এমনি যায় না, আবার তেনা পেঁচাইয়া? by শামীমুল হক
ছোট
বেলার নানা স্মৃতি মাঝে মাঝেই মনে হয়। গ্রামের স্মৃতি। খেলার স্মৃতি।
দিনের স্মৃতি। রাতের স্মৃতি। ভালোবাসার স্মৃতি। সুখের স্মৃতি। দুখের
স্মৃতি।
মধুর স্মৃতি। ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি। চোখ বুঝলেই নানা স্মৃতি তাড়া করে। ফিরে যাই ছোট বেলায়। ভাবি কেন যে বড় হলাম। ছোট থাকাটাইতো ভালো ছিল। কিন্তু তাতো হবার নয়। প্রকৃতির নিয়ম। বড় হতে হবে। এভাবে দিন ফুরিয়ে যাবে। মিশে যাব মাটির সঙ্গে। তখন আমিই হয়ে যাব অনেকের স্মৃতি।
যাক ফিরে যাই আমার স্মৃতিতে। আমার এক স্বজনের পুত্র সন্তান হয়েছে। তিনি পুত্রের নাম রাখা অনুষ্ঠান করবেন। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে ছইট্টা। ওই দিন প্রথম শিশুর মাথার চুল ফেলা হয়। রাতে শিশু সন্তানের নাম রাখা হয়। এ সময় তার হাতে টাকা তুলে দেয়া হয়। যেন বড় হয়ে ওই শিশু টাকাওয়ালা হয়। স্বর্ণ, রুপাও তুলে দেয়া হয়। নজর যেন না লাগে কপালে দেয়া হয় টিপ। সারা রাত এসব করে কাটানো হয়। তো সেই অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয়েছে আমাদের। গ্রামের অন্য মহল্লায় যেতে হবে। আমি আর আমার বড় বোনকে মা পাঠালেন দুপুরে খাওয়ার জন্য। আমরা দুজনই এক ক্লাসে পড়তাম। বয়স তখন নয় দশ বছর হবে। যাওয়ার সময় মা একশ’ টাকা আপার হাতে দিয়ে বললেন, খাবার শেষে নবজাতকের হাতে এই একশ’ টাকা দিয়ে দিও। আমরা গেলাম। অনেকের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করলাম। পরে শিশুকে দেখে যখন টাকা দিতে যাবে তখন আপা দেখে তার কোমরে সালোয়ারের ভাঁজে গুঁজে রাখা টাকা নেই। মুখ কালো দেখে আপাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? তিনি বললেন, টাকা পাচ্ছি না। দুই ভাই বোনে অনেক খুঁজলাম। পেলাম না। কি আর করা? সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এর আগে বাড়ি না গেলে মা বকবে। তাই বাড়ির দিকে ছুটলাম। বাড়ির কাছাকাছি এসে আপা লুকিয়ে গেলো। আমি বাড়িতে প্রবেশ করলেও তিনি আসলেন না। মা জিজ্ঞেস করলেন আপার কথা। বললাম এক সঙ্গেইতো আসলাম। উনি কোথায় গেলেন? মা জানতে চাইলেন ওই বাড়িতে কিছু হয়েছে কিনা? কিছু বলছি না। মা বুঝে গেলেন। বললেন, কি হয়েছে বল? তখন টাকা হারানোর কথা বললাম। মা বললেন, তাতে কি হয়েছে? তাই বলে ওকে লুকিয়ে থাকতে হবে। মা বেরিয়ে পড়লেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে আরেক বাড়ির দরজার পেছনে লুকিয়ে থাকা আপাকে বের করে আনলেন। ঘরে এনে বললেন, আর কখনো এমন করবে না। টাকা হারিয়ে গেছে বলে বাড়ি আসবে না। এটা হতে পারেনা। কাল গিয়ে আমি টাকা দিয়ে আসব। একই সঙ্গে বললেন, তোমরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারনি। তোমাদের উপর দেয়া দায়িত্বে অবহেলা করেছ। দায়িত্বের দিকে তোমাদের মনযোগ ছিলনা। তাই এমনটা হয়েছে। আমরা দুই ভাইবোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এখন বুঝি সত্যিই সেদিন আমরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।
