সুন্দরবনের শেষ বেলায় by শাহদীন মালিক
হাফপ্যান্ট পরার বয়সে অনেকবার সুন্দরবনে গিয়েছিলাম। খুলনা থেকে লঞ্চে করে দক্ষিণে, অনেকবার একেবারে দক্ষিণের শেষ মাথা পর্যন্ত, যেখানে নদী বঙ্গোপসাগরে মিলায়। বন বিভাগের চাকুরে বাবা তখন ছিলেন সুন্দরবনের দায়িত্বে। তাঁকে বনের ভেতরে যেতে হতো ঘন ঘন। আমরা তাঁর সঙ্গে যেতাম প্রতি দুই-তিন মাসে একবার। সরকারি বাসা ছিল সরকারি লঞ্চঘাটের পাশে। মাঝেমধ্যে স্কুল ছুটির পর স্কুল থেকেই সোজা লঞ্চঘাটে। বন বিভাগের দুটো বড় লঞ্চ ছিল, ছোট লঞ্চ-নৌকা ছিল অজস্র। সুন্দরবনের মাঝখানে দুজনেই হাফপ্যান্ট পরা আর হাতে দোনলা বিরাট বন্দুক। আমাদের উচ্চতা আর বন্দুকের দৈর্ঘ্য প্রায় সমান। তখন আমাদের বলা হতো বন্দুকের নলার আগা যাতে কোনো কিছু স্পর্শ না করে—মাটি, গাছ, নিজের পা, কোথাও যেন না ছুঁয়ে যায়। ওভাবে বন্দুক বহন করার বাহাদুরিটা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য। বলা বাহুল্য, সেই গাদাবন্দুক দিয়ে গুলি ছোড়ার জন্য শরীরের যে ওজন দরকার, তা হতে অনেক বছরের তরুণ হতে হয়। সে সময় ছিলাম বালক। তখনকার যে ছবি আমার সংগ্রহে আছে, তাতে আমার পাশে দাঁড়ানো বন্দুক নিয়ে অন্য বালকটি ছিল রুমী—জাহানারা ইমামের পুত্র।
অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তাই নদীর নাম এখন মনে পড়ছে না। নদীটার তীরে শীতের সকালে দুই-তিন কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ডজন ডজন কুমির চিত হয়ে রোদ পোহাত। লঞ্চের ইঞ্জিন খুব আস্তে বা একেবারে বন্ধ করে দিয়ে নদী দিয়ে ভেসে গেলে কুমিররা মোটেও বিরক্ত হতো না। অবশ্য ইঞ্জিনের শব্দ হলে ঝুপঝুপ করে নদীতে নেমে পড়ত। সুন্দরবনের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে নদী-সমুদ্রের মোহনায় যেখানে জঙ্গল বা গাছের ঘনত্ব থাকত কম, সেখানে বালুচরে সন্ধ্যায় হরিণের পাল দেখা যেত। দু-তিনবার লঞ্চ থেকে সাঁতার কেটে নদী পার হতে দেখেছি বাঘ মামাকে। মাছের কোনো হিসাব–নিকাশ ছিল না। জেলেদের নৌকা থেকে গলদা চিংড়ি কেনা হতো ছোট বালতির হিসাবে। এক বালতি চিংড়ি এক বা দুই টাকা, সঙ্গে বেশ কিছু রুপচাঁদা আর ভেটকি মাছ ফাউ। বাবার চাকরির সুবাদেই ময়মনসিংহের মধুপুরের জঙ্গলে ছোট চিতাবাঘ দেখেছি। শূকর, হনুমান আর বানর ছিল জঙ্গলে শত শত, হাজার হাজার, পাখি বেশুমার। সিলেটেও বাঘ দেখেছি আর বিল-হাওরের মাছরাঙা পাখির টকটকে উজ্জ্বল কত যে রং হতে পারে, তা যাঁরা হরেক কিছিমের মাছরাঙা দেখেননি, তাঁদের পক্ষে আন্দাজ করা অতি দুরূহ। সেই বন-জঙ্গল আর বন্য পশুর খুব অল্পই এখনো টিকে আছে। গত বছর বেশ কিছুদিন পর পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। বান্দরবান হয়ে রাঙামাটি। রাস্তার পাশে সব লেংটা লেংটা পাহাড়-টিলা। কবে যে গাছ কাটা হয়ে গেছে, কে জানে।
অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। তাই নদীর নাম এখন মনে পড়ছে না। নদীটার তীরে শীতের সকালে দুই-তিন কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ডজন ডজন কুমির চিত হয়ে রোদ পোহাত। লঞ্চের ইঞ্জিন খুব আস্তে বা একেবারে বন্ধ করে দিয়ে নদী দিয়ে ভেসে গেলে কুমিররা মোটেও বিরক্ত হতো না। অবশ্য ইঞ্জিনের শব্দ হলে ঝুপঝুপ করে নদীতে নেমে পড়ত। সুন্দরবনের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে নদী-সমুদ্রের মোহনায় যেখানে জঙ্গল বা গাছের ঘনত্ব থাকত কম, সেখানে বালুচরে সন্ধ্যায় হরিণের পাল দেখা যেত। দু-তিনবার লঞ্চ থেকে সাঁতার কেটে নদী পার হতে দেখেছি বাঘ মামাকে। মাছের কোনো হিসাব–নিকাশ ছিল না। জেলেদের নৌকা থেকে গলদা চিংড়ি কেনা হতো ছোট বালতির হিসাবে। এক বালতি চিংড়ি এক বা দুই টাকা, সঙ্গে বেশ কিছু রুপচাঁদা আর ভেটকি মাছ ফাউ। বাবার চাকরির সুবাদেই ময়মনসিংহের মধুপুরের জঙ্গলে ছোট চিতাবাঘ দেখেছি। শূকর, হনুমান আর বানর ছিল জঙ্গলে শত শত, হাজার হাজার, পাখি বেশুমার। সিলেটেও বাঘ দেখেছি আর বিল-হাওরের মাছরাঙা পাখির টকটকে উজ্জ্বল কত যে রং হতে পারে, তা যাঁরা হরেক কিছিমের মাছরাঙা দেখেননি, তাঁদের পক্ষে আন্দাজ করা অতি দুরূহ। সেই বন-জঙ্গল আর বন্য পশুর খুব অল্পই এখনো টিকে আছে। গত বছর বেশ কিছুদিন পর পার্বত্য চট্টগ্রামে গিয়েছিলাম। বান্দরবান হয়ে রাঙামাটি। রাস্তার পাশে সব লেংটা লেংটা পাহাড়-টিলা। কবে যে গাছ কাটা হয়ে গেছে, কে জানে।
আর চারা লাগানো হয়নি। বাবা বন বিভাগে চাকরি নিয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে, পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হওয়ার পর। বছর পাঁচেক আগে প্রথম জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘বন বিভাগে কেন?’ ‘পাস করার পর প্রথম যে চাকরির বিজ্ঞাপন চোখে পড়েছিল, সেটা ছিল বন বিভাগের।’ সিলেট সব সময়ই ছিল আসাম প্রদেশের, রাজধানী ছিল শিলং। ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ সরকারের বন বিভাগে চাকরি করে অবসরে যান ১৯৮৪ সালে। পরে আরও ১০ বছর ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচারে (আইইউসিএন) চাকরি। ১৯৯৭-৯৮ বা ওই রকম এক সময়ে বাবা খুব হতাশার সুরে বলেছিলেন, পশুপাখি, বন-জঙ্গল এ দেশে কিছু হয়তো থাকবে না। বুড়ো বয়সে তাঁর এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছিল যে আমাদের উন্নয়ন-ধারণা মোটেও পরিবেশবান্ধব নয়। উন্নয়নের জন্য আমরা পরিবেশ বিসর্জন দেব। বাবা শেষের দিকে আর বন-জঙ্গলের কথা বলতেন না। এত বন-জঙ্গল উজাড় হয়ে গেলে দেশটাও উজাড় হয়ে যাবে, অর্থাৎ বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়বে। বসবাসের জন্য ঢাকা এখন বিশ্বের চতুর্থ নিকৃষ্টতম শহর। পুরো দেশের অবস্থা খুব বেশি ওপরে হওয়ার কথা নয়। নিকৃষ্ট, তা বুঝি আমরা। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, রামপালে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে। অবশ্যই হবে। দেশের উন্নয়ন হচ্ছে না!
