সাংবাদিকের শত্রু-মিত্র by উদিসা ইসলাম
আজ
বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস। যখন দিবসটি পালিত হচ্ছে, তখন দেশের
সাংবাদিকদের একটি বড় অংশ মনে করছে, স্বাধীন সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে হুমকি
দিন দিন বেড়েই চলেছে। শত্রুর সংখ্যা যত বাড়ছে, সাংবাদিকের মিত্র-সংখ্যাও
ততটাই কমে আসছে। সাংবাদিক ও তাদের অধিকার নিয়ে কাজ করে, এমন সংগঠনের
অভিযোগ, সরকার ও বিভিন্ন সংস্থার চাপে সঠিক সাংবাদিকতা কঠিন হয়ে পড়েছে।
এমনকি সাংবাদিক নেতারা দলীয় আনুগত্য প্রকাশ করার কারণে নির্যাতনের শিকার
সাংবাদিকের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করাও যায় না।
এদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার প্রবণতাও বেড়েছে। সে কারণে গণমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপের প্রবণতাও বাড়ছে বলে মনে করেন সংবাদব্যক্তিত্বরা।
এদিকে, প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার’-এর১৮ এপ্রিল প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক বৈশ্বিক সূচকে চার ধাপ নিচে নেমে গেছে বাংলাদেশ। সূচকে থাকা ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম। এই সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন মারাত্মকভাবে বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সংবাদকর্মীদের ওপর রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা, নিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ ও সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা বেড়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
আইনে বাধা সাংবাদিকতা
‘আর্টিকেল নাইন্টিন’ নামের একটি সংগঠন জানিয়েছে, ২০১৮ সালে মতপ্রকাশজনিত ১৩১টি ঘটনায় আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, শুধু মতপ্রকাশজনিত কারণে মোট ৩১টি ফৌজদারি (মানহানি) মামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ৭১টি মামলা করা হয়েছে আইসিটিঅ্যাক্টের ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায়। ৯টি বেআইনি আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনাসহ ২০টি বিভিন্ন ধরনের হয়রানিমূলক মামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদন বলছে, ডিজিটাল অ্যাক্টের মাধ্যমে অনলাইন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও সাময়িক বন্ধ বা ব্লক করার একাধিক ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ সালে। এ ধরনের মোট ৮টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। উদাহরণ হিসেবে ‘দ্য ডেইলি স্টার’, ‘এশিয়ান এজ’ ও ‘বিডিনিউজ ২৪’-এর উল্লেখ করা যায়।
গত কয়েক বছরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিক হয়রানির ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো৷ ২০১৫ সালে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখালেখির কারণে সিনিয়র সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করা হয়৷ এরপর বিডিনিউজ যমুনা টেলিভিশনসহ বেশকিছু পত্রিকার সাংবাদিকরা এই মামলার মুখোমুখি হয়েছে।
আইনি বাধা বিষয়ে আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণ করতে এ ধরনের আইন বরাবরই ছিল। এখন ডিজিটাল সময় বলে ডিজিটাল আইন দরকার হয়েছে।’
সেল্ফ সেন্সরশিপ
