পঁচাত্তরের নভেম্বর -কর্নেল তাহের: এক অমীমাংসিত চরিত্র by শাহাদুজ্জামান
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অমীমাংসিত একটি চরিত্র কর্নেল তাহের। তাঁকে ঘিরে অস্পষ্টতা আছে, আছে বিতর্ক, বর্ণাঢ্যতাও। একটি মুহূর্ত তৈরি হয়েছিল যখন বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ এসে বসেছিল কর্নেল তাহেরের হাতের মুঠোয়। কিন্তু ইতিহাসের এক আপতিক মোচড়ে তাঁর মুঠো থেকে ফসকে গেছে সে মুহূর্তটি। তারপর সেই পতিত ইতিহাস নিয়ে অবিরাম জন্ম দেওয়া হয়েছে ধোঁয়াচ্ছনতা। ফলে বাংলাদেশের ইতিহাসের তাত্পর্যপূর্ণ এ চরিত্রটি কখন থাকেন সম্পূর্ণ উহ্য, কখনো বা উপস্থাপিত হন পরস্পরবিরোধী বক্তব্যে। আর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটা উপেক্ষার চাদর বরাবরই ঢেকে রাখে তাঁকে। দুঃসাহসিক এক অভিযানের মধ্য দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়ে যোগ দিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, যুদ্ধক্ষেত্রের দুর্ধর্ষ এক অপারেশনে হারিয়েছেন একটি পা, ক্রাচে ভর দিয়ে তারপর নেতৃত্ব দিয়েছেন বিরল এক সিপাহি অভ্যুত্থানের এবং সর্বোপরি কিংবদন্তি সেই ক্ষুদিরামের পর শিকার হয়েছেন উপমহাদেশের দ্বিতীয় রাজনৈতিক ফাঁসির। একটি আদর্শকে তাড়া করতে গিয়ে একজন মানুষ যতটুকু দিতে পারেন, দিয়েছেন সবটুকুই। যদিও সে আদর্শ প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছেন তিনি। কিন্তু তথাকথিত বহু সাফল্যের চেয়ে কোনো কোনো ব্যর্থতাও হয়ে উঠতে পারে উজ্জ্বল।
একজন লেখক হিসেবে এবং বাংলাদেশের রাজনীতির একজন কৌতূহলী পর্যবেক্ষক হিসেবে এই ব্যতিক্রমী মানুষটিকে নিয়ে একটি সাহিত্যিক মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিই, যার ফল আমার সম্প্রতি প্রকাশিত বই ক্রাচের কর্নেল। লক্ষ করি কর্নেল তাহের কারও কাছে একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ, কারও কাছে লাল সালামের আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী, কারও কাছে বা তিনি নেহাত পেটি বুর্জয়া এক রোমান্টিক বিপ্লবী। রাজনীতিতে মারাত্মকভাবে বিভক্ত এই জনপদে তাহেরকে ঘিরে থাকা নানা কুয়াশা সরিয়ে তাঁর সঠিক ঐতিহাসিক বয়ানটি অনুসন্ধান দুরূহ ব্যাপার। দীর্ঘ গবেষণায় তাহেরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা, সীমিত এবং বিক্ষিপ্ত দলিল আর লেখাপত্রের মধ্য দিয়ে তাহেরের রক্ত-মাংসের অবয়ব এবং তাঁর যাত্রাপথটিকে বোঝার চেষ্টা করি।
লক্ষ করি আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনে বেড়ে ওঠা একজন স্টেশন মাস্টারের ছেলে আবু তাহের একদিন যে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে আবৃত্তি করছেন ‘জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করবও বলে’, তা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। তাহেরের এই কৌতূহলোদ্দীপক পথপরিক্রমাটি লক্ষ করলে দেখতে পাই, ব্যতিক্রমের বীজ তাঁর পরিবারটির ভেতরই। বিশেষ করে নজর কাড়েন তাহেরের মা আশরাফুন্নেসা। কর্নেল তাহেরের ভাইবোনের সঙ্গে, তাঁদের বাড়ি শ্যামগঞ্জের কাজলা গ্রামের অধিবাসীদের সঙ্গে যখন আলাপ করেছি, তখন তাঁদের টুকরো টুকরো স্মৃতিচারনায় যে নারীর অবয়ব ফুটে উঠেছে, তার সঙ্গে আবেগবিহ্বল, অশ্রুসজল বাঙালি মায়ের রূপের কোনো মিল নেই। কড়া শাসনে ১০ সন্তানের বিশাল পরিবারটি যূথবদ্ধভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের মতো করে গড়ে তুলেছেন তাহেরের মা আশরাফুন্নেসা। ছেলেমেয়েদের কঠিন কায়িক শ্রমে বাধ্য করেছেন, পাঠিয়েছেন নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, অবিরাম অন্যের উপকার করার একটা স্পৃহা জাগিয়েছেন তাঁদের মধ্যে, পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তে অনুপ্রাণিত করেছেন। ফলে পুরো পরিবারটিরই তৈরি হয়েছে এক ব্যতিক্রমী যৌথ ব্যক্তিত্ব। স্মরণ করা যেতে পারে, কর্নেল তাহেরের সব ভাইবোন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে ১১ নং সেক্টরে যৌথভাবে যুদ্ধ করেছেন। সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থানে তাঁর প্রত্যেক ভাই ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। বন্দী তাহেরকে মুক্ত করতে ভারতীয় হাইকমিশনারকে জিম্মি করার সুইসাইডাল স্কোয়াডের যে নাটকীয়তা ঘটেছিল, তার দুজন সদস্যই ছিলেন তাহেরের ভাই, যার একজন নিহত হন সেদিনের অপারেশনে। যুদ্ধ আর বিপ্লবকে এ রকম একটি পারিবারিক ব্যাপারে পরিণত করার দ্বিতীয় উদাহরণ বাংলাদেশে আছে বলে আমার জানা নেই।
