হাসপাতালের বেডে তরিকুলের আর্তনাদ লোমহর্ষক বর্ণনা by আসলাম-উদ-দৌলা
রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার দাবিতে পতাকা হাতে আসা শিক্ষার্থীদের ওপর
বর্বর কায়দায় যে হামলা চালানো হয় তার শিকার বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার
সংরক্ষণ পরিষদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখা যুগ্ম আহ্বায়ক তরিকুল ইসলাম। হামলার
৪র্থ দিনেও সে ক্ষত তাকে বারংবার পীড়া দিচ্ছে। নাড়া দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়
শিক্ষকদের। হাতুড়ি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য সহপাঠীদের করেছে মর্মাহত। পতাকা
হাতে আসা এই শিক্ষার্থীকে বর্বর হামলার স্মৃতি বয়ে বেড়াতে হবে বহুদিন।
গতকাল নগরীর একটি বেসরকারি হাসপাতালের বেডে ব্যথায় কাতর রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রলীগের হামলায় গুরুতর
আহত তরিকুল ইসলামের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়।
তার ভাষায় ফুটে উঠে সেইদিনের লোমহর্ষক বর্ণনা। ওইদিন তরিকুলের আর্তনাদ হামলাকারীদের থামাতে পারেনি। পরে ওদের মধ্য থেকেই কয়েকজন ‘মারা যাবে’ বলে সতর্ক করে। এরপরও যেন হামলাকারীরা থামতে চায়নি।
আহত তরিকুলের ভাষ্যমতে, ‘কোটা সংস্কার দাবিতে সেদিন বিকেলে পতাকা হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করি। সামনে এগুতে দেখি প্রধান ফটকের সামনে অনেক পুলিশ। ফটকও তালাবদ্ধ। আমার সঙ্গে বেশ কয়েকজন সহযোগীও ছিল। কিন্তু হঠাৎ হাতুড়ি, লোহার রড, রামদা আর লাঠিসোটা নিয়ে একদল লোক ‘ধর ধর’ বলে আমাদের তাড়া করছে। সামনের দিকে দৌড়ে তাদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা। দৌড়াতেই পিচঢালা পাকা রাস্তায় আমার এক সহযোগী ওপর হয়ে পড়ে গেল। তার জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাতেই আমার মাথায় তাদের লাঠির আঘাত! ফিনকি দিয়ে বেরুচ্ছিল রক্ত! তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। চতুর্দিক থেকে আমাকে ঘিরে তারা নির্দয়ের মতো শক্ত লাঠি আর হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছিল। ‘মরে যাবো! মরে যাবো! আর মারেন না’ বলে আর্তনাদ করলেও ওদের দয়া হয়নি।’
ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, হাতুড়ি দিয়ে তরিকুলের শরীরে আঘাত করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন। হামলায় রামদা হাতে দেখা গেছে ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী লতিফুল কবির মানিককে। মানিক ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ড নেতা। তার বাড়ি লালমনিরহাট জেলায়। বড় লাঠি দিয়ে তরিকুলকে বেধড়ক আঘাত করছিল মেহেদী হাসান মিশু। মিশুর বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী এলাকায়। হামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে মেহেদী হাসান মিশু বলেন, প্রথম আঘাত সে করেনি। ভিডিওটা প্রথম থেকে দেখলে বোঝা যাবে। তবে হামলার সময় সেখানে ছিলেন বলে স্বীকার করেছে। আরো দেখা গেছে রাবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি মিজানুর রহমান সিন্হা, রমিজুল ইসলাম রিমু, সহসভাপতি আহমেদ সজিব, সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান লাবন প্রমুখকে।
এ ব্যাপারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুু বলেন, কোটা আন্দোলনের নামে শিবির ক্যাডাররা সেদিন ক্যাম্পাসে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তারা পতাকা মিছিলের নামে পতাকার সঙ্গে লাঠি নিয়ে এসেছিল। তাই ছাত্রলীগ চেষ্টা করেছে যে, ক্যাম্পাসে যাতে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে না পারে।
গত সোমবার বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের এই শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় ছাত্রলীগের রোষানলে পড়েন। তারা তাকে লাঠি আর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ডান পা ভেঙে দেয়াসহ পুরো শরীর জখম করে। ব্যথায় জর্জরিত শরীর নিয়েই তাকে গত বৃহস্পতিবার বিকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়তে হয়েছে। পরে ঠাঁই মেলে বেসরকারি এক হাসপাতালে।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার গোমানিগঞ্জ ইউনিয়নের সুন্দরখোল গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলমের ছেলে তরিকুল তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজে মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র। আর ছোটবোন ফাতেমা খাতুন বগুড়া সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