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রভাবশালী মহলের চাপে পড়ে অনেক সময় সাংবাদিকরাই সেল্ফ সেন্সরশিপ অবলম্বন করেন। অনেকসময় চাকরি হারানোর ভয়ে অফিসের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ বেশি, তাদের বিষয়েও প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে নিজেরাই সতর্ক হয়ে যায়।
২০১৭ সালের ১১ জুন বিডিনিউজে ‘একটি অসুস্থ শিশু, বিচারকের ট্রাক ও একটি মামলা' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করায় গোলাম মুজতবা ধ্রুব'র বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেন মানিকগঞ্জের এক বিচারক। এ ঘটনার দুই বছর পরও সংবেদনশীল বিষয়ে রিপোর্ট লেখার সময় অজানা অস্বস্তি পেয়ে বসে বলে মন্তব্য করেন গোলাম মুজতা। তিনি বলেন, সবসময় পেশাদারিত্বের সঙ্গে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে নিউজ ছাড়ি। ওই সময়ের হয়রানির কথা মনে করে যেকোনো সংবেদনশীল নিউজ লিখতে আজও অজানা অস্বস্তি কাজ করে।’
অযোগ্য নেতাদের কারণে সাংবাদিকরা এই ভয়-ভীতি থেকে নিজেদের বের করে আনতে পারে না বলে মনে করেন ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বলেন, ‘একসময় সাংবাদিকদের চাকরি গেলে ইউনিয়নের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ মালিকদের ছিল না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি নানা কারণেই যেতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান নিয়ম মানছে কি না, সেটা দেখার লোক ছিল। কিন্তু এখন বেশিরভাগ মালিকপক্ষ নিয়মের ধার ধারে না। কারণ ইউনিয়ন দুর্বল, সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য নেই।’
সাংবাদিকদের আনুগত্য
অন্যান্য পেশার মতো রাজনৈতিক কারণে সাংবাদিকরাও এখন দ্বিধাবিভক্ত। আর এ কারণে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের চাপ বেশি হওয়া স্বাভাবিক। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি দেওয়া হয় না। নেই চাকরির নিরাপত্তাও। শারীরিক নিরাপত্তার কথাও ভাবা হয় না। কিন্তু বিষয়গুলো বলার কেউ নেই।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে সাংবাদিককে তার চাকরি হারাতে হয় কেবল প্রতিষ্ঠিত ও নেতা সাংবাদিকদের দলীয় আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই। সাংবাদিকরা বলছেন, আনুগত্য নিশ্চিত করা গেলে নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হয়। অপেশাদার আচরণ ও দলীয় সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি নির্বাচনি প্রচারণার দলীয় কমিটিতেও সাংবাদিকদের যুক্ত হতে দেখেছি। পেশাদার সাংবাদিক এভাবে দলীয় কমিটিতে যুক্ত হতে পারেন না।’
সাংবাদিকতার বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘এখন অনেক অনলাইন, অনেক সংবাদপত্র। এরমধ্যে অনেকেই সংবাদপত্র করার মৌলিক ধারণা থেকে সংবাদপত্র করেন না।’
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ড. কাবেরী গায়েন বলেন, ‘যে দেশে সাংবাদিকরা নিজেরাই নিজেদের সেন্সর করেন, সে দেশে মুক্ত গণমাধ্যম শব্দটির কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। আর যে গুটিকয়েক সাংবাদিক মুক্ত থাকতে চান, তাদের নানাভাবে হয়রানি করে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। সাংবাদিকতার সঙ্গে যু্ক্তরা যখন হয় কোনো কিছু প্রত্যাশা করেন, না হয় ভীত থাকেন; তখন মুক্ত সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। আমাদের গণমাধ্যম প্রত্যাশা, লোভ ও ভয়ের মধ্যে পড়ে মুক্ত সাংবাদিকতা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।’
