যেভাবে সৌদি আরবে নাজেহাল হয়েছিলেন সাদ হারিরি (পর্ব-২)
সৌদি
আরবের সঙ্গে সাদ হারিরির সম্পর্ক বেশ কয়েক বছর ধরে অস্বস্তিকর ছিল। তবে
পিতা রফিক হারিরির মতো সাদ হারিরিও তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ও পারিবারিক
বিত্তের অনেকটাই পেয়েছেন সৌদি আরবের কৃপায়। কিন্তু ইরানপন্থী হিজবুল্লাহকে
অনেক ছাড় দিচ্ছে হারিরি সরকার। এ নিয়ে সৌদি আরব অনেকদিন ধরেই বিরক্ত।
হিজবুল্লাহ লেবাননে এতটাই শক্তিধর যে সংগঠনটিকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়
সরকারের পক্ষে।
এ বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে একবার রিয়াদ গিয়েছিলেন হারিরি। ফিরে এসে তিনি অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলেন। তার ধারণা ছিল যে, সৌদি বাদশাহকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা এড়াতে হলে হিজবুল্লাহকে আপাতত ছাড় দেওয়া বৈ উপায় নেই। বৈরুতে ফিরে তিনি হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে বাহক মারফত বার্তা পাঠান যে, সৌদি আরবকে আপাতত শান্ত রাখতে তিনি যেন ইয়েমেন যুদ্ধ ও প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করেন।
কিন্তু হারিরি বেশিদিন স্বস্তিতে থাকতে পারেন নি। ওই সপ্তাহেই সৌদি আরবের কট্টর ইরান-বিরোধী মন্ত্রী থামের আল-সাবান লেবাননকে ‘অবিশ্বাস্য’ পরিস্থিতি ঘটতে পারে বলে সতর্ক করে দেন। পাশাপাশি, তিনি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধানোর অভিযোগ আনেন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে।
৩রা নভেম্বর হারিরি ইরানের সফররত কর্মকর্তা আলি আকবর বেলায়েতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বেলায়েতি ওই সফরে লেবানন ও ইরানের পারস্পরিক সহযোগীতার প্রশংসা করেন। এতেই সম্ভবত সৌদি আরব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
ঠিক কয়েক ঘণ্টা পরই সৌদি বাদশাহর কাছ থেকে বার্তা পান হারিরি: এখনই আসুন।
তার সৌদি সফর হওয়ার কথা ছিল আরও কয়েকদিন পর। কিন্তু এই আদেশ পেয়ে তখনই সৌদি আরবে রওনা দেন হারিরি। লেবাননের প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক জনি মুনায়ের বলেন, প্রধানমন্ত্রী হারিরিকে ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে মরুভূমিতে ক্যাম্পিং করার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
কিন্তু রিয়াদে বিমান অবতরণের পরই সৌদি কর্মকর্তারা হারিরিকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। এরপর তাকে বলা হয় অপেক্ষা করতে। বাদশাহর জন্য নয়, ক্রাউন প্রিন্সের জন্য। হারিরি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করতে কেউই আসেনি।
পরেরদিন সকালে তাকে বলা হয় ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে দেখা করতে। রীতি মোতাবেক রাজকীয় গাড়িবহর পাঠানো হয়নি তাকে নিতে। অগত্যা, নিজের গাড়ি ব্যবহার করেই রাজ দপ্তরের দিকে রওনা দেন তিনি। কিন্তু ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে সাক্ষাতের বদলে, সৌদি কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার জোটে তার কপালে।
