শাসন
ব্যবস্থা বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের সমাজে এক নতুন ধনিক শ্রেণীর উদ্ভবের মধ্য দিয়ে সমাজে নতুন শ্রেণী বিন্যাস ঘটেছে। রাষ্ট্রের আনূকূল্যে ও ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই শ্রেণীর মধ্যে জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার আকাঙ্খার ঘাটতি আছে, যা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের প্রভাব বেড়েছে এবং আগামীতে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ক্ষেত্র যতই সীমিত হবে, এই শক্তির প্রভাব ও ক্ষমতা বাড়বে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব ক্রমবৃদ্ধিমান এবং সব প্রধান রাজনৈতিক দলই তা মেনে নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতির ভারত এক নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
ভারত বাংলাদেশে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকার চায়, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের কারণে এখন তা আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এতে করে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের লাভবান না হবার সম্ভাবনাই বেশি।
বাংলাদেশের রাজনীতি আগামীতে কোন পথে যাবে সেই বিষয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে, উদ্বেগ আছে এবং আশংকাও আছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তা কোনো নতুন বিষয় নয়; গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ বারবার রাজনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৯১ সালে দেশে নির্বাচিত বেসামরিক শাসন চালুর পরে আশা করা হয়েছিল যে এই ধরণের অনিশ্চয়তার অবসান ঘটবে। কিন্তু তার পরিবর্তে ১৯৯৬, ২০০৬ এবং ২০১৪ সালে আমরা আবারও এই ধরণের অনিশ্চয়তা প্রত্যক্ষ করেছি। এই অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ আপাতদৃষ্টে আসন্ন নির্বাচন-কেন্দ্রিক- সংবিধানের বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত এই বছর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কী না, কী ধরণের নির্বাচন হবে, কাদের অংশগ্রহণে এই নির্বাচন হবে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কী না এই সব প্রশ্নই সাধারণত আলোচনা হয়ে থাকে। এই প্রশ্নগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কেন এই সব প্রশ্ন ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেই বিষয়ে মনোনিবেশ না করলে এই সংকটের গভীরতা ও ব্যপ্তি বোঝা যাবেনা।
অতীতে বাংলাদেশ যত ধরণের রাজনৈতিক সংকট বা অনিশ্চয়তার মোকাবেলা করেছে এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তার আপাত সাদৃশ্য থাকলেও এবারের সংকট অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন এবং এই সংকট আরো গভীর।
এই সংকট কেন গভীর তা উপলব্ধি এবং বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা চিহ্নিত করতে চাইলে আমাদের চারটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশে বিরাজমান শাসনের রূপ, বাংলাদেশের সমাজে নতুন শ্রেণী বিন্যাসের প্রতিক্রিয়া, সমাজ ও রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের প্রভাব এবং ভারতের ভূমিকা।
বাংলাদেশের বিরাজমান শাসনের রূপ
১৯৯০ সালে বাংলাদেশে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কেবল জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়নি, তা তৈরি করেছিল একটি অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা। স্বল্প সময়ের একদলীয় ব্যবস্থা, দেড় দশকের প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন ও বেসামরিক সরকারের মোড়কে সামরিক শাসন সব মিলে প্রায় দুই দশক ধরে চালু থাকা কর্তৃত্ববাদী ধরণের শাসনের অবসান ঘটেছিল এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সুনির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলের কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন হয়েছিল এমন দাবি করার কোনো সুযোগ নেই, কিন্তু একথা অতিরঞ্জন নয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদ (পপুলিস্ট অথরিটারিয়ানইজম) এবং সামরিক কর্তৃত্ববাদের যে ইতিহাস তা থেকে বেরুবার আকাঙ্খা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। সাধারণত কর্তৃত্ববাদী শাসনের কেন্দ্রে থাকেন একজন ব্যক্তি, কিন্তু এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে সাজিয়ে তোলে, যা সবার অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। ফলে, সারা পৃথিবীর গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, যে কোনো দেশেই কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের হলেই সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মনে করার কারণ নেই।
১৯৭০-এর দশকে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, নীতি-নির্ধারক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্র বলতে নির্বাচনের ওপরেই বেশি জোর দিতেন। যে কারণে সেই সময়ে দেশে দেশে স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসকেরাও নির্বাচনের আয়োজন করে নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে জাহির করার চেষ্টা করেছেন, সামরিক শাসকদেরও ‘গণতান্ত্রিক’ বলে বর্ণনা করার ঘটনা দেখতে পাই। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এটা স্পষ্ট হয় যে, নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান; কিন্তু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। নির্বাচনের ওপরে অতিরিক্ত জোর দেয়াকে কেউ কেউ ‘ফ্যালাসি অব ইলেক্টোরালইজম’ বলে বর্ণনা করলেন (স্মিটার ও কার্ল ১৯৯১)। অনেকেই এই বিষয়ে উৎসাহী হলেন যে কর্তৃত্ববাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ কী? আর কেউ কেউ দেখতে চাইলেন উত্তরণের পর কীভাবে সেখানে গণতন্ত্র সংহত হয়।
এই সব আলোচনার সূচনা পর্বেই ১৯৯১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় স্যামুয়েল হান্টিংটন দেখান, শাসনব্যবস্থা হিসেবে ইতিহাসে তিন দফা গণতন্ত্রের প্রসার হয়েছে; একে তিনি বলেন ‘গণতন্ত্রের তিন ঢেউ’ (হান্টিংটন ১৯৯১)।
তিনি বলেন, প্রতিটি ঢেউয়ের পরেই এসেছে ভাটার টান। প্রথম ঢেউয়ের ঘটনা ১৮২৬ থেকে ১৯২৬ সাল। দ্বিতীয় ঢেউ দেখতে পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, যার শেষ হয়েছে ১৯৬২ সালে। তৃতীয় ঢেউয়ের সূচনা হয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৯১ সালে তাঁর গবেষণার শেষে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে খুব শিগগির ভাটার টান আসবে। তাঁর ‘তিন ঢেউ তত্ত্বের’ সমর্থন পাওয়া গেলো তথ্যের মধ্যেই। ১৯৭৩ সালে সারা পৃথিবীর মোট দেশের এক-চর্তুাংশ ছিল গণতান্ত্রিক, ১৯৮০ সালে তা দাঁড়ায় এক-তৃতীয়াংশে এবং ১৯৯২ সালে প্রায় অর্ধেকে। নব্বইয়ের দশকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে একদলীয় শাসনের অবসান থেকে এটাই বোঝা গেলো যে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
