বিশ্ব শিক্ষক দিবসের প্রত্যাশা by কাজী ফারুক আহমেদ
৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস। এ বছর বিশ্ব
শিক্ষক দিবসের প্রতিপাদ্য : শিক্ষকদের জন্য আহ্বান। দিনটিতে দেশে দেশে
বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা, সমাজের শিক্ষানুরাগী জনগণ নানা
কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শিক্ষকদের ত্যাগ, তাদের অবদানের স্বীকৃতি জানিয়ে
শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন। বাংলাদেশে শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ১৯৯৪ সালে দিবসটি
পালন শুরু করে। পরের বছর ১৯৯৫ সাল থেকে ফেডারেশনের সঙ্গে কলেজ শিক্ষক সমিতি
ও অন্যান্য শিক্ষক-কর্মচারী সংগঠনও যুক্ত হয়। ২০১১ সাল থেকে ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে পৃষ্ঠপোষক করে শিক্ষক সংগঠনগুলো ও এনজিওদের
নিয়ে গঠিত বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদযাপন জাতীয় কমিটির ব্যানারে দিবসটি পালিত
হচ্ছে। এ বছর যখন দিবসটি পালিত হচ্ছে তখন বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত বিষয়-
শিক্ষকদের অবদান ও ত্যাগ স্বীকারের পাশাপাশি জবাবদিহিতা, কর্মক্ষেত্রে
তাদের নানামুখী সমস্যা, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, জনবল সংকট, শিক্ষার্থীর জন্য
প্রণীত যুগোপযোগী শিক্ষাক্রমে মানসম্মত পাঠদান, শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য,
শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণ ও শিক্ষায় ক্রমহ্রাসমান বরাদ্দের দিক। ক্যামব্রিজ
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর এমেরিটাস জন ম্যাকবেথ গত বছর (২০১২)
প্রকাশিত ফিউচার অব টিচিং প্রফেশন গ্রন্থে শিক্ষকদের কাছে সমাজের
প্রত্যাশা, সার্থক ও সফল শিক্ষকের পাশাপাশি এর বিপরীতে অবস্থানকারী
শিক্ষকের চিত্র তুলে ধরে শিক্ষক অসন্তোষের পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন : ১.
সমস্যার ব্যাপকতা ও তীব্রতা বৃদ্ধি, ২. দায়িত্বের অত্যধিক বোঝা, ৩.
অপেশাদারিত্ব, ৪. শিক্ষার্থীর আচরণ, ৫. অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থা ও বিশেষ
চাহিদা। তিনি শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের মধ্যে সন্তুষ্ট ও
অসন্তুষ্টদের মধ্যে তারতম্যের সীমারেখা নির্ধারণ করে সন্তুষ্টদের প্রসঙ্গে
বলেন, তারা আত্মবিশ্বাস ও স্বাতন্ত্র্যের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেন। সমাজ
তাদের মূল্যায়ন করে ও আস্থায় নেয়। তাদের পাঠদান ও শিক্ষা পরিকল্পনা,
উদ্যোগ, শিক্ষার্থী সংযোগ এবং শিক্ষায় উদ্ভাবন, পরীক্ষা-নিরীক্ষার
কার্যক্রম সমাদৃত হয়। অন্যদিকে অসন্তুষ্টরা মোকাবেলা করেন প্রতিকূল
পরিবেশের। তাদের ধারণা, পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণে নেই এবং তারা
সহকর্মীদের থেকে বিচ্ছিন্ন। পাঠ্যসূচি অনমনীয় মনে হয় এবং লক্ষ্য পূরণের
ক্ষেত্রে তারা চাপ অনুভব করেন। অভিভাবকের সমর্থন অপ্রতুল এবং শিক্ষার্থীদের
আচরণ তাদের কাছে আশানুরূপ না হওয়ায় তারা অব্যাহত দুশ্চিন্তার মধ্যে থাকেন।
নিষ্ঠাবান শিক্ষক পাঠদানের অনুকূল পরিবেশ ও স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের
সুযোগ পেলে শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রত্যাশার বাইরেও যে অর্জন সম্ভব হয়, তার
উল্লেখ করে অধ্যাপক ম্যাকবেথ একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে বিশ্বব্যাপী
শিক্ষক নিয়োগ দান এবং তাদের শিক্ষকতায় ধরে রাখার ক্ষেত্রে ঘনীভূত সমস্যার
বর্ণনা দিয়েছেন। কে শিক্ষক হতে চায় ও শিক্ষকতা পেশায় টিকে থাকতে চায়, এ