রাজ কার্যালয়ে পৌঁছার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর সৌদি টেলিভিশনে নিজের পদত্যাগ ঘোষণা করেন হারিরি। কিন্তু মাঝের এই কয়েক ঘণ্টা কী হয়েছিল তা সম্পর্কে কেউই পুরোপুরি অবগত নন। লেবানিজ কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় হারিরিকে এ নিয়ে বলতে তারা চাপ দিতে চাননি। তবে এক কর্মকর্তা বলেছেন, হারিরিকে এই কয়েক ঘণ্টার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, তিনি মাথা নিচু করে বলেন, আপনারা যা জানেন, এটি ছিল তার চেয়েও খারাপ।
হারিরির বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো অস্ত্রের অভাব নেই সৌদি আরবের। যেমন, সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় আড়াই লাখ লেবানিজ শ্রমিককে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া যেতে পারে। কেননা, এতে লেবাননের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ পড়বে। হারিরি নিজে লেবানন ও সৌদি আরবের দ্বৈত নাগরিক। সৌদি আরবে তার পারিবারিক ব্যবসা আছে বিপুল। দেশটিতে রাজপরিবার চাইলে নিমিষেই তার সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। ফলে হারিরিকে ব্যক্তিগতভাবেও কাবু করার শক্তি রাখে সৌদি আরব। এক আরব কূটনীতিক এ-ও বলেন যে, হারিরির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ গঠনেরও হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
বেলা আড়াইটায় যে কক্ষ থেকে হারিরি নিজের পদত্যাগের ঘোষণা দেন, তা ছিল প্রিন্স মোহাম্মদের দপ্তরের ঠিক নিচে। হারিরির পদত্যাগপত্রে লেখা ছিল, তার পদত্যাগের জন্য হিজবুল্লাহ দায়ী। তার জীবনের ওপরও শঙ্কা আছে। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীরা বলেন, ওই পদত্যাগপত্রে এমন সব শব্দ আছে যা তার সঙ্গে বেমানান।
হারিরির পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টা পরই দুর্নীতির অভিযোগে বহু সৌদি প্রিন্স ও ব্যবসায়ীকে আটক করা শুরু হয়। আটককৃতদের মধ্যে হারিরির সাবেক দুই ব্যবসায়িক আংশীদারও ছিলেন। এভাবে যেন হারিরিকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো, তাকে আটক করাও অসম্ভব কিছু নয়।
পশ্চিমা কূটনীতিক ও লেবানিজ কর্মকর্তারা বলেন, সৌদিরা ভেবেছিল হারিরি যা বলবে, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করবে। আর তাতে গণআন্দোলন শুরু হবে, যার ফলে হিজবুল্লাহর প্রতিপক্ষরা শক্তিশালী হবে। কিন্তু ঘটলো পুরো উল্টোটা। হারিরির পদত্যাগকে সন্দেহের চোখে দেখলো জনগণ। কেউই রাস্তায় নামেনি। পরিস্থিতি আরও জটিল হয় যখন লেবাননের প্রেসিডেন্ট ও হিজবুল্লাহর মিত্র মিশেল আয়োন ওই পদত্যাগপত্র গ্রহণে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, হারিরি নিজে এসে পদত্যাগপত্র না দিলে, তার পদত্যাগ গৃহীত হবে না।
ওদিকে কয়েক ঘণ্টা ধরে হারিরির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। প্রেসিডেন্ট মিশেল আয়োন তার পদত্যাগ গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশের পর হারিরি তাকে ফোন দেন। এটিই ছিল অজ্ঞাতবাসে থাকা অবস্থায় তার প্রথম ফোন কল। কিন্তু ফোনকলে হারিরির কথা শুনেই প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারেন, তার প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছেন না। আর তারপর আর কারোই কিছু বুঝতে বাকি রইলো না।