দুই. সরকার এসেছে, সরকার গিয়েছে। সরকারগুলো হাজারীবাগের ট্যানারি নিয়ে হম্বিতম্বি করছে বহু বছর ধরে। জোট সরকার, মহাজোট সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সেনা-সমর্থিত সরকার, সাম্প্রদায়িক শক্তি-সমর্থিত সরকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক ও অসাম্প্রদায়িক, অর্থাৎ কোনো ধরনের সরকারই বাদ নেই। কিন্তু ট্যানারি সেই ট্যানারির জায়গায়ই আছে। নদী শেষ করেছে, লাখো মানুষের জীবন শেষ করছে। পরিবেশ-টরিবেশ তো খুচরা ব্যাপার। সরকারি কলকারখানা সম্পর্কে ২৮ এপ্রিলের প্রথম আলো বলছে, বিসিআইসির ১৪টি কারখানার মধ্যে ১০টিতে নেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা; সাতটিতে নেই কোনো বর্জ্য পরিশোধনাগার। এটাই শেষ নয়, পাঁচটির কোনো পরিবেশ ছাড়পত্রই নেই। তবে হ্যাঁ, পরিবেশ অধিদপ্তর হয়েছে একটা পরিবেশ আইনের অধীনে। পরিবেশ রক্ষা করবে। কেউ পরিবেশ আইন ভঙ্গ করলে অধিদপ্তর মামলা করবে। পরিবেশ আদালতও হয়েছে পরিবেশ মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য। ছোট্ট একটা কিন্তু আছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো নিজস্ব পরিবেশ আইনে বিশেষজ্ঞ আইন কর্মকর্তা নেই, মাঝেমধ্যে দু-একজন বিচারক প্রেষণে আসেন। অর্থাৎ পরিবেশ আইন অনুযায়ী পরিবেশ রক্ষার আইনগত ব্যবস্থা শুধু আইনেই সীমাবদ্ধ। আইনজীবী না হলে না-ই হলো, বন রক্ষা করতে বন কর্মকর্তা তো লাগবে। সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে ১৯৮৬ থেকে ২০০৩ সালের আগ পর্যন্ত একজন বন কর্মকর্তাও নিয়োগ দেয়নি কোনো সরকার। ২০০৩ সালে ১৭ বছর পর একসঙ্গে ৩০ জন বন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তারপর গত ১২ বছরে বন কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন মোট ৩৮ জন। বছরে গড়ে জনা তিনেক।
তিন. বিভিন্ন কারণে পরিবেশ নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। পরিবেশ, বন-জঙ্গল, পশুপাখি রক্ষা করার ক্ষমতা সরকারের। কিন্তু সরকারের গত দুই দশকের কোনো লোক কি বলতে পারবে যে এই বড় দূষণটা তারা ভীষণভাবে কমিয়ে বা রোধ করে পরিবেশ ও বনের বড় রকমের উন্নতি করেছে? সরকার যখন, বিশেষত সরকারপ্রধান যখন বলছেন রামপাল থেকে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না, তখন নিশ্চয় হবে না। কয়েক বছর আগেও সুন্দরবনে বাঘ ছিল সাড়ে চার শর মতো। এখন বলা হচ্ছে সোয়া শ। বাবা মারা গেছেন গত বছর, ৯০ বছর বয়সে। বেঁচে থাকলে রামপাল নিয়ে সম্ভবত উল্লসিত হতেন না। আমাদের বাসায় সেগুন কাঠের ফার্নিচার কখনো ছিল না, এখনো নেই।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।