গ্রামবাসী ও পারিবারিক স্মৃতিচারণায় কিশোর তাহেরকে দেখি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা আর নানা চারণ বিপ্লবীপনায়। নামজাদা ডাকাতের মোকাবিলা করা, গহিন জঙ্গলে অভিযানে বেরিয়ে পড়া, পাকিস্তানি মন্ত্রী নুরুল আমিনের ট্রেনে দলবেঁধে ঢিল ছোড়া ইত্যাদি গল্প ছড়িয়ে আছে তাঁকে নিয়ে। তাহেরের স্কুল সহপাঠী কাজলার বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক আব্দুল হান্নান মাস্টার আমার সঙ্গে গল্প করেছেন, কী করে স্কুলে আরবির বদলে সংস্কৃত পড়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তুলকালাম কাণ্ড করেছিলেন তাহের। জানতে পারি, রাজনীতির বৃহত্তর ছবিটি তাহের দেখতে পেয়েছিলেন চট্টগ্রামের প্রবর্তক স্কুলে পড়ার সময় তাঁর এক শিক্ষকের সাহচর্যে। সূর্য সেনের সঙ্গী এই শিক্ষক সশস্ত্র স্বদেশি আন্দোলনের ব্যাপারে আকৃষ্ট করে তুলেছিলেন তাহেরকে। পরবর্তী সময়ে সিলেটের এমসি কলেজে পড়ার সময় রাজনীতির বিস্তারিত পাঠ শুরু হয় তাহেরের। সে সময়কার আরও অনেক তরুণের মতো তাহের আকৃষ্ট হন মার্ক্সবাদে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পৃথিবীর নানা দেশে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের বহু তরুণের কাছে কমিউনিজম এক নিষিদ্ধ, রোমান্সকর স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে তাড়িত হয়েছিলেন তাহের। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো পড়ে উত্তেজিত হয়ে ভাই আনোয়ার হোসেনকে লিখেছিলেন, ‘দিস ইজ দ্য বেস্ট বুক দ্যাট আই হ্যাভ রিড সো ফার।’
তাহেরের জীবনের এই পর্বটির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই এমসি কলেজে তাহেরের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু লন্ডন-প্রবাসী জনাব মঞ্জু এবং ঢাকা কৃষি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব মজুমদারের কাছে। তাঁদের স্মৃতিচারণায় আমার চোখের সামনে ফুটে ওঠে রাজনীতির ঘোর লাগা প্রাণবন্ত কলেজছাত্র তাহেরের ছবি। আমাকে তাঁরা দেখিয়েছেন সযত্নে রেখে দেওয়া তরুণ তাহেরের হাতে লেখা উষ্ণ চিঠি। লক্ষ করি, সমাজতন্ত্রের সামরিক দিকটির ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ তাহেরের। পূর্ব পাকিস্তানে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের আশঙ্কা নিয়ে তখন ভাবছেন তিনি। এ সময় তাহের একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নেন। বন্ধুদের বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি আর্মস স্ট্রাগলের জন্য মিলিটারি ট্রেনিং নিতে আর্মিতে যোগ দেবেন তিনি। পুরো ভাবনাটি অদ্ভুত ঠেকে বন্ধুদের কাছে। কিন্তু তাহের তাঁর সংকল্পে স্থির থেকে পর পর দুবার পরীক্ষা দিয়ে তারপর আর্মিতে সুযোগ পান। বিপ্লবের প্রয়োজনে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে সচেতনভাবে সেনাবাহিনীতে ঢোকার এমন নজির বিরল। আর্মিতে ঢুকে এরপর দ্রুত তাহের পরিণত হন প্রথম সারির অফিসারে। প্রথম বাঙালি অফিসার হিসেবে পাকিস্তান আর্মির কমান্ডো দলে অন্তর্ভুক্ত হন, নেতৃত্ব দেন প্যারাস্যুট জাম্পিংয়ে। যত রকম সামরিক প্রশিক্ষণ আছে, সেগুলো আত্মস্থ করার ব্যাপারে তত্পর থাকেন তিনি। পাকিস্তান আর্মির জানার কথা নয়, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ কমান্ডো দলের জুনিয়র অফিসার মেজর আনোয়ার তাঁর হেল কমান্ডো বইয়ে তাহেরের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জীবনের চমত্কার বর্ণনা দিয়েছেন।
এমসি কলেজে বন্ধুদের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, লক্ষ করি সেটা নেহাত ঠাট্টা নয়। আয়ুব খানের সামরিক শাসনের চাপে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অবস্থা তখন নাজেহাল। বিশ্বরাজনীতির প্রভাবে সেখানেও তখন চীন-রাশিয়া বিভেদ, কিন্তু দেখতে পাই পাকিস্তান আর্মির ভেতর থেকেও তাহের যোগাযোগ স্থাপন করেছেন পূর্ব পাকিস্তানের বাম রাজনীতির সবচেয়ে র্যাডিক্যাল একটি অংশের সঙ্গে, যারা নিজেদের তখন প্রস্তুত করছে সশন্ত্র সংগ্রামের জন্য। তরুণ প্রকৌশলী সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই ছোট দলটির সঙ্গে তাহেরের যোগাযোগ হয় ছোট ভাই আনোয়ারের মারফত, সঙ্গে ছিলেন ভাই আবু সাঈদ ও আবু ইউসুফও। সেই ১৯৬৯ সালে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মিলে টেকনাফকে ঘাঁটি করে, তত্কালীন বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় একটি সশন্ত্র সংগ্রামের সিরিয়াস প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তাহের। ছুটি নিয়ে গোপনে বহু তরুণকে তিনি আর্মস ট্রেনিং দিয়েছিলেন তখন। একটা ঘোর এবং গভীর প্রত্যয় ছাড়া পাকিস্তানি আর্মির একজন অফিসার হিসেবে এমন মারাত্মক ঝুঁকি নেওয়ার দুঃসাহস থাকার কথা নয়। বিপ্লরের নেশায় মত্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখায় ইস্তফা দিয়ে টেকনাফের গভীর অরণ্যে ঘাঁটি গাড়ার সেসব স্মৃাতি আমাকে বলেছেন আনোয়ার হোসেন। আরেক ভাই আবু সাঈদ জানিয়েছেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। সিরাজ শিকাদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফজলুল হক রানা আমাকে বলছিলেন তাহের ও শিকদারের সেই গোপন বিপ্লবী প্রশিক্ষণের গল্প। মতদ্বৈধতার কারণে তাহের ও শিকদারের সেই যৌথ উদ্যোগ সে সময় অগ্রসর হয়নি বেশি দূর। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট হয় তাঁর ভাবনার গতিপথটি, তাঁর প্রস্তুতিটি। টের পাই কী করে ক্রমেই তাহের ধাবিত হচ্ছেন তাঁর পরিণতির দিকে। সেই ঊনসত্তরে ব্যর্থ বিপ্লবীর জীবনে আসে বসন্তের হাওয়া। এ সময়ই ঈশ্বরগঞ্জের ডা. খুরশীদুদ্দিনের মেয়ে লুত্ফার সঙ্গে বিয়ে হয় তাহেরের। সেনাবাহিনীর ট্রুপ দিয়ে বরযাত্রী সাজিয়ে ফাঁকা গুলি করতে করতে অভিনব কায়দায় বিয়ের আসরে গিয়েছিলেন তাহের।
২.