ছোট সময়ে দেখতাম গ্রামের ঘরে ঘরে হুক্কা। কেউ বেড়াতে এলে আগে তাকে হুক্কা দিতে হতো। হুক্কা টানতো আর কথা বলতো মুরব্বিরা। হুক্কার জন্য বাজার থেকে তামাক আনা হতো। এ তামাকের সঙ্গে মেশানো হতো রাব। মেশানো হতো নানা সুগন্ধি। এক বাড়িতে তামাক খেলে দশ বাড়ি খবর হতো। গন্ধে মোহিত হতো এলাকা। তামাক খাওয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি তখন টিক্কা দেয়া হতো। উঠানে পাটি বিছিয়ে টিক্কা দেয়া হতো। সে টিক্কা রোদে শুকানো হতো। তারপর ড্রাম ভরে রাখা হতো। নানা ধরনের হুক্কা ছিল। কেউ চেয়ারে বসে পাইপের মাধ্যমে টেনে হুক্কা খেতেন। এ হুক্কার পানির রাখার জায়গা ছিল পিতলের। আবার কেউ সরাসরি হুক্কা টানতেন। বিশেষ করে বেশিরভাগ হুক্কার নিচের দিকটা তৈরি হতো নারকেলের মালা দিয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হতো একটি কাঠের লম্বা টুকরা (নইছা)। যার মাঝে ফাঁকা থাকত। উপরে থাকত তামাক রাখার জন্য মাটি দিয়ে তৈরি কলকি। ওই কলকিতে রাখা হতো তামাক। এর উপর দেয়া হতো টিক্কা। যে টিক্কা আগুনে গরম করে আনা হতো। হুক্কার টানের সঙ্গে সঙ্গে টিক্কাও আস্তে আস্তে জ¦লত। আর টিক্কার আগুনে পুড়ত তামাক। টানের সঙ্গে বের হতো ধোঁয়া। হুক্কার নিচের সেই নারকেলের মালায় দেয়া হতো পানি। ধোঁয়া পানিতে ফিল্টার হয়ে পাইপ দিয়ে মুখে যেত। কিংবা সরাসরি টানলেও পানিতে ফিল্টার হয়ে ধোঁয়া মুখে যেত। প্রতিদিন সকালে বাড়ির বউ-ঝিরা সেই হুক্কার পানি ফেলে নতুন পানি ভরত। পানি ফেলার সময় দেখা যেত তামাকের বিষে সেই পানির রং কালো হয়ে যেত। কখনো কখনো দেখা যেত হুক্কা পুরনো হয়ে গেলে কাঠের লম্বা টুকরা (নইছা) ঢিলা হয়ে যেত। তখন ওই কাঠের টুকরায় কাপড়ের ছেঁড়া অংশ যাকে স্থানীয় ভাষায় তেনা বলে তা পেঁচিয়ে বসানো হতো। একদিন এক বাড়িতে পানি পরিষ্কার করতে গিয়ে হুক্কার নিচের অংশ থেকে নইছা খুলে পড়ে। গৃহবধূ অনেক চেষ্টা করছেন নইছাটি ফাঁকা জায়গায় বসাতে। কিন্তু কোন ভাবেই ঢুকাতে পারছেন না। এক সময় গৃহবধূ এক টুকরা তেনা পেঁচিয়ে কাঠের টুকরা বসাতে যান। এখনতো একেবারেই যাচ্ছে না। এ সময় বাড়ির গৃহকর্তা বলেন, এমনি যায় না, আবার তেনা পেঁচাইয়া?
মধুর স্মৃতি। ঘুরে বেড়ানোর স্মৃতি। চোখ বুঝলেই নানা স্মৃতি তাড়া করে। ফিরে যাই ছোট বেলায়। ভাবি কেন যে বড় হলাম। ছোট থাকাটাইতো ভালো ছিল। কিন্তু তাতো হবার নয়। প্রকৃতির নিয়ম। বড় হতে হবে। এভাবে দিন ফুরিয়ে যাবে। মিশে যাব মাটির সঙ্গে। তখন আমিই হয়ে যাব অনেকের স্মৃতি।
যাক ফিরে যাই আমার স্মৃতিতে। আমার এক স্বজনের পুত্র সন্তান হয়েছে। তিনি পুত্রের নাম রাখা অনুষ্ঠান করবেন। গ্রামের ভাষায় যাকে বলে ছইট্টা। ওই দিন প্রথম শিশুর মাথার চুল ফেলা হয়। রাতে শিশু সন্তানের নাম রাখা হয়। এ সময় তার হাতে টাকা তুলে দেয়া হয়। যেন বড় হয়ে ওই শিশু টাকাওয়ালা হয়। স্বর্ণ, রুপাও তুলে দেয়া হয়। নজর যেন না লাগে কপালে দেয়া হয় টিপ। সারা রাত এসব করে কাটানো হয়। তো সেই অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয়েছে আমাদের। গ্রামের অন্য মহল্লায় যেতে হবে। আমি আর আমার বড় বোনকে মা পাঠালেন দুপুরে খাওয়ার জন্য। আমরা দুজনই এক ক্লাসে পড়তাম। বয়স তখন নয় দশ বছর হবে। যাওয়ার সময় মা একশ’ টাকা আপার হাতে দিয়ে বললেন, খাবার শেষে নবজাতকের হাতে এই একশ’ টাকা দিয়ে দিও। আমরা গেলাম। অনেকের সঙ্গে খাওয়া দাওয়া করলাম। পরে শিশুকে দেখে যখন টাকা দিতে যাবে তখন আপা দেখে তার কোমরে সালোয়ারের ভাঁজে গুঁজে রাখা টাকা নেই। মুখ কালো দেখে আপাকে জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে? তিনি বললেন, টাকা পাচ্ছি না। দুই