‘রাজকোষে’ চুরি by আলী রীয়াজ
‘চুরি
হয়ে গেছে রাজকোষে’—১৯৩৬ সালে লেখা রবীন্দ্রনাথের গান যে ২০১৬ সালে এসে
বাংলাদেশে আক্ষরিক অর্থেই সত্য হবে, তা মনে হয় কারও কল্পনায়ও আসেনি। এখন
রবীন্দ্রনাথের শ্যামা নৃত্যনাট্যে বর্ণিত কল্পিত ‘রাজকোষ’ না থাকলেও
রাষ্ট্রীয় কোষাগার আছে এবং সেখান থেকেই চুরি হয়ে গেছে ১০ কোটি ডলার। ঘটনার
সারসংক্ষেপ এ রকম—যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের
স্থিতি অ্যাকাউন্টে গচ্ছিত বাংলাদেশের ১০ কোটি ডলার (বাংলাদেশের টাকায়
প্রায় ৮০০ কোটি টাকা) ওই ব্যাংক থেকে চুরি করে (অ্যাকাউন্ট ‘হ্যাক’ করে)
নিয়ে যাওয়া হয়েছে ফিলিপাইনে ও শ্রীলঙ্কায়।
ঘটনা ঘটেছে ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে। ফিলিপাইনের একটি সংবাদপত্রে এ বিষয়ে তদন্তের খবর বেরোনোর পর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে অবগত হয়। তখন জানা গেল যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ফিলিপাইনে ছোটাছুটি করে কিছু অর্থ উদ্ধার করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সেই প্রথম এ বিষয়ে কোনো স্বীকৃতি পাওয়া গেল। কিন্তু বেশির ভাগ অর্থ উদ্ধার হয়নি বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশের দাবি হলো যে হ্যাক হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে, অতএব দায়িত্ব তাদের। অন্যদিকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের ভাষ্য, তাদের সিস্টেম হ্যাক হয়নি। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল যে তিনি এ বিষয়ে অবগত নন, কিন্তু পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দিয়েছেন।
কিন্তু ইতিমধ্যে আরও খবর এসেছে, যাতে দেখা যায়, টাকা হস্তান্তরের জন্য অ্যাডভাইস গেছে বাংলাদেশ থেকে, বলা হচ্ছে যে সব মিলিয়ে ৩০টি অ্যাডভাইসের মধ্যে পাঁচটি মাত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যক্রম করার পর বাকিগুলো আটকে দেওয়া হয়, অন্যথায় এর পরিমাণ আরও বেশি হতো। ফিলিপাইনের ‘এনকোয়ার’ নামের যে কাগজের তদন্তের কারণে এসব খবর প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় এবং ফিলিপাইনের সিনেটসহ অনেক প্রতিষ্ঠান তদন্ত শুরু করেছে, তারা জানাচ্ছে যে আরও ৮৭ কোটি ডলার সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাংকের কারণে সফল হয়নি। এই লেখা পাঠকের দৃষ্টিগোচর হতে হতে আরও নতুন কিছু জানা গেলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক রকম প্রশ্ন উঠেছে—অর্থ যদি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকের কারণে খোয়া গিয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি করতে হচ্ছে কেন? অন্যদিকে যদি অ্যাডভাইসগুলো বাংলাদেশ থেকে যায়, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রযুক্তি নিরাপত্তা যে ভাঙা হয়েছে সেটা নিশ্চিত। এতে বোঝা যায়, হয় ব্যাংকের ভেতরের লোকজনের কোনো না কোনোভাবে যুক্ততা আছে, নয়তো প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে।
এসব আলোচনা, বিতর্ক ও ধোঁয়াশে অবস্থার মধ্যে কেউ যদি মৃদুস্বরে বলেন যে খোয়া যাওয়া অর্থ নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই—অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়, তাহলে আমি নিশ্চিত যে সবাই সমস্বরে তাঁর বিরোধিতা করবেন, ক্ষুব্ধ হবেন। বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার, খোয়া যাওয়া এই অর্থের পরিমাণ তার মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। ফলে অঙ্কের হিসাবে সেটা ভুল হবে না, সেটা বলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু ভালো করে বিবেচনা করে দেখুন, দেশের অর্থ এভাবে গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা কি এই প্রথম? হ্যাঁ, এভাবে হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি। কিন্তু গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সবার জ্ঞাতসারে কি প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়নি? ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে এ খবর দেওয়ার সময় প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে এই অর্থ দিয়ে অন্তত দুই বছরের বাজেট তৈরি করতে পারত বাংলাদেশ। বছরে গড়ে পাচার হয়েছে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থ আগের বছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি ছিল। ব্যাংকের টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় নিশ্চয় হল–মার্ক কেলেঙ্কারির কথা মনে হবে। সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকা। ২০১২ সালের ঘটনার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪ লাখ কোটি টাকার সেক্টরে ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি এমন কিছু নয়। বেসিক ব্যাংকের ঘটনাও সবার মনে থাকার কথা। দুদকের করা মামলার সূত্রে জানা যায় যে কমপক্ষে ২ হাজার ২৬৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে বড় ধরনের ডাকাতি ও জালিয়াতি হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা লুট করার চেষ্টা করেছেন। এসব ডাকাতির ঘটনায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর গতিকে সাংবাদিকেরা ‘মন্থর’ বলেই বর্ণনা করেন। যদিও অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি।
এগুলো কেবল উদাহরণ। উদাহরণ সেই দেশে, যেখানে মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ বানানোর এক প্রতিযোগিতা সহজেই লক্ষণীয়। ২০০৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩ হাজার বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম মালয়েশিয়ার জন্য আবেদন করেছেন। এই কর্মসূচির জন্য কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, তার একটা ধারণা নিলে বোঝা যায় যে কেউ চাইলেই আবেদন করতে পারেন না। এর একটি শর্ত হচ্ছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫ লাখ রিঙ্গিত বা ১ কোটি ৬ লাখ টাকা থাকা, মালয়েশিয়ার ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করতে হয় ৬৫ লাখ টাকা এবং মাসিক আয় হতে হয় কমপক্ষে ২ লাখ ১২ হাজার টাকা। এ রকম লোকের যে অভাব হচ্ছে না, তা বাংলাদেশে এ জন্য নিয়োজিত সাব-এজেন্টের সংখ্যাই বলে দেবে। কেউ কেউ বলবেন বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে, ধনীর সংখ্যা বাড়ছে, ফলে এ আর বিচিত্র কী! তাঁদের সঙ্গে একমত, বাংলাদেশে কোটিপতি বাড়ছে। সেই হিসাব আমাদের অজ্ঞাত নয়। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের হিসাব ধরলে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি ৪০ হাজার ৬৮৭ জন। কিন্তু এর সঙ্গে এটাও তো আমরা জানি যে বৈষম্য বাড়ছে। গত বছরের মাঝামাঝি একটি সংবাদপত্রকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেছিলেন, ১৯৭২ সালের তুলনায় ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এখন বেশি (‘বাড়ছে কোটিপতি বাড়ছে বৈষম্য’, মানবজমিন, ২৬ জুলাই ২০১৫)। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এ কথা আমাদের কেন শুনতে হবে, সেই প্রশ্ন তো করাই যায়।
