‘ত্যাগ চাই মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না’
আজ পহেলা আগস্ট। একটি বেদনাবিধুর মাসের শুরু। এই মাসের পনেরো তারিখে বাংলাদেশের মাটিতে একটি কারবালা-কাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। দেড় হাজার বছর আগে আরবি মহররম মাসে কারবালার মাঠে ইমাম হোসেনকে তার পরিবারের অনেক সদস্যসহ হত্যা করেছিল ক্ষমতালোলুপ এজিদের দল। আর এখন থেকে একচল্লিশ বছর আগে ইংরেজি আগস্ট মাসে বাংলাদেশের নব্য এজিদের দল সপরিবারে হত্যা করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। তার দুই কন্যা মাত্র বেঁচে গিয়েছিলেন। মহররমের মতোই আগস্ট মাস বাংলার মানুষের কাছে একটি শোকের মাস। মহররম নিয়ে নজরুল কবিতা লিখেছিলেন, ‘মহররমের চাঁদ এলো ওই কাঁদাতে ফের দুনিয়ায়।’ বঙ্গবন্ধ হত্যাকাণ্ডের সময় নজরুল ছিলেন জীবন্মৃত, স্মৃতিশক্তিহীন। তিনি যদি সুস্থ ও স্বাভাবিক থাকতেন, তাহলে তার কলম হয়তো আবার শোকের তরবারিতে রূপান্তরিত হতো।
মহররম যেমন বিশ্ব মুসলমানের কাছে একটি শোকের মাস, ইংরেজি আগস্ট মাস তেমনি বাংলার মানুষের কাছে একটি শোকের মাস। পশ্চিমা বিশ্বে কোনো মাস বা দিন শোকের মাস বা দিন হিসেবে চিহ্নিত হয় না। কারও মৃত্যু হলে তারা বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক প্রকাশ করে। তারপর আর শোক নয়, মৃত ব্যক্তি, তিনি বিখ্যাত লোক হলেও জন্ম বা মৃত্যুদিবসে ভাবগম্ভীর পরিবেশে তাকে স্মরণ করে। তার বা তাদের জীবন ও কর্ম পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যেসব ব্রিটিশ সৈন্য ও নাগরিক আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের জন্য এখন আর শোক প্রকাশ করা হয় না। তাদের জন্য সরকারিভাবে Rememberence day বা স্মরণ দিবস পালন করা হয়। এই স্মরণ দিবসে ঘটে ব্রিটিশ জাতির মধ্যে অভাবনীয় ঐক্যের প্রকাশ। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতা ফুলের মালা হাতে মৃত সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভে এসে দাঁড়ান এবং যুক্তভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এদিন ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে দলমতের কোনো পার্থক্য থাকে না। তাদের এক ও অভিন্ন চরিত্রের প্রকাশ ঘটে।
এ ব্যাপারে আমাদের দেশের চরিত্র ও চেহারাটা ভিন্ন। জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন- স্বাধীনতা লাভের যুদ্ধে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, বাংলাদেশের Founding father বা স্থপতি পিতা হিসেবে যিনি বিশ্বময় স্বীকৃত, তার শোকাবহ মৃত্যু দিবসে জাতি শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করলেও নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন না। এই পরম শোকের দিনটিতেও বাংলাদেশের নব্য এজিদের দলের নেত্রী তার বানোয়াট জন্মদিবসে কয়েক মণ ওজনের কেক কেটে উৎসব করেন। ভক্তদের স্তুতি শোনেন এবং রঙিন বেলুন ওড়ান। ভারতে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সমর্থক দলটি গান্ধীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আহমেদাবাদে মিষ্টি বিতরণ করে উৎসব পালন করেছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তখন গান্ধী-রাজনীতির চরম বিরোধী হলেও এক বিবৃতি প্রকাশ করে গড্সের সমর্থকদের নিন্দা জানিয়ে বলেছিল, ‘এর চাইতে বড় অশ্লীলতা আর কিছু হতে পারে না।’ চার্চিল-রাজনীতির ঘোরবিরোধী ব্রিটিশ লেবার পার্টির ভূতপূর্ব নেতা ক্লেমেন্ট এটলি চার্চিলের জন্মদিনে তাকে ফুল উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘সিজারকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি, হত্যা করতে আসিনি।’ আর বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির নেত্রী জাতির পিতার মৃত্যু দিবসকেও উৎসবের দিবসে পরিণত করতে চান। জাতীয় শোকের যে মাস অথবা দিবসটি যুক্তভাবে পালন দ্বারা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি গড়ে তোলা যেত, সেই ভিত্তিটিকেও একটি দল ও গোষ্ঠী প্রতি বছর ভাঙতে চান আর মুখে বলেন জাতীয় ঐক্য চাই।