লেবানিজ কর্মকর্তারা দ্রুতই পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শুরু করেন। পশ্চিমা কূটনীতিকরাও তখন এক হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতিতে। তাদের কাছে লেবানিজ কর্মকর্তারা এক অস্বাভাবিক বার্তা নিয়ে আসেন, যার সারমর্ম হলো, আমাদের কাছে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আটক করে রাখা হয়েছে।
তখন হারিরিকে সৌদি আরবে তারই বাড়ির এক অতিথিশালায় রাখা হয়েছে। বাইরে শুধু সৌদি রক্ষী। নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গেও তার দেখা করা নিষেধ। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকজন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হন। অবশ্য, তিনি কতটা মুক্ত, সেই ব্যাপারে তারা পরস্পরবিরোধী বার্তা নিয়ে ফিরে আসেন। এক কক্ষে দুইজন সৌদি রক্ষী অবস্থান করছিলেন। পশ্চিমা কূটনীতিকরা তার সঙ্গে কথা বলার সময় ওই রক্ষীদের চলে যেতে বলেন। কিন্তু হারিরি বলেন, না, তারা থাকুক।
লেবানিজ কর্মকর্তারা পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করতে গেলে, তারা এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, একজন বিদেশি নেতাকে আরেকটি দেশ কীভাবে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে! তখন লেবাননের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল আব্বাস ইবরাহিম একে ব্যাখ্যা দেন এভাবে: ‘এটি খুব সহজ। আমি দু’জন সৈন্য এনে আপনাকে বলবো টিভিতে বলুন আপনি আপনার দেশকে ঘৃণা করেন।’
এদিকে, আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মধ্যেও ভাবলেশহীন ছিলেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স। তিনি এবার আরেক আরব নেতাকে সৌদি আরবে আমন্ত্রণ জানান। তিনি হলেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। আব্বাসকে সৌদি প্রিন্স ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেন। রিয়াদে আব্বাসকে কী বলা হয়েছিল, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ এসেছে। কিন্তু লেবানন এ নিয়ে আরও উদ্বিগ্ন হয়। কারণ তারা ইসরাইলের সীমান্তবর্তী। দেশটির সঙ্গে তাদের দুইটি যুদ্ধের ক্ষত এখনও লেবানিজদের মনে দগদগে। লেবানন দূত হিসেবে জেনারেল ইবরাহিম ও আম্মানে কর্মরত একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাকে পাঠায় মাহমুদ আব্বাসের কাছ থেকে তার ও সৌদি প্রিন্সের সাক্ষাৎ সম্পর্কে সবিস্তারে জানতে। বেশ অনেক কারণেই এত উদ্বেগ।
প্রথমত, সৌদি আরব আব্বাসকে যেই নির্দেশনা দিয়েছিল, সেই হিসাবে লেবাননে অবস্থিত ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি, লেবাননে সৌদি আরবের এক প্রভাবশালী মিত্র ফিলিস্তিনি ওই শিবিরে থাকা একটি জিহাদি গোষ্ঠিকে ‘সুন্নি বাহিনী’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। কিন্তু এই আহ্বান এতটা বিপজ্জনক ছিল যে, ওই জিহাদিরা নিজেরাই তা প্রত্যাখ্যান করে। এই বিবরণ নিশ্চিত করেন লেবানিজ, ফিলিস্তিনি ও পশ্চিমা কর্মকর্তারা।