বলছিলাম, ক্রাচের কর্নেল বইটিতে তাহেরের যাত্রাপথটিই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি আমি। সেখানে বরাবর একটি নাটকীয়তা লক্ষ করেছি, পাশাপাশি লক্ষ করেছি চিন্তার ধারাবাহিকতাও। নাটকীয়ভাবেই আর্মিতে ঢুকেছিলেন তিনি, কিন্তু কোনো জেনারেল হওয়ার আশায় নয়, বরং একটি আদর্শিক মিশন নিয়ে। সে কারণে সেই ঊনসত্তরেই আর্মি ছেড়ে দিয়ে সিরাজ শিকদারের গোপন বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার সব রকম ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাহের। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম সুযোগেই আর্মির চাকরিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়েছেন। মেজর জিয়াউদ্দীন, মেজর মঞ্জুর আর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে নিয়ে এবোটাবাদ থেকে দেবীগড় পালানোর দুঃসাহসিক অভিযানটির বর্ণনা নিজেই লিখে গেছেন তাহের। জনাব পাটোয়ারীর কাছ থেকে পরবর্তী সময়ে শুনছিলাম, কী করে তাহেরই পাকিস্তান পালানোর পুরো অভিযানটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, শিয়ালকোটের ধানক্ষেতের কাদার ভেতর গভীর রাতে সন্তর্পণে পা ফেলে চলা সেই ছোট অভিযাত্রী দলটিকে।
বলা বাহুল্য, কোনো কনভেনশনাল যুদ্ধ করার জন্য তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেননি। তিনি করোটিতে বহন করে এনেছিলেন তাঁর গোপন মিশনটিও। মুক্তিযুদ্ধ একটি স্বাধীকারের যুদ্ধ হলেও তিনি এর বাঁক ঘোরানোর চেষ্টা করছিলেন সমাজতান্ত্রিক জনযুদ্ধের দিকে। ১১ নম্বর সেক্টরে প্রচলিত ব্রিগেড গড়ার বদলে তিনি ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে থাকেন অপেশাদার গেরিলাদের ওপর। তাঁর সেক্টরের কোম্পানিগুলোতে পলিটিক্যাল কমিশনার হিসেবে তিনি নিয়োগ দেন বাম আদর্শে উদ্বুদ্ধ তরুণদের। এ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে বিরোধ বাধে তাহেরের। তাহেরের সহযোদ্ধার সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, একটি গলফস্টিক হাতে ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ঘুরে কী গভীর আন্তরিকতায় তিনি শোনাতেন হো চি মিনের পিপলস ওয়ারের গল্প। ১১ সেক্টরের যুদ্ধ সাংবাদিক হারুন হাবীব রণক্ষেত্রের প্রাণবন্ত তাহেরের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়, জানিয়েছেন তাহেরের দেওয়া ইয়াশিকা ক্যামেরাটি দিয়েই তিনি তুলেছিলেন যুদ্ধের যাবতীয় ছবি।
তাহের ভেবেছিলেন, ময়মনসিংহ সীমান্তের কামালপুরে পাকিস্তানিদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটিটির পতনের মধ্য দিয়েই তিনি ঢাকা দখলের পথ সুগম করবেন। দুর্ধর্ষ কামালপুর অপারেশনটি যেদিন তাহের করেছিলেন, সেদিন গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ভাইবোনেরা। ভাই আনোয়ার ছিলেন তাঁর স্টাফ অফিসার, ছিলেন সাঈদ, ইউসুফ, বেলাল, বাহার, এমনকি কিশোরী বোন ডালিয়াও, যাঁকে তাহের ডাকতেন গেরিলী বলে। সেদিন ছিল ১৪ নভেম্বর, তাহেরের জন্মদিন। কথা ছিল, ভোর রাতের মধ্যে কামালপুর দখল করে সেখানে সহযোদ্ধা, ভাইবোনদের নিয়ে পালন করবেন জন্মদিন। তুরা ক্যাম্প থেকে এসে যোগ দেবেন স্ত্রী লুত্ফা আর বোন জুলিয়া। বড় ভাই আরিফ তখন মা-বাবাকে আগলে আছেন কাজলায়। একপর্যায়ে ধরা পড়েছেন পাকিস্তানিদের হাতে। কামালপুর অপারেশনে বিজয় প্রায় নিশ্চিত ছিল। উত্তেজনায় নিজের কমান্ড পোস্ট থেকে সরে গিয়ে তাহের চলে গিয়েছিলেন শত্রুব্যূহের একেবারে কাছে। সেদিন একটি শেল এসে উড়িয়ে দিয়েছিল তাহেরর পা। সেই মর্মান্তিক মুহূর্তের বর্ণনা শুনছিলাম তাঁর দুই হাত দূরে পজিশন নিয়ে থাকা ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের কাছ থেকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় দ্রুত তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গৌহাটি হাসপতালে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছে, তাহের তখন পুনায় চিকিত্সাধীন। মুক্তিযুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তিতে খুশি হননি তাহের। একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে ভিয়েতনামের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে, এমনই প্রত্যাশা ছিল তাঁর।