সরকার, মালিকপক্ষ, সাংবাদিক নেতা ও বিজ্ঞাপনকে স্বাধীন সাংবাদিকার পথে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করতে চান ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘মুক্ত সাংবাদিকতায় স্টাবলিশমেন্ট বড় বাধা। যারা নিজেদের দুর্নীতি ও গণবিরোধী কাজ চেপে রাখতে নানা আইন তৈরি করে, আমলাতন্ত্র কাজের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর মালিকপক্ষ ‘পুঁজি রক্ষার জন্য’ সর্বত্র আপস করে এবং রাজনীতিকদের প্রতি আনুগত্য দেখায়।’’
গণমাধ্যমের মালিকানার ধরনটাও ঝামেলার উল্লেখ করে জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘মালিকানার ধরনটা প্রফেশনাল নয়। ব্যবসার স্বার্থে বিভিন্ন করপোরেট হাউজের কাছে মাথা নত করে তারা টিকে থাকে। সবশেষে বলতে চাই, যে ভয়াবহতার মুখোমুখি আজকের সাংবাদিকতা, সেটি হলো বিজ্ঞাপন সংস্থার আধিপত্য। তারা এতদিন কেবল রিপোর্টের কনসেপ্ট হাজির করতেন। এখন তারা ভাষাও নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। অর্থের কারণে গণমাধ্যমগুলো সেগুলো প্রচার করছে।’
সাংবাদিকদের শত্রুমিত্র নিয়ে আলাপকালে আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘সাংবাদিকের প্রধান শত্রু সাংবাদিকরা, মিত্রও তারা।’
বিষয়টির ব্যাখ্যা করে এই সাংবাদিক বলেন, ‘অনেকেই তাদের ভূমিকা দিয়ে সাংবাদিকতার ক্ষতি করছেন, ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছেন। তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে দুরূহ করে চলেছেন। আবার এরমধ্যে অনেকেই নিজের শ্রম মেধা দিয়ে সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করার লড়াইও অব্যাহত রেখেছেন।’
সাংবাদিকতার ক্লাসিক্যাল কিছু শত্রু আছে উল্লেখ করে নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘স্টাবলিশমেন্ট, বড় পুঁজি, রাষ্ট্রক্ষমতা, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিত্তশালী অসৎ ও বৃহৎ ব্যবসায়ীরা এই তালিকায় রয়েছে। আর মিত্র সাধারণ মানুষ, সিভিল সোসাইটি, গবেষক—যারা আমাদের সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করে।’ তবে শত্রুমিত্র বিষয়টি স্থায়ী কিছু নয় বলেও তিনি মনে করেন।
এদিকে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করার প্রবণতাও বেড়েছে। সে কারণে গণমাধ্যমে সেলফ সেন্সরশিপের প্রবণতাও বাড়ছে বলে মনে করেন সংবাদব্যক্তিত্বরা।
এদিকে, প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার’-এর১৮ এপ্রিল প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক বৈশ্বিক সূচকে চার ধাপ নিচে নেমে গেছে বাংলাদেশ। সূচকে থাকা ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫০তম। এই সূচক অনুযায়ী বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা লঙ্ঘন মারাত্মকভাবে বেড়েছে। মাঠ পর্যায়ে সংবাদকর্মীদের ওপর রাজনৈতিক কর্মীদের হামলা, নিউজ ওয়েবসাইট বন্ধ ও সাংবাদিক গ্রেফতারের ঘটনা বেড়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের অধিকার প্রশ্নে দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ।
আইনে বাধা সাংবাদিকতা