হারিরির পদত্যাগের কিছুকাল পরেই ওয়াশিংটন সফর করেন সেই সৌদি মন্ত্রী সাবান। কিন্তু ওয়াশিংটনে তিনি বেশ শীতল অভ্যর্থনা পান। মার্কিন ভারপ্রাপ্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড এম. স্যাটারফিল্ড তার কাছে জানতে চান, কেন লেবাননকে অস্থিতিশীল করে তুলছে সৌদি আরব। এরপর ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও অন্যান্য দেশ ব্যপক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। তারই ফলস্বরূপ এক সমঝোতায় আসে সব পক্ষ, আর হারিরি সৌদি ত্যাগ করেন।
সমঝোতায় জড়িত ছিলেন এমন পশ্চিমা, লেবানিজ ও আরব কূটনীতিকরা বলেন, হারিরিকে দেশে ফেরত যাওয়ার আগে শর্ত বেঁধে দেন প্রিন্স মোহাম্মদ। সেটি হলো, ইয়েমেন থেকে যোদ্ধা সরাতে হিজবুল্লাহকে রাজি করাতে হবে তাকে। অনেক কর্মকর্তা বলেন, এ থেকে প্রমাণ মিলে যে, প্রিন্স মোহাম্মদ আসলে ইয়েমেন সম্পর্কে অত জানেনও না। এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, ইয়েমেনে হিজবুল্লাহর মাত্র ৫০ জন যোদ্ধা আছে। সেখানে হুতি বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগীতায় বড় ভূমিকা পালন করছে বরং ইরান। তাই ইয়েমেনের যুদ্ধ থামাতে বৈরুতকে নাড়া দেওয়াকে অনেকটা ভুল ‘পোস্ট অফিসে চিঠি পাঠানো’র মতো বলে বর্ণনা করেছেন এক লেবানিজ কর্মকর্তা।
তবে এই উত্তাল পরিস্থিতি থেকে রিয়াদের কিছুটা অর্জনও আছে। লেবানিজ কর্মকর্তারা এখন হিজবুল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করছেন একটি সমঝোতায় উপনীত হতে, যাতে করে হিজবুল্লাহ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বর কম করে। পাশাপাশি, বৈরুতে হুতি বিদ্রোহী-পন্থী একটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে সংগঠনটি।
রিয়াদকে শান্ত করতে যথেষ্ট কিছু হারিরি করতে পারবেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর সাম্প্রতিক বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রিন্স মোহাম্মদের সমালোচনা অনুপস্থিত। গত বুধবার তিনি ইয়েমেনে শান্তি আলোচনার ডাক দিয়েছেন, যা সংঘাত নিরসনের পথে বড় ধাপ। কিন্তু মঙ্গলবার ফের হুতি বিদ্রোহীরা রিয়াদে মিশাইল নিক্ষেপ করেছে।
(নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ‘হোয়াই সাদ হারিরি হ্যাড দ্যাট স্ট্রেঞ্জ সোজুর্ন ইন সৌদি অ্যারাবিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বের অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
এ বছরের অক্টোবরের শেষের দিকে একবার রিয়াদ গিয়েছিলেন হারিরি। ফিরে এসে তিনি অনেকটা নিশ্চিন্ত ছিলেন। তার ধারণা ছিল যে, সৌদি বাদশাহকে তিনি বোঝাতে সক্ষম হয়েছেন, রাজনৈতিক অচলাবস্থা এড়াতে হলে হিজবুল্লাহকে আপাতত ছাড় দেওয়া বৈ উপায় নেই। বৈরুতে ফিরে তিনি হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরাল্লাহকে বাহক মারফত বার্তা পাঠান যে, সৌদি আরবকে আপাতত শান্ত রাখতে তিনি যেন ইয়েমেন যুদ্ধ ও প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানকে ব্যক্তিগত আক্রমণ না করেন।
কিন্তু হারিরি বেশিদিন স্বস্তিতে থাকতে পারেন নি। ওই সপ্তাহেই সৌদি আরবের কট্টর ইরান-বিরোধী মন্ত্রী থামের আল-সাবান লেবাননকে ‘অবিশ্বাস্য’ পরিস্থিতি ঘটতে পারে বলে সতর্ক করে দেন। পাশাপাশি, তিনি সৌদি আরবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাধানোর অভিযোগ আনেন হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে।