মুক্ত বাংলাদেশে ক্রাচে ভর দিয়ে ফেরেন তাহের। কিন্তু তাঁর মিশন থাকে অব্যহত। লক্ষ করি, এবার তাঁর মনোযোগ ক্যান্টনমেন্টে। তিনি সেনাবাহিনীর খোলনলচে পালটে ফেলার চেষ্টা করেন। জনগণ ও সেনাবাহিনীর দূরত্ব ঘুচিয়ে তিনি পিপলস আর্মি গঠনের প্রস্তাব করেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তিনি সিপাহিদের নামিয়ে দেন চাষাবাদে, গ্রাম উন্নয়নে। মেজর জিয়াউদ্দীন, যিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সে সময় ছিলেন তাহেরের অধীনস্থ অফিসার স্মরণ করছিলেন ক্যান্টনমেন্টে সন্ধ্যার পর সেসব সেশনের কথা, যখন তাহের তাঁর ক্রাচটি পাশে রেখে তরুণ অফিসারদের উদ্বুদ্ধ করতেন ঔপনিবেশিক ধাঁচের সেনাবাহিনীকে বদলে ফেলতে। জিয়াউদ্দীন পুরোপুরি তাহেরের ভক্ত হয়ে উঠলেও সাধারণভাবে আর্মির ভেতর তাহেরের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা ওঠে। তাঁর ব্রিগেডকে লাঙল ব্রিগেড বলে মশকরা করে অভিযোগ তোলা হয় যে তাহের আর্মির ভেতর কমিউনিস্ট চিন্তা ঢোকানোর চেষ্টা করছেন। তাহেরকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের অ্যাকটিভ কমান্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বলা বাহুল্য, একটি কমিউনিস্ট ধাঁচের আর্মির কথাই ভাবছিলেন তাহের। কিন্তু পুরো রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে সেটি ছিল বেমানান। কর্নেল তাহের তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে সে সময় বেশ কয়েকবার আলাপ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে। শেখ মুজিব তাহেরকে উত্সাহিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। শেখ মুজিব বাম ধারার রাজনীতিবিদ না হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর প্রবল প্রভাবের কথা ভেবেই তাঁর ওপর আস্থা রাখছিলেন তাহের। কিন্তু অচিরেই টের পেয়েছিলেন, সে সময়কার বিশ্বরাজনীতি আর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিল জটাজালকে ব্যক্তিগত কারিশমা দিয়ে সামাল দেওয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে হবে দুরূহ। তাহের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে এবার সরাসরি বিকল্প রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পদত্যাগপত্রে তাহের লিখেছিলেন, তিনি আঁচ করছেন, একটি গভীর বিপদ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের মানুষের দিকে। সেটা ১৯৭২ সাল। তাহেরের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে গভীর বিপদ বাস্তবিকই আঘাত হেনেছিল বাংলাদেশকে অচিরেই।
তাহের তাঁর করোটির মিশনটি এবার একটি দলীয় কাঠামোর ভেতর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তান আমলেও একবার চেষ্টা করেছিলেন সিরাজ শিকদারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে, সফল হননি। স্বাধীন বাংলাদেশে তাহের খুঁজতে থাকেন তাঁর জন্য যথার্থ একটি বাম রাজনৈতিক দল। প্রধান বাম দল ন্যাপ এবং সিপিবি তখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত, ফলে তালিকা থেকে তারা বাদ যায়। তাহের বরং এক এক করে দেখা করেন ভাসানী, আবুল বাশার, মোহাম্মদ তোয়াহা, সিরাজুল হোসেন খান প্রমুখ প্রবীণ বাম নেতাদের সঙ্গে। বদরুদ্দীন উমর আমাকে বলছিলেন, কীভাবে তাহের ক্রাচে ভর দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে তাঁর শান্তিনগরের বাসায় এসে গভীর উদ্বিগ্নতায় আলাপ করতেন দেশে একটি যথার্থ সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের সম্ভাবনা নিয়ে। কারও সঙ্গে মেলেনি তাহেরের। এককালীন সহযোগী সিরাজ শিকদার সে সময় সর্বহারা পার্টির মাধ্যমে যে সন্ত্রাসী প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, তাঁকেও সমর্থন করেননি তাহের। এ সময় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়ে আবির্ভূত হয় জাসদ। তাঁর তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করেন তাহের। হাসানুল হক ইনু, সে সময়ের তরুণ জাসদ নেতা আমাকে জানিয়েছেন রাতের পর রাত ধরে তাহেরের নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে তর্ক-বিতর্ক করার স্মৃতি। একপর্যায়ে নিজের নাম গোপন রেখে জাসদে যোগ দেন তাহের।
একদিকে গণ-আন্দোলন, অন্যদিকে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের জন্য সমান্তরাল একটি সশস্ত্র গণবাহিনী তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে জাসদ। তাহের হন গণবাহিনীর প্রধান। সে সময়কার দেশের উদ্ভ্রান্ত পরিস্থিতিতে তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে জাসদ। একটি সুদূরপ্রয়াসী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল জাসদ। কিন্তু পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ওলট-পালট করে দেয় সব হিসাব। শেখ মুজিবকে উত্খাতকারী ঘটনার নায়কেরা আওয়ামী লীগবিরোধী হিসেবে জাসদকে তাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু ১৫ অগাস্টের ভোরেই তাহের ক্রাচে ভর দিয়ে ভাই আনোয়ার ও জাসদ নেতা ইনুকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন শাহবাগ রেডিও স্টেশনে। ঘটনার কুশীলব মোশতাক ও মেজর রশীদকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর অবস্থন। বলেছিলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তিনি চাইছিলেন ঠিকই, কিন্তু এমন কাপুরুষ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নয়। খন্দকার