প্রতি বছর আগস্ট মাস এলে আমরা জাতির পিতার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করি। কিন্তু তাকে অন্তর থেকে স্মরণ এবং তার আদর্শে নতুন করে ব্রতী হওয়ার শপথ গ্রহণ করি কি? মহররম মাস উপলক্ষে নজরুলই আবার লিখেছিলেন, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’ অর্থাৎ মহররম মাসে শহীদ ইমাম হোসেন ও তার পরিবার-পরিজনের জন্য কান্না ও মর্সিয়া গীত (শোকের গীত) চাই না। চাই ইমাম হোসেনের ত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হওয়ার শপথ। এই যুগে বাংলাদেশেও আগস্ট মাস এলেই কেবল শোকের মাতম তুললেই চলবে না, শোককে শপথে পরিণত করতে হবে। এই শপথ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষা করার। তা না করে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মাসটিকে আনুষ্ঠানিকতার মাসে পরিণত করলে তাকে জাতীয় জীবনে ধরে রাখা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শটি কী ছিল? কেবল বারবার নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসা? গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপস করে ক্ষমতায় থাকা? তা যদি হতো তাহলে তো তিনি সত্তরের নির্বাচনে জিতে সামরিক জান্তার সঙ্গে আপস করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। তিনি তা না করে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন কেন? আর সেই সংগ্রামে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে দেশের নব্যধনী এবং তাদের সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে আপস করে ওই ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার ব্যবস্থা না করে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের পথ ধরেছিলেন কেন এবং সেই বিপ্লবেই আত্মাহুতি দিলেন কেন? এই সত্যটি অনুধাবন করার চেষ্টা আজকাল বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই করেন কি?
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা উঠলেই আপ্তবাক্য হল, তিনি গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু সেটা কোন্ গণতন্ত্র? পশ্চিমা গণতন্ত্র? বুর্জোয়া গণতন্ত্র? না চীন ও সাবেক পূর্ব ইউরোপীয় জনগণতন্ত্র (People's democracy)? বঙ্গবন্ধু তার অভীষ্ট লক্ষ্যের নাম দিয়েছিলেন শোষিতের গণতন্ত্র। আমি বঙ্গবন্ধুকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি শোষিতের গণতন্ত্র বলতে কী বোঝাতে চান? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। তাই প্রোলেতারিয়েত ডিকটেটরশিপ কথাটা ব্যবহার করতে চাই না। তাছাড়া কোনো ধরনের ডিকটেটরশিপেই আমি বিশ্বাস করি না। আমি চাই সর্বহারা বা শোষিতের শাসন। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠনও করেছিলেন এই লক্ষ্যে। দেশের নব্যধনীরা তা চাননি। তারা চেয়েছেন পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আদলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। যে ব্যবস্থায় তাদের শাসন ও শোষণ অব্যাহত থাকবে। তাই বাকশাল পদ্ধতিকে ‘একদলীয় স্বৈরাচারী শাসন’ আখ্যা দিয়ে তারা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। তারপর বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার নামে বাংলাদেশে যে ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে তা পার্লামেন্টে বিরোধী দলবিহীন একদলীয় ব্যবস্থাই। তাতে নব্যধনী ও দুর্নীতিবাজ শোষক শ্রেণীর আধিপত্য দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে সাম্প্রদায়িকতা ও হিংস্র মৌলবাদী তৎপরতা। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ আজ আর নেই। তার কন্যা শেখ হাসিনা প্রবল প্রতিকূলতার মুখে সেই স্বপ্নের রেশটুকু মাত্র ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার সঙ্গে আদর্শনিষ্ঠ সহযোদ্ধা কই?