এই সময়ে অনেকেই বিস্মৃত হলেন যে, জোয়ারের শেষে আসে ভাটার টান। ১৯৮০-এর দশকে গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে আশাবাদের জোয়ারের মধ্যেও উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ, যেমন গুয়েলারমো ও’ডানেল এবং ফিলিপ স্মিটার, ১৯৮৬ সালে এই বলে সতর্ক করেছিলেন যে কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে উত্তরণের ফল হতে পারে তুলনামূলক উন্মুক্ত কর্তৃত্ববাদী শাসন অথবা নিয়ন্ত্রণমূলক অনুদার (Illiberal) গণতন্ত্র (ও’ডানেল এবং স্মিটার ১৯৮৬: ৯)। তাঁদের এই উদ্বেগ গবেষকদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে পড়লো ২০০০-এর দশকে এসে। দেখা গেলো যে, এই ‘নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলো’র অনেকেই গণতন্ত্রের পথে খুব বেশি অগ্রসর হয়নি, অর্থাৎ সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিয়মিতভাবে, নাগরিকেরা সীমিতভাবে অধিকার পাচ্ছেন এবং যদিও অধিকাংশ দেশ আগের স্বৈরাচারী বা প্রত্যক্ষভাবে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় ফিরে যায়নি (কয়েকটি দেশে যদিও আবার পুরোনো ব্যবস্থা ফিরেও এসেছিল), কিন্তু এসব দেশে বড়জোর নির্বাচন হচ্ছে কিন্তু এর বাইরে গণতন্ত্রের আর কোনো দিকই বিকশিত হচ্ছে না। কেউ কেউ এই রকম আশা করলেন যে, এগুলো আসলে উত্তরণের পথে আছে।
এই ধরণের ব্যবস্থাকে কী বলা যায় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন বিশেষণ ব্যবহার করতে শুরু করেন। এইসব বিশেষণের মধ্যে রয়েছে আধা গণতন্ত্র (Semi-democracy), প্রায়-গণতন্ত্র (Virtual democracy), নির্বাচনী গণতন্ত্র (Electoral democracy), ছদ্ম গণতন্ত্র (Pseudo-democracy), অনুদার গণতন্ত্র (Illiberaldemocracy), আধা কর্তৃত্ববাদ (Semi-authoritarianism); কোমল কর্তৃত্ববাদ (Soft authoritarianism) এবং নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ (Electoral authoritarianism) (লেভিটস্কি এবং ওয়ে, ২০০২)। ল্যারি ডায়মন্ড এই ধরনের বিভিন্ন শাসনকে একত্রে হাইব্রিড রেজিম (Hybrid Regime) বা সংকর/ দোআঁশলা শাসনব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেন (ডায়মন্ড, ২০০২)।
গোড়ার দিকে এসব শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ‘আধা’, ‘প্রায়’ ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত করে একে গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী স্তর বলে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হলেও পরবর্তী সময় বিশেষজ্ঞরা ক্রমেই স্বীকার করে নেন যে এগুলো গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদের কোনো উপরূপ নয়। বরং এগুলো হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের শাসন, নিজেই একটা বিশেষ রূপ। ফলে এদের গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদ বলে বর্ণনার সুযোগ নেই (বোগার্ড ২০০৯)। ল্যারি ডায়মন্ড ২০০২ সালে খুব জোর দিয়ে বলেন যে হাইব্রিড রেজিম বা ‘দোআঁশলা শাসন’কে উত্তরণের পথে রয়েছে এমন শাসনব্যবস্থার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। উত্তরণ পর্যায় হচ্ছে শাসনব্যবস্থা এক ধরন থেকে অন্য ধরনে যাওয়ার অন্তর্বর্তী অবস্থান হাইব্রিড রেজিম তা নয়, এগুলো নিজেই একধরনের শাসনব্যবস্থা। এই ধরণের ব্যবস্থার নির্ধারক চরিত্র হচ্ছে যে, এগুলোতে একই সময়ে গণতন্ত্রের কিছু, আর স্বৈরতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য বিরাজ করে।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় দু’টি; প্রথমত একে এক বিশেষ ধরণের সরকার না বলে ‘রেজিম’ বলা হয়েছে; দ্বিতীয়ত হাইব্রিড রেজিম এই ধারণার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের শাসন ব্যবস্থা রয়েছে, এটা একটি মাত্র শাসন ব্যবস্থা নয়। রেজিম বলা হচ্ছে এই কারণে যে, এগুলো যে কোনো সরকারের চেয়ে বেশি স্থায়ী ধরণের রাজনৈতিক সংগঠন ‘more permanent form of political organization’ (ফিশম্যান ১৯৯০)। যে কোনো রেজিম আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতা কাঠামোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, ক্ষমতার সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। রেজিম নির্ধারণ করে ক্ষমতায় কার প্রবেশযোগ্যতা থাকবে, আর কার থাকবে না। এই ধরণের রেজিমে বেশ কয়েক ধরণের শাসন থাকতে পারে সেটা নির্ভর করে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কী ধরণের সম্পর্ক আছে এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কি ধরণের বোঝাপড়া হয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পরে যে ব্যবস্থা তৈরি হয় তাঁকে আমরা ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি বা নির্বাচনী গণতন্ত্র বলে বর্ণনা করতে পারি। এই ধরণের ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন, বহু দলের উপস্থিতি, সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার, নিয়মিত গোপন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান যাতে বড় ধরণের জালিয়াতির অনুপস্থিত এবং যাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে; যেখানে গণমাধ্যম এবং নিয়ন্ত্রণহীন নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে বড় দলগুলোর ভোটারদের কাছে যাবার সুযোগ আছে (ফ্রিডম হাউস ২০১২)। এই ব্যবস্থাটা চালু হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর হাতে এমন ক্ষমতা অর্পণ করে যা ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের সুযোগ বহাল রাখে এবং গোটা ব্যবস্থাই হয়ে ওঠে ‘প্রধানমন্ত্রীর শাসন’ ব্যবস্থা। তদুপরি, বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া বিষয়ে যে অস্পষ্টতা যা ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল তাই বহাল থাকল।
সাংবিধানিক বিধিবিধান, স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান (যেমন নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন) গঠনে অনুৎসাহীতা, দলের ভেতরে গণতন্ত্রহীনতা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করে দল ও ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতার ফলে এই ব্যবস্থাটিতে ক্রমেই অগণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রধান হয়ে ওঠে। দুই প্রধান প্রতিদ্বন্ধী দলের উপস্থিতি এবং ক্ষমতার হাত বদলের মধ্য দিয়ে শাসনের রূপ হয়ে দাঁড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্তৃত্ববাদ বা কমপিটিটিভ অথরিটারিয়ানইজম। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই কারণে যে ক্ষমতাসীনদের কাজের বৈধতা তৈরি হয় একমাত্র নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়েই, সেই নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হল কিনা সেটা আর বিবেচ্য থাকে না (কিলিঞ্চ ২০১৭)। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বা ২০০৬ সালের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা তাই প্রমাণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উপলব্ধি করলো যে এই ব্যবস্থার ভিত্তি এবং যেই ক্ষমতায় থাকুক তার বৈধতার ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর, বিশেষ করে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর, বাংলাদেশে নতুন ধরণের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে। অন্যান্য দেশে বিরাজমান এই ধরণের ব্যবস্থা নিয়ে এন্ড্রিয়াস স্যাডলার বলেছেন, এই ব্যবস্থায় যা চলে তা ‘বহুদলীয় রাজনীতির খেলা’ এবং নির্বাচন গণতন্ত্রের নয়, কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ারে পরিণত হয় (স্যাডলার ২০০৬)। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে এই ধরণের ব্যবস্থা সহজেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেই তা ভিন্ন হত কিনা, কিংবা এর কারণ ২০১৫ সালের গোড়াতে বিএনপি’র সহিংস আন্দোলন কিনা সেটা এখন প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরপরই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপি’কে আর কোনভাবেই রাজনীতিতে জায়গা দিতে আগ্রহী নয়। ২০১৫ সালে ১লা জানুয়ারি প্রকাশিত ‘দেয়ার ক্যান বি অনলি ওয়ান’ (কেবল এক পক্ষই থাকতে পারবে) শিরোনামের এক নিবন্ধে জাফর সোবহান সুস্পষ্টভাবেই বলেছিলেন যে, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গেম প্ল্যান খুব স্পষ্ট। আগামী বছরে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা খুব সোজাসাপ্টা চেপে ধরে বিএনপি’র প্রাণবায়ু বের করে ফেলা অব্যাহত রাখা’ (সোবহান ২০১৫) (তাঁর ভাষায়, The game plan for the ruling Awami League is clear. The AL plan for the coming year is therefore straightforward: Continue to squeeye life out of the BNP.) ১৯৮২ সালের পর থেকে এই দুই দলের মধ্যে যে অলিখিত চুক্তি বা সমঝোতা ছিল তা ছিল কার্যত সেনা-আমলাতন্ত্রের বিপরীতে বেসামরিক রাজনৈতিক দলের শাসন প্রতিষ্ঠার।
২০০৯ সালের পরে সেটার আর কোনো তাগিদ থাকেনি। তদুপরি যে কোনো হাইব্রিড রেজিম অবশ্যই নির্বাচন করতে চায় কিন্তু ক্ষমতাসীন দল কখনো চায় না যে এমন প্রতিপক্ষ উপস্থিত থাকুক যা তাকে পরাজিত করতে পারবে এমন সম্ভাবনা আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পরে এমন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে যেখানে ক্ষমতাসীনরা পরাজিত হবেন। বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনের ইতিহাসই কেবল সেই সাক্ষ্যই দেয়না, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও তাই বলে।
এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি তা আসলে যে কোনো হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা ব্যবস্থায় যা হয় তা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ইকনোমিস্ট ইন্টিলেজিন্স ইউনিটের হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীর ১৬৭টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশের অবস্থাই এই রকম; পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৬.৭% মানুষ এখন এই ধরণের ব্যবস্থার অধীন। সারা পৃথিবীতেই এখন গণতন্ত্রের পিছু হটার ঘটনা ঘটছে। রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা, ফিলিপাইন, তুরস্ক, কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া এর সহজে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ১৯৯০-এর দশকে যখন গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে কিছু দেশ এই ধরণের ব্যবস্থায় উপনীত হল তখন অনেক আশাবাদী গবেষক, বিশেষজ্ঞরা মনে করতেন যে এই ধরণের দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থা সম্ভবত আস্তে আস্তে গণতন্ত্রের দিকেই অগ্রসর হবে, অন্যরা একে এক ধরণের নিশ্চল ব্যবস্থা বলেই মনে করতেন, মনে করতেন যে স্থিতাবস্থা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু গত দুই দশকের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে বলা যায় যে এগুলো নিশ্চল নয়, হাইব্রিড রেজিমের পরিবর্তনের পথরেখা গণতন্ত্র অভিমুখী নয়, বরঞ্চ কর্তৃত্ববাদের দিকেই।
যে কোনো হাইব্রিড রেজিমকে টিকে থাকার জন্যে দরকার হয় তিনটি ক্ষেত্রের ওপরে নিয়ন্ত্রণ সেগুলো হচ্ছে নির্বাচন, নির্বাহী ও আইন সভা, এবং বিচার ব্যবস্থা (লেভিতস্কি এবং ওয়ে ২০০২; একম্যান ২০০৯)। গবেষণায় এও দেখা যাচ্ছে যে নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা এবং বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র তৈরি হয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। যে কোনো হাইব্রিড রেজিমের জন্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দরকার হয় আন্তর্জাতিক বৈধতা অর্জন, ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতার বা পেট্রনেজ নেটওয়ার্ক বজায় রাখা এবং তাঁদের অপরাজেয়তার প্রমাণ হিসেবে। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, হাইব্রিড রেজিম, তুরস্ক বা রাশিয়া যে দেশেই হোক না কেন, নির্বাচনের আয়োজনের কথা তাঁরা জোর দিয়ে বলে, কিন্তু সেই নির্বাচন অবাধ এবং সরকারি প্রভাব মুক্ত হলো কীনা, সেই নির্বাচনের সততা বা ইন্টিগ্রিটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে তাঁরা নীরবতা পালন করে থাকে।
এক্ষেত্রে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে এই ধরণের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা কী হওয়া উচিত। কেউ কেউ মনে করেন যে এই ধরণের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ক্ষমতাসীনদের বৈধতা প্রদান করে, ফলে তাঁরা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে। কেউ কেউ মনে করেন যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ তৈরি, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনা তৈরি করা যাতে পারে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাশিয়া, তুরস্ক এবং মালয়েশিয়ার নির্বাচনের শিক্ষাগুলো এ ক্ষেত্রে মনোযোগ দাবি করে। মালয়েশিয়ায় বিরোধী দল ও শক্তিগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টাই কেবল ক্ষমতাসীনদের পরাজিত করতে পেরেছে।
বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণের প্রশ্নটি এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনা করতে হবে। সে সব দল ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছে তাঁদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া দরকার যে তাঁরা যে সব বিবেচনায় নির্বাচন বর্জন করেছিলেন তার কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কিনা এবং অপরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা, নিলে কী বিবেচনা থেকে অংশ নেবেন। আগামী নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনায় দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কিনা তা যথাযথ কারণেই বিশদভাবে আলোচিত হয়; বিএনপি’র ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করা হয়ে থাকে। ২০১৫ সালে কথিত আন্দোলনের কৌশল এবং সে সময়কার ঘটনা প্রবাহের দায় বিএনপি’কে বহন করতে হয়। কিন্তু আসন্ন নির্বাচন কী ধরণের হবে, আদৌ অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ হবে কী না সেই প্রশ্নটিকে কেবল বিএনপি’র অংশগ্রহণের প্রশ্ন, কিংবা দলের প্রধান খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপি’র অংশগ্রহণের প্রশ্ন বলে আলোচনা করা সঠিক নয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকেই এই বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। আলোচিত হওয়া দরকার যে, দোআঁশলা এই ব্যবস্থায় কী ভাবে একটি নির্বাচন করা সম্ভব যা জনগণের অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করবে এবং নির্ভয়ে তাঁদের রায় প্রদান করতে পারবে। এই নির্বাচন কেবল অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষকদের সামনে অনুষ্ঠানই যথেষ্ট নয় তা স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে তাঁদের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণেই স্পষ্ট (আহমেদ, কামাল, ২০১৮)।