‘আর্টিকেল নাইন্টিন’ নামের একটি সংগঠন জানিয়েছে, ২০১৮ সালে মতপ্রকাশজনিত ১৩১টি ঘটনায় আইনের অপব্যবহার করা হয়েছে। প্রতিবেদন বলছে, শুধু মতপ্রকাশজনিত কারণে মোট ৩১টি ফৌজদারি (মানহানি) মামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। ৭১টি মামলা করা হয়েছে আইসিটিঅ্যাক্টের ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের আওতায়। ৯টি বেআইনি আটক ও জিজ্ঞাসাবাদের ঘটনাসহ ২০টি বিভিন্ন ধরনের হয়রানিমূলক মামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানটির প্রতিবেদন বলছে, ডিজিটাল অ্যাক্টের মাধ্যমে অনলাইন মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ ও সাময়িক বন্ধ বা ব্লক করার একাধিক ঘটনা ঘটেছে ২০১৮ সালে। এ ধরনের মোট ৮টি ঘটনার কথা উল্লেখ করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে। উদাহরণ হিসেবে ‘দ্য ডেইলি স্টার’, ‘এশিয়ান এজ’ ও ‘বিডিনিউজ ২৪’-এর উল্লেখ করা যায়।
গত কয়েক বছরে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় সাংবাদিক হয়রানির ঘটনা ঘটেছে অনেকগুলো৷ ২০১৫ সালে একজন প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ফেসবুকে লেখালেখির কারণে সিনিয়র সাংবাদিক প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা দায়ের ও গ্রেফতার করা হয়৷ এরপর বিডিনিউজ যমুনা টেলিভিশনসহ বেশকিছু পত্রিকার সাংবাদিকরা এই মামলার মুখোমুখি হয়েছে।
আইনি বাধা বিষয়ে আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘সাংবাদিক নিয়ন্ত্রণ করতে এ ধরনের আইন বরাবরই ছিল। এখন ডিজিটাল সময় বলে ডিজিটাল আইন দরকার হয়েছে।’
সেল্ফ সেন্সরশিপ
সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রভাবশালী মহলের চাপে পড়ে অনেক সময় সাংবাদিকরাই সেল্ফ সেন্সরশিপ অবলম্বন করেন। অনেকসময় চাকরি হারানোর ভয়ে অফিসের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যাদের যোগাযোগ বেশি, তাদের বিষয়েও প্রতিবেদন করার ক্ষেত্রে নিজেরাই সতর্ক হয়ে যায়।
২০১৭ সালের ১১ জুন বিডিনিউজে ‘একটি অসুস্থ শিশু, বিচারকের ট্রাক ও একটি মামলা' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করায় গোলাম মুজতবা ধ্রুব'র বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেন মানিকগঞ্জের এক বিচারক। এ ঘটনার দুই বছর পরও সংবেদনশীল বিষয়ে রিপোর্ট লেখার সময় অজানা অস্বস্তি পেয়ে বসে বলে মন্তব্য করেন গোলাম মুজতা। তিনি বলেন, সবসময় পেশাদারিত্বের সঙ্গে সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে নিউজ ছাড়ি। ওই সময়ের হয়রানির কথা মনে করে যেকোনো সংবেদনশীল নিউজ লিখতে আজও অজানা অস্বস্তি কাজ করে।’
অযোগ্য নেতাদের কারণে সাংবাদিকরা এই ভয়-ভীতি থেকে নিজেদের বের করে আনতে পারে না বলে মনে করেন ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বলেন, ‘একসময় সাংবাদিকদের চাকরি গেলে ইউনিয়নের কথার বাইরে যাওয়ার সুযোগ মালিকদের ছিল না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরি নানা কারণেই যেতে পারে। কিন্তু প্রতিষ্ঠান নিয়ম মানছে কি না, সেটা দেখার লোক ছিল। কিন্তু এখন বেশিরভাগ মালিকপক্ষ নিয়মের ধার ধারে না। কারণ ইউনিয়ন দুর্বল, সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য নেই।’
সাংবাদিকদের আনুগত্য
অন্যান্য পেশার মতো রাজনৈতিক কারণে সাংবাদিকরাও এখন দ্বিধাবিভক্ত। আর এ কারণে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের চাপ বেশি হওয়া স্বাভাবিক। বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ড বা গ্র্যাচুইটি দেওয়া হয় না। নেই চাকরির নিরাপত্তাও। শারীরিক নিরাপত্তার কথাও ভাবা হয় না। কিন্তু বিষয়গুলো বলার কেউ নেই।
