কেন বন্ধু দিবস

হঠাৎ রাস্তায় অফিস অঞ্চলে হারিয়ে যাওয়া মুখ চমকে দিয়ে বলে বন্ধু কী খবর বল কত দিন দেখা হয়নি। পৃথিবীর অন্যতম নিষ্পাপ সম্পর্কের একটি হল ‘বন্ধুত্ব’। একে অন্যের সুখে-খুশিতে লাফিয়ে ওঠার; একে অন্যের দুঃখে পাশে দাঁড়ানোর। মন খুলে কথা বলা, হেসে গড়াগড়ি খাওয়া আর চূড়ান্ত পাগলামি করার একমাত্র আধার এ ‘বন্ধুত্ব’। বন্ধুত্ব কোনো বয়স মেনে হয় না, ছোট-বড় সবাই বন্ধু হতে পারে। তবে হ্যাঁ, বয়সের ব্যবধানের কারণে ছোটদের প্রতি স্নেহ আর বড়দের প্রতি সম্মানটা থাকা অত্যাবশ্যকীয়। বন্ধুত্বের মধ্যে যে জিনিসটা থাকা চাই তা হল ‘ভালোবাসা’। আত্মার সঙ্গে আত্মার টান থাকতেই হবে। আজকাল আধুনিকতার স্পর্শে এ ‘বন্ধু’ শব্দটির বদলে মানুষ ইংরেজি ‘ফ্রেন্ড’ শব্দটিতেই বেশি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তা সত্ত্বেও বাংলা ‘বন্ধু’ শব্দটির মাঝে যে আবেদন আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। ছোটকালে বাংলা ব্যাকরণে আমরা সবাই শিখেছি- বন্ধু (পুংলিঙ্গ) ও বান্ধবী (স্ত্রীলিঙ্গ)। তবে নারী-পুরুষ উভয়ের ক্ষেত্রেই ‘বন্ধু’ শব্দটি প্রয়োগযোগ্য।
বন্ধুত্বের জন্য কোনো ক্ষণ লাগে না। তবুও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে একটি নির্দিষ্ট দিনে ‘বন্ধু দিবস’ পালন করা হয়ে থাকে। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও প্রতিবছরের আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে বন্ধু দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। আমাদের দেশে এ দিবসটির প্রচলন বিগত শতাব্দীর শেষাংশে হলেও এখন তা সারা দেশের মানুষের মাঝে ছড়িয়ে গেছে। বন্ধু দিবসের সূচনা নিয়ে ভিন্ন দুটি তথ্য আছে। একপক্ষের মতে, বন্ধু দিবসের ধারণা ও উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানে ১৯১৯ সালে সর্বপ্রথম আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে প্রথম ‘বন্ধু দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়েছিল। এ দিনটির মধ্য দিয়ে পরবর্তী সময়ে তারা নিজেদের মধ্যে কার্ড, উপহার বিনিময় করত। আর তখন থেকেই নাকি বন্ধু দিবসের উৎপত্তি। অন্যপক্ষের মতে, ১৯৩৫ সালে আমেরিকান সরকার এক ব্যক্তির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ঘটনার প্রতিবাদে পরদিন ওই ব্যক্তির এক বন্ধু আত্মহত্যা করে। সেই দিনটি ছিল আগস্ট মাসের প্রথম রোববার। তখন থেকেই জীবনের নানা ক্ষেত্রে বন্ধুদের অবদান আর আত্মত্যাগকে সম্মান জানাতে আমেরিকান কংগ্রেস ১৯৩৫ সালের আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে ‘বন্ধু দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। পরে বেশকিছু দেশ বন্ধু দিবসের সংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহণ করে। এভাবেই বন্ধু দিবস পালনের প্রসার ঘটতে থাকে।
বন্ধু দিবসের সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে হলুদ গোলাপ আর ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডের মতো বিষয়গুলোও। এ ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ডের ধারণাটিও এসেছে আমেরিকা থেকে। আমেরিকার আদিবাসীদের মধ্যে অনেক আগে থেকেই বন্ধুত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ব্যান্ড দেয়ার রীতি চালু ছিল। তারা তাদের বন্ধুদের জন্য নিজেরাই ব্যান্ড তৈরি করত। আর যাকে ব্যান্ড দেয়া হতো, সে কখনোই ব্যান্ডটি খুলে রাখত না। অপরদিকে, বন্ধুত্বের প্রতীক হলুদ গোলাপের হলুদ রংটি