একইভাবে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি’র ওপরেও এই দায়িত্ব বর্তায় যে তাঁরা একে কেবল দলীয় বিবেচনা থেকে বা দলের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের সুযোগ হিসেবে দেখছে কীনা তা পরিষ্কার করা এবং সেই আলোকেই পদক্ষেপ নেয়া।
সব হাইব্রিড রেজিমেই দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদান থাকলেও হাইব্রিড রেজিম প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভর করে। শক্তি প্রয়োগের এই প্রবণতার ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাঁদেরকে একধরনের দায়মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু হাইব্রিড রেজিম একই সঙ্গে তার পক্ষে সমর্থক গোষ্ঠীদের সমাবেশ ঘটায়, তাঁদেরকে শক্তিশালী করে, নাগরিকদের মধ্যে তাঁদের যে সমর্থন আছে তাকে বহুভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করে। এ জন্যে গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার, মিথ্যা প্রচার, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে প্রচলিত পদ্ধতি।
বাংলাদেশে গত এক দশকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ যেমন নির্বাহী বিভাগ এবং আইন সভার ওপরে ক্ষমতাসীন দলের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা না প্রতিনিধিত্বশীল, না কার্যকর। অতীতে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালনে সমর্থ না হলেও যে অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে পেরেছিল গত চার বছরে তা অবসিত হয়েছে।
বাংলাদেশে এক সময় যে প্রাণবন্ত সিভিল সোসাইটি ছিল আজ তার চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। সিভিল সোসাইটিকে দলীয়করণের যে ধারা ১৯৯১ সালের পরে তৈরি হয়েছিল সেই সুযোগকে ব্যবহার করে, গত এক দশকে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘সিভিল সোসাইটি’র বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে প্রচার চালানো হয়েছে।
এর অন্যতম কারণ হচ্ছে জবাবদিহির একমাত্র ব্যবস্থা হিসেবে নির্বাচনকে প্রতিষ্ঠিত করা। যেহেতু নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপরে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এখন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় নির্বাচনে তাঁদের বিজয় ‘আনুষ্ঠানিকতা’ মাত্র (প্রথম আলো, ১৬ই মার্চ ২০১৮), সেহেতু আর সব ধরণের জবাবদিহির ব্যবস্থা চূর্ণ করে ফেলাই হচ্ছে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উপায়। গণতান্ত্রিক সমাজে জবাবদিহির ব্যবস্থা যেমন সুষ্ঠু, অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, তেমনিভাবে আরো দুই ধরণের জবাদিহির ব্যবস্থা থাকে সাংবিধানিকভাবে তৈরি করা ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান (যেমন দুর্নীতি কমিশন) যারা ক্ষমতাসীনদের ওপরে নজরদারি করতে পারেন, আর হচ্ছে সিভিল সোসাইটি যার মধ্যে আছে স্বাধীন গণমাধ্যম এবং অন্যান্য ধরণের প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অবস্থা এমন এক জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছে যে এর সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক এবং নীতি-নির্ধারকরা দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে নিজেদের সিভিল সোসাইটির অংশ মনে করেন না, সিভিল সোসাইটির মানহানি (ভিলিফাই) করার কাজে তারাই অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ, স্বতঃপ্রণোদিত সেন্সরশিপ এবং দলীয় আনুগত্য এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যাতে করে গণমাধ্যমগুলো এখন সমাজের বৃহদাংশের কাছে কতটা আবেদন রাখেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
রাশিয়া, তানজানিয়া এবং ভেনেজুয়েলায় বিরাজমান হাইব্রিড রেজিমের টিকে থাকার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে একম্যান তাঁর গবেষণায় দেখান যে, দুর্বল বা অকার্যকর বিরোধী দল এবং দলগুলোর জনবিচ্ছিন্নতা অন্যতম কারণ।
তিনি আরো দেখান যে, রাজনীতি বিষয়ে অনাগ্রহ বা হতাশা সাহায্যকারী উপাদান হিসেবে কাজ করে (একম্যান ২০০৯)। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-ই শুধু নয়, অন্য দলগুলোর ভূমিকা এবং রাজনীতিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তোলার ফলে দলগুলোর আবেদন সীমিত হয়েছে। রাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে তাঁরা যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে কম সফল তা সহজেই বোধগম্য। বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের আচরণের কারণে দল-নির্বিশেষে রাজনীতিকেই দোষারোপ, তরুণদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনীহা তৈরি এবং এই ধারণা সৃষ্টি যে তাঁদের ব্যক্তিগত সাফল্য দেশের সার্বিক রাজনীতি থেকে আলাদা সেটা ইচ্ছে করেই তৈরি করে হয়েছে। সমাজে এখন যারা সক্রিয় আছেন তাঁদেরকে ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা এখন প্রতিদিনের বিষয়। সে কারণে বিচার বহির্ভূত হত্যা এবং গুমকে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্যে দেখুন, রীয়াজ ২০১৪)।
বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থাকে হাইব্রিড রেজিম বলে চিহ্নিত করলে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা অনুধাবন করা দুরূহ হয়না। ইতিমধ্যেই দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের যে প্রবণতা লক্ষ্য করেছি তার মাত্রা যে ক্রমবর্ধমান তাও সহজেই দৃষ্ট। শুধু তাই নয়, এই শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি কেবল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেই সীমিত তা নয়, ক্ষমতাসীন দলের নিমড়বতম স্তরের কর্মীদের মধ্যেও তা বিস্তার লাভ করেছে এবং সমাজের সর্বস্তরে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই দায়মুক্তির জন্যে যথেষ্ট। বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, সহিংসতার ব্যাপক বিস্তারের যে সব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তি এইখানেই।
যেসব দেশে গণতন্ত্র ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়েছে এবং ক্ষয়ের পথে অগ্রসর হয়েছে, বিশেষ করে যেখানে হাইব্রিড রেজিমের উত্থান ঘটেছে, সেখানেই ক্ষমতাসীনরা অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীতে তাদের ক্ষমতায় থাকার যুক্তি হিসেবে, এক ধরণের আদর্শিক বাতাবরণ তৈরি করেছেন। এই সব আদর্শিক বাতাবরণের মধ্যে আছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতীয় উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা, ধর্মীয় আদর্শ। এও দেখা গেছে যে, গত কয়েক এক দশকে যে সব দেশে এই ধরণের হাইব্রিড রেজিম তৈরি হয়েছে সেখানে এক ধরণের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে (মাহমুদ ২০১৮)। বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই ধরণের প্রবৃদ্ধিকে সাধারণত ‘উন্নয়ন’ বলে বলা হলেও তার সুফল সকলে সমানভাবে ভোগ করে তা নয়। তদুপরি এই ধরণের প্রবৃদ্ধি সমাজের শ্রেণী বিন্যাস বদলে দেয়