ভাই বোনে অনেক খুঁজলাম। পেলাম না। কি আর করা? সন্ধ্যা হয়ে আসছে। এর আগে বাড়ি না গেলে মা বকবে। তাই বাড়ির দিকে ছুটলাম। বাড়ির কাছাকাছি এসে আপা লুকিয়ে গেলো। আমি বাড়িতে প্রবেশ করলেও তিনি আসলেন না। মা জিজ্ঞেস করলেন আপার কথা। বললাম এক সঙ্গেইতো আসলাম। উনি কোথায় গেলেন? মা জানতে চাইলেন ওই বাড়িতে কিছু হয়েছে কিনা? কিছু বলছি না। মা বুঝে গেলেন। বললেন, কি হয়েছে বল? তখন টাকা হারানোর কথা বললাম। মা বললেন, তাতে কি হয়েছে? তাই বলে ওকে লুকিয়ে থাকতে হবে। মা বেরিয়ে পড়লেন। অনেক খোঁজাখুঁজি করে আরেক বাড়ির দরজার পেছনে লুকিয়ে থাকা আপাকে বের করে আনলেন। ঘরে এনে বললেন, আর কখনো এমন করবে না। টাকা হারিয়ে গেছে বলে বাড়ি আসবে না। এটা হতে পারেনা। কাল গিয়ে আমি টাকা দিয়ে আসব। একই সঙ্গে বললেন, তোমরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারনি। তোমাদের উপর দেয়া দায়িত্বে অবহেলা করেছ। দায়িত্বের দিকে তোমাদের মনযোগ ছিলনা। তাই এমনটা হয়েছে। আমরা দুই ভাইবোন একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। এখন বুঝি সত্যিই সেদিন আমরা সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারিনি।
ছোট সময়ে দেখতাম গ্রামের ঘরে ঘরে হুক্কা। কেউ বেড়াতে এলে আগে তাকে হুক্কা দিতে হতো। হুক্কা টানতো আর কথা বলতো মুরব্বিরা। হুক্কার জন্য বাজার থেকে তামাক আনা হতো। এ তামাকের সঙ্গে মেশানো হতো রাব। মেশানো হতো নানা সুগন্ধি। এক বাড়িতে তামাক খেলে দশ বাড়ি খবর হতো। গন্ধে মোহিত হতো এলাকা। তামাক খাওয়ার জন্য বাড়ি বাড়ি তখন টিক্কা দেয়া হতো। উঠানে পাটি বিছিয়ে টিক্কা দেয়া হতো। সে টিক্কা রোদে শুকানো হতো। তারপর ড্রাম ভরে রাখা হতো। নানা ধরনের হুক্কা ছিল। কেউ চেয়ারে বসে পাইপের মাধ্যমে টেনে হুক্কা খেতেন। এ হুক্কার পানির রাখার জায়গা ছিল পিতলের। আবার কেউ সরাসরি হুক্কা টানতেন। বিশেষ করে বেশিরভাগ হুক্কার নিচের দিকটা তৈরি হতো নারকেলের মালা দিয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হতো একটি কাঠের লম্বা টুকরা (নইছা)। যার মাঝে ফাঁকা থাকত। উপরে থাকত তামাক রাখার জন্য মাটি দিয়ে তৈরি কলকি। ওই কলকিতে রাখা হতো তামাক। এর উপর দেয়া হতো টিক্কা। যে টিক্কা আগুনে গরম করে আনা হতো। হুক্কার টানের সঙ্গে সঙ্গে টিক্কাও আস্তে আস্তে জ¦লত। আর টিক্কার আগুনে পুড়ত তামাক। টানের সঙ্গে বের হতো ধোঁয়া। হুক্কার নিচের সেই নারকেলের মালায় দেয়া হতো পানি। ধোঁয়া পানিতে ফিল্টার হয়ে পাইপ দিয়ে মুখে যেত। কিংবা সরাসরি টানলেও পানিতে ফিল্টার হয়ে ধোঁয়া মুখে যেত। প্রতিদিন সকালে বাড়ির বউ-ঝিরা সেই হুক্কার পানি ফেলে নতুন পানি ভরত। পানি ফেলার সময় দেখা যেত তামাকের বিষে সেই পানির রং কালো হয়ে যেত। কখনো কখনো দেখা যেত হুক্কা পুরনো হয়ে গেলে কাঠের লম্বা টুকরা (নইছা) ঢিলা হয়ে যেত। তখন ওই কাঠের টুকরায় কাপড়ের ছেঁড়া অংশ যাকে স্থানীয় ভাষায় তেনা বলে তা পেঁচিয়ে বসানো হতো। একদিন এক বাড়িতে পানি পরিষ্কার করতে গিয়ে হুক্কার নিচের অংশ থেকে নইছা খুলে পড়ে। গৃহবধূ অনেক চেষ্টা করছেন নইছাটি ফাঁকা জায়গায় বসাতে। কিন্তু কোন ভাবেই ঢুকাতে পারছেন না। এক সময় গৃহবধূ এক টুকরা তেনা পেঁচিয়ে কাঠের টুকরা বসাতে যান। এখনতো একেবারেই যাচ্ছে না। এ সময় বাড়ির গৃহকর্তা বলেন, এমনি যায় না, আবার তেনা পেঁচাইয়া?
No comments