দক্ষিণ এশিয়ার দুঃখ কাশ্মির? by মো. জাকির হোসেন
সমুদ্রপৃষ্ঠ
থেকে প্রায় সাত হাজার ফুট ওপরে সবুজ উপত্যকা আর শান্ত হ্রদে ঘেরা কাশ্মির।
পাইন, ফার, বার্চ গাছের সারি, নীল আকাশে মাথা গুঁজে থাকা পর্বতজুড়ে মেঘের
খেলা। গভীর গিরিখাদের নিচে উন্মত্ত পাহাড়ি নদী। কাশ্মিরের সৌন্দর্যসুধা পান
করতে পর্যটকেরা আর হামলে পড়েন না। কবি-সাহিত্যিকরা কাশ্মিরের নেশায় বুঁদ
হয়ে আজকাল আর কবিতা-সাহিত্য-গল্প-উপন্যাস রচনা করেন না। যে কাশ্মির হতে
পারতো দক্ষিণ এশিয়ার অহংকার, সেই কাশ্মির আজ পরিণত হয়েছে দক্ষিণ-এশিয়ার
অভিশাপে। এশিয়ার এ অঞ্চলের নিরন্তর দুঃখ এখন কাশ্মির। পৃথিবীর স্বর্গ
খ্যাতি পাওয়া কাশ্মিরের ঝিলম নদীর তীরে, ডাল লেকের শিকারায় (ডিঙ্গি নৌকা)
কাশ্মিরের প্রিয় বাদ্যযন্ত্র সন্তুরের আওয়াজ থেমে গেছে অনেক দিন আগেই।
তার বদলে এখন পুরোদস্তুর মর্টার-গ্রেনেড বা পেলেট গান (ভয়ঙ্কর
মারণাস্ত্র)-এর আওয়াজে প্রকম্পিত কাশ্মির। কাশ্মিরকে ঘিরে
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পরমাণু যুদ্ধের চোখ-রাঙানি এখন মাঝে-মধ্যেই আতঙ্কিত
করে পৃথিবীর জনগোষ্ঠীর চার ভাগের এক ভাগ অধ্যুষিত দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের।
পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে সারা বিশ্বে ভারতের অবস্থান পঞ্চম আর এশিয়ায় দ্বিতীয়। তাদের সামরিক ব্যয়ের অংক ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। স্টকহোম পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালে বিদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানি করেছে ভারত। এর জেরে বিশ্বে এখন অস্ত্র আমদানিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দেশটি। বিশ্বে মোট অস্ত্রের ৯.৫ শতাংশই এখন ভারতের হাতে। আর মোট আমদানিকৃত অস্ত্রের ১৩ শতাংশই ভারতের। পাকিস্তানের অর্থনীতি এতটাই চাপের মধ্যে পড়েছে যে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। এরই মাঝে প্রতিরক্ষা খাতে পাকিস্তান ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ দিয়েছে ১১০০ বিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি (৯৬০ কোটি ডলার)। এবারই প্রথম দেশটির সামরিক বাজেট ট্রিলিয়ন রুপির কোটা ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সামরিক খাতে পাকিস্তানের বরাদ্দ ছিল ৬০০ বিলিয়ন ডলার। সে তুলনায় গত পাঁচ বছর পর এবার শতকরা ৮৪ ভাগ বরাদ্দ বেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস ) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ১৪ লাখ সেনা সদস্যের জন্য ২০১৮ সালে ভারত সামরিক খাতে বরাদ্দ করেছিল চার ট্রিলিয়ন রুপি (৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এই পরিমাণ অর্থ দেশটির জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ।
অন্যদিকে পাকিস্তান তার ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮০০ সেনা সদস্যের জন্য গত বছর ১ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি (১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বাজেট বরাদ্দ করেছিল, যা দেশটির জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮ সালে ইসলামাবাদ ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিদেশি সামরিক সহায়তা পেয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধ বেঁধে গেলে তা পরবর্তী দীর্ঘ সময় অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। যুদ্ধে শুধু ভারতের ক্ষতি প্রতিদিন পাঁচ হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাবে। এমনকি যুদ্ধ যদি দুই সপ্তাহ দীর্ঘ হয় তবে ভারতের ক্ষতি হবে কমপক্ষে দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি রুপি। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের রাজস্ব ঘাটতি ৫০ শতাংশ বেড়ে হবে প্রায় আট লাখ কোটি রুপি। যুদ্ধের একটি বড় ধরনের প্রভাব পড়বে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং পর্যটনে। ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির ব্যাপক দরপতন হবে। পুলওয়ামার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে যে বিমান হামলা চালিয়েছে, কেবল তাতেই ৬ হাজার ৩০০ কোটি রুপি ব্যয় হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ভারত তার প্রতিরক্ষার জন্য বছরে খরচ করে মাথাপিছু ১০ ডলার আর পাকিস্তান করে ২৬ ডলার। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ভারত খরচ করে মাথাপিছু ১৪ ডলার আর পাকিস্তান খরচ করে ১০ ডলার। পাকিস্তান ও ভারত যে পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় করে, তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, একটি ট্যাংকের যে দাম, তা দিয়ে ৪০ লাখ শিশুকে প্রাণঘাতী অসুখের প্রতিষেধক টিকা দেওয়া সম্ভব। একটি ট্যাংকের দাম ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। আর একটি শিশুকে প্রাণঘাতী ছয় রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিতে খরচ হয় মাত্র এক ডলার। ভারতীয় বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত একটি মিরেজ-২০০০ যুদ্ধবিমানের দাম ৯ কোটি মার্কিন ডলার। আর একটি শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর পড়ালেখার জন্য গড় খরচ হয় ৩০ ডলার। মিরেজ-২০০০ যুদ্ধবিমান কেনা না হলে ওই অর্থে ৩০ লাখ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার খরচ মেটানো সম্ভব। উভয় দেশের রয়েছে কয়েক ডজন অত্যাধুনিক সাবমেরিন। আনুষঙ্গিক সাজসজ্জাসহ আধুনিক একটি সাবমেরিনের দাম ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে একজনকে এক বছরের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ করতে ব্যয় হয় পাঁচ ডলার। অর্থাৎ একটি সাবমেরিন কেনা মানে ছয় কোটি লোককে সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত করা। এসআইপিআরআইয়ের তথ্য অনুসারে, পাকিস্তানের ১৪০ থেকে ১৫০টি পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র আছে। অন্যদিকে ভারতের আছে ১৩০ থেকে ১৪০টি। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ যদি পারমাণবিক হয় তবে তার ক্ষতি হবে বহুমুখী। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়ার এবং ফিজিশিয়ানস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি এই দুটি সংগঠনের গবেষণামূলক এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, কোনও কারণে শেষ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বাঁধলে অন্তত ২০০ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে মানবসভ্যতা। দুই দেশের মধ্যে সীমিত পর্যায়ে পারমাণবিক অস্ত্রের লড়াই হলেও বিশ্বের আবহাওয়া মণ্ডলের ব্যাপক ক্ষতি ও শস্যক্ষেত্র ধ্বংস হবে। পরিণামে খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। খাদ্য জোগানে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা।
চির বৈরী পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোনও ভালো খবর নয়। দেশ দুটি সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েই চলেছে। ভারত ও পাকিস্তানে সামরিক খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হলেও সামাজিক খাতে অগ্রগতি হয়েছে অতি সামান্যই। ভারত ও পাকিস্তানে ব্যাপক দারিদ্র্য রয়েছে। শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। মায়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যাচ্ছেন। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশ মিলিয়ে ৭০ কোটির বেশি মানুষ অনাহারে, চূড়ান্ত কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বিরাট সংখ্যক মানুষের কাজের সংস্থান নেই। কৃষক, শ্রমিক, কর্মহীন অসংখ্য মানুষ ঋণের ভারে বিপর্যস্ত। এই ভয়ঙ্কর ব্যবস্থায় বেঁচে থাকতে না পেরে তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন। কেউবা বাঁচার চেষ্টায় নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, কেউবা নিজের অঙ্গ বিক্রি করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। বিশ্বের ১১৯টি দেশকে নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০১৮ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় তিন ধাপ পিছিয়েছে ভারত; গত বছর ভারতের অবস্থান ছিল ১০০ নম্বরে, এবার ১০৩ নম্বরে। ভারতের চেয়েও তিন ধাপ পেছনে ১০৬ নম্বরে রয়েছে পাকিস্তান। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার বিবাদের কারণে বছরে দু’দেশে বাণিজ্যিক ক্ষতি হচ্ছে ৩৫ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩৭ বিলিয়ন ডলার হতে পারে যদি দিল্লি ও ইসলামাবাদ সব ধরনের বিরোধ মিটিয়ে নেয়। দেশ থেকে দ্রারিদ্য দূর করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বাণিজ্যের বিস্তার করতেই হবে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে কয়টি সীমিত পরিসরে যুদ্ধ হয়েছে তার একটি বাদে সব ক’টিই কাশ্মিরকে ঘিরে। কাশ্মিরকে ঘিরে কেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ সর্বনাশা বৈরিতা? ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন বিদায় নেয় তখন ভারত উপমহাদেশে প্রিন্সলি স্টেট নামে পরিচিত ছোট-বড় ৫৬২টি স্বাধীন অঞ্চল ছিল। এরা ব্রিটিশ উপনিবেশের আওতামুক্ত ছিল এবং এ দেশীয় রাজন্যবর্গরা এ অঞ্চলগুলো শাসন করতো। উপমহাদেশের বিভক্তির সময় এ স্বাধীন অঞ্চলগুলোকে ভারত কিংবা পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দেওয়া বা স্বাধীন থাকার মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়। সীমানা চিহ্নিত হওয়ার পর ভারতের স্টেটগুলো ভারতে এবং পাকিস্তানেরগুলো পাকিস্তানে যোগ দেয়। কিন্তু ৩টি স্টেট স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলো। হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় এবং জম্মু ও কাশ্মির। এদের মধ্যে হায়দ্রাবাদ এবং জুনাগড় ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু তাদের রাজা ছিল মুসলিম। জুনাগড়ের জনগণ বিক্ষোভ করে ভারতে যোগদান করার জন্য, ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী অ্যাকশনে যায় এবং দখল করে নেয়। আর চারদিকে ভারতবেষ্টিত হায়দ্রাবাদের শাসক ছিলেন নিজাম উসমান আলি খান। নিজাম স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একটি ফরমানের মাধ্যমে ঘোষণা করেন হায়দ্রাবাদ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে এবং ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেবে না। তবে ভারত সরকার তার এই ফরমান প্রত্যাখ্যান করে এবং এর আইনত বৈধতা নেই বলে দাবি করে। ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদে প্রবেশ করে। নিজাম উসমান আলি খান ভারতকে প্রতিহত করতে সক্ষম ছিলেন না তাই আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। হায়দ্রাবাদ পরাজিত হয় এবং ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। অপরদিকে জম্মু এবং কাশ্মিরের জনসংখ্যা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু রাজা ছিল হিন্দু হরি সিং। হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের মদতে পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলো কাশ্মির আক্রমণ করে মুজাফফরাবাদ দখল করে শ্রীনগর অভিমুখে রওনা করে। আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতের সামরিক সহায়তা চাইলে ভারত সহায়তার বিনিময়ে কাশ্মিরকে ভারতে যোগ দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। হরি সিং কাশ্মিরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং ভারতের সামরিক সহায়তা পান। পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ– যা চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে। ১৯৪৮ সালে ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। জাতিসংঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মিরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়। কাশ্মিরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে। তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মির কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। অন্যদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চীন কাশ্মিরের আকসাই-চীন অংশটিতে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। তার পরের বছর পাকিস্তান কাশ্মিরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনকে উপহার হিসাবে দেয়। সেই থেকে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীন– এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। এক হিসাব মতে,কাশ্মিরের ৬০ ভাগ ভারতের (শ্রীনগর, জম্মু ও কাশ্মির, লাদাখ), ৩০ ভাগ পাকিস্তানের (আজাদ কাশ্মির) এবং ১০ ভাগ চীনের (আকসাই-চীন, সিয়াচেন) অধীনস্থ হয়েছে।