৩রা নভেম্বর হারিরি ইরানের সফররত কর্মকর্তা আলি আকবর বেলায়েতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। বেলায়েতি ওই সফরে লেবানন ও ইরানের পারস্পরিক সহযোগীতার প্রশংসা করেন। এতেই সম্ভবত সৌদি আরব ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে।
ঠিক কয়েক ঘণ্টা পরই সৌদি বাদশাহর কাছ থেকে বার্তা পান হারিরি: এখনই আসুন।
তার সৌদি সফর হওয়ার কথা ছিল আরও কয়েকদিন পর। কিন্তু এই আদেশ পেয়ে তখনই সৌদি আরবে রওনা দেন হারিরি। লেবাননের প্রখ্যাত রাজনৈতিক বিশ্লেষক জনি মুনায়ের বলেন, প্রধানমন্ত্রী হারিরিকে ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে মরুভূমিতে ক্যাম্পিং করার আমন্ত্রণ জানানো হয়।
কিন্তু রিয়াদে বিমান অবতরণের পরই সৌদি কর্মকর্তারা হারিরিকে তার বাড়িতে নিয়ে যান। এরপর তাকে বলা হয় অপেক্ষা করতে। বাদশাহর জন্য নয়, ক্রাউন প্রিন্সের জন্য। হারিরি সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। কিন্তু তার সঙ্গে দেখা করতে কেউই আসেনি।
পরেরদিন সকালে তাকে বলা হয় ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে দেখা করতে। রীতি মোতাবেক রাজকীয় গাড়িবহর পাঠানো হয়নি তাকে নিতে। অগত্যা, নিজের গাড়ি ব্যবহার করেই রাজ দপ্তরের দিকে রওনা দেন তিনি। কিন্তু ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে সাক্ষাতের বদলে, সৌদি কর্মকর্তাদের দুর্ব্যবহার জোটে তার কপালে।
রাজ কার্যালয়ে পৌঁছার বেশ কয়েক ঘণ্টা পর সৌদি টেলিভিশনে নিজের পদত্যাগ ঘোষণা করেন হারিরি। কিন্তু মাঝের এই কয়েক ঘণ্টা কী হয়েছিল তা সম্পর্কে কেউই পুরোপুরি অবগত নন। লেবানিজ কর্মকর্তারা বলছেন, পরিস্থিতি বিবেচনায় হারিরিকে এ নিয়ে বলতে তারা চাপ দিতে চাননি। তবে এক কর্মকর্তা বলেছেন, হারিরিকে এই কয়েক ঘণ্টার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে, তিনি মাথা নিচু করে বলেন, আপনারা যা জানেন, এটি ছিল তার চেয়েও খারাপ।
হারিরির বিরুদ্ধে ব্যবহার করার মতো অস্ত্রের অভাব নেই সৌদি আরবের। যেমন, সৌদি আরবে কর্মরত প্রায় আড়াই লাখ লেবানিজ শ্রমিককে ফেরত পাঠানোর হুমকি দেওয়া যেতে পারে। কেননা, এতে লেবাননের যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিতে ব্যাপক চাপ পড়বে। হারিরি নিজে লেবানন ও সৌদি আরবের দ্বৈত নাগরিক। সৌদি আরবে তার পারিবারিক ব্যবসা আছে বিপুল। দেশটিতে রাজপরিবার চাইলে নিমিষেই তার সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। ফলে হারিরিকে ব্যক্তিগতভাবেও কাবু করার শক্তি রাখে সৌদি আরব। এক আরব কূটনীতিক এ-ও বলেন যে, হারিরির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ গঠনেরও হুমকি দেওয়া হয়েছিল।
বেলা আড়াইটায় যে কক্ষ থেকে হারিরি নিজের পদত্যাগের ঘোষণা দেন, তা ছিল প্রিন্স মোহাম্মদের দপ্তরের ঠিক নিচে। হারিরির পদত্যাগপত্রে লেখা ছিল, তার পদত্যাগের জন্য হিজবুল্লাহ দায়ী। তার জীবনের ওপরও শঙ্কা আছে। প্রধানমন্ত্রীর সহযোগীরা বলেন, ওই পদত্যাগপত্রে এমন সব শব্দ আছে যা তার সঙ্গে বেমানান।
হারিরির পদত্যাগের কয়েক ঘণ্টা পরই দুর্নীতির অভিযোগে বহু সৌদি প্রিন্স ও ব্যবসায়ীকে আটক করা শুরু হয়। আটককৃতদের মধ্যে হারিরির সাবেক দুই ব্যবসায়িক আংশীদারও ছিলেন। এভাবে যেন হারিরিকে মনে করিয়ে দেওয়া হলো, তাকে আটক করাও অসম্ভব কিছু নয়।