তরিকুল ভাঙ্গা পা, মাথায় ৯ সেলাই আর পুরো শরীরে যখম নিয়ে প্রচণ্ড ব্যথায় হাসপাতাল বেডে কাতরাচ্ছিল। বলছিল- ‘বাবার অভাবের সংসারে আরো দুই ভাইবোন অনার্সে পড়ালেখা করে। বাবা প্রায়ই বলতো- কবে একটা চাকরি করবি, বাবা। সান্ত্বনা দিতাম আর বলতাম, আর কিছুদিন ধৈর্য ধর বাবা। বিসিএসের পড়াশোনাও শুরু করেছিলাম। স্বপ্ন ছিল- বিসিএস ক্যাডার হয়ে কৃষক বাবার দুঃখ ঘুচাবো। কিন্তু স্বপ্নটা আজ দুঃস্বপ্ন। জীবনটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।’ এই বলে বার বার দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছিল তরিকুল।
চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে তরিকুল দুঃখ করে বলছিলেন, ‘ভাঙ্গা পা। পুরো শরীরে জখম। প্রচণ্ড ব্যথায় তিন-চারজন না ধরলে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারি না। আমি মুমূর্ষু একজন রোগী। কিন্তু এই অবস্থায় সরকারি হাসপাতাল থেকে আমাকে (বৃহস্পতিবার বিকালে) রিলিজ দেয়া হয়েছে। এই দুঃখের কথা কাকে বলব।’
এব্যাপারে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জামিলুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসরা যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই করেছে। ডাক্তারদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এটি একটি ক্লিনিক্যাল বিষয়। সুতরাং, তারা যেটা এডভাইস দিয়েছে রোগীর নিয়ম অনুযায়ী দিয়েছেন।’
তরিকুলের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি হাসপাতালের ডা. সাঈদ আহম্মদ বাবু জানান. তার মাথায় ৯টি সেলাই রয়েছে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পিঠে ও কোমরের নিচে বেশ কয়েকটি স্থানে মারাত্মক জখম রয়েছে। এছাড়া ডান পা তো ভেঙেই গেছে। তার শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। শারীরিক অবস্থাও খারাপ। একটু উন্নতি না হলে সার্জারি কিংবা অন্য কোনো কিছু করা যাচ্ছে না।’
হাসপাতালে সার্বক্ষণিক সঙ্গে থাকা তরিকুলের বন্ধু আব্দুল মতিন জানান, বিশ্ববিদ্যায়ের একজন শিক্ষার্থীকে মেরে পা ভেঙে দেয়া হয়েছে। জখম করা হয়েছে পুরো শরীর। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ তরিকুলের খোঁজ নেয়নি। এমনকি হাসপাতাল থেকে এমন মুমুর্ষু রোগীকে রিলিজ দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। মতিনসহ তার বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তরিকুলের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের জোর দাবি জানান। এই ব্যাপারে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমানে সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
রাবির ১৪ শিক্ষকের প্রতিবাদ: দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় জড়িতদের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের আইনি সহায়তার দাবি জানান তারা। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১২৩ নম্বর কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।
এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের বিচারের দাবি জানান ১৪ শিক্ষক। এরা হলেন- গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, শাতিল সিরাজ, মাহাবুবুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক কাজী মামুন হায়দার, প্রভাষক আব্দুল্লাহিল বাকী, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী, সহকারী অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ, নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিব জাকারিয়া, সহকারী অধ্যাপক কাজী শুসমিন আফসানা, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা ও বাংলা বিভাগের ড. সৌভিক রেজা।
সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পুলিশ ও ছাত্রলীগের আগ্রাসী আচরণ এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে, আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা মামলা-হামলার ভয়ে তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার যেন হারিয়ে ফেলেছে। অথচ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি। বরং, নীরবতা দেখতে পেয়েছি। এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার, মামলা ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েও হয়রানির শিকার হচ্ছে।’
