আনু মুহাম্মদের লড়াই by জাকারিয়া পলাশ

বৈষম্যের বিরুদ্ধে সাম্যের কথা বলেন তিনি। তিনি বলেন, সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা। ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের মূলেই আঘাত করেন তিনি। আধুনিকতার মোড়কে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ অর্থনীতির এ অধ্যাপক। মার্কসবাদের কঠিন তত্ত্বকথা আর ‘রাজনৈতিক অর্থনীতি’র জটিল ধাঁধাও তার বর্ণনায় সরল হয়ে হাজির হয় শ্রমজীবী, দরিদ্র জনসাধারণের কাছে। তিনি একজন শিক্ষক। নাম মো. আনিসুর রহমান। আনু তার ডাক নাম। দেশ-বিদেশে তার পরিচয় আনু মুহাম্মদ হিসেবে। তার শিক্ষকতার গণ্ডি ক্লাসরুমের বাইরেও বিস্তৃত বহুদূর। ফুলবাড়ি থেকে রামপাল; সর্বত্র। পরিবেশ-প্রকৃতি আর গরিবের স্বার্থের লড়াইয়ে এই শিক্ষক ছুটে বেড়ান। রাজপথে তার উপস্থিতি আর রাজনৈতিক বক্তৃতাও যেন অর্থনীতির পাঠ। আপনি একজন শিক্ষক না বিপ্লবী? প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘দুটোই। একজন অ্যাকাডেমিক একটা বিষয়ে জানার্জন করে। তারপর সেটা তুলে ধরে লেখা বা কথায়; ক্লাসে। আর একজন অ্যাকটিভিস্ট সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করে। কেউ এই দুটো একসঙ্গে করলে তার দায়িত্বটা পূর্ণতা পায়। আমি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। জনগণের টাকায় বেতন পাই। সুতরাং, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ আমি। কোনটা ন্যায় আর কোনটা অন্যায় তা পরিষ্কারভাবে জানানো আমার দায়িত্ব।’ বাংলাদেশের বামপন্থীরা বিভক্ত বহুভাবে। নানা পন্থার পক্ষে-বিপক্ষে। কিন্তু, আনু মুহাম্মদ সকল ‘পন্থিবাজি’ বিভক্তির ঊর্ধ্বে। বিপ্লবের প্রসব বেদনা নিয়ে বামপন্থায় শরিক হওয়া অনেকেই হাল আমলে ভিড় করেছেন পুঁজিবাদ কিংবা দেশীয় সামন্তবাদের ছায়ায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাতো বলেই ছিলেন, ‘ঝানু বাম সব আমরা নিয়ে নিয়েছি। এখন যা আছে তা চিটা।’ কিন্তু, আনু মুহাম্মদ স্রোতের বিপরীতে, অটল-অবিচল। জনগণের স্বার্থই তার কাছে দেশের স্বার্থ। দেশের বুদ্ধিজীবীরা অধিকাংশই যখন এদল-ওদলে বিভক্ত তখন আনু মুহাম্মদ সাদাকে বলছেন সাদা, আর কালোকে কালো। প্রতিবাদী রাজনীতির সক্রিয় নেতৃত্বে তিনি। জাতীয় সম্পদ রক্ষায় গঠিত তেল-গ্যাস-বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির তিনি সদস্য সচিব। তবুও, অর্থনীতির অধ্যাপক হিসাবে তার বিরুদ্ধে ক্লাস ফাঁকির অভিযোগ নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি হলেন সকলের আস্থাভাজন এক ক্লাস শিক্ষক। রাজধানীর মালিবাগের নিজ বাসভবনে মানবজমিনের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিনি জানান তার বেড়ে ওঠার কথা। স্কুল জীবনেই বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। এমন সময় এসেছিল মুক্তিযুদ্ধ। তার মতে, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমাদের বয়স বাড়িয়ে দিয়েছিল। রাষ্ট্র, জনগণের মুক্তির লড়াই, আন্তর্জাতিক রাজনীতি, গণহত্যা, অন্যান্য দেশের মুক্তিযুদ্ধ, বিপ্লব ও ইতিহাসের দিকে কৌতূহল সৃষ্টি হয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। আর ৭১’র পর দেশ, সরকার ও আগামী নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করি। স্বাধীনতা-পরবর্তী অস্থিরতার কারণে আশাভঙ্গ হয় দ্রুতই।’ ৬/৭ম শ্রেণিতে পড়াকালীন থেকেই তিনি লিখতেন। স্বাধীনতার পরপরই তিনি লিখেছিলেন, ‘স্কুল-কলেজগুলো কিছুকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হোক। স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠানো হোক গ্রামেগঞ্জে। তারা নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও গ্রামোন্নয়নের মতো কাজে স্বেচ্ছাসেবীর কাজ করুক। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের পর সব শিশু-কিশোরেরও মনে স্পৃহা ছিল দেশের জন্য কাজ করার।’ তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের পর মানুষের সেই বিপ্লবী অনুভূতি বুঝতে না পারার কারণে দুই কূল হারাতে হলো। জোর করেও অনেককে স্কুলে আনা যায়নি। অন্যদিকে জনসেবাও হয়নি।’ সেই পারিপার্শ্বিক অবস্থা থেকেই তিনি বেড়ে ওঠেন আজকের আনু মুহাম্মদ হিসেবে। তিনি জানান, জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ, হলের জীবন তাকে আরো সমৃদ্ধ করেছে। পাঠচক্র, পত্রিকা প্রকাশ, বন্ধুদের সঙ্গে একসঙ্গে কাজ করার পাশাপাশি জনসংযোগের সঙ্গে অভ্যস্ত হন সেখান থেকেই। অন্যান্য দেশের জ্বালানি সম্পদ নিয়ে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিষয়ে তিনি গবেষণা করতেন শুরু থেকেই। পরে, নব্বইয়ের দশকে যখন বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ ভারতে রপ্তানির উদ্যোগ নেয়া হয়, যখন মাগুরছড়ায় বিস্ফোরণ ঘটে, তখনই জাতীয় কমিটি হয়। জাতীয় কমিটির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলছিলেন, ‘২০০৫ সালে ফুলবাড়ির মানুষের কাছ থেকে আমরা শিক্ষা পাই কিভাবে প্রতিরোধ গড়তে হয়। জাতীয় কমিটির কোনও তৎপরতা ছিল না ফুলবাড়িতে। সেখানকার জনগণই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আন্দোলনে সহায়তার জন্য। পরে আমরা গবেষণা করে দেখি যে সেটা ভয়ঙ্কর প্রজেক্ট।’ 
আনু মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষকতা করছেন ১৯৮২ সাল থেকে। পড়িয়েছেন নৃবিজ্ঞানেও। ছিলেন অর্থনীতি বিভাগের সভাপতি। উইনিবেগ ও মনিটোবায় ভিজিটিং প্রফেসর ছিলেন। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে ছিলেন ভিজিটিং স্কলার (১৯৯৩)। কমিউনিস্ট জগতের কিউবা ও ভেনিজুয়েলায় সফর করেছেন তিনি। হুগো শ্যাভেজের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল তার। সাম্রাজ্যবাদের কড়া সমালোচক এই অধ্যাপক মনে করেন, ‘মানুষের খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা বা শিক্ষার চেয়ে সমরাস্ত্র এবং যুদ্ধ সরঞ্জামের পেছনে পৃথিবীর সম্পদ ব্যয় হয় বেশি। প্রতি বছর ৯০০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় এ খাতে। আর এর ৬০ ভাগ অর্থাৎ ৬০০ বিলিয়ন ডলার খরচ করে একা আমেরিকাই। এর বিরুদ্ধে তার সোচ্চার ভূমিকা। ২০০৯ সালে দুইটি বহুজাতিক কোম্পানির সঙ্গে জাতীয় তেল সম্পদ উত্তোলনের বিষয়ে চুক্তির উদ্যোগ নেয় সরকার। ‘জনস্বার্থবিরোধী’ সেই চুক্তির বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের লাঠির আঘাতে আহত হন আনু মুহাম্মদ। ২০১১ সালে তাকে আটকও করা হয়েছিল। আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘পন্থিবাজী রাজনীতি বাংলাদেশের বাম রাজনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে, জাতীয় কমিটি গঠিত হওয়ার পর ভিন্নমত থাকলেও জাতীয় স্বার্থে সব বামগ্রুপকে একসঙ্গে আনা গেছে। এটা জাতীয় কমিটির একটা সাফল্য।’ আনু মুহাম্মদের বেড়ে ওঠা ঢাকার মালিবাগ চৌধুরী পাড়ায়। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি তৃতীয়। ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাসের পর তিনি ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগরে ১৯৭৬-৭৭ সালে। ব্যক্তিগত জীবনে আনু মুহাম্মদ বিবাহিত। তার স্ত্রী শিল্পী বড়ুয়াও ছিলেন জাহাঙ্গীরনগরের শিক্ষার্থী।

No comments

Powered by Blogger.