আবার বছর ঘুরে আগস্ট মাস এসেছে। জাতীয় শোকের মাসে মাসব্যাপী অনুষ্ঠান হবে। সুধীজন বক্তৃতা দেবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলবেন এবং লিখবেন। তার অনুসারী দলটির নেতা ও কর্মীরা দাবি করবেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শ কী ছিল? বর্তমান পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতন্ত্র কী? ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার হয়ে ধর্মীয় পলিটিক্যাল কালচারের অনুসরণ করা কী? বাংলাদেশী জাতীয়তার নামে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চা করা কী? উদার অর্থনীতির নামে অবাধ লুটপাট ও শোষণের অর্থনীতি কী? পশ্চিমা গণতন্ত্রের খোলসটুকু বজায় রেখে সন্ত্রাস ও স্বেচ্ছাচারভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা কী? প্রতি বছর আগস্ট মাস এলে কেবল অনুষ্ঠানসর্বস্বতা দ্বারা বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক প্রকাশ করা নয়, ওপরের এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়া এবং তার জবাব খুঁজে দেখা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, ‘আমি মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করি না এর একটা বড় কারণ এই যে, মূর্তি পূজায় মূর্তিটাই বড় হয়ে ওঠে। তার আত্মা ও আদর্শের সন্ধান কেউ রাখে না। তা হারিয়ে যায়।’ এই কথাটা বঙ্গবন্ধুর বেলাতেও যেন সত্য না হয়। বঙ্গবন্ধু যেন প্রতি বছর শোকের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে হারিয়ে না যান। শোক স্থায়ী নয়। কিন্তু স্মরণ স্থায়ী। বঙ্গবন্ধুকে, তার আদর্শ ও লক্ষ্যকে প্রতিনিয়ত- বিশেষ করে এই আগস্ট মাসে স্মরণ করা দরকার। নতুন প্রজন্মের কাছে তা তুলে ধরা দরকার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু তার গণতান্ত্রিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে।
মহররম যেমন বিশ্ব মুসলমানের কাছে একটি শোকের মাস, ইংরেজি আগস্ট মাস তেমনি বাংলার মানুষের কাছে একটি শোকের মাস। পশ্চিমা বিশ্বে কোনো মাস বা দিন শোকের মাস বা দিন হিসেবে চিহ্নিত হয় না। কারও মৃত্যু হলে তারা বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে শোক প্রকাশ করে। তারপর আর শোক নয়, মৃত ব্যক্তি, তিনি বিখ্যাত লোক হলেও জন্ম বা মৃত্যুদিবসে ভাবগম্ভীর পরিবেশে তাকে স্মরণ করে। তার বা তাদের জীবন ও কর্ম পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে ধরে। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যেসব ব্রিটিশ সৈন্য ও নাগরিক আত্মাহুতি দিয়েছেন, তাদের জন্য এখন আর শোক প্রকাশ করা হয় না। তাদের জন্য সরকারিভাবে Rememberence day বা স্মরণ দিবস পালন করা হয়। এই স্মরণ দিবসে ঘটে ব্রিটিশ জাতির মধ্যে অভাবনীয় ঐক্যের প্রকাশ। ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধী দলের নেতা ফুলের মালা হাতে মৃত সৈনিকদের স্মৃতিস্তম্ভে এসে দাঁড়ান এবং যুক্তভাবে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এদিন ব্রিটিশ জনগণের মধ্যে দলমতের কোনো পার্থক্য থাকে না। তাদের এক ও অভিন্ন চরিত্রের প্রকাশ ঘটে।
এ ব্যাপারে আমাদের দেশের চরিত্র ও চেহারাটা ভিন্ন। জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন- স্বাধীনতা লাভের যুদ্ধে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, বাংলাদেশের Founding father বা স্থপতি পিতা হিসেবে যিনি বিশ্বময় স্বীকৃত, তার শোকাবহ মৃত্যু দিবসে জাতি শ্রদ্ধাভরে তাকে স্মরণ করলেও নেতারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সেই শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারেন না। এই পরম শোকের দিনটিতেও বাংলাদেশের নব্য এজিদের দলের নেত্রী তার বানোয়াট জন্মদিবসে কয়েক মণ ওজনের কেক কেটে উৎসব করেন। ভক্তদের স্তুতি শোনেন এবং রঙিন বেলুন ওড়ান। ভারতে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যাকারী নাথুরাম গডসের সমর্থক দলটি গান্ধীর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে আহমেদাবাদে মিষ্টি বিতরণ করে উৎসব পালন করেছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তখন গান্ধী-রাজনীতির চরম বিরোধী হলেও এক বিবৃতি প্রকাশ করে গড্সের সমর্থকদের নিন্দা জানিয়ে বলেছিল, ‘এর চাইতে বড় অশ্লীলতা আর কিছু হতে পারে না।’ চার্চিল-রাজনীতির ঘোরবিরোধী ব্রিটিশ লেবার পার্টির ভূতপূর্ব নেতা ক্লেমেন্ট এটলি চার্চিলের জন্মদিনে তাকে ফুল উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘সিজারকে শ্রদ্ধা জানাতে এসেছি, হত্যা করতে আসিনি।’ আর বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটির নেত্রী জাতির পিতার মৃত্যু দিবসকেও উৎসবের দিবসে পরিণত করতে চান। জাতীয় শোকের যে মাস অথবা দিবসটি যুক্তভাবে পালন দ্বারা জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি গড়ে তোলা যেত, সেই ভিত্তিটিকেও একটি দল ও গোষ্ঠী প্রতি বছর ভাঙতে চান আর মুখে বলেন জাতীয় ঐক্য চাই।