কাশ্মির সমস্যার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারতীয় ইতিহাসবিদ ড. কিংশুক চ্যাটার্জি বলছেন, ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেশনের (অন্তর্ভুক্তি চুক্তি) মাধ্যমে কাশ্মির ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যে শর্তে হয়েছিল কালক্রমে ভারত তা থেকে অনেকটা সরে এসেছে। পাকিস্তানও জোর করেই এই অ্যারেঞ্জমেন্টের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ফলে সাতচল্লিশে এই সমস্যার শুরু হলেও এখন সেই সমস্যা অনেক বেশি জটিল আকার নিয়েছে।’ অনেকটা এই কথার সুরেই কাশ্মিরের হিন্দু রাজাদের বংশধর ড. করন সিং সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টেও বলেছেন, যে শর্তে তার বাবা নিজের রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, দিল্লি তার মর্যাদা দিতে পারেনি। ড. সিং বলেছেন, ‘যেদিন আমার বাবা সেই চুক্তিতে সই করেন সেদিন থেকেই জম্মু ও কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ২৭ অক্টোবর তারিখে সেদিন আমি নিজেও ওই ঘরে উপস্থিত ছিলাম।’ ‘কিন্তু মনে রাখতে হবে, মহারাজা হরি সিং কিন্তু প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক- শুধু এই তিনটি ক্ষেত্রে ভারতভুক্তি স্বীকার করেছিলেন, নিজের রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি মিশিয়ে দেননি। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মিরকে যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই’।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কাশ্মির বিশেষ স্বাধীন মর্যাদার এমন এক রাজ্য, যার নিজের আলাদা সংবিধান, পতাকা ইত্যাদি আছে। আর এই বিশেষ মর্যাদার কথাগুলোর স্বীকৃতি আছে ৩৭০ অনুচ্ছেদে। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ একটা অস্থায়ী প্রভিশন যা এখন অকার্যকর– এই দাবিতে করা একটি রিট মামলা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গত ৩ এপ্রিল ২০১৮ নাকচ করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, কাশ্মিরের অন্তর্ভুক্তির পর প্রথমদিকে কোনও ভারতীয় নাগরিককে কাশ্মির যেতে হলে সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য পারমিট নিতে হতো। পরবর্তী সময়ে পারমিট প্রথা প্রত্যাহার করা হয়।
কাশ্মির সমস্যা শিকড়-বাকড় ছড়িয়ে জটিল রূপ ধারণ করেছে। কাশ্মিরের জনগণের চাওয়া এখন একাধিক ধারায় বিভক্ত। কাশ্মিরের প্রয়াত নেতা ন্যাশনাল কনফারেন্সের শেখ আবদুল্লাহর সেক্যুলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ইসলামিকরণ হয়ে আজাদির দাবিতে পরিণত হয়েছে, যা ভারত সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন।কাশ্মিরিরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি থেকে সরে আসবেন না। আর এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানও তাদের মদত দিতেই থাকবে। কারণ, এছাড়া পাকিস্তানেরও গতি নেই। কাশ্মিরিদের সাহায্য, সহযোগিতা, সমর্থন না দিয়ে পাকিস্তানে কোনও সরকারই টিকে থাকতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কর্তৃক সরকার উৎখাতের সম্ভাবনাই বেশি। এদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত কনফারেন্স খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে। সৈয়দ শাহ জিলানির নেতৃত্বাধীন অংশটি চায় পাকিস্তানে ‘যোগ’ দিতে। ইয়াসিন মালিকের নেতৃত্বাধীন অংশটি আজাদি চায়। অন্যদিকে রাজ্যের দুটি অংশ আজাদির বিপক্ষে। হিন্দু-অধ্যুষিত জম্মু ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে চায় আর বৌদ্ধ-অধ্যুষিত লাদাখ ভারতের ইউনিয়ন টেরিটরি হিসেবে থাকতে চায়। ফলে আজাদির দাবিটি মূলত সেই উপত্যকার, যেখানকার ৯৮ শতাংশ মানুষ মুসলমান। ভারত বা পাকিস্তান কেউই জিতবে না বা হারবে না, কাশ্মিরের জনগণের সম্মানহানিও হবে না কাশ্মির সমস্যার এমন একটি বাস্তবসম্মত সমাধান নিয়ে শেখ আবদুল্লাহ পাকিস্তানের সাথে আলোচনা চালানোর সময় নেহরুর মৃত্যু হয়। হাতছাড়া হয়ে যায় সমস্যা সমাধানের সুবর্ণ সুযোগ।
বিশ্বের আয়তনের মাত্র ৩ ভাগ ভূমি সার্ক অঞ্চলভুক্ত হলেও বিশ্বের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকের বাস দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোতে। প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর অবদান মাত্র ৯.১২ ভাগ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিদ্যমান দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বৈষম্য নিরসন করে সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন মান উন্নয়ন ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তা আজ পুরোপুরি অকেজো।