দুই. সরকার এসেছে, সরকার গিয়েছে। সরকারগুলো হাজারীবাগের ট্যানারি নিয়ে হম্বিতম্বি করছে বহু বছর ধরে। জোট সরকার, মহাজোট সরকার, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, সেনা-সমর্থিত সরকার, সাম্প্রদায়িক শক্তি-সমর্থিত সরকার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক-বাহক ও অসাম্প্রদায়িক, অর্থাৎ কোনো ধরনের সরকারই বাদ নেই। কিন্তু ট্যানারি সেই ট্যানারির জায়গায়ই আছে। নদী শেষ করেছে, লাখো মানুষের জীবন শেষ করছে। পরিবেশ-টরিবেশ তো খুচরা ব্যাপার। সরকারি কলকারখানা সম্পর্কে ২৮ এপ্রিলের প্রথম আলো বলছে, বিসিআইসির ১৪টি কারখানার মধ্যে ১০টিতে নেই দূষণ নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা; সাতটিতে নেই কোনো বর্জ্য পরিশোধনাগার। এটাই শেষ নয়, পাঁচটির কোনো পরিবেশ ছাড়পত্রই নেই। তবে হ্যাঁ, পরিবেশ অধিদপ্তর হয়েছে একটা পরিবেশ আইনের অধীনে। পরিবেশ রক্ষা করবে। কেউ পরিবেশ আইন ভঙ্গ করলে অধিদপ্তর মামলা করবে। পরিবেশ আদালতও হয়েছে পরিবেশ মামলা নিষ্পত্তি করার জন্য। ছোট্ট একটা কিন্তু আছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো নিজস্ব পরিবেশ আইনে বিশেষজ্ঞ আইন কর্মকর্তা নেই, মাঝেমধ্যে দু-একজন বিচারক প্রেষণে আসেন। অর্থাৎ পরিবেশ আইন অনুযায়ী পরিবেশ রক্ষার আইনগত ব্যবস্থা শুধু আইনেই সীমাবদ্ধ। আইনজীবী না হলে না-ই হলো, বন রক্ষা করতে বন কর্মকর্তা তো লাগবে। সরকারি কর্মকমিশনের মাধ্যমে ১৯৮৬ থেকে ২০০৩ সালের আগ পর্যন্ত একজন বন কর্মকর্তাও নিয়োগ দেয়নি কোনো সরকার। ২০০৩ সালে ১৭ বছর পর একসঙ্গে ৩০ জন বন কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। তারপর গত ১২ বছরে বন কর্মকর্তা নিযুক্ত হয়েছেন মোট ৩৮ জন। বছরে গড়ে জনা তিনেক।
তিন. বিভিন্ন কারণে পরিবেশ নিয়ে কখনো মাথা ঘামাইনি। পরিবেশ, বন-জঙ্গল, পশুপাখি রক্ষা করার ক্ষমতা সরকারের। কিন্তু সরকারের গত দুই দশকের কোনো লোক কি বলতে পারবে যে এই বড় দূষণটা তারা ভীষণভাবে কমিয়ে বা রোধ করে পরিবেশ ও বনের বড় রকমের উন্নতি করেছে? সরকার যখন, বিশেষত সরকারপ্রধান যখন বলছেন রামপাল থেকে সুন্দরবনের কোনো ক্ষতি হবে না, তখন নিশ্চয় হবে না। কয়েক বছর আগেও সুন্দরবনে বাঘ ছিল সাড়ে চার শর মতো। এখন বলা হচ্ছে সোয়া শ। বাবা মারা গেছেন গত বছর, ৯০ বছর বয়সে। বেঁচে থাকলে রামপাল নিয়ে সম্ভবত উল্লসিত হতেন না। আমাদের বাসায় সেগুন কাঠের ফার্নিচার কখনো ছিল না, এখনো নেই।
ড. শাহদীন মালিক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট। শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক।
No comments