প্রতি বছর আগস্ট মাস এলে আমরা জাতির পিতার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে শোক প্রকাশ করি। কিন্তু তাকে অন্তর থেকে স্মরণ এবং তার আদর্শে নতুন করে ব্রতী হওয়ার শপথ গ্রহণ করি কি? মহররম মাস উপলক্ষে নজরুলই আবার লিখেছিলেন, ‘ত্যাগ চাই, মর্সিয়া ক্রন্দন চাহি না।’ অর্থাৎ মহররম মাসে শহীদ ইমাম হোসেন ও তার পরিবার-পরিজনের জন্য কান্না ও মর্সিয়া গীত (শোকের গীত) চাই না। চাই ইমাম হোসেনের ত্যাগের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হওয়ার শপথ। এই যুগে বাংলাদেশেও আগস্ট মাস এলেই কেবল শোকের মাতম তুললেই চলবে না, শোককে শপথে পরিণত করতে হবে। এই শপথ বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং রক্ষা করার। তা না করে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর মাসটিকে আনুষ্ঠানিকতার মাসে পরিণত করলে তাকে জাতীয় জীবনে ধরে রাখা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শটি কী ছিল? কেবল বারবার নির্বাচনে জিতে ক্ষমতায় বসা? গণবিরোধী শক্তির সঙ্গে আপস করে ক্ষমতায় থাকা? তা যদি হতো তাহলে তো তিনি সত্তরের নির্বাচনে জিতে সামরিক জান্তার সঙ্গে আপস করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতেন। তিনি তা না করে সংগ্রামের পথ বেছে নিয়েছিলেন কেন? আর সেই সংগ্রামে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় বসে দেশের নব্যধনী এবং তাদের সামন্তবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠপোষকদের সঙ্গে আপস করে ওই ক্ষমতায় চিরস্থায়ী হওয়ার ব্যবস্থা না করে শোষিতের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের পথ ধরেছিলেন কেন এবং সেই বিপ্লবেই আত্মাহুতি দিলেন কেন? এই সত্যটি অনুধাবন করার চেষ্টা আজকাল বঙ্গবন্ধুর অনুসারীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই করেন কি?
বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা উঠলেই আপ্তবাক্য হল, তিনি গণতন্ত্রের জন্য যুদ্ধ করেছেন। কিন্তু সেটা কোন্ গণতন্ত্র? পশ্চিমা গণতন্ত্র? বুর্জোয়া গণতন্ত্র? না চীন ও সাবেক পূর্ব ইউরোপীয় জনগণতন্ত্র (People's democracy)? বঙ্গবন্ধু তার অভীষ্ট লক্ষ্যের নাম দিয়েছিলেন শোষিতের গণতন্ত্র। আমি বঙ্গবন্ধুকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি শোষিতের গণতন্ত্র বলতে কী বোঝাতে চান? বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি কমিউনিস্ট নই। তাই প্রোলেতারিয়েত ডিকটেটরশিপ কথাটা ব্যবহার করতে চাই না। তাছাড়া কোনো ধরনের ডিকটেটরশিপেই আমি বিশ্বাস করি না। আমি চাই সর্বহারা বা শোষিতের শাসন। কিন্তু গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠনও করেছিলেন এই লক্ষ্যে। দেশের নব্যধনীরা তা চাননি। তারা চেয়েছেন পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতন্ত্রের আদলে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। যে ব্যবস্থায় তাদের শাসন ও শোষণ অব্যাহত থাকবে। তাই বাকশাল পদ্ধতিকে ‘একদলীয় স্বৈরাচারী শাসন’ আখ্যা দিয়ে তারা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করে এবং বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। তারপর বহুদলীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার নামে বাংলাদেশে যে ব্যবস্থা প্রচলিত রয়েছে তা পার্লামেন্টে বিরোধী দলবিহীন একদলীয় ব্যবস্থাই। তাতে নব্যধনী ও দুর্নীতিবাজ শোষক শ্রেণীর আধিপত্য দিন দিন বাড়ছে। বাড়ছে সাম্প্রদায়িকতা ও হিংস্র মৌলবাদী তৎপরতা। বঙ্গবন্ধুর সেই স্বপ্নের গণতান্ত্রিক, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ আজ আর নেই। তার কন্যা শেখ হাসিনা প্রবল প্রতিকূলতার মুখে সেই স্বপ্নের রেশটুকু মাত্র ধরে রাখার চেষ্টা করছেন। কিন্তু তার সঙ্গে আদর্শনিষ্ঠ সহযোদ্ধা কই?