এবং তার প্রভাব পরে রাজনীতিতে।
উৎস: সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর জন্য আলোচনাপত্র
লেখক পরিচিতি : লেখক, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
বাংলাদেশের সমাজে এক নতুন ধনিক শ্রেণীর উদ্ভবের মধ্য দিয়ে সমাজে নতুন শ্রেণী বিন্যাস ঘটেছে। রাষ্ট্রের আনূকূল্যে ও ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এই শ্রেণীর মধ্যে জবাবদিহি ও অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থার আকাঙ্খার ঘাটতি আছে, যা রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিমধ্যেই রক্ষণশীল ইসলামপন্থীদের প্রভাব বেড়েছে এবং আগামীতে অংশগ্রহণমূলক রাজনীতির ক্ষেত্র যতই সীমিত হবে, এই শক্তির প্রভাব ও ক্ষমতা বাড়বে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতের প্রভাব ক্রমবৃদ্ধিমান এবং সব প্রধান রাজনৈতিক দলই তা মেনে নিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতির ভারত এক নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।
ভারত বাংলাদেশে তার ঘনিষ্ঠ মিত্র সরকার চায়, বিশেষ করে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের কারণে এখন তা আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এতে করে দীর্ঘমেয়াদে ভারতের লাভবান না হবার সম্ভাবনাই বেশি।
বাংলাদেশের রাজনীতি আগামীতে কোন পথে যাবে সেই বিষয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন আছে, উদ্বেগ আছে এবং আশংকাও আছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তা কোনো নতুন বিষয় নয়; গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ বারবার রাজনৈতিক সংকট ও অনিশ্চয়তার মুখোমুখি হয়েছে। ১৯৯১ সালে দেশে নির্বাচিত বেসামরিক শাসন চালুর পরে আশা করা হয়েছিল যে এই ধরণের অনিশ্চয়তার অবসান ঘটবে। কিন্তু তার পরিবর্তে ১৯৯৬, ২০০৬ এবং ২০১৪ সালে আমরা আবারও এই ধরণের অনিশ্চয়তা প্রত্যক্ষ করেছি। এই অনিশ্চয়তা ও উদ্বেগ আপাতদৃষ্টে আসন্ন নির্বাচন-কেন্দ্রিক- সংবিধানের বিধান অনুযায়ী নির্ধারিত এই বছর একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে কী না, কী ধরণের নির্বাচন হবে, কাদের অংশগ্রহণে এই নির্বাচন হবে, ২০১৪ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কী না এই সব প্রশ্নই সাধারণত আলোচনা হয়ে থাকে। এই প্রশ্নগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কেন এই সব প্রশ্ন ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেই বিষয়ে মনোনিবেশ না করলে এই সংকটের গভীরতা ও ব্যপ্তি বোঝা যাবেনা।
অতীতে বাংলাদেশ যত ধরণের রাজনৈতিক সংকট বা অনিশ্চয়তার মোকাবেলা করেছে এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে তার আপাত সাদৃশ্য থাকলেও এবারের সংকট অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে ভিন্ন এবং এই সংকট আরো গভীর।
এই সংকট কেন গভীর তা উপলব্ধি এবং বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা চিহ্নিত করতে চাইলে আমাদের চারটি বিষয়ের দিকে নজর দিতে হবে। সেগুলো হচ্ছে বাংলাদেশে বিরাজমান শাসনের রূপ, বাংলাদেশের সমাজে নতুন শ্রেণী বিন্যাসের প্রতিক্রিয়া, সমাজ ও রাজনীতিতে ইসলামপন্থীদের প্রভাব এবং ভারতের ভূমিকা।
বাংলাদেশের বিরাজমান শাসনের রূপ
১৯৯০ সালে বাংলাদেশে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কেবল জেনারেল এরশাদের নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়নি, তা তৈরি করেছিল একটি অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা। স্বল্প সময়ের একদলীয় ব্যবস্থা, দেড় দশকের প্রত্যক্ষ সামরিক শাসন ও বেসামরিক সরকারের মোড়কে সামরিক শাসন সব মিলে প্রায় দুই দশক ধরে চালু থাকা কর্তৃত্ববাদী ধরণের শাসনের অবসান ঘটেছিল এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। সুনির্দিষ্টভাবে রাষ্ট্রের চরিত্র বদলের কর্মসূচির ভিত্তিতে আন্দোলন হয়েছিল এমন দাবি করার কোনো সুযোগ নেই, কিন্তু একথা অতিরঞ্জন নয় যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদ (পপুলিস্ট অথরিটারিয়ানইজম) এবং সামরিক কর্তৃত্ববাদের যে ইতিহাস তা থেকে বেরুবার আকাঙ্খা এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল। সাধারণত কর্তৃত্ববাদী শাসনের কেন্দ্রে থাকেন একজন ব্যক্তি, কিন্তু এই ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে এমনভাবে সাজিয়ে তোলে, যা সবার অংশগ্রহণমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। ফলে, সারা পৃথিবীর গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, যে কোনো দেশেই কর্তৃত্ববাদী শাসনের অবসানের হলেই সেখানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মনে করার কারণ নেই।
১৯৭০-এর দশকে অনেক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, রাজনীতিবিদ, নীতি-নির্ধারক এবং আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান গণতন্ত্র বলতে নির্বাচনের ওপরেই বেশি জোর দিতেন। যে কারণে সেই সময়ে দেশে দেশে স্বৈরাচারী বা কর্তৃত্ববাদী শাসকেরাও নির্বাচনের আয়োজন করে নিজেদের গণতান্ত্রিক বলে জাহির করার চেষ্টা করেছেন, সামরিক শাসকদেরও ‘গণতান্ত্রিক’ বলে বর্ণনা করার ঘটনা দেখতে পাই। কিন্তু ক্রমান্বয়ে এটা স্পষ্ট হয় যে, নির্বাচন গণতন্ত্রের একটি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ উপাদান; কিন্তু নির্বাচনই গণতন্ত্র নয়। নির্বাচনের ওপরে অতিরিক্ত জোর দেয়াকে কেউ কেউ ‘ফ্যালাসি অব ইলেক্টোরালইজম’ বলে বর্ণনা করলেন (স্মিটার ও কার্ল ১৯৯১)। অনেকেই এই বিষয়ে উৎসাহী হলেন যে কর্তৃত্ববাদ থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ কী? আর কেউ কেউ দেখতে চাইলেন উত্তরণের পর কীভাবে সেখানে গণতন্ত্র সংহত হয়।
এই সব আলোচনার সূচনা পর্বেই ১৯৯১ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় স্যামুয়েল হান্টিংটন দেখান, শাসনব্যবস্থা হিসেবে ইতিহাসে তিন দফা গণতন্ত্রের প্রসার হয়েছে; একে তিনি বলেন ‘গণতন্ত্রের তিন ঢেউ’ (হান্টিংটন ১৯৯১)।
তিনি বলেন, প্রতিটি ঢেউয়ের পরেই এসেছে ভাটার টান। প্রথম ঢেউয়ের ঘটনা ১৮২৬ থেকে ১৯২৬ সাল। দ্বিতীয় ঢেউ দেখতে পাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, যার শেষ হয়েছে ১৯৬২ সালে। তৃতীয় ঢেউয়ের সূচনা হয় ১৯৭৪ সালে। ১৯৯১ সালে তাঁর গবেষণার শেষে তিনি আশঙ্কা করেছিলেন যে খুব শিগগির ভাটার টান আসবে। তাঁর ‘তিন ঢেউ তত্ত্বের’ সমর্থন পাওয়া গেলো তথ্যের মধ্যেই। ১৯৭৩ সালে সারা পৃথিবীর মোট দেশের এক-চর্তুাংশ ছিল গণতান্ত্রিক, ১৯৮০ সালে তা দাঁড়ায় এক-তৃতীয়াংশে এবং ১৯৯২ সালে প্রায় অর্ধেকে। নব্বইয়ের দশকে এসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন এবং পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলোতে একদলীয় শাসনের অবসান থেকে এটাই বোঝা গেলো যে এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