তার ভাষায় ফুটে উঠে সেইদিনের লোমহর্ষক বর্ণনা। ওইদিন তরিকুলের আর্তনাদ হামলাকারীদের থামাতে পারেনি। পরে ওদের মধ্য থেকেই কয়েকজন ‘মারা যাবে’ বলে সতর্ক করে। এরপরও যেন হামলাকারীরা থামতে চায়নি।
আহত তরিকুলের ভাষ্যমতে, ‘কোটা সংস্কার দাবিতে সেদিন বিকেলে পতাকা হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢোকার চেষ্টা করি। সামনে এগুতে দেখি প্রধান ফটকের সামনে অনেক পুলিশ। ফটকও তালাবদ্ধ। আমার সঙ্গে বেশ কয়েকজন সহযোগীও ছিল। কিন্তু হঠাৎ হাতুড়ি, লোহার রড, রামদা আর লাঠিসোটা নিয়ে একদল লোক ‘ধর ধর’ বলে আমাদের তাড়া করছে। সামনের দিকে দৌড়ে তাদের হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা। দৌড়াতেই পিচঢালা পাকা রাস্তায় আমার এক সহযোগী ওপর হয়ে পড়ে গেল। তার জন্য থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে তাকাতেই আমার মাথায় তাদের লাঠির আঘাত! ফিনকি দিয়ে বেরুচ্ছিল রক্ত! তৎক্ষণাৎ মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। চতুর্দিক থেকে আমাকে ঘিরে তারা নির্দয়ের মতো শক্ত লাঠি আর হাতুড়ি দিয়ে পেটাচ্ছিল। ‘মরে যাবো! মরে যাবো! আর মারেন না’ বলে আর্তনাদ করলেও ওদের দয়া হয়নি।’
ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, হাতুড়ি দিয়ে তরিকুলের শরীরে আঘাত করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসম্পাদক আবদুল্লাহ আল মামুন। হামলায় রামদা হাতে দেখা গেছে ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী লতিফুল কবির মানিককে। মানিক ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ড নেতা। তার বাড়ি লালমনিরহাট জেলায়। বড় লাঠি দিয়ে তরিকুলকে বেধড়ক আঘাত করছিল মেহেদী হাসান মিশু। মিশুর বাড়ি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাটাখালী এলাকায়। হামলার ব্যাপারে জানতে চাইলে মেহেদী হাসান মিশু বলেন, প্রথম আঘাত সে করেনি। ভিডিওটা প্রথম থেকে দেখলে বোঝা যাবে। তবে হামলার সময় সেখানে ছিলেন বলে স্বীকার করেছে। আরো দেখা গেছে রাবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি মিজানুর রহমান সিন্হা, রমিজুল ইসলাম রিমু, সহসভাপতি আহমেদ সজিব, সাংগঠনিক সম্পাদক হাসান লাবন প্রমুখকে।
এ ব্যাপারে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনুু বলেন, কোটা আন্দোলনের নামে শিবির ক্যাডাররা সেদিন ক্যাম্পাসে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল। তারা পতাকা মিছিলের নামে পতাকার সঙ্গে লাঠি নিয়ে এসেছিল। তাই ছাত্রলীগ চেষ্টা করেছে যে, ক্যাম্পাসে যাতে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে না পারে।
গত সোমবার বিকেলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের মাস্টার্সের এই শিক্ষার্থী ও বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার যুগ্ম আহ্বায়ক কোটা সংস্কার আন্দোলন করতে গিয়ে প্রধান ফটকের সামনের রাস্তায় ছাত্রলীগের রোষানলে পড়েন। তারা তাকে লাঠি আর হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ডান পা ভেঙে দেয়াসহ পুরো শরীর জখম করে। ব্যথায় জর্জরিত শরীর নিয়েই তাকে গত বৃহস্পতিবার বিকালে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ছাড়তে হয়েছে। পরে ঠাঁই মেলে বেসরকারি এক হাসপাতালে।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার গোমানিগঞ্জ ইউনিয়নের সুন্দরখোল গ্রামের কৃষক খোরশেদ আলমের ছেলে তরিকুল তিন ভাইবোনের মধ্যে দ্বিতীয়। বড় ভাই তৌহিদুল ইসলাম বগুড়া সরকারি আযিযুল হক কলেজে মার্কেটিং বিভাগের ছাত্র। আর ছোটবোন ফাতেমা খাতুন বগুড়া সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী।
তরিকুল ভাঙ্গা পা, মাথায় ৯ সেলাই আর পুরো শরীরে যখম নিয়ে প্রচণ্ড ব্যথায় হাসপাতাল বেডে কাতরাচ্ছিল। বলছিল- ‘বাবার অভাবের সংসারে আরো দুই ভাইবোন অনার্সে পড়ালেখা করে। বাবা প্রায়ই বলতো- কবে একটা চাকরি করবি, বাবা। সান্ত্বনা দিতাম আর বলতাম, আর কিছুদিন ধৈর্য ধর বাবা। বিসিএসের পড়াশোনাও শুরু করেছিলাম। স্বপ্ন ছিল- বিসিএস ক্যাডার হয়ে কৃষক বাবার দুঃখ ঘুচাবো। কিন্তু স্বপ্নটা আজ দুঃস্বপ্ন। জীবনটাই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেল।’ এই বলে বার বার দীর্ঘশ্বাস নিচ্ছিল তরিকুল।