মোশতাককে শাসিয়ে দিয়েছিলেন আর কোনো ষড়যন্ত্রের পথে না গিয়ে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তখন ঝড়ের বেগে বদলে যাচ্ছে সব। বলা যায়, প্রতিদিনই তখন তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাস। ১৫ অগাস্টে শেখ মুজিব হত্যা, ২ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান, ৩ নভেম্বরে জেলহত্যা ইত্যাদি মিলিয়ে পুরো রাজনীতি এসে তখন কেন্দ্রীভূত হয়েছে সামরিক বাহিনী ও ক্যান্টনমেন্টে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাসদ বদলে ফেলে তাদের আন্দোলনের কৌশল, সক্রিয় করে তোলে গণবাহিনীকে, প্রস্তুতি নেয় পাল্টা অভ্যুত্থানের। গণবাহিনীর প্রধান হিসেবে এবং সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে কর্নেল তাহেরই তখন হয়ে ওঠেন জাসদ রাজনীতির পুরোধা।
বাকি অংশ আগামীকাল
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
একজন লেখক হিসেবে এবং বাংলাদেশের রাজনীতির একজন কৌতূহলী পর্যবেক্ষক হিসেবে এই ব্যতিক্রমী মানুষটিকে নিয়ে একটি সাহিত্যিক মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিই, যার ফল আমার সম্প্রতি প্রকাশিত বই ক্রাচের কর্নেল। লক্ষ করি কর্নেল তাহের কারও কাছে একটি অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ, কারও কাছে লাল সালামের আনুষ্ঠানিকতায় বন্দী, কারও কাছে বা তিনি নেহাত পেটি বুর্জয়া এক রোমান্টিক বিপ্লবী। রাজনীতিতে মারাত্মকভাবে বিভক্ত এই জনপদে তাহেরকে ঘিরে থাকা নানা কুয়াশা সরিয়ে তাঁর সঠিক ঐতিহাসিক বয়ানটি অনুসন্ধান দুরূহ ব্যাপার। দীর্ঘ গবেষণায় তাহেরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতা, সীমিত এবং বিক্ষিপ্ত দলিল আর লেখাপত্রের মধ্য দিয়ে তাহেরের রক্ত-মাংসের অবয়ব এবং তাঁর যাত্রাপথটিকে বোঝার চেষ্টা করি।
লক্ষ করি আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের বিভিন্ন স্টেশনে বেড়ে ওঠা একজন স্টেশন মাস্টারের ছেলে আবু তাহের একদিন যে ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে আবৃত্তি করছেন ‘জন্মেছি মৃত্যুকে পরাজিত করবও বলে’, তা কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। তাহেরের এই কৌতূহলোদ্দীপক পথপরিক্রমাটি লক্ষ করলে দেখতে পাই, ব্যতিক্রমের বীজ তাঁর পরিবারটির ভেতরই। বিশেষ করে নজর কাড়েন তাহেরের মা আশরাফুন্নেসা। কর্নেল তাহেরের ভাইবোনের সঙ্গে, তাঁদের বাড়ি শ্যামগঞ্জের কাজলা গ্রামের অধিবাসীদের সঙ্গে যখন আলাপ করেছি, তখন তাঁদের টুকরো টুকরো স্মৃতিচারনায় যে নারীর অবয়ব ফুটে উঠেছে, তার সঙ্গে আবেগবিহ্বল, অশ্রুসজল বাঙালি মায়ের রূপের কোনো মিল নেই। কড়া শাসনে ১০ সন্তানের বিশাল পরিবারটি যূথবদ্ধভাবে একটি প্রতিষ্ঠানের মতো করে গড়ে তুলেছেন তাহেরের মা আশরাফুন্নেসা। ছেলেমেয়েদের কঠিন কায়িক শ্রমে বাধ্য করেছেন, পাঠিয়েছেন নানা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে, অবিরাম অন্যের উপকার করার একটা স্পৃহা জাগিয়েছেন তাঁদের মধ্যে, পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তে অনুপ্রাণিত করেছেন। ফলে পুরো পরিবারটিরই তৈরি হয়েছে এক ব্যতিক্রমী যৌথ ব্যক্তিত্ব। স্মরণ করা যেতে পারে, কর্নেল তাহেরের সব ভাইবোন মুক্তিযুদ্ধে তাঁর নেতৃত্বে ১১ নং সেক্টরে যৌথভাবে যুদ্ধ করেছেন। সাতই নভেম্বরের অভ্যুত্থানে তাঁর প্রত্যেক ভাই ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে। বন্দী তাহেরকে মুক্ত করতে ভারতীয় হাইকমিশনারকে জিম্মি করার সুইসাইডাল স্কোয়াডের যে নাটকীয়তা ঘটেছিল, তার দুজন সদস্যই ছিলেন তাহেরের ভাই, যার একজন নিহত হন সেদিনের অপারেশনে। যুদ্ধ আর বিপ্লবকে এ রকম একটি পারিবারিক ব্যাপারে পরিণত করার দ্বিতীয় উদাহরণ বাংলাদেশে আছে বলে আমার জানা নেই।
গ্রামবাসী ও পারিবারিক স্মৃতিচারণায় কিশোর তাহেরকে দেখি অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়তা আর নানা চারণ বিপ্লবীপনায়। নামজাদা ডাকাতের মোকাবিলা করা, গহিন জঙ্গলে অভিযানে বেরিয়ে পড়া, পাকিস্তানি মন্ত্রী নুরুল আমিনের ট্রেনে দলবেঁধে ঢিল ছোড়া ইত্যাদি গল্প ছড়িয়ে আছে তাঁকে নিয়ে। তাহেরের স্কুল সহপাঠী কাজলার বৃদ্ধ স্কুলশিক্ষক আব্দুল হান্নান মাস্টার আমার সঙ্গে গল্প করেছেন, কী করে স্কুলে আরবির বদলে সংস্কৃত পড়ার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তুলকালাম কাণ্ড করেছিলেন তাহের। জানতে পারি, রাজনীতির বৃহত্তর ছবিটি তাহের দেখতে পেয়েছিলেন চট্টগ্রামের প্রবর্তক স্কুলে পড়ার সময় তাঁর এক শিক্ষকের সাহচর্যে। সূর্য সেনের সঙ্গী এই শিক্ষক সশস্ত্র স্বদেশি আন্দোলনের ব্যাপারে আকৃষ্ট করে তুলেছিলেন তাহেরকে। পরবর্তী সময়ে সিলেটের এমসি কলেজে পড়ার সময় রাজনীতির বিস্তারিত পাঠ শুরু হয় তাহেরের। সে সময়কার আরও অনেক তরুণের মতো তাহের আকৃষ্ট হন মার্ক্সবাদে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে পৃথিবীর নানা দেশে বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের বহু তরুণের কাছে কমিউনিজম এক নিষিদ্ধ, রোমান্সকর স্বপ্ন। সেই স্বপ্নে তাড়িত হয়েছিলেন তাহের। কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো পড়ে উত্তেজিত হয়ে ভাই আনোয়ার হোসেনকে লিখেছিলেন, ‘দিস ইজ দ্য বেস্ট বুক দ্যাট আই হ্যাভ রিড সো ফার।’