বৈষম্য বৃদ্ধির এই প্রেক্ষাপটে যখন ব্যাংকের টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে, তখন স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় যে দেশের এই অর্থের উৎস কী? বাংলাদেশের ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের শ্রমে–ঘামে বছরে ২ হাজার ৬২৫ কোটি ডলার আয় হয়। এই অর্থের উৎস সেই শ্রম। বাংলাদেশের ৮০ লাখ শ্রমিক দেশের বাইরে উদয়াস্ত কাজ করে গত বছর ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, এই অর্থ তার অংশ। যে অর্থ হারিয়ে গেছে, তা খুঁজে না পাওয়া গেলেও নিশ্চিত করেই বলা যায় যে প্রকারান্তরে পোশাকশ্রমিকদের শ্রম থেকে তা পুষিয়ে নেওয়া হবে। খেয়ে না–খেয়ে যে প্রবাসী শ্রমিক দেশে অর্থ পাঠান, তাঁর অর্থ থেকে তা আবার রিজার্ভে জমা হবে। দেশে ও দেশের বাইরের ১ কোটি ২০ লাখ শ্রমিকের কত দিনের শ্রম এই ১০ কোটি ডলার, সেই হিসাব যত দিন না পর্যন্ত আমরা করতে চাইব, তত দিন এভাবেই কথিত হ্যাকাররা, হল–মার্ক ও বেসিক ব্যাংকের পরিচালকেরা, অর্থ পাচারকারীরা, সেকেন্ড হোমের আবেদনকারীরা দেশের অর্থ লোপাট করতে সক্ষম হবেন। এ নিয়ে মামলা চলবে মন্থর গতিতে।
এই মুহূর্তে অবশ্য করণীয় এই ১০ কোটি ডলার কীভাবে খোয়া গেল তার সুষ্ঠু তদন্ত, দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। ফিলিপাইনে এ নিয়ে যতটা উদ্যোগ দেখি, বাংলাদেশে এখনো তা চোখে পড়ে না। কিন্তু তার চেয়ে বেশি দরকার জবাবদিহির ব্যবস্থা তৈরির দাবি তোলা। এসব যে জবাবদিহির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতির প্রমাণ, তা বুঝতে না পারলে; সেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যে রাজনীতিতে জবাবদিহির ব্যবস্থার বাইরে নয়, সেটা উপলব্ধি করতে না পারলে, সে বিষয়ে সরব না হলে হা–হুতাশ করে লাভ হবে না। বড়জোর ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের মতো পরিণতি হতে পারে।
* আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
ঘটনা ঘটেছে ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে। ফিলিপাইনের একটি সংবাদপত্রে এ বিষয়ে তদন্তের খবর বেরোনোর পর বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ এ বিষয়ে অবগত হয়। তখন জানা গেল যে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা ফিলিপাইনে ছোটাছুটি করে কিছু অর্থ উদ্ধার করেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে সেই প্রথম এ বিষয়ে কোনো স্বীকৃতি পাওয়া গেল। কিন্তু বেশির ভাগ অর্থ উদ্ধার হয়নি বলে সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছে। বাংলাদেশের দাবি হলো যে হ্যাক হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকে, অতএব দায়িত্ব তাদের। অন্যদিকে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কের ভাষ্য, তাদের সিস্টেম হ্যাক হয়নি। এ নিয়ে অর্থমন্ত্রীর প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল যে তিনি এ বিষয়ে অবগত নন, কিন্তু পরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকের বিরুদ্ধে মামলার হুমকি দিয়েছেন।
কিন্তু ইতিমধ্যে আরও খবর এসেছে, যাতে দেখা যায়, টাকা হস্তান্তরের জন্য অ্যাডভাইস গেছে বাংলাদেশ থেকে, বলা হচ্ছে যে সব মিলিয়ে ৩০টি অ্যাডভাইসের মধ্যে পাঁচটি মাত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যক্রম করার পর বাকিগুলো আটকে দেওয়া হয়, অন্যথায় এর পরিমাণ আরও বেশি হতো। ফিলিপাইনের ‘এনকোয়ার’ নামের যে কাগজের তদন্তের কারণে এসব খবর প্রথম দৃষ্টিগোচর হয় এবং ফিলিপাইনের সিনেটসহ অনেক প্রতিষ্ঠান তদন্ত শুরু করেছে, তারা জানাচ্ছে যে আরও ৮৭ কোটি ডলার সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্যাংকের কারণে সফল হয়নি। এই লেখা পাঠকের দৃষ্টিগোচর হতে হতে আরও নতুন কিছু জানা গেলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এ নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক রকম প্রশ্ন উঠেছে—অর্থ যদি যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকের কারণে খোয়া গিয়ে থাকে, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের ছোটাছুটি করতে হচ্ছে কেন? অন্যদিকে যদি অ্যাডভাইসগুলো বাংলাদেশ থেকে যায়, তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রযুক্তি নিরাপত্তা যে ভাঙা হয়েছে সেটা নিশ্চিত। এতে বোঝা যায়, হয় ব্যাংকের ভেতরের লোকজনের কোনো না কোনোভাবে যুক্ততা আছে, নয়তো প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে।
এসব আলোচনা, বিতর্ক ও ধোঁয়াশে অবস্থার মধ্যে কেউ যদি মৃদুস্বরে বলেন যে খোয়া যাওয়া অর্থ নিয়ে এতটা উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই—অর্থের পরিমাণ খুব বেশি নয়, তাহলে আমি নিশ্চিত যে সবাই সমস্বরে তাঁর বিরোধিতা করবেন, ক্ষুব্ধ হবেন। বাংলাদেশের রিজার্ভের পরিমাণ ২ হাজার ৮০০ কোটি ডলার, খোয়া যাওয়া এই অর্থের পরিমাণ তার মাত্র শূন্য দশমিক ৩৫ শতাংশ। ফলে অঙ্কের হিসাবে সেটা ভুল হবে না, সেটা বলাও আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু ভালো করে বিবেচনা করে দেখুন, দেশের অর্থ এভাবে গায়েব হয়ে যাওয়ার ঘটনা কি এই প্রথম? হ্যাঁ, এভাবে হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা আগে ঘটেনি। কিন্তু গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে সবার জ্ঞাতসারে কি প্রতিবছর হাজার হাজার কোটি টাকা উধাও হয়ে যায়নি? ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটিগ্রিটির (জিএফআই) দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গত ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৫ হাজার ৫৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা ৪ লাখ ৪১ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। গত বছরের ডিসেম্বরে এ খবর দেওয়ার সময় প্রথম আলোর প্রতিবেদনে আমাদের মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে এই অর্থ দিয়ে অন্তত দুই বছরের বাজেট তৈরি করতে পারত বাংলাদেশ। বছরে গড়ে পাচার হয়েছে ৫৫৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার।
২০১৩ সালে পাচার হওয়া অর্থ আগের বছরের তুলনায় ৩৩ দশমিক ৭৯ শতাংশ বেশি ছিল। ব্যাংকের টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনায় নিশ্চয় হল–মার্ক কেলেঙ্কারির কথা মনে হবে। সোনালী ব্যাংক থেকে নেওয়া প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উদ্ধার হয়েছে ৫২৫ কোটি টাকা। ২০১২ সালের ঘটনার সময় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ৪ লাখ কোটি টাকার সেক্টরে ৪ হাজার কোটি টাকা জালিয়াতি এমন কিছু নয়। বেসিক ব্যাংকের ঘটনাও সবার মনে থাকার কথা। দুদকের করা মামলার সূত্রে জানা যায় যে কমপক্ষে ২ হাজার ২৬৬ কোটি ৩৪ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের দেওয়া বক্তব্য অনুযায়ী, রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে বড় ধরনের ডাকাতি ও জালিয়াতি হয়েছে। বেসিক ব্যাংকের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা লুট করার চেষ্টা করেছেন। এসব ডাকাতির ঘটনায় যাঁরা জড়িত, তাঁদের বিরুদ্ধে যেসব মামলা হয়েছে, সেগুলোর গতিকে সাংবাদিকেরা ‘মন্থর’ বলেই বর্ণনা করেন। যদিও অর্থমন্ত্রী সংসদকে জানিয়েছেন, বেসিক ব্যাংকের ঋণ কেলেঙ্কারিতে ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর সংশ্লিষ্টতা ছিল, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তাঁর সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পায়নি।