পশ্চিমা কূটনীতিক ও লেবানিজ কর্মকর্তারা বলেন, সৌদিরা ভেবেছিল হারিরি যা বলবে, মানুষ তা-ই বিশ্বাস করবে। আর তাতে গণআন্দোলন শুরু হবে, যার ফলে হিজবুল্লাহর প্রতিপক্ষরা শক্তিশালী হবে। কিন্তু ঘটলো পুরো উল্টোটা। হারিরির পদত্যাগকে সন্দেহের চোখে দেখলো জনগণ। কেউই রাস্তায় নামেনি। পরিস্থিতি আরও জটিল হয় যখন লেবাননের প্রেসিডেন্ট ও হিজবুল্লাহর মিত্র মিশেল আয়োন ওই পদত্যাগপত্র গ্রহণে অসম্মতি জানান। তিনি বলেন, হারিরি নিজে এসে পদত্যাগপত্র না দিলে, তার পদত্যাগ গৃহীত হবে না।
ওদিকে কয়েক ঘণ্টা ধরে হারিরির সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। প্রেসিডেন্ট মিশেল আয়োন তার পদত্যাগ গ্রহণে অসম্মতি প্রকাশের পর হারিরি তাকে ফোন দেন। এটিই ছিল অজ্ঞাতবাসে থাকা অবস্থায় তার প্রথম ফোন কল। কিন্তু ফোনকলে হারিরির কথা শুনেই প্রেসিডেন্ট বুঝতে পারেন, তার প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছেন না। আর তারপর আর কারোই কিছু বুঝতে বাকি রইলো না।
লেবানিজ কর্মকর্তারা দ্রুতই পশ্চিমা কূটনীতিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শুরু করেন। পশ্চিমা কূটনীতিকরাও তখন এক হতবুদ্ধিকর পরিস্থিতিতে। তাদের কাছে লেবানিজ কর্মকর্তারা এক অস্বাভাবিক বার্তা নিয়ে আসেন, যার সারমর্ম হলো, আমাদের কাছে বিশ্বাস করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে আটক করে রাখা হয়েছে।
তখন হারিরিকে সৌদি আরবে তারই বাড়ির এক অতিথিশালায় রাখা হয়েছে। বাইরে শুধু সৌদি রক্ষী। নিজের স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গেও তার দেখা করা নিষেধ। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই বেশ কয়েকজন পশ্চিমা রাষ্ট্রদূত তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে সক্ষম হন। অবশ্য, তিনি কতটা মুক্ত, সেই ব্যাপারে তারা পরস্পরবিরোধী বার্তা নিয়ে ফিরে আসেন। এক কক্ষে দুইজন সৌদি রক্ষী অবস্থান করছিলেন। পশ্চিমা কূটনীতিকরা তার সঙ্গে কথা বলার সময় ওই রক্ষীদের চলে যেতে বলেন। কিন্তু হারিরি বলেন, না, তারা থাকুক।
লেবানিজ কর্মকর্তারা পশ্চিমা রাষ্ট্রদূতদের ঘটনা সম্পর্কে অবহিত করতে গেলে, তারা এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন যে, একজন বিদেশি নেতাকে আরেকটি দেশ কীভাবে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে! তখন লেবাননের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জেনারেল আব্বাস ইবরাহিম একে ব্যাখ্যা দেন এভাবে: ‘এটি খুব সহজ। আমি দু’জন সৈন্য এনে আপনাকে বলবো টিভিতে বলুন আপনি আপনার দেশকে ঘৃণা করেন।’
এদিকে, আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মধ্যেও ভাবলেশহীন ছিলেন সৌদি ক্রাউন প্রিন্স। তিনি এবার আরেক আরব নেতাকে সৌদি আরবে আমন্ত্রণ জানান। তিনি হলেন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস। আব্বাসকে সৌদি প্রিন্স ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক বিষয়ে কিছু নির্দেশনা দেন। রিয়াদে আব্বাসকে কী বলা হয়েছিল, তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বিবরণ এসেছে। কিন্তু লেবানন এ নিয়ে আরও উদ্বিগ্ন হয়। কারণ তারা ইসরাইলের সীমান্তবর্তী। দেশটির সঙ্গে তাদের দুইটি যুদ্ধের ক্ষত এখনও লেবানিজদের মনে দগদগে। লেবানন দূত হিসেবে জেনারেল ইবরাহিম ও আম্মানে কর্মরত একজন ফিলিস্তিনি কর্মকর্তাকে পাঠায় মাহমুদ আব্বাসের কাছ থেকে তার ও সৌদি প্রিন্সের সাক্ষাৎ সম্পর্কে সবিস্তারে জানতে। বেশ অনেক কারণেই এত উদ্বেগ।