পাকিস্তান-ভারত দ্বন্দ্ব, উত্তেজনা আর অস্ত্র প্রতিযোগিতা এ অঞ্চলের উন্নয়নের পথে অন্যতম অন্তরায়। সামরিক খাতে ব্যয়ের দিক থেকে সারা বিশ্বে ভারতের অবস্থান পঞ্চম আর এশিয়ায় দ্বিতীয়। তাদের সামরিক ব্যয়ের অংক ৫ হাজার ৬০০ কোটি ডলার। স্টকহোম পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৮ সালে বিদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র আমদানি করেছে ভারত। এর জেরে বিশ্বে এখন অস্ত্র আমদানিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে দেশটি। বিশ্বে মোট অস্ত্রের ৯.৫ শতাংশই এখন ভারতের হাতে। আর মোট আমদানিকৃত অস্ত্রের ১৩ শতাংশই ভারতের। পাকিস্তানের অর্থনীতি এতটাই চাপের মধ্যে পড়েছে যে প্রায় দেউলিয়া হওয়ার উপক্রম হয়েছে। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে হাত পাততে হচ্ছে। এরই মাঝে প্রতিরক্ষা খাতে পাকিস্তান ২০১৮-১৯ অর্থবছরে মোট বরাদ্দ দিয়েছে ১১০০ বিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি (৯৬০ কোটি ডলার)। এবারই প্রথম দেশটির সামরিক বাজেট ট্রিলিয়ন রুপির কোটা ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে সামরিক খাতে পাকিস্তানের বরাদ্দ ছিল ৬০০ বিলিয়ন ডলার। সে তুলনায় গত পাঁচ বছর পর এবার শতকরা ৮৪ ভাগ বরাদ্দ বেড়েছে। ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (আইআইএসএস ) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, ১৪ লাখ সেনা সদস্যের জন্য ২০১৮ সালে ভারত সামরিক খাতে বরাদ্দ করেছিল চার ট্রিলিয়ন রুপি (৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। এই পরিমাণ অর্থ দেশটির জিডিপির ২ দশমিক ১ শতাংশ।
অন্যদিকে পাকিস্তান তার ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৮০০ সেনা সদস্যের জন্য গত বছর ১ দশমিক ২৬ ট্রিলিয়ন পাকিস্তানি রুপি (১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) বাজেট বরাদ্দ করেছিল, যা দেশটির জিডিপির প্রায় ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮ সালে ইসলামাবাদ ১০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিদেশি সামরিক সহায়তা পেয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, দুই দেশের মধ্যে একটি যুদ্ধ বেঁধে গেলে তা পরবর্তী দীর্ঘ সময় অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠবে। যুদ্ধে শুধু ভারতের ক্ষতি প্রতিদিন পাঁচ হাজার কোটি রুপি ছাড়িয়ে যাবে। এমনকি যুদ্ধ যদি দুই সপ্তাহ দীর্ঘ হয় তবে ভারতের ক্ষতি হবে কমপক্ষে দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি রুপি। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে ভারতের রাজস্ব ঘাটতি ৫০ শতাংশ বেড়ে হবে প্রায় আট লাখ কোটি রুপি। যুদ্ধের একটি বড় ধরনের প্রভাব পড়বে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং পর্যটনে। ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির ব্যাপক দরপতন হবে। পুলওয়ামার হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নিতে ভারত পাকিস্তানের বালাকোটে যে বিমান হামলা চালিয়েছে, কেবল তাতেই ৬ হাজার ৩০০ কোটি রুপি ব্যয় হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, ভারত তার প্রতিরক্ষার জন্য বছরে খরচ করে মাথাপিছু ১০ ডলার আর পাকিস্তান করে ২৬ ডলার। স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ভারত খরচ করে মাথাপিছু ১৪ ডলার আর পাকিস্তান খরচ করে ১০ ডলার। পাকিস্তান ও ভারত যে পরিমাণ অর্থ সামরিক খাতে ব্যয় করে, তা দিয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব। উদাহরণস্বরূপ, একটি ট্যাংকের যে দাম, তা দিয়ে ৪০ লাখ শিশুকে প্রাণঘাতী অসুখের প্রতিষেধক টিকা দেওয়া সম্ভব। একটি ট্যাংকের দাম ৪০ লাখ মার্কিন ডলার। আর একটি শিশুকে প্রাণঘাতী ছয় রোগের বিরুদ্ধে টিকা দিতে খরচ হয় মাত্র এক ডলার। ভারতীয় বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত একটি মিরেজ-২০০০ যুদ্ধবিমানের দাম ৯ কোটি মার্কিন ডলার। আর একটি শিশুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এক বছর পড়ালেখার জন্য গড় খরচ হয় ৩০ ডলার। মিরেজ-২০০০ যুদ্ধবিমান কেনা না হলে ওই অর্থে ৩০ লাখ শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার খরচ মেটানো সম্ভব। উভয় দেশের রয়েছে কয়েক ডজন অত্যাধুনিক সাবমেরিন। আনুষঙ্গিক সাজসজ্জাসহ আধুনিক একটি সাবমেরিনের দাম ৩০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে একজনকে এক বছরের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ করতে ব্যয় হয় পাঁচ ডলার। অর্থাৎ একটি সাবমেরিন কেনা মানে ছয় কোটি লোককে সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত করা। এসআইপিআরআইয়ের তথ্য অনুসারে, পাকিস্তানের ১৪০ থেকে ১৫০টি পারমাণবিক যুদ্ধাস্ত্র আছে। অন্যদিকে ভারতের আছে ১৩০ থেকে ১৪০টি। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ যদি পারমাণবিক হয় তবে তার ক্ষতি হবে বহুমুখী। নোবেল শান্তি পুরস্কার জয়ী ইন্টারন্যাশনাল ফিজিশিয়ানস ফর দ্য প্রিভেনশন অব নিউক্লিয়ার ওয়ার এবং ফিজিশিয়ানস ফর সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি এই দুটি সংগঠনের গবেষণামূলক এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে, কোনও কারণে শেষ পর্যন্ত ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ বাঁধলে অন্তত ২০০ কোটি মানুষের মৃত্যু হতে পারে। এতে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে মানবসভ্যতা। দুই দেশের মধ্যে সীমিত পর্যায়ে পারমাণবিক অস্ত্রের লড়াই হলেও বিশ্বের আবহাওয়া মণ্ডলের ব্যাপক ক্ষতি ও শস্যক্ষেত্র ধ্বংস হবে। পরিণামে খাদ্যপণ্যের বিশ্ববাজারে ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে। খাদ্য জোগানে দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা।
চির বৈরী পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে অস্ত্র প্রতিযোগিতা কোনও ভালো খবর নয়। দেশ দুটি সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়েই চলেছে। ভারত ও পাকিস্তানে সামরিক খাতে ব্যাপক অগ্রগতি হলেও সামাজিক খাতে অগ্রগতি হয়েছে অতি সামান্যই। ভারত ও পাকিস্তানে ব্যাপক দারিদ্র্য রয়েছে। শিশুরা অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। মায়েরা সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় মারা যাচ্ছেন। ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশ মিলিয়ে ৭০ কোটির বেশি মানুষ অনাহারে, চূড়ান্ত কষ্টের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। বিরাট সংখ্যক মানুষের কাজের সংস্থান নেই। কৃষক, শ্রমিক, কর্মহীন অসংখ্য মানুষ ঋণের ভারে বিপর্যস্ত। এই ভয়ঙ্কর ব্যবস্থায় বেঁচে থাকতে না পেরে তাদের কেউ কেউ আত্মহত্যা করছেন। কেউবা বাঁচার চেষ্টায় নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন, কেউবা নিজের অঙ্গ বিক্রি করে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছেন। বিশ্বের ১১৯টি দেশকে নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক ক্ষুধা সূচক-২০১৮ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছরের তুলনায় তিন ধাপ পিছিয়েছে ভারত; গত বছর ভারতের অবস্থান ছিল ১০০ নম্বরে, এবার ১০৩ নম্বরে। ভারতের চেয়েও তিন ধাপ পেছনে ১০৬ নম্বরে রয়েছে পাকিস্তান। ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার বিবাদের কারণে বছরে দু’দেশে বাণিজ্যিক ক্ষতি হচ্ছে ৩৫ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ২ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ৩৭ বিলিয়ন ডলার হতে পারে যদি দিল্লি ও ইসলামাবাদ সব ধরনের বিরোধ মিটিয়ে নেয়। দেশ থেকে দ্রারিদ্য দূর করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে বাণিজ্যের বিস্তার করতেই হবে।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যে কয়টি সীমিত পরিসরে যুদ্ধ হয়েছে তার একটি বাদে সব ক’টিই কাশ্মিরকে ঘিরে। কাশ্মিরকে ঘিরে কেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে এ সর্বনাশা বৈরিতা? ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা যখন বিদায় নেয় তখন ভারত উপমহাদেশে প্রিন্সলি স্টেট নামে পরিচিত ছোট-বড় ৫৬২টি স্বাধীন অঞ্চল ছিল। এরা ব্রিটিশ উপনিবেশের আওতামুক্ত ছিল এবং এ দেশীয় রাজন্যবর্গরা এ অঞ্চলগুলো শাসন করতো। উপমহাদেশের বিভক্তির সময় এ স্বাধীন অঞ্চলগুলোকে ভারত কিংবা পাকিস্তান রাষ্ট্রে যোগ দেওয়া বা স্বাধীন থাকার মধ্যে একটি বেছে নেওয়ার কথা বলা হয়। সীমানা চিহ্নিত হওয়ার পর ভারতের স্টেটগুলো ভারতে এবং পাকিস্তানেরগুলো পাকিস্তানে যোগ দেয়। কিন্তু ৩টি স্টেট স্বাধীন থাকতে চেয়েছিলো। হায়দ্রাবাদ, জুনাগড় এবং জম্মু ও কাশ্মির। এদের মধ্যে হায়দ্রাবাদ এবং জুনাগড় ছিল হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু তাদের রাজা ছিল মুসলিম। জুনাগড়ের জনগণ বিক্ষোভ করে ভারতে যোগদান করার জন্য, ফলে ভারতীয় সেনাবাহিনী অ্যাকশনে যায় এবং দখল করে নেয়। আর চারদিকে ভারতবেষ্টিত হায়দ্রাবাদের শাসক ছিলেন নিজাম উসমান আলি খান। নিজাম স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি একটি ফরমানের মাধ্যমে ঘোষণা করেন হায়দ্রাবাদ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে থাকবে এবং ভারতীয় ইউনিয়নে যোগ দেবে না। তবে ভারত সরকার তার এই ফরমান প্রত্যাখ্যান করে এবং এর আইনত বৈধতা নেই বলে দাবি করে। ১৯৪৮ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী হায়দ্রাবাদে প্রবেশ করে। নিজাম উসমান আলি খান ভারতকে প্রতিহত করতে সক্ষম ছিলেন না তাই আত্মসমর্পণে বাধ্য হন। হায়দ্রাবাদ পরাজিত হয় এবং ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়ে। অপরদিকে জম্মু এবং কাশ্মিরের জনসংখ্যা ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কিন্তু রাজা ছিল হিন্দু হরি সিং। হরি সিং চাইছিলেন স্বাধীন থাকতে অথবা ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে। অন্যদিকে পশ্চিম জম্মু এবং গিলগিট-বালতিস্তানের মুসলিমরা চাইছিলেন পাকিস্তানের সঙ্গে যোগ দিতে। ১৯৪৭ সালের অক্টোবরে পাকিস্তানের মদতে পাশতুন উপজাতীয় বাহিনীগুলো কাশ্মির আক্রমণ করে মুজাফফরাবাদ দখল করে শ্রীনগর অভিমুখে রওনা করে। আক্রমণের মুখে হরি সিং ভারতের সামরিক সহায়তা চাইলে ভারত সহায়তার বিনিময়ে কাশ্মিরকে ভারতে যোগ দেওয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। হরি সিং কাশ্মিরের ভারতে অন্তর্ভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন এবং ভারতের সামরিক সহায়তা পান। পরিণামে ১৯৪৭ সালেই শুরু হয় ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ– যা চলেছিল প্রায় দু’বছর ধরে। ১৯৪৮ সালে ভারত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মির প্রসঙ্গ উত্থাপন করে। জাতিসংঘের ৪৭ নম্বর প্রস্তাবে কাশ্মিরে গণভোট, পাকিস্তানের সেনা প্রত্যাহার এবং ভারতের সামরিক উপস্থিতি ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে আহ্বান জানানো হয়। কাশ্মিরে যুদ্ধবিরতি বলবৎ হয় ১৯৪৮ সালে। তবে পাকিস্তান সেনা প্রত্যাহার করতে অস্বীকার করে। তখন থেকেই কাশ্মির কার্যত পাকিস্তান ও ভারত নিয়ন্ত্রিত দুই অংশে ভাগ হয়ে যায়। অন্যদিকে ১৯৬২ সালের চীন-ভারত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে চীন কাশ্মিরের আকসাই-চীন অংশটিতে নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। তার পরের বছর পাকিস্তান কাশ্মিরের ট্রান্স-কারাকোরাম অঞ্চলটি চীনকে উপহার হিসাবে দেয়। সেই থেকে কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তান, ভারত ও চীন– এই তিন দেশের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। এক হিসাব মতে,কাশ্মিরের ৬০ ভাগ ভারতের (শ্রীনগর, জম্মু ও কাশ্মির, লাদাখ), ৩০ ভাগ পাকিস্তানের (আজাদ কাশ্মির) এবং ১০ ভাগ চীনের (আকসাই-চীন, সিয়াচেন) অধীনস্থ হয়েছে।
কাশ্মির সমস্যার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভারতীয় ইতিহাসবিদ ড. কিংশুক চ্যাটার্জি বলছেন, ‘ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাক্সেশনের (অন্তর্ভুক্তি চুক্তি) মাধ্যমে কাশ্মির ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু যে শর্তে হয়েছিল কালক্রমে ভারত তা থেকে অনেকটা সরে এসেছে। পাকিস্তানও জোর করেই এই অ্যারেঞ্জমেন্টের মধ্যে প্রবেশ করেছে। ফলে সাতচল্লিশে এই সমস্যার শুরু হলেও এখন সেই সমস্যা অনেক বেশি জটিল আকার নিয়েছে।’ অনেকটা এই কথার সুরেই কাশ্মিরের হিন্দু রাজাদের বংশধর ড. করন সিং সম্প্রতি ভারতের পার্লামেন্টেও বলেছেন, যে শর্তে তার বাবা নিজের রাজ্যকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন, দিল্লি তার মর্যাদা দিতে পারেনি। ড. সিং বলেছেন, ‘যেদিন আমার বাবা সেই চুক্তিতে সই করেন সেদিন থেকেই জম্মু ও কাশ্মির ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ তাতে কোনও সন্দেহ নেই। ২৭ অক্টোবর তারিখে সেদিন আমি নিজেও ওই ঘরে উপস্থিত ছিলাম।’ ‘কিন্তু মনে রাখতে হবে, মহারাজা হরি সিং কিন্তু প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ ও বৈদেশিক সম্পর্ক- শুধু এই তিনটি ক্ষেত্রে ভারতভুক্তি স্বীকার করেছিলেন, নিজের রাজ্যকে ভারতের সঙ্গে পুরোপুরি মিশিয়ে দেননি। ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মিরকে যে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই’।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কাশ্মির বিশেষ স্বাধীন মর্যাদার এমন এক রাজ্য, যার নিজের আলাদা সংবিধান, পতাকা ইত্যাদি আছে। আর এই বিশেষ মর্যাদার কথাগুলোর স্বীকৃতি আছে ৩৭০ অনুচ্ছেদে। সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ একটা অস্থায়ী প্রভিশন যা এখন অকার্যকর– এই দাবিতে করা একটি রিট মামলা ভারতের সুপ্রিম কোর্ট গত ৩ এপ্রিল ২০১৮ নাকচ করে দিয়েছে। উল্লেখ্য, কাশ্মিরের অন্তর্ভুক্তির পর প্রথমদিকে কোনও ভারতীয় নাগরিককে কাশ্মির যেতে হলে সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য পারমিট নিতে হতো। পরবর্তী সময়ে পারমিট প্রথা প্রত্যাহার করা হয়।
কাশ্মির সমস্যা শিকড়-বাকড় ছড়িয়ে জটিল রূপ ধারণ করেছে। কাশ্মিরের জনগণের চাওয়া এখন একাধিক ধারায় বিভক্ত। কাশ্মিরের প্রয়াত নেতা ন্যাশনাল কনফারেন্সের শেখ আবদুল্লাহর সেক্যুলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি ইসলামিকরণ হয়ে আজাদির দাবিতে পরিণত হয়েছে, যা ভারত সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন।কাশ্মিরিরা তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের দাবি থেকে সরে আসবেন না। আর এ ক্ষেত্রে পাকিস্তানও তাদের মদত দিতেই থাকবে। কারণ, এছাড়া পাকিস্তানেরও গতি নেই। কাশ্মিরিদের সাহায্য, সহযোগিতা, সমর্থন না দিয়ে পাকিস্তানে কোনও সরকারই টিকে থাকতে পারবে না। সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী কর্তৃক সরকার উৎখাতের সম্ভাবনাই বেশি। এদিকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হুরিয়ত কনফারেন্স খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত হয়ে গেছে। সৈয়দ শাহ জিলানির নেতৃত্বাধীন অংশটি চায় পাকিস্তানে ‘যোগ’ দিতে। ইয়াসিন মালিকের নেতৃত্বাধীন অংশটি আজাদি চায়। অন্যদিকে রাজ্যের দুটি অংশ আজাদির বিপক্ষে। হিন্দু-অধ্যুষিত জম্মু ভারতের সঙ্গে যোগ দিতে চায় আর বৌদ্ধ-অধ্যুষিত লাদাখ ভারতের ইউনিয়ন টেরিটরি হিসেবে থাকতে চায়। ফলে আজাদির দাবিটি মূলত সেই উপত্যকার, যেখানকার ৯৮ শতাংশ মানুষ মুসলমান। ভারত বা পাকিস্তান কেউই জিতবে না বা হারবে না, কাশ্মিরের জনগণের সম্মানহানিও হবে না কাশ্মির সমস্যার এমন একটি বাস্তবসম্মত সমাধান নিয়ে শেখ আবদুল্লাহ পাকিস্তানের সাথে আলোচনা চালানোর সময় নেহরুর মৃত্যু হয়। হাতছাড়া হয়ে যায় সমস্যা সমাধানের সুবর্ণ সুযোগ।
বিশ্বের আয়তনের মাত্র ৩ ভাগ ভূমি সার্ক অঞ্চলভুক্ত হলেও বিশ্বের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেকের বাস দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত দেশগুলোতে। প্রায় এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যা নিয়ে বিশ্ব অর্থনীতিতে সার্কভুক্ত দেশগুলোর অবদান মাত্র ৯.১২ ভাগ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে বিদ্যমান দারিদ্র্য, অশিক্ষা, বৈষম্য নিরসন করে সম্মিলিত উদ্যোগ ও সহযোগিতার মধ্য দিয়ে মানুষের জীবন মান উন্নয়ন ও পারস্পরিক নির্ভরশীলতা ও আস্থার পরিবেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে যে আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা সার্ক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো তা আজ পুরোপুরি অকেজো।
ভারত-পাকিস্তান দ্বৈরথ কেবল এ দু’দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং পুরো দক্ষিণ এশিয়া এর দ্বারা নানাভাবে প্রভাবিত হয়। বিশেষ করে সার্কভূক্ত অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনীতি, বাণিজ্য ও বাজারে যে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে তার ফলশ্রুতিতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ অঞ্চলের দরিদ্র মানুষেরা। পৃথিবীর স্বর্গ যে কাশ্মির দক্ষিণ এশিয়ার গর্ব ছিলো, তা-ই আজ দক্ষিণ এশিয়ার দুঃখ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে পাকিস্তান-ভারত দুই দেশের অবিমৃশ্যকারিতার জেরে।
লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments