আমলাচালিত অর্থলোলুপ গণতন্ত্র—গণতন্ত্র নয় by মইনুল হোসেন
বারবার হরতাল ডাকার ফলে জনজীবন অচল হচ্ছে, পুলিশের সঙ্গে হরতাল সংগঠকদের সংঘাত বাধছে এবং সরকারি কর্মকাণ্ড বিপর্যস্ত হচ্ছে। জনগণ ক্রোধে ফুঁসছে। সরকারি কর্মসূচি যতই ভালো হোক না কেন তার বেশির ভাগই বাস্তবায়িত হচ্ছে না। এ জন্য দায়ী সংঘাত-সংঘর্ষের বিকৃত রাজনীতি।
দেশের জন্য এবং রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি কী ধরনের বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে, তা ভেবে দেখার মতো সময় মনে হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের নেই। সুতরাং যখন আমরা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের প্রত্যাশা করি, তখন আমাদের রাজনীতির ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। কে সঠিক অথবা সঠিক নয়—বাইরে থেকে যতটা বোঝা সম্ভব, তার আলোকে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা সেই সত্যের প্রতি কর্ণপাত করলেন কি করলেন না সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় না। জাতির কাছে আমাদের বৃহত্তর দায়দায়িত্ব রয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থে মুষ্টিমেয় লোকের ক্ষমতায় যাওয়ার ও আঁকড়ে থাকার কুটিল খেলায় পরিণত হয়েছে দলীয় রাজনীতি। গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত আলোচনা, বিতর্ক ও সহনশীলতার মূল্যবোধ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, জাতীয় রাজনীতি দুই নেত্রীর কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরূপ লড়াইয়ের এমনও অর্থ হতে পারে যে কে কাকে রাজনৈতিকভাবে উৎখাত করতে পারেন।
একশ্রেণীর আমলা রাজনীতিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যে সহযোগিতা এবং সমঝোতার ইচ্ছা ও দক্ষতার সম্পর্ক ছিল, তা ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা জবরদখলকারী বলা যেতে পারে। কিন্তু তাঁরা রাজনীতি বলতে বোঝেন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরা, ক্ষমতা ছাড়া নয়। ক্ষমতার পরিবর্তন আনা আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। তাই নির্বাচনে কারচুপি করার জন্য অনেক সময় এবং শক্তি ব্যয় করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন, নির্বাচনী ফলাফল কখনো বিরোধী দলের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। নির্বাচন তো লড়াই নয়, রীতিমতো যুদ্ধ—যা অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হয়।
বস্তুত, রাজনীতির চরিত্রই বদলে গেছে। রাজনীতি ক্ষমতায় থাকার জন্য নিষ্ঠুর শক্তি প্রয়োগের খেলায় পরিণত হয়েছে। সংঘাতের রাজনীতিই তাঁরা বেশি পছন্দ করছেন। কারণ, তাহলে অপশাসন ও আসল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে সুবিধা হয়। এবারের সংঘাতকে অযথা বলতে না চাইলে, আগাম বলতে হবে, যা সরকারই ডেকে এনেছে। কারণ, নির্বাচনের এখনো আড়াই বছর বাকি রয়েছে।
জনগণের ভেতর থেকে রাজনৈতিক নেতাদের উত্থান ঘটে আর আমলারা আসেন প্রশাসন থেকে। এ থেকেই তাঁদের মনমানসিকতা ও রুচিবোধ পরিষ্কার হয়ে যায়। আমলাতন্ত্রের কাজ হচ্ছে হুকুম দেওয়া ও তা তামিল করা। রাজনীতিতে তাই গণতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের মিশেল চলে না। গণতন্ত্রে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আমলাতন্ত্রকে। অথচ আমাদের আমলারা নিয়ন্ত্রণ করছেন গণতন্ত্র। পাকিস্তান আমলে জেনারেল আইয়ুব খানও এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালু করেছিলেন।
সাবেক আমলা ও ব্যবসায়ীদের একটি দুষ্টচক্র রাজনীতিতে ঢুকে রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈশিষ্ট্য বদলে দিয়েছেন। রাজনীতিবিদদের মর্যাদা এই প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে অবনমিত হয়েছে। নিজ নিজ দলের ভেতরেও দলের রাজনীতিবিদদের যথেষ্ট যোগ্য মনে করা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুটি দলেই আমলা ও ব্যবসায়ীদের দাপট দেখা যাচ্ছে। জনসেবার বদলে আমলারা ক্ষমতার রাজনীতিতে এবং ব্যবসায়ীরা লোভ-লালসা চরিতার্থ করার রাজনীতিতে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছেন।
