বিচ্ছিন্ন মানব by সাজেদুল হক
১৪
বছর বয়সী নরওয়েজিয় কিশোরী সোফি এমুন্ডসেন। একদিন তার ঠিকানায় আশ্চার্য এক
চিঠি আসে। যে চিঠিতে প্রশ্ন ছিল একটাই- তুমি কে? যে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার
মধ্যদিয়ে ইয়স্তেন গার্ডার আসলে দর্শনের ইতিহাস বর্ণনা শুরু করেন। সোফির
জগতের চারশ’ পৃষ্ঠায় আবদ্ধ করা হয়েছে তিন হাজার বছরের চিন্তাকে। যে
গ্রন্থকে দর্শনের পক্ষ থেকে স্টিফেন হকিং রচিত এ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমের
জবাব বলে মনে করা হয়। তবে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন প্রশ্নের জবাব আজও
মিলেনি। আপনি, আমি, তুমি এবং সে সবাই খুঁজছেন সে উত্তর। কেউ কি তা পেয়েছেন?
কেউ কি কখনও তা পাবেন? না কি মানুষ নিজেই নিজের কাছে রহস্য থেকে যাবে।
গর্ডন ই বিগেলো তার অস্তিত্ববাদের প্রথম পাঠ শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছেন,
মানুষ জাতির সংজ্ঞা কি? গ্রিক দর্শনের এই প্রশ্নের মধ্যে ‘বিশ্বের যুক্তি
আবদ্ধ শৃঙ্খলাকে উপলব্ধি করতে পারলে তার মধ্যে মানুষেরও একটা নির্দিষ্ট
স্থান ও সংজ্ঞা নিশ্চয়ই থাকবে- এরকম একটা বিশ্বাস জড়িত আছে, যা অস্তিত্ববাদ
স্বীকার করে না। তার পরিবর্তে সে জব এবং সেন্ট অগাস্টাইনের মতো প্রশ্ন
রাখে ‘আমি কে?’ য়োহান ভোলফ গাঙ ফন গ্যোতে তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, আমি
কোথায় চলেছি তা আমি জানি না। শৈশব হতে বাল্য, বাল্য থেকে যৌবন, আমার
সারাজীবন ধরে আমি কি খুঁজে চলেছি, পাহাড় প্রান্তরে জলে স্থলে সুন্দর,
অসুন্দরে, রূপে অরূপে ইন্দ্রিয় ও অতীন্দ্রীয়ের মাঝে কি খুঁজেছি আমি? যা
খুঁজেছি তা কি আমি পেয়েছি কোনদিন। তা কি কেউ পায়। বিখ্যাত গীতিকাব্য
ফাউস্টে গ্যোতে অনুসন্ধান করেছেন মানুষের স্বরূপ। ফাউস্টের বর্ণনা, মানুষ
হচ্ছে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র নির্বোধ এক সত্ত্বা। আমি আসলে একজন ক্রীতদাস। যারই
হই না কেন আমি আসলে একজন ক্রীতদাস।ফাউস্টেই আবার ফ্রয়েডের তত্ত্ব ধ্বনিত
হতে দেখি আমরা। যেখানে বলা হয়েছে-বহিরঙ্গের কিছু রূপান্তর সত্ত্বেও মানুষের
জীবনের মূল ধাতুর কোন পরিবর্তন হয় না। তবে শেষ পর্যন্ত মানুষের জয়ী হওয়ার
আকাঙ্ক্ষার ওপরই আস্থা রেখেছেন গ্যোতে- শোন বন্ধু একমাত্র জীবনকে উপভোগ কর।