হল আনন্দের প্রতীক। হলুদ গোলাপ মানে যে শুধু আনন্দই তা কিন্তু নয়; এটি প্রতিশ্র“তিরও প্রতীক। এমন তথ্যও রয়েছে যে, বন্ধুদের মাঝে জিনগত সাদৃশ্য থাকে! এক গবেষণার মাধ্যমে একদল বিজ্ঞানী এ তথ্য জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের ফার্মিংহাম হার্ট স্টাডির ওই গবেষণায় বলা হয়, মানুষ নিজের সঙ্গে জিনগত সাদৃশ্যপূর্ণ মানুষকে সাধারণত বন্ধু হিসেবে বাছাই করে থাকে। আর সেই মিল এতটাই বেশি যে তা অনেকটা কাজিন ভাইবোনের জিনগত বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে তুলনীয়। জানা যায়, গবেষকরা ১ হাজার ৯৩২ মানুষের ওপর জরিপ চালান। আত্মীয়দের বাইরে তাদের বন্ধু-বান্ধব ও অপরিচিত ব্যক্তিদের সঙ্গে জিনগত বৈশিষ্ট্যের তুলনামূলক বিশ্লেষণও করা হয়। একই সামাজিক পরিমণ্ডলের মানুষের জিনে প্রায় এক শতাংশ মিল পাওয়া যায়। আর অনাত্মীয় বন্ধুদের মধ্যে জিনগত মিল অনেকটা দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের সঙ্গে বিদ্যমান মিলের মতো। প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস সাময়িকীতে এ গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তবে গবেষণায় অংশগ্রহণকারী মানুষের অধিকাংশই ছিল শ্বেতাঙ্গ।
কালে কালে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বদলাচ্ছে। শোনা যায়, এখনকার শিশুদের বাসা থেকে বলে দেয়া হয় ভালো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক তো যে কোনো ধরনের স্বার্থের ঊর্ধ্বে। স্বার্থান্বেষী মানুষ কখনও কারও বন্ধু হতে পারে না। যদি তিনি কারও বন্ধুও হন তবে তিনি ‘সময়ের বন্ধু’; সময় ফুরোলেই শেষ। বসন্তের কোকিল অর্থাৎ সুসময়ের বন্ধুরা মানসিক দীনতায় ভোগে। বন্ধুত্বের সত্যিকার আনন্দ থেকে এরা বঞ্চিত। বন্ধুত্বের ভালোবাসায় কোনো শর্ত বসে না। দুঃসময়ে হাত বাড়িয়ে দিতে সময় লাগে না। বন্ধুর প্রয়োজনে এক দৌড়ে ছুটে যাওয়াই ‘বন্ধুত্ব’। এবার একটু অন্য কথায় আসি। ধরুন, একটি সুযোগ পেলেন অতীতে ফিরে যাওয়ার। জীবনের কোন পর্যায়ে ফিরে যাবেন? শৈশব নাকি কৈশোরে? জানি, বেশিরভাগ মানুষই নিজ নিজ শৈশবের সময়টাতে ফিরে যেতে চাইবেন। কারণ, বয়স ২০ পেরিয়ে ২২ কিংবা ২৩ এলেই মনটা কেমন যেন পেছনে তাকাতে চায়। ফিরে যেতে চায় সেই চেনা শৈশবে। সময় যত বাড়তে থাকে শৈশবে ফিরতে চাওয়ার আকাক্সক্ষাটাও সমান তালে মনে ঘুরতে থাকে। সশরীরে তো আর অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না; কিন্তু মনে মনে ঘুরে আসতে দোষ কী? মানুষ এ জন্যই হয়তো স্মৃতিভ্রমণ করে। খুব আবেগী মানুষ হলে চোখে জল এসে যেতেই পারে। সবাই জানে, স্কুল-বন্ধুদের ওপর কোনো বন্ধু হয় না। স্কুলের বন্ধুরা খুব আপন হয়। একজন মানুষকে খুব বেশি জানার সুযোগ হয় স্কুল বন্ধুদেরই। বেশ একটা লম্বা সময় একসঙ্গে সবাই পাড়ি দিয়ে থাকে। মনের টানটাও কিন্তু কম নয়। জীবনে ভালো বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। এ পৃথিবীতে সব সম্পর্কই যত্নের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। বন্ধুত্বের সম্পর্কও এর ব্যতিক্রম নয়। ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পাওয়া যেমন কঠিন, এর চেয়েও বেশি কঠিন এ সম্পর্ককে রক্ষা করা। নিজে ভালো হওয়া খুব জরুরি। মনকে শুদ্ধ রাখা প্রয়োজন। ভালো মনের মানুষরা ভালো বন্ধু হয়ে থাকে।
এ পৃথিবীতে সবার বন্ধুত্ব অমর হোক। ভালো থাকুক বন্ধুত্ব।
প্রীতি রাহা : প্রাবন্ধিক
preetiraha@ymail.com

No comments

Powered by Blogger.