প্রশ্ন তুলে বিভিন্ন দেশে শিক্ষকদের পেশা ত্যাগ ও দক্ষ-অভিজ্ঞ শিক্ষকদের
অবসর পরবর্তী সৃষ্ট শূন্যতা নিয়ে বিভিন্ন দেশের গবেষণালব্ধ তথ্য উপস্থাপন
করেছেন। নেদারল্যান্ডে ২০১৪ সালের মধ্যে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষায় প্রায় ৭৫
শতাংশ শিক্ষক হয় অবসর নেবেন, না হয় শিক্ষকতা থেকে ঝরে পড়বেন। যোগদানের পাঁচ
বছরের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় অনেক শিক্ষককে পেশা ত্যাগ করতে দেখা যায়।
বাংলাদেশে এক দশক আগে পরিচালিত আমাদের এক জরিপে দেখা যায়, শিক্ষকতায় যোগ
দেয়া তরুণদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ তিন বছরের মাথায় পেশা ত্যাগ করে। এর বড়
কারণ পেশাগত নিরাপত্তাহীনতা, প্রত্যাশিত আর্থসামাজিক মর্যাদার অনুপস্থিতি
এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লাগামহীন দলীয় রাজনীতি। আবার বিয়ের আগে শিক্ষকতায়
যোগ দিয়ে বিয়ের পর নারী শিক্ষকদের পেশা থেকে বাদ পড়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে।
কতিপয় পর্যবেক্ষণ : আমার নিজের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বিশ্বে শিক্ষকতা পেশার বর্তমান হাল সম্বন্ধে সরকারের নীতিনির্ধারক, শিক্ষা প্রশাসন এমনকি শিক্ষক নেতৃত্বের একটি বড় অংশের যথাযথ ধারণা নেই। যাদের আছে তারাও বস্তনিষ্ঠ মূল্যায়নে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। স্বীকার করতে হবে, গত অর্ধশতকে বিশেষ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে শিক্ষায় অর্জন অনেক। প্রাথমিকে মেয়ে শিশুদের উপস্থিতি সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেশিরভাগই এখন নারী। মাধ্যমিকেও এ সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। তবে উচ্চশিক্ষা স্তরে তা এখনও অনুল্লেখযোগ্য। বর্তমান সরকারের আমলে বিনামূল্যে কোটি কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, বিপুলসংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ, বিএনপি আমলে বেসরকারি শিক্ষকদের বন্ধকৃত টাইম স্কেল ও এমপিও আবার চালু, দুই হাজারের কাছাকাছি নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মেধা সহায়তা তহবিল গঠন ইত্যাদি প্রশংসার দাবি রাখে। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাসা ভাড়া ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় উন্নীত করা এবং চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। তবে যাদের তা দেয়া হয়েছে তারা তাতে সন্তুষ্ট নন। যোগ্যতার শর্ত পূরণ করেও এমপিওবঞ্চিত বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীর ক্ষোভের বিষয়টিও মানবিক বিবেচনার দাবি রাখে। বিনা বেতনে কাউকে খাটানোর মধ্যে কৃতিত্ব নেই। বেতন-ভাতা না দিতে পারলে তা বলে দেয়া ভালো। পারলে কবে দেয়া হবে তা বলে দেয়াই সুবিবেচনার কাজ। অন্যদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর, সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার মধ্যে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমেনি। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের মধ্যে বেতন-ভাতা ও মর্যাদার বৈষম্যও প্রকট। একই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে একই ধরনের দায়িত্ব পালন সত্ত্বেও বৈষম্য অবসানের লক্ষণ নেই। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো, নিয়োগ কমিশন, স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের উদ্যোগও দৃষ্টিগোচর নয়। প্রাথমিক শিক্ষা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা সরকারিকরণ না করে সরকারি-বেসরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের সমন্বয়ে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ যে জরুরি, তাও সরকারের উপলব্ধিতে অনুপস্থিত। আজ যখন বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে, তখন একটি প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের সদস্যরা মর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন। অন্যদিকে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে অবরোধ করে রাখার ঘটনা ঘটেছে। একটিতে তা হয়েছে বেতন-ভাতার দাবিতে। আরেকটিতে ভিসিকে পছন্দ নয়- এ অবস্থান থেকে। শিক্ষা অথবা পেশাগত মর্যাদা উন্নয়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক জানা যায় না। অন্যদিকে মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পরবর্তী শিক্ষা স্তরে ৯৮ শতাংশের বেশি দায়িত্ব পালনকারী বেসরকারি শিক্ষকরা বিভিন্ন বঞ্চনাবোধে আক্রান্ত। এমপিওভুক্তি, পদোন্নতি, চিকিৎসা ও উৎসব ভাতা, বিগত সময় থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ও ব্যবস্থাপনার রাজনীতিকরণের ধারাবাহিক অব্যাহত গ্রাস থেকে মুক্তিলাভের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে খসড়া শিক্ষা আইনে শুধু শিক্ষকদের শাস্তিদানের প্রসঙ্গ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষা প্রশাসনের জবাবদিহিতার উল্লেখ না থাকা, আÍপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে একতরফা শিক্ষকদের এমপিও বাবদ প্রাপ্য অর্থ কেটে নেয়ার বিধান এবং কারও বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হওয়ার পরও কর্তিত বা স্থগিতকৃত বেতন ফিরিয়ে না দেয়ার মানবাধিকার পরিপন্থী প্রস্তাব এ মুহূর্তে বেসরকারি শিক্ষকদের উৎকণ্ঠার একটা বড় কারণ। অবশ্য সর্বশেষ ২ অক্টোবর খসড়া শিক্ষক আইন নিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় কর্মশালায় শাস্তি প্রদান সম্পর্কিত বিতর্কিত ধারাগুলো তুলে নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের জন্য তা স্বস্তির কারণ হয়েছে। কিন্তু এককভাবে অর্থ কেটে নেয়ার বিধান বহাল থাকবে কি-না তা এখনও স্পষ্ট নয়। সেজন্য শিক্ষকদের যৌক্তিক উদ্বেগের অবসান এখনও হয়নি। অন্যদিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের অশিক্ষক সুলভ আচরণ যেমন দেশে সর্বত্র আলোচনার বিষয়, একই সঙ্গে শিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষার্থী নিপীড়ন, শারীরিক শাস্তি ও গতানুগতিক, প্রাণহীন পাঠদান পদ্ধতির জন্যও শিক্ষকদের ভাবমূর্তি ক্ষ্ণুœ হচ্ছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে অন্তত শিক্ষক নেতৃত্বের এখনই বিষয়টি ভাবনার মধ্যে নেয়া দরকার।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসের চেতনার পক্ষে : শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও করণীয়-সংক্রান্ত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের আইএলও-ইউনেস্কো সুপারিশমালায় বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী। ওই সুপারিশমালা স্মরণ ও কার্যকরের দাবিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৬ কোটি শিক্ষক আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করছেন। স্বভাবতই শিক্ষকদের জন্য আহ্বান প্রতিপাদ্যের সপক্ষে বাংলাদেশের সরকার, শিক্ষা প্রশাসন বিশেষ করে যাদের উদ্দেশে দিনটি নিবেদিত- তারা এ দিনে কে কী ভূমিকা পালন করছেন তা বিশেষভাবে বিবেচ্য। শিক্ষকদের কাছে সমাজের প্রত্যাশা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে শিক্ষকদের প্রত্যাশা, মান মর্যাদা নিয়ে শিক্ষকদের বেঁচে থাকার আকুতি এবং তা নিশ্চিতকরণে সমাজের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা, শিক্ষকতার মতো মর্যাদাপূর্ণ পেশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ঘনিষ্ঠ আচরণ কতটুকু সম্ভব হচ্ছে, তার যথাযথ মূল্যায়ন প্রয়োজন। দিবসটির এ বছরের আহ্বান সবাইকে অনুপ্রাণিত, কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনে সহায়তা করুক। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের চেতনা অমর হোক।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : শিক্ষা আন্দোলনের নেতা, ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান
কতিপয় পর্যবেক্ষণ : আমার নিজের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বিশ্বে শিক্ষকতা পেশার বর্তমান হাল সম্বন্ধে সরকারের নীতিনির্ধারক, শিক্ষা প্রশাসন এমনকি শিক্ষক নেতৃত্বের একটি বড় অংশের যথাযথ ধারণা নেই। যাদের আছে তারাও বস্তনিষ্ঠ মূল্যায়নে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। স্বীকার করতে হবে, গত অর্ধশতকে বিশেষ করে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশে শিক্ষায় অর্জন অনেক। প্রাথমিকে মেয়ে শিশুদের উপস্থিতি সারাবিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেশিরভাগই এখন নারী। মাধ্যমিকেও এ সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। তবে উচ্চশিক্ষা স্তরে তা এখনও অনুল্লেখযোগ্য। বর্তমান সরকারের আমলে বিনামূল্যে কোটি কোটি পাঠ্যপুস্তক বিতরণ, বিপুলসংখ্যক প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সরকারিকরণ, বিএনপি আমলে বেসরকারি শিক্ষকদের বন্ধকৃত টাইম স্কেল ও এমপিও আবার চালু, দুই হাজারের কাছাকাছি নতুন প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তি, শিক্ষার্থীদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মেধা সহায়তা তহবিল গঠন ইত্যাদি প্রশংসার দাবি রাখে। এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাসা ভাড়া ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকায় উন্নীত করা এবং চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধির বিষয়টিও প্রাসঙ্গিক। তবে যাদের তা দেয়া হয়েছে তারা তাতে সন্তুষ্ট নন। যোগ্যতার শর্ত পূরণ করেও এমপিওবঞ্চিত বিপুলসংখ্যক শিক্ষক-কর্মচারীর ক্ষোভের বিষয়টিও মানবিক বিবেচনার দাবি রাখে। বিনা বেতনে কাউকে খাটানোর মধ্যে কৃতিত্ব নেই। বেতন-ভাতা না দিতে পারলে তা বলে দেয়া ভালো। পারলে কবে দেয়া হবে তা বলে দেয়াই সুবিবেচনার কাজ। অন্যদিকে শিক্ষা ক্ষেত্রে গ্রাম-শহর, সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষার মধ্যে বরাদ্দের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমেনি। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষকদের মধ্যে বেতন-ভাতা ও মর্যাদার বৈষম্যও প্রকট। একই যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা নিয়ে একই ধরনের দায়িত্ব পালন সত্ত্বেও বৈষম্য অবসানের লক্ষণ নেই। বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতন কাঠামো, নিয়োগ কমিশন, স্থায়ী শিক্ষা কমিশন গঠনের উদ্যোগও দৃষ্টিগোচর নয়। প্রাথমিক শিক্ষা পরবর্তী শিক্ষাব্যবস্থা সরকারিকরণ না করে সরকারি-বেসরকারি, প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের সমন্বয়ে জাতীয় পরিকল্পনা গ্রহণ যে জরুরি, তাও সরকারের উপলব্ধিতে অনুপস্থিত। আজ যখন বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হচ্ছে, তখন একটি প্রাথমিক শিক্ষক