জীবনের সোনালী গাছটাই হলো একমাত্র সবুজ আর সজীব। বাকি সব তত্ত্ব হলো
মিথ্যা, ধূসরবর্ণ, সব নিরস।দর্শনের গোটা ইতিহাস জুড়ে দার্শনিকেরা আবিষ্কার
করতে চেয়েছেন মানুষ কি বা মানবপ্রকৃতি কি। কিন্তু জাঁ পল সার্ত্র বিশ্বাস
করতেন যে মানুষের এ ধরনের কোন শাশ্বত প্রকৃতি নেই যার ওপর ভরসা করা যেতে
পারে। কাজেই সাধারণভাবে জীবনের মানে খোঁজার চেষ্টা অর্থহীন। আরও কিছু জীবনে
সার্ত্র বর্ণনা করেছেন সে অর্থহীনতা ‘পরাজয়ের স্বাদ রণক্ষেত্রে যেমন কেউ
পছন্দ করুক আর না করুক জীবন ক্ষেত্রেও তেমনি। আইভিচ পছন্দ করুক বা না করুক
জীবনের তাতে কিছু আসে যায় না।’ একইগ্রন্থে বলা হয়েছে , আমি চঞ্চল। সবসময়
চলছি, সবসময় নতুন করে শুরু করছি। সবসময় কোন না কোন কিছু থেকে পালিয়ে
যাচ্ছি। যখনই মনে হয় কোন এক জায়গায় একটু ভাল লেগে গেছে ওর তখন অস্বস্তি
লাগে, অপরাধী মনে হয়, নিজেকে মনে হয় ও নিরাপদ নয়।দার্শনিক কিয়েকগার্ড বলেন,
যে নিজের থেকে, নিজের চিন্তা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়, বরং চিন্তার দ্বারা
মানুষের পথ বেঁছে নেয়া, তার সঙ্গে একাত্ম হওয়া, বেছে নেয়ার সঙ্গে জড়িত
যন্ত্রণা এবং নিজের আবিষ্কৃত পথে নিবিষ্টভাবে চলার এবং যা ফেলে এলাম তার
জন্য সমস্ত বেদনা- এতেই প্রকাশ হয় আমাদের আসল রূপ। কিয়ের্কগার্ডের দৃষ্টিতে
নিজের এই সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজনীয়তা প্রত্যেক মানুষের জীবনকে করে অন্যসব
জীবন থেকে আলাদা। ডিএইচ লরেন্সের আবেগময় বক্তব্যও স্মরণ করা যায়, মানুষকে
আদর্শ অবস্থায় নিয়ে আসা! কোন মানুষকে আদর্শ অবস্থায় নিয়ে আসা। আমিতো অনেক
মানুষ। কোনটিকে আপনারা আদর্শ অবস্থায় নিয়ে আসবেন? আমিতো একটা যন্ত্র বিশেষ
নই। মানুষের অন্তর বড়ই অদ্ভুত। এই তার সবকিছু, তার মধ্যে লুকিয়ে অনেক জানা
আর অজানা। মানুষের ভিতরটা একটা গভীর অন্ধকারময় বিশাল অরণ্য। তার নিজস্ব
বন্যপ্রাণীরাও আছে সেখানে। গর্ডন ই বিগেলোর বর্ণনায় আবার ফিরে যাই। তিনি
লিখেছেন, অস্তিত্ববাদীরা গভীরভাবে অনুভব করেছেন যে আধুনিক মানুষ
সৃষ্টিকর্তা থেকে, প্রকৃতির থেকে, চারপাশের অন্য মানুষদের থেকে এবং নিজের
আসল পরিচয় থেকেও নিজে বিচ্ছিন্ন। মানুষের সৃষ্টিকর্তা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার
এই অভিজ্ঞতার সব থেকে যন্ত্রণাময় প্রকাশ রয়েছে নিটশের রচনার তীব্র
অভিব্যক্তিতে-ঈশ্বর মারা গেছেন!
শেরউড আন্ডারসনের স্টোরিট্রেলার স্টোরিতেও শোনা যায় সে হাহাকার। তার বর্ণনায় তিনি একদিন এক জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে একাকি রাস্তায় হাঁটছিলেন, যখন ‘সহসা অমানুষিক কিছুর সামনে প্রণত হওয়ার অদ্ভুত বাসনা জেগে উঠলো আমার মধ্যে। এটা হাস্যকর জেনেও আমি এগিয়ে গেলাম। আর প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাঁটুগেড়ে বসলাম জ্যেৎস্নাপ্লাবিত পথের ধুলিতে।কিন্তু আমারতো কোন ঈশ্বর নেই, আমার চারপাশের জীবন আমার কাছ থেকে সমস্ত ঈশ্বরকেই কেড়ে নিয়েছে, যেমনভাবে প্রত্যেক আধুনিক মানুষের কাছ থেকে মানুষের আত্মগত বুদ্ধি নামে দুর্বোধ্য শক্তি কেড়ে নিয়েছে তার ঈশ্বরকে- তাই পথের মধ্যে জানু পেতে বসা আমার চেহারার কথা ভেবে আমার নিজেরই হাসি পেল।সেদিন আকাশে কোন ঈশ্বর ছিলেন না, আমার নিজের মধ্যেও কোন ঈশ্বর ছিলেন না, ঈশ্বরে বিশ্বাস করার মতো শক্তি আছে আমার এই প্রত্যয়ও ছিল না আমার মধ্যে, তাই শুধুই পথের ধুলোয় জানু পেতে রইলাম আমি, আমার মুখে প্রার্থনার কোন শব্দই ছিল না চিন্তার জগতে উলট-পালট সৃষ্টি করা এক চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো। কারাগার আর হাসপাতালকে ইতিহাসের নতুন আঙ্গিকে উপস্থান করেছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে ফুকো বলেছিলেন, আমার ভূমিকা হলো- এবং তা হয়তো বাড়িয়ে বলা হবে- মানুষকে দেখানো যে, তারা যেটুকু অনুভব করে তারচেয়েও তারা বেশি স্বাধীন। মিশেল ফুকোর বিচিত্র জীবনের মাধ্যমে মানুষের প্রকৃতি অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন তার সমকামী বন্ধু এর্ভে গিবের। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে নিয়মিত ফুকোর শয্যার পাশে বসে থাকতেন তিনি। বন্ধুকে শয্যাপাশে দেখে ফুকো বেশ শান্তি পেয়েছিলেন। পরে যখন তিনি পুরোপুরি প্রলাপ বকছেন, তখন গিবের কাগজ কলম নিয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে সেগুলো টুকে রাখতেন। এর ওপর ভিত্তি করেই তিনি লিখেন ছোট গল্প, লে সোক্রে দ্যাঁনম-একজন মানুষের রহস্য। গল্পের শুরুতে আমরা দেখি এক নিউরো সার্জন জনৈক মহান দার্শনিকের খুলি চিরে মস্তিষ্কটি পরীক্ষা করছেন-যেন এক গোপন অজেয় দুর্গে ঢুকেছে কোন অবাঞ্চিত হানাদার। গল্পে বর্ণিত তৃতীয় স্মৃতিচিহ্নে দেখা যায় কিশোর দার্শনিক এক সাদামাটা উঠানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অনুভব করেন, বাড়িটি দুঃসহ কলঙ্কে শিহরিত হয়ে আছে। বাড়ির ভিতরে কোথাও একটা অন্ধকার ঘরে খড়ের বিছানায় এক অসহায় মহিলা চেনে বাঁধা রয়েছেন; খবরের কাগজের ভাষায় তার নাম ‘সেকুয়েসত্রে দ পোয়াতিয়ে পোয়াতিয়ে-র নির্জনবাসিনী। অভিজিৎ চক্রবর্তী তার ‘মিশেল ফুকো’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন, পোয়াতিয়ে শহরে নির্জনবাসিনী একজন সত্যিই ছিলেন। তাকে অবশ্য ফুকো স্বচক্ষে দেখেননি। ঘটনাটি ফাঁস হয় ১৯০১ সালে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ এক উড়ো খবরের ভিত্তিতে শহরের এক গৃহস্থবাড়িতে হানা দিয়ে মেলানি বাস্তিয়ান নামে জনৈকা উন্মাদিনীকে আবিষ্কার করে। ওই ভদ্র পরিবারেই মহিলার জন্ম। যৌবনে এক অবৈধ প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে তিনি সন্তান সম্ভবা হন। বাচ্চাটি অবশ্য নষ্ট হয়ে যায়। তখন তার মা ও ভাই লোকলজ্জা এড়াতে মেলানিকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর তার স্বাভাবিক আচরণ দেখে কতৃপক্ষ তাকে মুক্তি দেন। তখন মা ও ভাই মেলানিকে একটি অন্ধকার ঘরে চেন বেঁধে আটকে রাখেন। সেখানে ২৫ বছর আটক থাকার পর সম্পূর্ণ উন্মাদ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। সুদীর্ঘ ২৫ বছরের কোন এক অজ্ঞাত মুহূর্তে আকাটা নখর দিয়ে দেয়াল আঁচড়ে-আঁচড়ে মেলানি দু’ একটি অসংলগ্ন কথা লিখে রেখেছেন: ‘সুন্দরের জন্ম দিতে হলে- প্রেম নয়, স্বাধীনতা নয়-অবিনাশী একাকিত্বের ভিতর এক ভূগর্ভস্থ কারাকক্ষে তোমাকে বাঁচতে হবে মরতে হবে......’ এই কথাগুলো ভিতরেই কি কোথাও উন্মোচিত হয়েছেন প্রকৃত মিশেল ফুকো। ’ গর্ডন ই বিগেলো লিখেছেন, ঈশ্বর থেকে, তার চারপাশের মানুষ থেকে এবং নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের জন্য শেষে শূন্যতা ছাড়া আর কি পড়ে থাকে? এলিয়ট তার Hollowman ফাঁপা মানুষ এ লিখেছেন- Shape without form, shade without color Paralyzed force, gesture without motion জীবনের সংক্ষিপ্ততা শেক্সপীয়ারের চিন্তাকে আছন্ন করে রেখেছিল। তার সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি ছিল- টুবি অর নট টু বি। হ্যামলেটের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে সেই হাহাকার- একদিন আমরা এই পৃথিবীর ওপর হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি তো পরেরদিন হারিয়ে যাচ্ছি, মিশে যাচ্ছি মাটিতে।
শেরউড আন্ডারসনের স্টোরিট্রেলার স্টোরিতেও শোনা যায় সে হাহাকার। তার বর্ণনায় তিনি একদিন এক জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাতে একাকি রাস্তায় হাঁটছিলেন, যখন ‘সহসা অমানুষিক কিছুর সামনে প্রণত হওয়ার অদ্ভুত বাসনা জেগে উঠলো আমার মধ্যে। এটা হাস্যকর জেনেও আমি এগিয়ে গেলাম। আর প্রার্থনার ভঙ্গিতে হাঁটুগেড়ে বসলাম জ্যেৎস্নাপ্লাবিত পথের ধুলিতে।কিন্তু আমারতো কোন ঈশ্বর নেই, আমার চারপাশের জীবন আমার কাছ থেকে সমস্ত ঈশ্বরকেই কেড়ে নিয়েছে, যেমনভাবে প্রত্যেক আধুনিক মানুষের কাছ থেকে মানুষের আত্মগত বুদ্ধি নামে দুর্বোধ্য শক্তি কেড়ে নিয়েছে তার ঈশ্বরকে- তাই পথের মধ্যে জানু পেতে বসা আমার চেহারার কথা ভেবে আমার নিজেরই হাসি পেল।সেদিন আকাশে কোন ঈশ্বর ছিলেন না, আমার নিজের মধ্যেও কোন ঈশ্বর ছিলেন না, ঈশ্বরে বিশ্বাস করার মতো শক্তি আছে আমার এই প্রত্যয়ও ছিল না আমার মধ্যে, তাই শুধুই পথের ধুলোয় জানু পেতে রইলাম আমি, আমার মুখে প্রার্থনার কোন শব্দই ছিল না চিন্তার জগতে উলট-পালট সৃষ্টি করা এক চিন্তাবিদ মিশেল ফুকো। কারাগার আর হাসপাতালকে ইতিহাসের নতুন আঙ্গিকে উপস্থান করেছেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে ফুকো বলেছিলেন, আমার ভূমিকা হলো- এবং তা হয়তো বাড়িয়ে বলা হবে- মানুষকে দেখানো যে, তারা যেটুকু অনুভব করে তারচেয়েও তারা বেশি স্বাধীন। মিশেল ফুকোর বিচিত্র জীবনের মাধ্যমে মানুষের প্রকৃতি অনুসন্ধানের চেষ্টা করেছেন তার সমকামী বন্ধু এর্ভে গিবের। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে নিয়মিত ফুকোর শয্যার পাশে বসে থাকতেন তিনি। বন্ধুকে শয্যাপাশে দেখে ফুকো বেশ শান্তি পেয়েছিলেন। পরে যখন তিনি পুরোপুরি প্রলাপ বকছেন, তখন গিবের কাগজ কলম নিয়ে কাঁপা-কাঁপা হাতে সেগুলো টুকে রাখতেন। এর ওপর ভিত্তি করেই তিনি লিখেন ছোট গল্প, লে সোক্রে দ্যাঁনম-একজন মানুষের রহস্য। গল্পের শুরুতে আমরা দেখি এক নিউরো সার্জন জনৈক মহান দার্শনিকের খুলি চিরে মস্তিষ্কটি পরীক্ষা করছেন-যেন এক গোপন অজেয় দুর্গে ঢুকেছে কোন অবাঞ্চিত হানাদার। গল্পে বর্ণিত তৃতীয় স্মৃতিচিহ্নে দেখা যায় কিশোর দার্শনিক এক সাদামাটা উঠানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় অনুভব করেন, বাড়িটি দুঃসহ কলঙ্কে শিহরিত হয়ে আছে। বাড়ির ভিতরে কোথাও একটা অন্ধকার ঘরে খড়ের বিছানায় এক অসহায় মহিলা চেনে বাঁধা রয়েছেন; খবরের কাগজের ভাষায় তার নাম ‘সেকুয়েসত্রে দ পোয়াতিয়ে পোয়াতিয়ে-র নির্জনবাসিনী। অভিজিৎ চক্রবর্তী তার ‘মিশেল ফুকো’ শীর্ষক লেখায় লিখেছেন, পোয়াতিয়ে শহরে নির্জনবাসিনী একজন সত্যিই ছিলেন। তাকে অবশ্য ফুকো স্বচক্ষে দেখেননি। ঘটনাটি ফাঁস হয় ১৯০১ সালে। পুলিশ কর্তৃপক্ষ এক উড়ো খবরের ভিত্তিতে শহরের এক গৃহস্থবাড়িতে হানা দিয়ে মেলানি বাস্তিয়ান নামে জনৈকা উন্মাদিনীকে আবিষ্কার করে। ওই ভদ্র পরিবারেই মহিলার জন্ম। যৌবনে এক অবৈধ প্রণয়ে জড়িয়ে পড়ে তিনি সন্তান সম্ভবা হন। বাচ্চাটি অবশ্য নষ্ট হয়ে যায়। তখন তার মা ও ভাই লোকলজ্জা এড়াতে মেলানিকে পাগলা গারদে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর তার স্বাভাবিক আচরণ দেখে কতৃপক্ষ তাকে মুক্তি দেন। তখন মা ও ভাই মেলানিকে একটি অন্ধকার ঘরে চেন বেঁধে আটকে রাখেন। সেখানে ২৫ বছর আটক থাকার পর সম্পূর্ণ উন্মাদ অবস্থায় তাকে উদ্ধার করা হয়। সুদীর্ঘ ২৫ বছরের কোন এক অজ্ঞাত মুহূর্তে আকাটা নখর দিয়ে দেয়াল আঁচড়ে-আঁচড়ে মেলানি দু’ একটি অসংলগ্ন কথা লিখে রেখেছেন: ‘সুন্দরের জন্ম দিতে হলে- প্রেম নয়, স্বাধীনতা নয়-অবিনাশী একাকিত্বের ভিতর এক ভূগর্ভস্থ কারাকক্ষে তোমাকে বাঁচতে হবে মরতে হবে......’ এই কথাগুলো ভিতরেই কি কোথাও উন্মোচিত হয়েছেন প্রকৃত মিশেল ফুকো। ’ গর্ডন ই বিগেলো লিখেছেন, ঈশ্বর থেকে, তার চারপাশের মানুষ থেকে এবং নিজের থেকে বিচ্ছিন্ন মানুষের জন্য শেষে শূন্যতা ছাড়া আর কি পড়ে থাকে? এলিয়ট তার Hollowman ফাঁপা মানুষ এ লিখেছেন- Shape without form, shade without color Paralyzed force, gesture without motion জীবনের সংক্ষিপ্ততা শেক্সপীয়ারের চিন্তাকে আছন্ন করে রেখেছিল। তার সবচেয়ে বিখ্যাত উক্তি ছিল- টুবি অর নট টু বি। হ্যামলেটের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে সেই হাহাকার- একদিন আমরা এই পৃথিবীর ওপর হেঁটে চলে বেড়াচ্ছি তো পরেরদিন হারিয়ে যাচ্ছি, মিশে যাচ্ছি মাটিতে।
No comments