প্রথমত, সৌদি আরব আব্বাসকে যেই নির্দেশনা দিয়েছিল, সেই হিসাবে লেবাননে অবস্থিত ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবির আরও অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। পাশাপাশি, লেবাননে সৌদি আরবের এক প্রভাবশালী মিত্র ফিলিস্তিনি ওই শিবিরে থাকা একটি জিহাদি গোষ্ঠিকে ‘সুন্নি বাহিনী’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানান। কিন্তু এই আহ্বান এতটা বিপজ্জনক ছিল যে, ওই জিহাদিরা নিজেরাই তা প্রত্যাখ্যান করে। এই বিবরণ নিশ্চিত করেন লেবানিজ, ফিলিস্তিনি ও পশ্চিমা কর্মকর্তারা।
হারিরির পদত্যাগের কিছুকাল পরেই ওয়াশিংটন সফর করেন সেই সৌদি মন্ত্রী সাবান। কিন্তু ওয়াশিংটনে তিনি বেশ শীতল অভ্যর্থনা পান। মার্কিন ভারপ্রাপ্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড এম. স্যাটারফিল্ড তার কাছে জানতে চান, কেন লেবাননকে অস্থিতিশীল করে তুলছে সৌদি আরব। এরপর ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, মিশর ও অন্যান্য দেশ ব্যপক কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করে। তারই ফলস্বরূপ এক সমঝোতায় আসে সব পক্ষ, আর হারিরি সৌদি ত্যাগ করেন।
সমঝোতায় জড়িত ছিলেন এমন পশ্চিমা, লেবানিজ ও আরব কূটনীতিকরা বলেন, হারিরিকে দেশে ফেরত যাওয়ার আগে শর্ত বেঁধে দেন প্রিন্স মোহাম্মদ। সেটি হলো, ইয়েমেন থেকে যোদ্ধা সরাতে হিজবুল্লাহকে রাজি করাতে হবে তাকে। অনেক কর্মকর্তা বলেন, এ থেকে প্রমাণ মিলে যে, প্রিন্স মোহাম্মদ আসলে ইয়েমেন সম্পর্কে অত জানেনও না। এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, ইয়েমেনে হিজবুল্লাহর মাত্র ৫০ জন যোদ্ধা আছে। সেখানে হুতি বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ ও সহযোগীতায় বড় ভূমিকা পালন করছে বরং ইরান। তাই ইয়েমেনের যুদ্ধ থামাতে বৈরুতকে নাড়া দেওয়াকে অনেকটা ভুল ‘পোস্ট অফিসে চিঠি পাঠানো’র মতো বলে বর্ণনা করেছেন এক লেবানিজ কর্মকর্তা।
তবে এই উত্তাল পরিস্থিতি থেকে রিয়াদের কিছুটা অর্জনও আছে। লেবানিজ কর্মকর্তারা এখন হিজবুল্লাহর সঙ্গে আলোচনা করছেন একটি সমঝোতায় উপনীত হতে, যাতে করে হিজবুল্লাহ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে বাগাড়ম্বর কম করে। পাশাপাশি, বৈরুতে হুতি বিদ্রোহী-পন্থী একটি টেলিভিশন চ্যানেল বন্ধ করে সংগঠনটি।
রিয়াদকে শান্ত করতে যথেষ্ট কিছু হারিরি করতে পারবেন কিনা তা স্পষ্ট নয়। তবে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহর সাম্প্রতিক বক্তব্য-বিবৃতিতে প্রিন্স মোহাম্মদের সমালোচনা অনুপস্থিত। গত বুধবার তিনি ইয়েমেনে শান্তি আলোচনার ডাক দিয়েছেন, যা সংঘাত নিরসনের পথে বড় ধাপ। কিন্তু মঙ্গলবার ফের হুতি বিদ্রোহীরা রিয়াদে মিশাইল নিক্ষেপ করেছে।
(নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত ‘হোয়াই সাদ হারিরি হ্যাড দ্যাট স্ট্রেঞ্জ সোজুর্ন ইন সৌদি অ্যারাবিয়া’ শীর্ষক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বের অনুবাদ। অনুবাদ করেছেন মাহমুদ ফেরদৌস।)
No comments