রূপরেখা তৈরির আগেই চুক্তি বাস্তবায়নের চাপ
বাজার করার আগেই অতিথি চলে এলে গৃহকর্তার যে অবস্থা হয়, মরক্কোর মারাক্কেশে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের অবস্থাও হয়েছে অনেকটা তাই। প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরির আগেই তা বাস্তবায়নের দাবি উঠেছে। মারাক্কেশে ২২তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের কারিগরি অধিবেশন গতকাল সোমবার শেষ হয়েছে। আজ মঙ্গলবার শুরু হবে রাষ্ট্রনেতাদের নিয়ে উচ্চপর্যায়ের আলোচনা। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৫৪টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা এতে বক্তৃতা করবেন। সবার আশা, প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা এই সম্মেলন থেকেই শুরু করার তাগিদ দেবেন তাঁরা। মারাক্কেশে সাত দিন ধরে ১৯০টি দেশের জলবায়ু সমঝোতাকারী প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরির চেষ্টা চালিয়েছেন। কিন্তু বিশ্বনেতারা গত বছরের সম্মেলনে ২০২০ সালের মধ্যে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের রূপরেখা তৈরির সময়কাল ঠিক করেছিলেন।
তাঁরা ভেবেছিলেন, রাষ্ট্রগুলো ওই চুক্তি অনুমোদন করতে বছর তিনেক সময় নেবে। তবে গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনেই ৪০টি দেশ প্যারিস চুক্তি অনুমোদন করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চুক্তিতে আদৌ স্বাক্ষর করবে কি না, তা নিয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ যেমন চীন, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) রাষ্ট্রগুলোর সংশয় ছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা দেশটিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল শুরু হওয়ার আগেই নির্বাহী আদেশে ওই চুক্তি অনুমোদন দেন। ১৯৯৭ সালে প্রথম জলবায়ু চুক্তি কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষরের পর যুক্তরাষ্ট্র তা অনুমোদন করেনি। তাই প্যারিস চুক্তির শর্তের মধ্যে ছিল, কোনো দেশ চুক্তি অনুমোদনের চার বছরের মধ্যে তা বাতিল করতে পারবে না। ফলে যুক্তরাষ্ট্র অনুমোদনের পর বিশ্বে এখন সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশ চীন ও ভারত তা অনুমোদন করে। অনুমোদন করে আরও শতাধিক রাষ্ট্র। আর মারাক্কেশ আলোচনার সাত দিনের মাথায়, গতকাল পর্যন্ত ১০৯টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম জ্যেষ্ঠ সদস্য অধ্যাপক মিজার আর খান প্রথম আলোকে বলেন, মারাক্কেশে মোট ১১টি সুনির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর যে আলোচনাগুলো চলছে, সে জন্য আরও দুই বছর রয়েছে বলে ভাবা হয়েছিল। এখন শতাধিক দেশ চুক্তি অনুমোদন করায় তা এই সম্মেলন থেকেই কার্যকরের চাপ তৈরি হয়েছে।
কিন্তু কোনো বিষয়ে আলোচনায় এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। এই পরিস্থিতিতে মারাক্কেশ আলোচনার ফল কী হবে, তা নিয়ে রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধি, জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এবং নাগরিক সংগঠনগুলো অপ্রস্তুত অবস্থায় রয়েছে। জলবায়ু বিপন্ন রাষ্ট্রগুলো সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে দ্রুত অর্থছাড় এবং সরাসরি অর্থপ্রাপ্তি নিশ্চিত করার দাবি তুলছে। কিন্তু সবুজ জলবায়ু তহবিলে এ পর্যন্ত মাত্র ১০০ কোটি ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে উন্নত দেশগুলো। সেই অর্থ কীভাবে দেওয়া হবে, তার কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিকাঠামো তৈরি হয়নি। গতকাল বাংলাদেশের পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের সচিব কামালউদ্দিন আহমেদ, মরক্কোর পরিবেশমন্ত্রী হাকিমা হেল হইতে, জার্মানির পরিবেশ ও প্রকৃতি সংরক্ষণমন্ত্রী বারবারা হেনড্রিকস, ফ্রান্সের প্রতিবেশ ও জ্বালানিমন্ত্রী সেগোলিয়েনে রয়েলসহ ১২ জন মন্ত্রী এক যৌথ বিবৃতি দেন। তাঁরা প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, প্যারিস চুক্তি তাঁদের পরিবেশ, জলবায়ু নিরাপত্তা ও অর্থনীতি টিকিয়ে রাখার পূর্বশর্ত। আজ রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানদের উচ্চপর্যায়ের আলোচনা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্যারিস চুক্তিবিষয়ক নীতিনির্ধারণী ফোরামের (সিএমএ) সভা শুরু হতে যাচ্ছে। এর আওতায় প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন রূপরেখা (আপা), জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি (লস অ্যান্ড ড্যামেজ), অভিযোজন তহবিল, সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ), ওয়ারশো আন্তর্জাতিক ম্যাকানিজমের (যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসনের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে) বিষয়গুলো চূড়ান্ত করে সিএমএ কমিটির কাছে জমা দিতে হবে।
কিন্তু গত সাত দিনের আলোচনায় এ বিষয়গুলোর ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য যুগ্ম সচিব নুরুল কাদির প্রথম আলোকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতির আলোচনায় আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিবাসিত ব্যক্তিদের অধিকারের বিষয়টি তুলে ধরছি। চেষ্টা করছি, যাতে তা প্যারিস চুক্তির রূপরেখায় স্থান পায়।’ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে এখনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আসেনি। এই প্রতিনিধিদলের বেশির ভাগ সদস্যই ওবামা প্রশাসনের সদস্য। ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে চুক্তি বাতিল করে দেবেন—এই আশঙ্কা বিশ্ববাসীর মতো তাঁদের মধ্যেও দেখা গেল। অনানুষ্ঠানিক আলোচনাগুলোতে তাঁরা হতাশা এবং সম্মেলনে তাঁদের অবস্থান নিয়ে দ্বিধার কথা জানিয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করেননি। বিশ্ব জলবায়ু রাজনীতির এত সব বড় বিষয়ে হয়তো বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর খুব বেশি কিছু করার নেই। তবে তারা তাদের জলবায়ু বিপন্নতার কথা তুলে ধরবে, বেশি করে তহবিল ও প্রযুক্তি চাইবে। এটাই বলছেন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা নাগরিক সংগঠনের হয়ে সম্মেলনে আসা সংগঠনগুলোর প্রতিনিধি রেজাউল করিম চৌধুরী। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক মির্জা শওকত বলেন, ‘আমরা ইতিমধ্যে সবুজ জলবায়ু তহবিল থেকে সরাসরি অর্থায়ন চেয়েছি। অভিযোজন তহবিল থেকে নিয়মিত অর্থ দেওয়ার দাবি তুলেছি।’
No comments