তাহেরের জীবনের এই পর্বটির গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাই এমসি কলেজে তাহেরের দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু লন্ডন-প্রবাসী জনাব মঞ্জু এবং ঢাকা কৃষি মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক জনাব মজুমদারের কাছে। তাঁদের স্মৃতিচারণায় আমার চোখের সামনে ফুটে ওঠে রাজনীতির ঘোর লাগা প্রাণবন্ত কলেজছাত্র তাহেরের ছবি। আমাকে তাঁরা দেখিয়েছেন সযত্নে রেখে দেওয়া তরুণ তাহেরের হাতে লেখা উষ্ণ চিঠি। লক্ষ করি, সমাজতন্ত্রের সামরিক দিকটির ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহ তাহেরের। পূর্ব পাকিস্তানে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের আশঙ্কা নিয়ে তখন ভাবছেন তিনি। এ সময় তাহের একটি অভূতপূর্ব সিদ্ধান্ত নেন। বন্ধুদের বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি আর্মস স্ট্রাগলের জন্য মিলিটারি ট্রেনিং নিতে আর্মিতে যোগ দেবেন তিনি। পুরো ভাবনাটি অদ্ভুত ঠেকে বন্ধুদের কাছে। কিন্তু তাহের তাঁর সংকল্পে স্থির থেকে পর পর দুবার পরীক্ষা দিয়ে তারপর আর্মিতে সুযোগ পান। বিপ্লবের প্রয়োজনে সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে সচেতনভাবে সেনাবাহিনীতে ঢোকার এমন নজির বিরল। আর্মিতে ঢুকে এরপর দ্রুত তাহের পরিণত হন প্রথম সারির অফিসারে। প্রথম বাঙালি অফিসার হিসেবে পাকিস্তান আর্মির কমান্ডো দলে অন্তর্ভুক্ত হন, নেতৃত্ব দেন প্যারাস্যুট জাম্পিংয়ে। যত রকম সামরিক প্রশিক্ষণ আছে, সেগুলো আত্মস্থ করার ব্যাপারে তত্পর থাকেন তিনি। পাকিস্তান আর্মির জানার কথা নয়, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ কমান্ডো দলের জুনিয়র অফিসার মেজর আনোয়ার তাঁর হেল কমান্ডো বইয়ে তাহেরের পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জীবনের চমত্কার বর্ণনা দিয়েছেন।
এমসি কলেজে বন্ধুদের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, লক্ষ করি সেটা নেহাত ঠাট্টা নয়। আয়ুব খানের সামরিক শাসনের চাপে পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অবস্থা তখন নাজেহাল। বিশ্বরাজনীতির প্রভাবে সেখানেও তখন চীন-রাশিয়া বিভেদ, কিন্তু দেখতে পাই পাকিস্তান আর্মির ভেতর থেকেও তাহের যোগাযোগ স্থাপন করেছেন পূর্ব পাকিস্তানের বাম রাজনীতির সবচেয়ে র্যাডিক্যাল একটি অংশের সঙ্গে, যারা নিজেদের তখন প্রস্তুত করছে সশন্ত্র সংগ্রামের জন্য। তরুণ প্রকৌশলী সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই ছোট দলটির সঙ্গে তাহেরের যোগাযোগ হয় ছোট ভাই আনোয়ারের মারফত, সঙ্গে ছিলেন ভাই আবু সাঈদ ও আবু ইউসুফও। সেই ১৯৬৯ সালে সিরাজ শিকদারের সঙ্গে মিলে টেকনাফকে ঘাঁটি করে, তত্কালীন বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির সহযোগিতায় একটি সশন্ত্র সংগ্রামের সিরিয়াস প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তাহের। ছুটি নিয়ে গোপনে বহু তরুণকে তিনি আর্মস ট্রেনিং দিয়েছিলেন তখন। একটা ঘোর এবং গভীর প্রত্যয় ছাড়া পাকিস্তানি আর্মির একজন অফিসার হিসেবে এমন মারাত্মক ঝুঁকি নেওয়ার দুঃসাহস থাকার কথা নয়। বিপ্লরের নেশায় মত্ত হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখায় ইস্তফা দিয়ে টেকনাফের গভীর অরণ্যে ঘাঁটি গাড়ার সেসব স্মৃাতি আমাকে বলেছেন আনোয়ার হোসেন। আরেক ভাই আবু সাঈদ জানিয়েছেন সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বার্মার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগের রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা। সিরাজ শিকাদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ফজলুল হক রানা আমাকে বলছিলেন তাহের ও শিকদারের সেই গোপন বিপ্লবী প্রশিক্ষণের গল্প। মতদ্বৈধতার কারণে তাহের ও শিকদারের সেই যৌথ উদ্যোগ সে সময় অগ্রসর হয়নি বেশি দূর। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড থেকে স্পষ্ট হয় তাঁর ভাবনার গতিপথটি, তাঁর প্রস্তুতিটি। টের পাই কী করে ক্রমেই তাহের ধাবিত হচ্ছেন তাঁর পরিণতির দিকে। সেই ঊনসত্তরে ব্যর্থ বিপ্লবীর জীবনে আসে বসন্তের হাওয়া। এ সময়ই ঈশ্বরগঞ্জের ডা. খুরশীদুদ্দিনের মেয়ে লুত্ফার সঙ্গে বিয়ে হয় তাহেরের। সেনাবাহিনীর ট্রুপ দিয়ে বরযাত্রী সাজিয়ে ফাঁকা গুলি করতে করতে অভিনব কায়দায় বিয়ের আসরে গিয়েছিলেন তাহের।
২.