পেশাগত দায়িত্ব পালনের কারণে সাংবাদিককে তার চাকরি হারাতে হয় কেবল প্রতিষ্ঠিত ও নেতা সাংবাদিকদের দলীয় আনুগত্য প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েই। সাংবাদিকরা বলছেন, আনুগত্য নিশ্চিত করা গেলে নিয়ন্ত্রণ আরও সহজ হয়। অপেশাদার আচরণ ও দলীয় সাংবাদিকতা প্রসঙ্গে নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমরা সম্প্রতি নির্বাচনি প্রচারণার দলীয় কমিটিতেও সাংবাদিকদের যুক্ত হতে দেখেছি। পেশাদার সাংবাদিক এভাবে দলীয় কমিটিতে যুক্ত হতে পারেন না।’
সাংবাদিকতার বর্তমান পরিস্থিতি বিষয়ে নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘এখন অনেক অনলাইন, অনেক সংবাদপত্র। এরমধ্যে অনেকেই সংবাদপত্র করার মৌলিক ধারণা থেকে সংবাদপত্র করেন না।’
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সভাপতি ড. কাবেরী গায়েন বলেন, ‘যে দেশে সাংবাদিকরা নিজেরাই নিজেদের সেন্সর করেন, সে দেশে মুক্ত গণমাধ্যম শব্দটির কোনো অর্থ দাঁড়ায় না। আর যে গুটিকয়েক সাংবাদিক মুক্ত থাকতে চান, তাদের নানাভাবে হয়রানি করে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়। সাংবাদিকতার সঙ্গে যু্ক্তরা যখন হয় কোনো কিছু প্রত্যাশা করেন, না হয় ভীত থাকেন; তখন মুক্ত সাংবাদিকতা সম্ভব নয়। আমাদের গণমাধ্যম প্রত্যাশা, লোভ ও ভয়ের মধ্যে পড়ে মুক্ত সাংবাদিকতা থেকে অনেক দূরে সরে গেছে।’
সরকার, মালিকপক্ষ, সাংবাদিক নেতা ও বিজ্ঞাপনকে স্বাধীন সাংবাদিকার পথে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করতে চান ডিবিসি টেলিভিশনের সম্পাদক জায়েদুল আহসান পিন্টু। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘মুক্ত সাংবাদিকতায় স্টাবলিশমেন্ট বড় বাধা। যারা নিজেদের দুর্নীতি ও গণবিরোধী কাজ চেপে রাখতে নানা আইন তৈরি করে, আমলাতন্ত্র কাজের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আর মালিকপক্ষ ‘পুঁজি রক্ষার জন্য’ সর্বত্র আপস করে এবং রাজনীতিকদের প্রতি আনুগত্য দেখায়।’’
গণমাধ্যমের মালিকানার ধরনটাও ঝামেলার উল্লেখ করে জায়েদুল আহসান পিন্টু বলেন, ‘মালিকানার ধরনটা প্রফেশনাল নয়। ব্যবসার স্বার্থে বিভিন্ন করপোরেট হাউজের কাছে মাথা নত করে তারা টিকে থাকে। সবশেষে বলতে চাই, যে ভয়াবহতার মুখোমুখি আজকের সাংবাদিকতা, সেটি হলো বিজ্ঞাপন সংস্থার আধিপত্য। তারা এতদিন কেবল রিপোর্টের কনসেপ্ট হাজির করতেন। এখন তারা ভাষাও নির্ধারণ করে দিচ্ছেন। অর্থের কারণে গণমাধ্যমগুলো সেগুলো প্রচার করছে।’
সাংবাদিকদের শত্রুমিত্র নিয়ে আলাপকালে আমাদের নতুন সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘সাংবাদিকের প্রধান শত্রু সাংবাদিকরা, মিত্রও তারা।’
বিষয়টির ব্যাখ্যা করে এই সাংবাদিক বলেন, ‘অনেকেই তাদের ভূমিকা দিয়ে সাংবাদিকতার ক্ষতি করছেন, ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছেন। তাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে দুরূহ করে চলেছেন। আবার এরমধ্যে অনেকেই নিজের শ্রম মেধা দিয়ে সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করার লড়াইও অব্যাহত রেখেছেন।’
সাংবাদিকতার ক্লাসিক্যাল কিছু শত্রু আছে উল্লেখ করে নাঈমুল ইসলাম খান বলেন, ‘স্টাবলিশমেন্ট, বড় পুঁজি, রাষ্ট্রক্ষমতা, প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো, বিত্তশালী অসৎ ও বৃহৎ ব্যবসায়ীরা এই তালিকায় রয়েছে। আর মিত্র সাধারণ মানুষ, সিভিল সোসাইটি, গবেষক—যারা আমাদের সাংবাদিকতাকে সমৃদ্ধ করে।’ তবে শত্রুমিত্র বিষয়টি স্থায়ী কিছু নয় বলেও তিনি মনে করেন।
No comments