এই সময়ে অনেকেই বিস্মৃত হলেন যে, জোয়ারের শেষে আসে ভাটার টান। ১৯৮০-এর দশকে গণতন্ত্রায়ণ নিয়ে আশাবাদের জোয়ারের মধ্যেও উদ্বিগ্ন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ, যেমন গুয়েলারমো ও’ডানেল এবং ফিলিপ স্মিটার, ১৯৮৬ সালে এই বলে সতর্ক করেছিলেন যে কর্তৃত্ববাদী শাসন থেকে উত্তরণের ফল হতে পারে তুলনামূলক উন্মুক্ত কর্তৃত্ববাদী শাসন অথবা নিয়ন্ত্রণমূলক অনুদার (Illiberal) গণতন্ত্র (ও’ডানেল এবং স্মিটার ১৯৮৬: ৯)। তাঁদের এই উদ্বেগ গবেষকদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে পড়লো ২০০০-এর দশকে এসে। দেখা গেলো যে, এই ‘নতুন গণতান্ত্রিক দেশগুলো’র অনেকেই গণতন্ত্রের পথে খুব বেশি অগ্রসর হয়নি, অর্থাৎ সেখানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে নিয়মিতভাবে, নাগরিকেরা সীমিতভাবে অধিকার পাচ্ছেন এবং যদিও অধিকাংশ দেশ আগের স্বৈরাচারী বা প্রত্যক্ষভাবে কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় ফিরে যায়নি (কয়েকটি দেশে যদিও আবার পুরোনো ব্যবস্থা ফিরেও এসেছিল), কিন্তু এসব দেশে বড়জোর নির্বাচন হচ্ছে কিন্তু এর বাইরে গণতন্ত্রের আর কোনো দিকই বিকশিত হচ্ছে না। কেউ কেউ এই রকম আশা করলেন যে, এগুলো আসলে উত্তরণের পথে আছে।
এই ধরণের ব্যবস্থাকে কী বলা যায় এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বিভিন্ন বিশেষণ ব্যবহার করতে শুরু করেন। এইসব বিশেষণের মধ্যে রয়েছে আধা গণতন্ত্র (Semi-democracy), প্রায়-গণতন্ত্র (Virtual democracy), নির্বাচনী গণতন্ত্র (Electoral democracy), ছদ্ম গণতন্ত্র (Pseudo-democracy), অনুদার গণতন্ত্র (Illiberaldemocracy), আধা কর্তৃত্ববাদ (Semi-authoritarianism); কোমল কর্তৃত্ববাদ (Soft authoritarianism) এবং নির্বাচনী কর্তৃত্ববাদ (Electoral authoritarianism) (লেভিটস্কি এবং ওয়ে, ২০০২)। ল্যারি ডায়মন্ড এই ধরনের বিভিন্ন শাসনকে একত্রে হাইব্রিড রেজিম (Hybrid Regime) বা সংকর/ দোআঁশলা শাসনব্যবস্থা বলে বর্ণনা করেন (ডায়মন্ড, ২০০২)।
গোড়ার দিকে এসব শাসনব্যবস্থার সঙ্গে ‘আধা’, ‘প্রায়’ ইত্যাদি বিশেষণ যুক্ত করে একে গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদী শাসনের পূর্ববর্তী বা পরবর্তী স্তর বলে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা হলেও পরবর্তী সময় বিশেষজ্ঞরা ক্রমেই স্বীকার করে নেন যে এগুলো গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদের কোনো উপরূপ নয়। বরং এগুলো হচ্ছে একটি বিশেষ ধরনের শাসন, নিজেই একটা বিশেষ রূপ। ফলে এদের গণতন্ত্র বা কর্তৃত্ববাদ বলে বর্ণনার সুযোগ নেই (বোগার্ড ২০০৯)। ল্যারি ডায়মন্ড ২০০২ সালে খুব জোর দিয়ে বলেন যে হাইব্রিড রেজিম বা ‘দোআঁশলা শাসন’কে উত্তরণের পথে রয়েছে এমন শাসনব্যবস্থার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। উত্তরণ পর্যায় হচ্ছে শাসনব্যবস্থা এক ধরন থেকে অন্য ধরনে যাওয়ার অন্তর্বর্তী অবস্থান হাইব্রিড রেজিম তা নয়, এগুলো নিজেই একধরনের শাসনব্যবস্থা। এই ধরণের ব্যবস্থার নির্ধারক চরিত্র হচ্ছে যে, এগুলোতে একই সময়ে গণতন্ত্রের কিছু, আর স্বৈরতন্ত্রের কিছু বৈশিষ্ট্য বিরাজ করে।
এখানে লক্ষ্যণীয় বিষয় দু’টি; প্রথমত একে এক বিশেষ ধরণের সরকার না বলে ‘রেজিম’ বলা হয়েছে; দ্বিতীয়ত হাইব্রিড রেজিম এই ধারণার মধ্যে বিভিন্ন ধরণের শাসন ব্যবস্থা রয়েছে, এটা একটি মাত্র শাসন ব্যবস্থা নয়। রেজিম বলা হচ্ছে এই কারণে যে, এগুলো যে কোনো সরকারের চেয়ে বেশি স্থায়ী ধরণের রাজনৈতিক সংগঠন ‘more permanent form of political organization’ (ফিশম্যান ১৯৯০)। যে কোনো রেজিম আনুষ্ঠানিক এবং অনানুষ্ঠানিক ক্ষমতা কাঠামোর সমন্বয়ে গড়ে ওঠে, ক্ষমতার সঙ্গে বৃহত্তর সমাজের সম্পর্ক নির্ধারণ করে। রেজিম নির্ধারণ করে ক্ষমতায় কার প্রবেশযোগ্যতা থাকবে, আর কার থাকবে না। এই ধরণের রেজিমে বেশ কয়েক ধরণের শাসন থাকতে পারে সেটা নির্ভর করে রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কী ধরণের সম্পর্ক আছে এবং রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের কি ধরণের বোঝাপড়া হয়েছে।
বাংলাদেশে ১৯৯১ সালের পরে যে ব্যবস্থা তৈরি হয় তাঁকে আমরা ইলেকটোরাল ডেমোক্রেসি বা নির্বাচনী গণতন্ত্র বলে বর্ণনা করতে পারি। এই ধরণের ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্যগুলো হচ্ছে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন, বহু দলের উপস্থিতি, সকল প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের ভোটাধিকার, নিয়মিত গোপন ভোটের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠান যাতে বড় ধরণের জালিয়াতির অনুপস্থিত এবং যাতে জনমতের প্রতিফলন ঘটে; যেখানে গণমাধ্যম এবং নিয়ন্ত্রণহীন নির্বাচনী প্রচারণার মাধ্যমে বড় দলগুলোর ভোটারদের কাছে যাবার সুযোগ আছে (ফ্রিডম হাউস ২০১২)। এই ব্যবস্থাটা চালু হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবিধান প্রধানমন্ত্রীর হাতে এমন ক্ষমতা অর্পণ করে যা ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণের সুযোগ বহাল রাখে এবং গোটা ব্যবস্থাই হয়ে ওঠে ‘প্রধানমন্ত্রীর শাসন’ ব্যবস্থা। তদুপরি, বাংলাদেশের সংবিধানে ক্ষমতা হস্তান্তর প্রক্রিয়া বিষয়ে যে অস্পষ্টতা যা ১৯৭২ সালের সংবিধানে ছিল তাই বহাল থাকল।
সাংবিধানিক বিধিবিধান, স্বাধীন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান (যেমন নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন) গঠনে অনুৎসাহীতা, দলের ভেতরে গণতন্ত্রহীনতা এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদ ব্যবহার করে দল ও ব্যক্তির পৃষ্ঠপোষকতার ফলে এই ব্যবস্থাটিতে ক্রমেই অগণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো প্রধান হয়ে ওঠে। দুই প্রধান প্রতিদ্বন্ধী দলের উপস্থিতি এবং ক্ষমতার হাত বদলের মধ্য দিয়ে শাসনের রূপ হয়ে দাঁড়ায় প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্তৃত্ববাদ বা কমপিটিটিভ অথরিটারিয়ানইজম। প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় নির্বাচন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই কারণে যে ক্ষমতাসীনদের কাজের বৈধতা তৈরি হয় একমাত্র নির্বাচনে বিজয়ের মধ্য দিয়েই, সেই নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হল কিনা সেটা আর বিবেচ্য থাকে না (কিলিঞ্চ ২০১৭)। বাংলাদেশে ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচন বা ২০০৬ সালের নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা তাই প্রমাণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) উপলব্ধি করলো যে এই ব্যবস্থার ভিত্তি এবং যেই ক্ষমতায় থাকুক তার বৈধতার ভিত্তি হচ্ছে নির্বাচন।
২০০৮ সালের নির্বাচনের পর, বিশেষ করে ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর, বাংলাদেশে নতুন ধরণের রাজনৈতিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছে। অন্যান্য দেশে বিরাজমান এই ধরণের ব্যবস্থা নিয়ে এন্ড্রিয়াস স্যাডলার বলেছেন, এই ব্যবস্থায় যা চলে তা ‘বহুদলীয় রাজনীতির খেলা’ এবং নির্বাচন গণতন্ত্রের নয়, কর্তৃত্ববাদের হাতিয়ারে পরিণত হয় (স্যাডলার ২০০৬)। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষে এই ধরণের ব্যবস্থা সহজেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু বিএনপি নির্বাচনে অংশ নিলেই তা ভিন্ন হত কিনা, কিংবা এর কারণ ২০১৫ সালের গোড়াতে বিএনপি’র সহিংস আন্দোলন কিনা সেটা এখন প্রশ্নসাপেক্ষ। কেননা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পরপরই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বিএনপি’কে আর কোনভাবেই রাজনীতিতে জায়গা দিতে আগ্রহী নয়। ২০১৫ সালে ১লা জানুয়ারি প্রকাশিত ‘দেয়ার ক্যান বি অনলি ওয়ান’ (কেবল এক পক্ষই থাকতে পারবে) শিরোনামের এক নিবন্ধে জাফর সোবহান সুস্পষ্টভাবেই বলেছিলেন যে, ‘ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের গেম প্ল্যান খুব স্পষ্ট। আগামী বছরে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনা খুব সোজাসাপ্টা চেপে ধরে বিএনপি’র প্রাণবায়ু বের করে ফেলা অব্যাহত রাখা’ (সোবহান ২০১৫) (তাঁর ভাষায়, The game plan for the ruling Awami League is clear. The AL plan for the coming year is therefore straightforward: Continue to squeeye life out of the BNP.) ১৯৮২ সালের পর থেকে এই দুই দলের মধ্যে যে অলিখিত চুক্তি বা সমঝোতা ছিল তা ছিল কার্যত সেনা-আমলাতন্ত্রের বিপরীতে বেসামরিক রাজনৈতিক দলের শাসন প্রতিষ্ঠার।
২০০৯ সালের পরে সেটার আর কোনো তাগিদ থাকেনি। তদুপরি যে কোনো হাইব্রিড রেজিম অবশ্যই নির্বাচন করতে চায় কিন্তু ক্ষমতাসীন দল কখনো চায় না যে এমন প্রতিপক্ষ উপস্থিত থাকুক যা তাকে পরাজিত করতে পারবে এমন সম্ভাবনা আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের পরে এমন নির্বাচনের ব্যবস্থা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে যেখানে ক্ষমতাসীনরা পরাজিত হবেন। বাংলাদেশের অতীত নির্বাচনের ইতিহাসই কেবল সেই সাক্ষ্যই দেয়না, স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও তাই বলে।
এখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি তা আসলে যে কোনো হাইব্রিড রেজিম বা দোআঁশলা ব্যবস্থায় যা হয় তা থেকে ভিন্ন কিছু নয়। ইকনোমিস্ট ইন্টিলেজিন্স ইউনিটের হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীর ১৬৭টি দেশের মধ্যে ৩৭টি দেশের অবস্থাই এই রকম; পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ১৬.৭% মানুষ এখন এই ধরণের ব্যবস্থার অধীন। সারা পৃথিবীতেই এখন গণতন্ত্রের পিছু হটার ঘটনা ঘটছে। রাশিয়া, ভেনেজুয়েলা, ফিলিপাইন, তুরস্ক, কম্বোডিয়া, ইথিওপিয়া এর সহজে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ। ১৯৯০-এর দশকে যখন গণতন্ত্রে উত্তরণের পথে কিছু দেশ এই ধরণের ব্যবস্থায় উপনীত হল তখন অনেক আশাবাদী গবেষক, বিশেষজ্ঞরা মনে করতেন যে এই ধরণের দেশগুলোর শাসন ব্যবস্থা সম্ভবত আস্তে আস্তে গণতন্ত্রের দিকেই অগ্রসর হবে, অন্যরা একে এক ধরণের নিশ্চল ব্যবস্থা বলেই মনে করতেন, মনে করতেন যে স্থিতাবস্থা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু গত দুই দশকের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়ে বলা যায় যে এগুলো নিশ্চল নয়, হাইব্রিড রেজিমের পরিবর্তনের পথরেখা গণতন্ত্র অভিমুখী নয়, বরঞ্চ কর্তৃত্ববাদের দিকেই।
যে কোনো হাইব্রিড রেজিমকে টিকে থাকার জন্যে দরকার হয় তিনটি ক্ষেত্রের ওপরে নিয়ন্ত্রণ সেগুলো হচ্ছে নির্বাচন, নির্বাহী ও আইন সভা, এবং বিচার ব্যবস্থা (লেভিতস্কি এবং ওয়ে ২০০২; একম্যান ২০০৯)। গবেষণায় এও দেখা যাচ্ছে যে নির্বাহী বিভাগ, আইন সভা এবং বিচার ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্র তৈরি হয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। যে কোনো হাইব্রিড রেজিমের জন্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দরকার হয় আন্তর্জাতিক বৈধতা অর্জন, ক্ষমতাসীনদের পৃষ্ঠপোষকতার বা পেট্রনেজ নেটওয়ার্ক বজায় রাখা এবং তাঁদের অপরাজেয়তার প্রমাণ হিসেবে। ফলে আমরা দেখতে পাই যে, হাইব্রিড রেজিম, তুরস্ক বা রাশিয়া যে দেশেই হোক না কেন, নির্বাচনের আয়োজনের কথা তাঁরা জোর দিয়ে বলে, কিন্তু সেই নির্বাচন অবাধ এবং সরকারি প্রভাব মুক্ত হলো কীনা, সেই নির্বাচনের সততা বা ইন্টিগ্রিটি প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার বিষয়ে তাঁরা নীরবতা পালন করে থাকে।
এক্ষেত্রে বড় প্রশ্নটি হচ্ছে এই ধরণের নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা কী হওয়া উচিত। কেউ কেউ মনে করেন যে এই ধরণের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ক্ষমতাসীনদের বৈধতা প্রদান করে, ফলে তাঁরা নির্বাচন বর্জনের পক্ষে। কেউ কেউ মনে করেন যে, নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই ক্ষমতাসীনদের ওপর চাপ তৈরি, জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করে গণতন্ত্রায়নের সম্ভাবনা তৈরি করা যাতে পারে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রাশিয়া, তুরস্ক এবং মালয়েশিয়ার নির্বাচনের শিক্ষাগুলো এ ক্ষেত্রে মনোযোগ দাবি করে। মালয়েশিয়ায় বিরোধী দল ও শক্তিগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টাই কেবল ক্ষমতাসীনদের পরাজিত করতে পেরেছে।
বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনে বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণের প্রশ্নটি এই দৃষ্টিকোণ থেকেই বিবেচনা করতে হবে। সে সব দল ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছে তাঁদের এই প্রশ্নের মুখোমুখি হওয়া দরকার যে তাঁরা যে সব বিবেচনায় নির্বাচন বর্জন করেছিলেন তার কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কিনা এবং অপরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তাঁরা নির্বাচনে অংশ নেবেন কিনা, নিলে কী বিবেচনা থেকে অংশ নেবেন। আগামী নির্বাচন সংক্রান্ত আলোচনায় দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি অংশগ্রহণ করবে কিনা তা যথাযথ কারণেই বিশদভাবে আলোচিত হয়; বিএনপি’র ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করা হয়ে থাকে। ২০১৫ সালে কথিত আন্দোলনের কৌশল এবং সে সময়কার ঘটনা প্রবাহের দায় বিএনপি’কে বহন করতে হয়। কিন্তু আসন্ন নির্বাচন কী ধরণের হবে, আদৌ অংশগ্রহণমূলক এবং অবাধ হবে কী না সেই প্রশ্নটিকে কেবল বিএনপি’র অংশগ্রহণের প্রশ্ন, কিংবা দলের প্রধান খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে বিএনপি’র অংশগ্রহণের প্রশ্ন বলে আলোচনা করা সঠিক নয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সিটি কর্পোরেশনগুলোর নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকেই এই বিষয়ে আলোচনা হওয়া দরকার। আলোচিত হওয়া দরকার যে, দোআঁশলা এই ব্যবস্থায় কী ভাবে একটি নির্বাচন করা সম্ভব যা জনগণের অংশগ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করবে এবং নির্ভয়ে তাঁদের রায় প্রদান করতে পারবে। এই নির্বাচন কেবল অভ্যন্তরীণ পর্যবেক্ষকদের সামনে অনুষ্ঠানই যথেষ্ট নয় তা স্থানীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষণে তাঁদের প্রশ্নবিদ্ধ আচরণেই স্পষ্ট (আহমেদ, কামাল, ২০১৮)।