বলছিলাম, ক্রাচের কর্নেল বইটিতে তাহেরের যাত্রাপথটিই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি আমি। সেখানে বরাবর একটি নাটকীয়তা লক্ষ করেছি, পাশাপাশি লক্ষ করেছি চিন্তার ধারাবাহিকতাও। নাটকীয়ভাবেই আর্মিতে ঢুকেছিলেন তিনি, কিন্তু কোনো জেনারেল হওয়ার আশায় নয়, বরং একটি আদর্শিক মিশন নিয়ে। সে কারণে সেই ঊনসত্তরেই আর্মি ছেড়ে দিয়ে সিরাজ শিকদারের গোপন বিপ্লবী দলে যোগ দেওয়ার সব রকম ঝুঁকি নিয়েছিলেন তাহের। সে কারণেই মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রথম সুযোগেই আর্মির চাকরিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালিয়েছেন। মেজর জিয়াউদ্দীন, মেজর মঞ্জুর আর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে নিয়ে এবোটাবাদ থেকে দেবীগড় পালানোর দুঃসাহসিক অভিযানটির বর্ণনা নিজেই লিখে গেছেন তাহের। জনাব পাটোয়ারীর কাছ থেকে পরবর্তী সময়ে শুনছিলাম, কী করে তাহেরই পাকিস্তান পালানোর পুরো অভিযানটির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম, শিয়ালকোটের ধানক্ষেতের কাদার ভেতর গভীর রাতে সন্তর্পণে পা ফেলে চলা সেই ছোট অভিযাত্রী দলটিকে।
বলা বাহুল্য, কোনো কনভেনশনাল যুদ্ধ করার জন্য তাহের পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেননি। তিনি করোটিতে বহন করে এনেছিলেন তাঁর গোপন মিশনটিও। মুক্তিযুদ্ধ একটি স্বাধীকারের যুদ্ধ হলেও তিনি এর বাঁক ঘোরানোর চেষ্টা করছিলেন সমাজতান্ত্রিক জনযুদ্ধের দিকে। ১১ নম্বর সেক্টরে প্রচলিত ব্রিগেড গড়ার বদলে তিনি ব্যাপকভাবে নির্ভর করতে থাকেন অপেশাদার গেরিলাদের ওপর। তাঁর সেক্টরের কোম্পানিগুলোতে পলিটিক্যাল কমিশনার হিসেবে তিনি নিয়োগ দেন বাম আদর্শে উদ্বুদ্ধ তরুণদের। এ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কমান্ডার জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে বিরোধ বাধে তাহেরের। তাহেরের সহযোদ্ধার সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি, একটি গলফস্টিক হাতে ক্যাম্প থেকে ক্যাম্পে ঘুরে কী গভীর আন্তরিকতায় তিনি শোনাতেন হো চি মিনের পিপলস ওয়ারের গল্প। ১১ সেক্টরের যুদ্ধ সাংবাদিক হারুন হাবীব রণক্ষেত্রের প্রাণবন্ত তাহেরের বর্ণনা দিয়েছেন তাঁর বিভিন্ন লেখায়, জানিয়েছেন তাহেরের দেওয়া ইয়াশিকা ক্যামেরাটি দিয়েই তিনি তুলেছিলেন যুদ্ধের যাবতীয় ছবি।
তাহের ভেবেছিলেন, ময়মনসিংহ সীমান্তের কামালপুরে পাকিস্তানিদের সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটিটির পতনের মধ্য দিয়েই তিনি ঢাকা দখলের পথ সুগম করবেন। দুর্ধর্ষ কামালপুর অপারেশনটি যেদিন তাহের করেছিলেন, সেদিন গুরুত্বপূর্ণ সব দায়িত্বে ছিলেন তাঁর ভাইবোনেরা। ভাই আনোয়ার ছিলেন তাঁর স্টাফ অফিসার, ছিলেন সাঈদ, ইউসুফ, বেলাল, বাহার, এমনকি কিশোরী বোন ডালিয়াও, যাঁকে তাহের ডাকতেন গেরিলী বলে। সেদিন ছিল ১৪ নভেম্বর, তাহেরের জন্মদিন। কথা ছিল, ভোর রাতের মধ্যে কামালপুর দখল করে সেখানে সহযোদ্ধা, ভাইবোনদের নিয়ে পালন করবেন জন্মদিন। তুরা ক্যাম্প থেকে এসে যোগ দেবেন স্ত্রী লুত্ফা আর বোন জুলিয়া। বড় ভাই আরিফ তখন মা-বাবাকে আগলে আছেন কাজলায়। একপর্যায়ে ধরা পড়েছেন পাকিস্তানিদের হাতে। কামালপুর অপারেশনে বিজয় প্রায় নিশ্চিত ছিল। উত্তেজনায় নিজের কমান্ড পোস্ট থেকে সরে গিয়ে তাহের চলে গিয়েছিলেন শত্রুব্যূহের একেবারে কাছে। সেদিন একটি শেল এসে উড়িয়ে দিয়েছিল তাহেরর পা। সেই মর্মান্তিক মুহূর্তের বর্ণনা শুনছিলাম তাঁর দুই হাত দূরে পজিশন নিয়ে থাকা ভাই ওয়ারেসাত হোসেন বেলালের কাছ থেকে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় দ্রুত তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল গৌহাটি হাসপতালে। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হচ্ছে, তাহের তখন পুনায় চিকিত্সাধীন। মুক্তিযুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তিতে খুশি হননি তাহের। একটি দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে ভিয়েতনামের মতো একটি সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটবে, এমনই প্রত্যাশা ছিল তাঁর।
মুক্ত বাংলাদেশে ক্রাচে ভর দিয়ে ফেরেন তাহের। কিন্তু তাঁর মিশন থাকে অব্যহত। লক্ষ করি, এবার তাঁর মনোযোগ ক্যান্টনমেন্টে। তিনি সেনাবাহিনীর খোলনলচে পালটে ফেলার চেষ্টা করেন। জনগণ ও সেনাবাহিনীর দূরত্ব ঘুচিয়ে তিনি পিপলস আর্মি গঠনের প্রস্তাব করেন। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে তিনি সিপাহিদের নামিয়ে দেন চাষাবাদে, গ্রাম উন্নয়নে। মেজর জিয়াউদ্দীন, যিনি কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে সে সময় ছিলেন তাহেরের অধীনস্থ অফিসার স্মরণ করছিলেন ক্যান্টনমেন্টে সন্ধ্যার পর সেসব সেশনের কথা, যখন তাহের তাঁর ক্রাচটি পাশে রেখে তরুণ অফিসারদের উদ্বুদ্ধ করতেন ঔপনিবেশিক ধাঁচের সেনাবাহিনীকে বদলে ফেলতে। জিয়াউদ্দীন পুরোপুরি তাহেরের ভক্ত হয়ে উঠলেও সাধারণভাবে আর্মির ভেতর তাহেরের এ ধরনের কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা ওঠে। তাঁর ব্রিগেডকে লাঙল ব্রিগেড বলে মশকরা করে অভিযোগ তোলা হয় যে তাহের আর্মির ভেতর কমিউনিস্ট চিন্তা ঢোকানোর চেষ্টা করছেন। তাহেরকে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের অ্যাকটিভ কমান্ড থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বলা বাহুল্য, একটি কমিউনিস্ট ধাঁচের আর্মির কথাই ভাবছিলেন তাহের। কিন্তু পুরো রাষ্ট্রকাঠামোর সঙ্গে সেটি ছিল বেমানান। কর্নেল তাহের তাঁর চিন্তাভাবনা নিয়ে সে সময় বেশ কয়েকবার আলাপ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে। শেখ মুজিব তাহেরকে উত্সাহিত করেছিলেন এবং বলেছিলেন, এ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ করবেন। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়ে ওঠেনি। শেখ মুজিব বাম ধারার রাজনীতিবিদ না হলেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁর প্রবল প্রভাবের কথা ভেবেই তাঁর ওপর আস্থা রাখছিলেন তাহের। কিন্তু অচিরেই টের পেয়েছিলেন, সে সময়কার বিশ্বরাজনীতি আর অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিল জটাজালকে ব্যক্তিগত কারিশমা দিয়ে সামাল দেওয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে হবে দুরূহ। তাহের সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করে এবার সরাসরি বিকল্প রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। পদত্যাগপত্রে তাহের লিখেছিলেন, তিনি আঁচ করছেন, একটি গভীর বিপদ ধেয়ে আসছে বাংলাদেশের মানুষের দিকে। সেটা ১৯৭২ সাল। তাহেরের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে গভীর বিপদ বাস্তবিকই আঘাত হেনেছিল বাংলাদেশকে অচিরেই।
তাহের তাঁর করোটির মিশনটি এবার একটি দলীয় কাঠামোর ভেতর স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। পাকিস্তান আমলেও একবার চেষ্টা করেছিলেন সিরাজ শিকদারের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মাধ্যমে, সফল হননি। স্বাধীন বাংলাদেশে তাহের খুঁজতে থাকেন তাঁর জন্য যথার্থ একটি বাম রাজনৈতিক দল। প্রধান বাম দল ন্যাপ এবং সিপিবি তখন আওয়ামী লীগের সঙ্গে একীভূত, ফলে তালিকা থেকে তারা বাদ যায়। তাহের বরং এক এক করে দেখা করেন ভাসানী, আবুল বাশার, মোহাম্মদ তোয়াহা, সিরাজুল হোসেন খান প্রমুখ প্রবীণ বাম নেতাদের সঙ্গে। বদরুদ্দীন উমর আমাকে বলছিলেন, কীভাবে তাহের ক্রাচে ভর দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে তাঁর শান্তিনগরের বাসায় এসে গভীর উদ্বিগ্নতায় আলাপ করতেন দেশে একটি যথার্থ সমাজতান্ত্রিক সংগ্রামের সম্ভাবনা নিয়ে। কারও সঙ্গে মেলেনি তাহেরের। এককালীন সহযোগী সিরাজ শিকদার সে সময় সর্বহারা পার্টির মাধ্যমে যে সন্ত্রাসী প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন, তাঁকেও সমর্থন করেননি তাহের। এ সময় বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ডাক দিয়ে আবির্ভূত হয় জাসদ। তাঁর তাত্ত্বিক নেতা সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে বিস্তারিত আলাপ করেন তাহের। হাসানুল হক ইনু, সে সময়ের তরুণ জাসদ নেতা আমাকে জানিয়েছেন রাতের পর রাত ধরে তাহেরের নারায়ণগঞ্জের বাড়িতে তর্ক-বিতর্ক করার স্মৃতি। একপর্যায়ে নিজের নাম গোপন রেখে জাসদে যোগ দেন তাহের।
একদিকে গণ-আন্দোলন, অন্যদিকে সম্ভাব্য অভ্যুত্থানের জন্য সমান্তরাল একটি সশস্ত্র গণবাহিনী তৈরি করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে থাকে জাসদ। তাহের হন গণবাহিনীর প্রধান। সে সময়কার দেশের উদ্ভ্রান্ত পরিস্থিতিতে তুমুলভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে জাসদ। একটি সুদূরপ্রয়াসী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল জাসদ। কিন্তু পঁচাত্তরের বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ওলট-পালট করে দেয় সব হিসাব। শেখ মুজিবকে উত্খাতকারী ঘটনার নায়কেরা আওয়ামী লীগবিরোধী হিসেবে জাসদকে তাদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু ১৫ অগাস্টের ভোরেই তাহের ক্রাচে ভর দিয়ে ভাই আনোয়ার ও জাসদ নেতা ইনুকে নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন শাহবাগ রেডিও স্টেশনে। ঘটনার কুশীলব মোশতাক ও মেজর রশীদকে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর অবস্থন। বলেছিলেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তন তিনি চাইছিলেন ঠিকই, কিন্তু এমন কাপুরুষ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নয়। খন্দকার মোশতাককে শাসিয়ে দিয়েছিলেন আর কোনো ষড়যন্ত্রের পথে না গিয়ে দ্রুত নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে। কিন্তু তখন ঝড়ের বেগে বদলে যাচ্ছে সব। বলা যায়, প্রতিদিনই তখন তৈরি হচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাস। ১৫ অগাস্টে শেখ মুজিব হত্যা, ২ নভেম্বরে খালেদ মোশাররফের অভ্যুত্থান, ৩ নভেম্বরে জেলহত্যা ইত্যাদি মিলিয়ে পুরো রাজনীতি এসে তখন কেন্দ্রীভূত হয়েছে সামরিক বাহিনী ও ক্যান্টনমেন্টে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জাসদ বদলে ফেলে তাদের আন্দোলনের কৌশল, সক্রিয় করে তোলে গণবাহিনীকে, প্রস্তুতি নেয় পাল্টা অভ্যুত্থানের। গণবাহিনীর প্রধান হিসেবে এবং সেনাবাহিনীর অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে কর্নেল তাহেরই তখন হয়ে ওঠেন জাসদ রাজনীতির পুরোধা।
বাকি অংশ আগামীকাল
শাহাদুজ্জামান: কথাসাহিত্যিক।
No comments