আবার বছর ঘুরে আগস্ট মাস এসেছে। জাতীয় শোকের মাসে মাসব্যাপী অনুষ্ঠান হবে। সুধীজন বক্তৃতা দেবেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলবেন এবং লিখবেন। তার অনুসারী দলটির নেতা ও কর্মীরা দাবি করবেন, আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর এই আদর্শ কী ছিল? বর্তমান পশ্চিমা বুর্জোয়া গণতন্ত্র কী? ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার হয়ে ধর্মীয় পলিটিক্যাল কালচারের অনুসরণ করা কী? বাংলাদেশী জাতীয়তার নামে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি চর্চা করা কী? উদার অর্থনীতির নামে অবাধ লুটপাট ও শোষণের অর্থনীতি কী? পশ্চিমা গণতন্ত্রের খোলসটুকু বজায় রেখে সন্ত্রাস ও স্বেচ্ছাচারভিত্তিক রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা কী? প্রতি বছর আগস্ট মাস এলে কেবল অনুষ্ঠানসর্বস্বতা দ্বারা বঙ্গবন্ধুর জন্য শোক প্রকাশ করা নয়, ওপরের এই প্রশ্নগুলোর মুখোমুখি হওয়া এবং তার জবাব খুঁজে দেখা প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু একবার বলেছিলেন, ‘আমি মূর্তি পূজায় বিশ্বাস করি না এর একটা বড় কারণ এই যে, মূর্তি পূজায় মূর্তিটাই বড় হয়ে ওঠে। তার আত্মা ও আদর্শের সন্ধান কেউ রাখে না। তা হারিয়ে যায়।’ এই কথাটা বঙ্গবন্ধুর বেলাতেও যেন সত্য না হয়। বঙ্গবন্ধু যেন প্রতি বছর শোকের আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে হারিয়ে না যান। শোক স্থায়ী নয়। কিন্তু স্মরণ স্থায়ী। বঙ্গবন্ধুকে, তার আদর্শ ও লক্ষ্যকে প্রতিনিয়ত- বিশেষ করে এই আগস্ট মাসে স্মরণ করা দরকার। নতুন প্রজন্মের কাছে তা তুলে ধরা দরকার। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটেছে। কিন্তু তার গণতান্ত্রিক ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয় ঘটেছে।
এই দুই মূল্যবোধ ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ধরে রাখার জন্য একটি শক্তিশালী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুনরুজ্জীবন প্রয়োজন। যেমন আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ভাষার জন্য সংগ্রামকে কেন্দ্র করে বাঙালির লোকায়ত ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে। বঙ্গবন্ধুকে স্মরণের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে আবার সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস প্রয়োজন। বর্তমানের ভয়াবহ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সবচেয়ে বড় অস্ত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু যখন ছয় দফার আন্দোলন শুরু করেন, তখন পাকিস্তানের সামরিক শাসক আইয়ুব খান হুঙ্কার দিয়ে বলেছিলেন, ‘আমি অস্ত্রের ভাষায় ((language of weapon) এই আন্দোলন দমন করব’, বঙ্গবন্ধু জবাবে বলেছিলেন, আমি আন্দোলনের ভাষায় (language of movement) সেই দমননীতি প্রতিহত করব।’ বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথে বর্তমান সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ভাষাই হোক বাংলাদেশের মানুষের হাতে বড় অস্ত্র। একটি সুষ্ঠু প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনই পারে আমাদের বিভ্রান্ত তরুণ সমাজকে সুস্থ করে তুলতে, ঘরে ফেরাতে। এই আগস্ট মাসে নজরুলের ভাষায় বলি, ‘মর্সিয়া, ক্রন্দন চাহি না।’ চাই বঙ্গবন্ধুকে সত্যিকারভাবে স্মরণ, তার আদর্শের পুনরুজ্জীবন। সামাজিক ও রাজনৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের প্রতিরোধ। আগস্ট হোক শোকের নয়, স্মরণের মাস, শপথ গ্রহণের মাস। সংকট ও সমস্যা উত্তরণের পথ খোঁজার মাস।
লন্ডন, ৩১ আগস্ট রোববার, ২০১৬
লন্ডন, ৩১ আগস্ট রোববার, ২০১৬
No comments