একইভাবে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে বিএনপি’র ওপরেও এই দায়িত্ব বর্তায় যে তাঁরা একে কেবল দলীয় বিবেচনা থেকে বা দলের ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের সুযোগ হিসেবে দেখছে কীনা তা পরিষ্কার করা এবং সেই আলোকেই পদক্ষেপ নেয়া।
সব হাইব্রিড রেজিমেই দৃশ্যত গণতন্ত্রের কিছু কিছু উপাদান থাকলেও হাইব্রিড রেজিম প্রধানত শক্তি প্রয়োগের ওপরে নির্ভর করে। শক্তি প্রয়োগের এই প্রবণতার ফলে রাষ্ট্রের নিপীড়ক যন্ত্রগুলো আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে এবং তাঁদেরকে একধরনের দায়মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু হাইব্রিড রেজিম একই সঙ্গে তার পক্ষে সমর্থক গোষ্ঠীদের সমাবেশ ঘটায়, তাঁদেরকে শক্তিশালী করে, নাগরিকদের মধ্যে তাঁদের যে সমর্থন আছে তাকে বহুভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করে। এ জন্যে গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার, মিথ্যা প্রচার, বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে প্রচলিত পদ্ধতি।
বাংলাদেশে গত এক দশকে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিভাগ যেমন নির্বাহী বিভাগ এবং আইন সভার ওপরে ক্ষমতাসীন দলের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে ২০১৪ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যে সংসদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা না প্রতিনিধিত্বশীল, না কার্যকর। অতীতে সংসদ কার্যকর ভূমিকা পালনে সমর্থ না হলেও যে অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থা বজায় রাখতে পেরেছিল গত চার বছরে তা অবসিত হয়েছে।
বাংলাদেশে এক সময় যে প্রাণবন্ত সিভিল সোসাইটি ছিল আজ তার চিহ্ন পর্যন্ত অবশিষ্ট নেই। সিভিল সোসাইটিকে দলীয়করণের যে ধারা ১৯৯১ সালের পরে তৈরি হয়েছিল সেই সুযোগকে ব্যবহার করে, গত এক দশকে রাষ্ট্র এবং ক্ষমতাসীনদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ‘সিভিল সোসাইটি’র বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে প্রচার চালানো হয়েছে।
এর অন্যতম কারণ হচ্ছে জবাবদিহির একমাত্র ব্যবস্থা হিসেবে নির্বাচনকে প্রতিষ্ঠিত করা। যেহেতু নির্বাচনী ব্যবস্থার ওপরে ক্ষমতাসীনদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং এখন ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের ভাষায় নির্বাচনে তাঁদের বিজয় ‘আনুষ্ঠানিকতা’ মাত্র (প্রথম আলো, ১৬ই মার্চ ২০১৮), সেহেতু আর সব ধরণের জবাবদিহির ব্যবস্থা চূর্ণ করে ফেলাই হচ্ছে ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করার উপায়। গণতান্ত্রিক সমাজে জবাবদিহির ব্যবস্থা যেমন সুষ্ঠু, অবাধ এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন, তেমনিভাবে আরো দুই ধরণের জবাদিহির ব্যবস্থা থাকে সাংবিধানিকভাবে তৈরি করা ক্ষমতাসীনদের প্রভাবমুক্ত প্রতিষ্ঠান (যেমন দুর্নীতি কমিশন) যারা ক্ষমতাসীনদের ওপরে নজরদারি করতে পারেন, আর হচ্ছে সিভিল সোসাইটি যার মধ্যে আছে স্বাধীন গণমাধ্যম এবং অন্যান্য ধরণের প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের অবস্থা এমন এক জায়গায় এসে উপস্থিত হয়েছে যে এর সঙ্গে যুক্ত সাংবাদিক এবং নীতি-নির্ধারকরা দলের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে নিজেদের সিভিল সোসাইটির অংশ মনে করেন না, সিভিল সোসাইটির মানহানি (ভিলিফাই) করার কাজে তারাই অগ্রণী ভূমিকা নিচ্ছেন। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ, স্বতঃপ্রণোদিত সেন্সরশিপ এবং দলীয় আনুগত্য এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে যাতে করে গণমাধ্যমগুলো এখন সমাজের বৃহদাংশের কাছে কতটা আবেদন রাখেন তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
রাশিয়া, তানজানিয়া এবং ভেনেজুয়েলায় বিরাজমান হাইব্রিড রেজিমের টিকে থাকার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে একম্যান তাঁর গবেষণায় দেখান যে, দুর্বল বা অকার্যকর বিরোধী দল এবং দলগুলোর জনবিচ্ছিন্নতা অন্যতম কারণ।
তিনি আরো দেখান যে, রাজনীতি বিষয়ে অনাগ্রহ বা হতাশা সাহায্যকারী উপাদান হিসেবে কাজ করে (একম্যান ২০০৯)। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)-ই শুধু নয়, অন্য দলগুলোর ভূমিকা এবং রাজনীতিকে ব্যক্তিকেন্দ্রিক করে তোলার ফলে দলগুলোর আবেদন সীমিত হয়েছে। রাজনৈতিক কৌশলের ক্ষেত্রে তাঁরা যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চেয়ে কম সফল তা সহজেই বোধগম্য। বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের আচরণের কারণে দল-নির্বিশেষে রাজনীতিকেই দোষারোপ, তরুণদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি অনীহা তৈরি এবং এই ধারণা সৃষ্টি যে তাঁদের ব্যক্তিগত সাফল্য দেশের সার্বিক রাজনীতি থেকে আলাদা সেটা ইচ্ছে করেই তৈরি করে হয়েছে। সমাজে এখন যারা সক্রিয় আছেন তাঁদেরকে ভীতি প্রদর্শনের ঘটনা এখন প্রতিদিনের বিষয়। সে কারণে বিচার বহির্ভূত হত্যা এবং গুমকে স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত করা হয়েছে (এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্যে দেখুন, রীয়াজ ২০১৪)।
বাংলাদেশের বর্তমান শাসন ব্যবস্থাকে হাইব্রিড রেজিম বলে চিহ্নিত করলে বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ পথরেখা অনুধাবন করা দুরূহ হয়না। ইতিমধ্যেই দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের যে প্রবণতা লক্ষ্য করেছি তার মাত্রা যে ক্রমবর্ধমান তাও সহজেই দৃষ্ট। শুধু তাই নয়, এই শক্তি প্রয়োগের বিষয়টি কেবল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতেই সীমিত তা নয়, ক্ষমতাসীন দলের নিমড়বতম স্তরের কর্মীদের মধ্যেও তা বিস্তার লাভ করেছে এবং সমাজের সর্বস্তরে এই ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই দায়মুক্তির জন্যে যথেষ্ট। বাংলাদেশের সমাজে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি, সহিংসতার ব্যাপক বিস্তারের যে সব ঘটনা আমরা প্রত্যক্ষ করেছি তা আগামীতে আরো বৃদ্ধি পাবার আশঙ্কার বাস্তব ভিত্তি এইখানেই।
যেসব দেশে গণতন্ত্র ক্রমাগতভাবে দুর্বল হয়েছে এবং ক্ষয়ের পথে অগ্রসর হয়েছে, বিশেষ করে যেখানে হাইব্রিড রেজিমের উত্থান ঘটেছে, সেখানেই ক্ষমতাসীনরা অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিপরীতে তাদের ক্ষমতায় থাকার যুক্তি হিসেবে, এক ধরণের আদর্শিক বাতাবরণ তৈরি করেছেন। এই সব আদর্শিক বাতাবরণের মধ্যে আছে উগ্র জাতীয়তাবাদ, জাতীয় উন্নয়ন, জাতীয় নিরাপত্তা, ধর্মীয় আদর্শ। এও দেখা গেছে যে, গত কয়েক এক দশকে যে সব দেশে এই ধরণের হাইব্রিড রেজিম তৈরি হয়েছে সেখানে এক ধরণের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে (মাহমুদ ২০১৮)। বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম হয়নি। এই ধরণের প্রবৃদ্ধিকে সাধারণত ‘উন্নয়ন’ বলে বলা হলেও তার সুফল সকলে সমানভাবে ভোগ করে তা নয়। তদুপরি এই ধরণের প্রবৃদ্ধি সমাজের শ্রেণী বিন্যাস বদলে দেয়
এবং তার প্রভাব পরে রাজনীতিতে।
উৎস: সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজ (সিজিএস)-এর জন্য আলোচনাপত্র
লেখক পরিচিতি : লেখক, যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর
No comments