সংগঠনের সদস্যরা মর্যাদা বৃদ্ধির দাবিতে কর্মসূচি পালন করছেন। অন্যদিকে একাধিক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে অবরোধ করে রাখার ঘটনা ঘটেছে। একটিতে তা হয়েছে বেতন-ভাতার দাবিতে। আরেকটিতে ভিসিকে পছন্দ নয়- এ অবস্থান থেকে। শিক্ষা অথবা পেশাগত মর্যাদা উন্নয়নের সঙ্গে এর সম্পর্ক জানা যায় না। অন্যদিকে মাধ্যমিক ও মাধ্যমিক পরবর্তী শিক্ষা স্তরে ৯৮ শতাংশের বেশি দায়িত্ব পালনকারী বেসরকারি শিক্ষকরা বিভিন্ন বঞ্চনাবোধে আক্রান্ত। এমপিওভুক্তি, পদোন্নতি, চিকিৎসা ও উৎসব ভাতা, বিগত সময় থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ও ব্যবস্থাপনার রাজনীতিকরণের ধারাবাহিক অব্যাহত গ্রাস থেকে মুক্তিলাভের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে খসড়া শিক্ষা আইনে শুধু শিক্ষকদের শাস্তিদানের প্রসঙ্গ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও শিক্ষা প্রশাসনের জবাবদিহিতার উল্লেখ না থাকা, আÍপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে একতরফা শিক্ষকদের এমপিও বাবদ প্রাপ্য অর্থ কেটে নেয়ার বিধান এবং কারও বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অসত্য প্রমাণিত হওয়ার পরও কর্তিত বা স্থগিতকৃত বেতন ফিরিয়ে না দেয়ার মানবাধিকার পরিপন্থী প্রস্তাব এ মুহূর্তে বেসরকারি শিক্ষকদের উৎকণ্ঠার একটা বড় কারণ। অবশ্য সর্বশেষ ২ অক্টোবর খসড়া শিক্ষক আইন নিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় কর্মশালায় শাস্তি প্রদান সম্পর্কিত বিতর্কিত ধারাগুলো তুলে নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী শিক্ষক-শিক্ষাকর্মীদের জন্য তা স্বস্তির কারণ হয়েছে। কিন্তু এককভাবে অর্থ কেটে নেয়ার বিধান বহাল থাকবে কি-না তা এখনও স্পষ্ট নয়। সেজন্য শিক্ষকদের যৌক্তিক উদ্বেগের অবসান এখনও হয়নি। অন্যদিক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশের অশিক্ষক সুলভ আচরণ যেমন দেশে সর্বত্র আলোচনার বিষয়, একই সঙ্গে শিক্ষকদের দ্বারা শিক্ষার্থী নিপীড়ন, শারীরিক শাস্তি ও গতানুগতিক, প্রাণহীন পাঠদান পদ্ধতির জন্যও শিক্ষকদের ভাবমূর্তি ক্ষ্ণুœ হচ্ছে। বিশ্ব শিক্ষক দিবসে অন্তত শিক্ষক নেতৃত্বের এখনই বিষয়টি ভাবনার মধ্যে নেয়া দরকার।
বিশ্ব শিক্ষক দিবসের চেতনার পক্ষে : শিক্ষকদের অধিকার, মর্যাদা ও করণীয়-সংক্রান্ত ১৯৬৬ ও ১৯৯৭ সালের আইএলও-ইউনেস্কো সুপারিশমালায় বাংলাদেশ স্বাক্ষরকারী। ওই সুপারিশমালা স্মরণ ও কার্যকরের দাবিতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের ৬ কোটি শিক্ষক আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালন করছেন। স্বভাবতই শিক্ষকদের জন্য আহ্বান প্রতিপাদ্যের সপক্ষে বাংলাদেশের সরকার, শিক্ষা প্রশাসন বিশেষ করে যাদের উদ্দেশে দিনটি নিবেদিত- তারা এ দিনে কে কী ভূমিকা পালন করছেন তা বিশেষভাবে বিবেচ্য। শিক্ষকদের কাছে সমাজের প্রত্যাশা এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে শিক্ষকদের প্রত্যাশা, মান মর্যাদা নিয়ে শিক্ষকদের বেঁচে থাকার আকুতি এবং তা নিশ্চিতকরণে সমাজের কাছে তাদের দায়বদ্ধতা, শিক্ষকতার মতো মর্যাদাপূর্ণ পেশার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ ঘনিষ্ঠ আচরণ কতটুকু সম্ভব হচ্ছে, তার যথাযথ মূল্যায়ন প্রয়োজন। দিবসটির এ বছরের আহ্বান সবাইকে অনুপ্রাণিত, কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনে সহায়তা করুক। বিশ্ব শিক্ষক দিবসের চেতনা অমর হোক।
অধ্যক্ষ কাজী ফারুক আহমেদ : শিক্ষা আন্দোলনের নেতা, ইনিশিয়েটিভ ফর হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান
No comments