রোহিঙ্গা নিপীড়নের বর্ণনা দিতে গিয়ে কানাডার সিনেটে কাঁদলেন বব রে
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি
স্বাক্ষরিত হলেও বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠীটির ওপর চালানো নিপীড়নের
বর্ণনা দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়েছেন কানাডার রাজনীতিক বব রে। মিয়ানমারে
নিযুক্ত কানাডার প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত রে দেশটির সিনেট কমিটির কাছে
বলেছেন ধর্ষণের কারনে জন্ম নেওয়া শিশুদের মাধ্যমে অপরাধ সংঘটনের জেনেটিক
প্রমাণ হাজির করা যায়। তিনি বলেন, ধর্ষণ আর নিপীড়নের শিকার হওয়া অনেক
রোহিঙ্গা এখন নিজেদের দেশে ফিরতে চায় না। কানাডার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম
সিবিসি নিউজ জানিয়েছে, কমিটির কাছে বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে নিপীড়িত এক
শিক্ষিত মানুষের বর্ণনা দিতে গিয়ে অশ্রু সামাল দিতে পারেননি বব।
গত
বছরের আগস্টে রাখাইনে নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে
কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানামর সেনাবাহিনী। খুন, ধর্ষণ আর অগ্নি
সংযোগের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। জাতিসংঘ ও
মানবাধিকার সংস্থাগুলো একে জাতিগত নিধনযজ্ঞ আখ্যা দিলে পরিস্থিতি
পর্যবেক্ষণে বিশেষ দূত হিসেবে বব রেকে নিয়োগ দেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী
জাস্টিন ট্রুডো। এই বছরের মার্চে জমা দেওয়া এক প্রতিবেদনে জন্মভূমি থেকে
বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের কানাডায় আশ্রয় ও চলমান মানবিক সংকটের জন্য দায়ী
ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির সুপারিশ করেন তিনি।
গত বুধবার (৬ জুন) কানাডার সিনেটের মানবাধিকার কমিটির কাছে স্বাক্ষ্য
দেন বব। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি
বলেন, ‘এটা ছিল খুব কঠিন আর আবেগতাড়িত অভিজ্ঞতা। সেখানকার মানবিক সংকটের
পরিধি আপনাদের কাছে বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। সে হিসেবে মানুষের
নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদের সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিতে হচ্ছে। আমার আশঙ্কা
আমাদের প্রাণহানি দেখতে হবে আর তাহলে আমি তা সহজভাবে নিতে পারবো না।’
বব অভিযোগ করেন সত্যি হলো সেখানে (মিয়ানমারে) কোনও নিয়মকানুন বা আধুনিক
যুদ্ধপরিস্থিতির আচরণ চর্চার বালাই নেই-বেসামরিক নাগরিকেরা নিয়মিতভাবে
লক্ষ্যবস্তু হচ্ছে আর ধর্ষণ নিপীড়নের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি
জানান, অনেক নারী তাদের গ্রামে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা তাকে বলেছেন।বব বলেন,
এই যুদ্ধ বেসামরিক নাগরিকদের আক্রান্ত করেছে আর সরাসরি সাধারণ মানুষের ওপর
সবচেয়ে নৃশংস উপায়ে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
ধর্ষণের কারণে অনেক শিশুর জন্ম হচ্ছে জানিয়ে বব বলেন, এদের মাধ্যমে
অপরাধ সংঘটনের জেনেটিক প্রমাণ হাজির করা যায়। বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর বলেও
জানান তিনি। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট বলছে রোহিঙ্গা শিবিরে
প্রতিদিন প্রায় ৬০জন শিশুর জন্ম হচ্ছে।
রোহিঙ্গা শিবিরের এক শিক্ষিত ব্যক্তির কথা বলতে গিয়ে সিনেট কমিটির কাছে
বব বলেন, তিনি আমাকে জড়িয়ে দীর্ঘসময় ধরে কাঁদতে শুরু করলেন আর বললেন,
তাদেরকে বলেন আমরা মানুষ। রোহিঙ্গা শিবিরে অল্প বয়সের শিশুদের দেখার
অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে নিজের কান্না আটকাতে পারেননি বব রে। তিনি বলেন,
শিবিরগুলো অল্প বয়সী মানুষে ভর্তি আর একজন বাবা ও দাদা হিসেবে যে বিষয়টি
আমি তাদের শিশু বলে মনে করেছি।
বাংলাদেশে পালিয়ে আসা সাত লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরাতে গত নভেম্ববরে
বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করে মিয়ানমার। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াায়
সম্পৃক্ত করতে গত মঙ্গলবার জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তি সআবক্ষর করে
মিয়ানমার। এর পরদিন কানাডার সিনেট কমিটির কাছে স্বাক্ষ্য দেন বব। চুক্তি
অনুযায়ী রোহিঙ্গারা নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী ফেরত যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
তবে বব বলেন, যারা নিপীড়নের শিকার হয়েছে, ভূমি আর সম্পদ হারিয়েছে বা
ধর্ষণের শিকার হওয়া নারীরা ফিরে যাওয়ার বিষয়ে আগ্রহী না। তিনি বলেন, ‘ফিরে
যাওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ভালো পরামর্শ নয়। আমি এটা বলছি কারণ আমি তাদের কথা
শুনেছি। তারা ফেরত যাচ্ছে না। তারা নড়বে না।’
জুনের শেষ নাগাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের মেয়াদ শেষ করবেন বব। সিনেট
কমিটির কাছে তিনি আশা প্রকাশ করেন দেশটির লিবারেল সরকার সমমনা দেশগুলোকে
সম্পৃক্ত করে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় সাড়া দেওয়া অব্যাহত রাখবে।
চলতি সপ্তাহে কানাডায় অনুষ্ঠিত শিল্পোন্নত দেশগুলোর গ্রুপ জি-৭ এর শীর্ষ
নেতাদের সম্মেলনে মিয়ানমার ইস্যু তোলা হবে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের
এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, রোহিঙ্গাদের ফাইলকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছে
তাদর সরকার। আন্তর্জাতিক সহায়তা ও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের
স্বচ্ছতার জন্য কানাডা চাপ প্রয়োগ করে যাবে বলেও জানান ওই মুখপাত্র। এই
সম্মেলনে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো
হয়েছে। যোগ দিতে ইতিমধ্যে কানাডার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন তিনি।
No comments