এগুলো কেবল উদাহরণ। উদাহরণ সেই দেশে, যেখানে মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ বানানোর এক প্রতিযোগিতা সহজেই লক্ষণীয়। ২০০৩ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত কমপক্ষে ৩ হাজার বাংলাদেশি সেকেন্ড হোম মালয়েশিয়ার জন্য আবেদন করেছেন। এই কর্মসূচির জন্য কী পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন হয়, তার একটা ধারণা নিলে বোঝা যায় যে কেউ চাইলেই আবেদন করতে পারেন না। এর একটি শর্ত হচ্ছে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৫ লাখ রিঙ্গিত বা ১ কোটি ৬ লাখ টাকা থাকা, মালয়েশিয়ার ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করতে হয় ৬৫ লাখ টাকা এবং মাসিক আয় হতে হয় কমপক্ষে ২ লাখ ১২ হাজার টাকা। এ রকম লোকের যে অভাব হচ্ছে না, তা বাংলাদেশে এ জন্য নিয়োজিত সাব-এজেন্টের সংখ্যাই বলে দেবে। কেউ কেউ বলবেন বাংলাদেশের উন্নতি হচ্ছে, ধনীর সংখ্যা বাড়ছে, ফলে এ আর বিচিত্র কী! তাঁদের সঙ্গে একমত, বাংলাদেশে কোটিপতি বাড়ছে। সেই হিসাব আমাদের অজ্ঞাত নয়। ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের হিসাব ধরলে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি ৪০ হাজার ৬৮৭ জন। কিন্তু এর সঙ্গে এটাও তো আমরা জানি যে বৈষম্য বাড়ছে। গত বছরের মাঝামাঝি একটি সংবাদপত্রকে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মঈনুল ইসলাম বলেছিলেন, ১৯৭২ সালের তুলনায় ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য এখন বেশি (‘বাড়ছে কোটিপতি বাড়ছে বৈষম্য’, মানবজমিন, ২৬ জুলাই ২০১৫)। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরে এ কথা আমাদের কেন শুনতে হবে, সেই প্রশ্ন তো করাই যায়।
বৈষম্য বৃদ্ধির এই প্রেক্ষাপটে যখন ব্যাংকের টাকা উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে, তখন স্মরণ করিয়ে দেওয়ার প্রয়োজন হয় যে দেশের এই অর্থের উৎস কী? বাংলাদেশের ৪০ লাখ পোশাকশ্রমিকের শ্রমে–ঘামে বছরে ২ হাজার ৬২৫ কোটি ডলার আয় হয়। এই অর্থের উৎস সেই শ্রম। বাংলাদেশের ৮০ লাখ শ্রমিক দেশের বাইরে উদয়াস্ত কাজ করে গত বছর ১ হাজার ৫৩১ কোটি ডলার দেশে পাঠিয়েছেন, এই অর্থ তার অংশ। যে অর্থ হারিয়ে গেছে, তা খুঁজে না পাওয়া গেলেও নিশ্চিত করেই বলা যায় যে প্রকারান্তরে পোশাকশ্রমিকদের শ্রম থেকে তা পুষিয়ে নেওয়া হবে। খেয়ে না–খেয়ে যে প্রবাসী শ্রমিক দেশে অর্থ পাঠান, তাঁর অর্থ থেকে তা আবার রিজার্ভে জমা হবে। দেশে ও দেশের বাইরের ১ কোটি ২০ লাখ শ্রমিকের কত দিনের শ্রম এই ১০ কোটি ডলার, সেই হিসাব যত দিন না পর্যন্ত আমরা করতে চাইব, তত দিন এভাবেই কথিত হ্যাকাররা, হল–মার্ক ও বেসিক ব্যাংকের পরিচালকেরা, অর্থ পাচারকারীরা, সেকেন্ড হোমের আবেদনকারীরা দেশের অর্থ লোপাট করতে সক্ষম হবেন। এ নিয়ে মামলা চলবে মন্থর গতিতে।
এই মুহূর্তে অবশ্য করণীয় এই ১০ কোটি ডলার কীভাবে খোয়া গেল তার সুষ্ঠু তদন্ত, দোষী ব্যক্তিদের খুঁজে বের করার চেষ্টা করা। ফিলিপাইনে এ নিয়ে যতটা উদ্যোগ দেখি, বাংলাদেশে এখনো তা চোখে পড়ে না। কিন্তু তার চেয়ে বেশি দরকার জবাবদিহির ব্যবস্থা তৈরির দাবি তোলা। এসব যে জবাবদিহির প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতির প্রমাণ, তা বুঝতে না পারলে; সেই প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা যে রাজনীতিতে জবাবদিহির ব্যবস্থার বাইরে নয়, সেটা উপলব্ধি করতে না পারলে, সে বিষয়ে সরব না হলে হা–হুতাশ করে লাভ হবে না। বড়জোর ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যের মতো পরিণতি হতে পারে।
* আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
No comments