যে পথে পরিস্থিতির বিকাশ ঘটতে দেওয়া হয়েছে তাতে উদ্ভূত সংকটের কোনো রাজনৈতিক সমাধান আপাতত আর দৃশ্যমান নয়। রাজনীতি থাকলে সহযোগিতা-সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া সম্ভব। বিতর্কিত জাতীয় ইস্যুতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারক ভূমিকা রাখতে পারে না যতক্ষণ না গোটা জাতিকে সঙ্গে নেওয়া সম্ভব হয়। এ কথা বলা হয়ে থাকে যে জনগণের শাসনতন্ত্রে জনগণের হূদয় ও মনের স্পন্দন ধ্বনিত হয়। আইনবিজ্ঞানীরাও স্বীকার করে থাকেন যে শাসনতন্ত্র সর্বোচ্চ আইনের বিধিবিধানই নয়, এর মধ্যে প্রতিফলিত হয় কিছু অলঙ্ঘনীয় নীতি ও মূল্যবোধ, যা জনগণ ধারণ ও লালন করে। শাসনতন্ত্রে কি থাকবে আর কি বাদ যাবে, তা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরিণত করা হয় তবে তা আর জাতীয় শাসনতন্ত্র থাকে না।
নিছক নির্বাচন আর নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আসলে রাজনীতির চাবিকাঠি কীভাবে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে কথা বলা দরকার। এটা সম্ভব না হলে, আমলাচালিত রাজনীতিতে লোভ-লালসাভিত্তিক রাজনৈতিক স্থিতাবস্থাই বহাল থাকবে। জনস্বার্থ সমুন্নত রাখার গণতান্ত্রিক রাজনীতি মরীচিকার মতোই অধরা থেকে যাবে, যা জাতির জীবনদায়িনী হতে পারে না।
নতুন যাত্রা শুরু করার জন্য হিংসা-বিদ্বেষের রাজনীতি থেকে মুক্তি পেতে হবে। সংঘাত কেবলই সংঘাতের জন্ম দেয়, একমাত্র ন্যায়ভিত্তিক সমঝোতার রাজনীতিই আমাদের সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে সম্ভব করে তুলতে পারে। এ বিশ্বাস এখনো আমি পোষণ করি যে প্রকৃত সুশীল সমাজ এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসবে।
মইনুল হোসেন: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
দেশের জন্য এবং রাজনীতিকদের জন্য রাজনীতি কী ধরনের বিপজ্জনক দিকে মোড় নিতে যাচ্ছে, তা ভেবে দেখার মতো সময় মনে হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের নেই। সুতরাং যখন আমরা রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সংলাপ অনুষ্ঠানের প্রত্যাশা করি, তখন আমাদের রাজনীতির ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। কে সঠিক অথবা সঠিক নয়—বাইরে থেকে যতটা বোঝা সম্ভব, তার আলোকে প্রকৃত সত্যকে তুলে ধরতে হবে। রাজনৈতিক নেতারা সেই সত্যের প্রতি কর্ণপাত করলেন কি করলেন না সেটা কোনো বিবেচ্য বিষয় না। জাতির কাছে আমাদের বৃহত্তর দায়দায়িত্ব রয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থে মুষ্টিমেয় লোকের ক্ষমতায় যাওয়ার ও আঁকড়ে থাকার কুটিল খেলায় পরিণত হয়েছে দলীয় রাজনীতি। গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত আলোচনা, বিতর্ক ও সহনশীলতার মূল্যবোধ প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয়, জাতীয় রাজনীতি দুই নেত্রীর কে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তার লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরূপ লড়াইয়ের এমনও অর্থ হতে পারে যে কে কাকে রাজনৈতিকভাবে উৎখাত করতে পারেন।
একশ্রেণীর আমলা রাজনীতিকের ছদ্মবেশ ধারণ করে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সঙ্গে যে সহযোগিতা এবং সমঝোতার ইচ্ছা ও দক্ষতার সম্পর্ক ছিল, তা ধ্বংস করে দিয়েছেন। তাঁদের রাজনৈতিক ক্ষমতা জবরদখলকারী বলা যেতে পারে। কিন্তু তাঁরা রাজনীতি বলতে বোঝেন ক্ষমতা আঁকড়ে ধরা, ক্ষমতা ছাড়া নয়। ক্ষমতার পরিবর্তন আনা আমলাতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। তাই নির্বাচনে কারচুপি করার জন্য অনেক সময় এবং শক্তি ব্যয় করা হয়েছে। রাজনৈতিক দলীয় সরকার বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সরকারের অধীনেই নির্বাচন হোক না কেন, নির্বাচনী ফলাফল কখনো বিরোধী দলের জন্য গ্রহণযোগ্য হয়নি। নির্বাচন তো লড়াই নয়, রীতিমতো যুদ্ধ—যা অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হয়।