চোখে মুখে আতঙ্কের ছাপ নিয়ে তরিকুল দুঃখ করে বলছিলেন, ‘ভাঙ্গা পা। পুরো শরীরে জখম। প্রচণ্ড ব্যথায় তিন-চারজন না ধরলে নড়াচড়া পর্যন্ত করতে পারি না। আমি মুমূর্ষু একজন রোগী। কিন্তু এই অবস্থায় সরকারি হাসপাতাল থেকে আমাকে (বৃহস্পতিবার বিকালে) রিলিজ দেয়া হয়েছে। এই দুঃখের কথা কাকে বলব।’
এব্যাপারে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. জামিলুর রহমান বলেন, ‘চিকিৎসরা যেটা ভালো মনে করেছে সেটাই করেছে। ডাক্তারদের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। এটি একটি ক্লিনিক্যাল বিষয়। সুতরাং, তারা যেটা এডভাইস দিয়েছে রোগীর নিয়ম অনুযায়ী দিয়েছেন।’
তরিকুলের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি হাসপাতালের ডা. সাঈদ আহম্মদ বাবু জানান. তার মাথায় ৯টি সেলাই রয়েছে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে পিঠে ও কোমরের নিচে বেশ কয়েকটি স্থানে মারাত্মক জখম রয়েছে। এছাড়া ডান পা তো ভেঙেই গেছে। তার শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। শারীরিক অবস্থাও খারাপ। একটু উন্নতি না হলে সার্জারি কিংবা অন্য কোনো কিছু করা যাচ্ছে না।’
হাসপাতালে সার্বক্ষণিক সঙ্গে থাকা তরিকুলের বন্ধু আব্দুল মতিন জানান, বিশ্ববিদ্যায়ের একজন শিক্ষার্থীকে মেরে পা ভেঙে দেয়া হয়েছে। জখম করা হয়েছে পুরো শরীর। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিশবিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কেউ তরিকুলের খোঁজ নেয়নি। এমনকি হাসপাতাল থেকে এমন মুমুর্ষু রোগীকে রিলিজ দিলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কেউ এ বিষয়ে কোনো কথা বলেননি। মতিনসহ তার বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে তরিকুলের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহনের জোর দাবি জানান। এই ব্যাপারে জানতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমানে সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
রাবির ১৪ শিক্ষকের প্রতিবাদ: দেশব্যাপী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় জড়িতদের সুষ্ঠু বিচারের দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক। হামলায় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা ও গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের আইনি সহায়তার দাবি জানান তারা। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ১২৩ নম্বর কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব দাবি জানানো হয়।
এ সময় আন্দোলনকারীদের ওপর যারা হামলা করেছে তাদের বিচারের দাবি জানান ১৪ শিক্ষক। এরা হলেন- গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, শাতিল সিরাজ, মাহাবুবুর রহমান, সহকারী অধ্যাপক কাজী মামুন হায়দার, প্রভাষক আব্দুল্লাহিল বাকী, ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন, ফোকলোর বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সুস্মিতা চক্রবর্তী, সহকারী অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ, নাট্যকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হাবিব জাকারিয়া, সহকারী অধ্যাপক কাজী শুসমিন আফসানা, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক সৈয়দ মুহাম্মদ আলী রেজা ও বাংলা বিভাগের ড. সৌভিক রেজা।
সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘পুলিশ ও ছাত্রলীগের আগ্রাসী আচরণ এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে যে, আন্দোলনকারী সাধারণ শিক্ষার্থীরা মামলা-হামলার ভয়ে তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার যেন হারিয়ে ফেলেছে। অথচ কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি। বরং, নীরবতা দেখতে পেয়েছি। এমনকি পুলিশের পক্ষ থেকে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার, মামলা ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। হামলায় আহত শিক্ষার্থীরা সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়েও হয়রানির শিকার হচ্ছে।’
No comments