বস্তুত, রাজনীতির চরিত্রই বদলে গেছে। রাজনীতি ক্ষমতায় থাকার জন্য নিষ্ঠুর শক্তি প্রয়োগের খেলায় পরিণত হয়েছে। সংঘাতের রাজনীতিই তাঁরা বেশি পছন্দ করছেন। কারণ, তাহলে অপশাসন ও আসল সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে রাখতে সুবিধা হয়। এবারের সংঘাতকে অযথা বলতে না চাইলে, আগাম বলতে হবে, যা সরকারই ডেকে এনেছে। কারণ, নির্বাচনের এখনো আড়াই বছর বাকি রয়েছে।
জনগণের ভেতর থেকে রাজনৈতিক নেতাদের উত্থান ঘটে আর আমলারা আসেন প্রশাসন থেকে। এ থেকেই তাঁদের মনমানসিকতা ও রুচিবোধ পরিষ্কার হয়ে যায়। আমলাতন্ত্রের কাজ হচ্ছে হুকুম দেওয়া ও তা তামিল করা। রাজনীতিতে তাই গণতন্ত্র ও আমলাতন্ত্রের মিশেল চলে না। গণতন্ত্রে রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে আমলাতন্ত্রকে। অথচ আমাদের আমলারা নিয়ন্ত্রণ করছেন গণতন্ত্র। পাকিস্তান আমলে জেনারেল আইয়ুব খানও এক ধরনের নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চালু করেছিলেন।
সাবেক আমলা ও ব্যবসায়ীদের একটি দুষ্টচক্র রাজনীতিতে ঢুকে রাজনীতির দৃষ্টিভঙ্গি ও বৈশিষ্ট্য বদলে দিয়েছেন। রাজনীতিবিদদের মর্যাদা এই প্রক্রিয়ায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে অবনমিত হয়েছে। নিজ নিজ দলের ভেতরেও দলের রাজনীতিবিদদের যথেষ্ট যোগ্য মনে করা হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি—দুটি দলেই আমলা ও ব্যবসায়ীদের দাপট দেখা যাচ্ছে। জনসেবার বদলে আমলারা ক্ষমতার রাজনীতিতে এবং ব্যবসায়ীরা লোভ-লালসা চরিতার্থ করার রাজনীতিতে উৎসাহ জুগিয়ে যাচ্ছেন।
যে পথে পরিস্থিতির বিকাশ ঘটতে দেওয়া হয়েছে তাতে উদ্ভূত সংকটের কোনো রাজনৈতিক সমাধান আপাতত আর দৃশ্যমান নয়। রাজনীতি থাকলে সহযোগিতা-সমঝোতার মাধ্যমে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান পাওয়া সম্ভব। বিতর্কিত জাতীয় ইস্যুতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নির্ধারক ভূমিকা রাখতে পারে না যতক্ষণ না গোটা জাতিকে সঙ্গে নেওয়া সম্ভব হয়। এ কথা বলা হয়ে থাকে যে জনগণের শাসনতন্ত্রে জনগণের হূদয় ও মনের স্পন্দন ধ্বনিত হয়। আইনবিজ্ঞানীরাও স্বীকার করে থাকেন যে শাসনতন্ত্র সর্বোচ্চ আইনের বিধিবিধানই নয়, এর মধ্যে প্রতিফলিত হয় কিছু অলঙ্ঘনীয় নীতি ও মূল্যবোধ, যা জনগণ ধারণ ও লালন করে। শাসনতন্ত্রে কি থাকবে আর কি বাদ যাবে, তা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তের বিষয়ে পরিণত করা হয় তবে তা আর জাতীয় শাসনতন্ত্র থাকে না।
নিছক নির্বাচন আর নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। আসলে রাজনীতির চাবিকাঠি কীভাবে রাজনৈতিক নেতাদের হাতে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে কথা বলা দরকার। এটা সম্ভব না হলে, আমলাচালিত রাজনীতিতে লোভ-লালসাভিত্তিক রাজনৈতিক স্থিতাবস্থাই বহাল থাকবে। জনস্বার্থ সমুন্নত রাখার গণতান্ত্রিক রাজনীতি মরীচিকার মতোই অধরা থেকে যাবে, যা জাতির জীবনদায়িনী হতে পারে না।
নতুন যাত্রা শুরু করার জন্য হিংসা-বিদ্বেষের রাজনীতি থেকে মুক্তি পেতে হবে। সংঘাত কেবলই সংঘাতের জন্ম দেয়, একমাত্র ন্যায়ভিত্তিক সমঝোতার রাজনীতিই আমাদের সবার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকে সম্ভব করে তুলতে পারে। এ বিশ্বাস এখনো আমি পোষণ করি যে প্রকৃত সুশীল সমাজ এ ব্যাপারে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসবে।
মইনুল হোসেন: জ্যেষ্ঠ আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট; তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।
No comments