হাইকোর্টের রায়ে আশার আলো
আইন পেশা, মহৎ পেশা। অভিজাত পেশা। বিশ্বজুড়ে রাজকীয় পেশা হিসেবে স্বীকৃত। তবে বাংলাদেশে এ পেশা যেন দিন দিন তার জৌলুস আর আভিজাত্য হারাতে বসেছিল। হারাতে বসেছিল তার গৌরবের মুকুট। এর কারণ দেশের ক্রমাবনতমুখী আইন শিক্ষার মান। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগগুলোর শিক্ষার মান নিয়ে কখনও সেভাবে গুরুতর আপত্তি ওঠেনি। এর কারণ যতটা না ‘যোগ্য শিক্ষক’, তার চেয়ে বেশি ‘যোগ্য শিক্ষার্থী’। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এলএলবি (অনার্স) কোর্সের প্রথম বর্ষে আসন সংখ্যা অনূর্ধ্ব ১০০০। চাহিদার তুলনায় এ সংখ্যা খুবই নগণ্য। ফলে ভর্তিচ্ছু মেধাবী শিক্ষার্থীদের এখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। যোগ্যতার চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সীমিত কিছু মেধাবী শিক্ষার্থীই কেবল এখানে পড়ার সুযোগ পায়। মানসম্পন্ন শিক্ষার্থী ভর্তি এবং মোটামুটি মানসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষাদানের কারণে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষার মান কখনও অতটা প্রশ্নবিদ্ধ হয়নি। বিপরীতে ছিল জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত আইন কলেজে ২ বছরের এলএলবি (পাস) কোর্স। বাছ-বিচারহীনভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি, স্বল্পমেয়াদি শিক্ষাকোর্স, খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে পাঠদান- ইত্যাদি কারণে এ শিক্ষার মান ক্রমশ ছিল পড়তির দিকে।
তারপর ১৯৯২ সালে এল বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন। তাতে দেশের আনাচে-কানাচে গজিয়ে উঠল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। যত্রতত্র কোচিং সেন্টারের মতো দেখা দিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, আইন বিভাগ। স্থানে স্থানে গজাল কোনো কোনোটির শাখা-প্রশাখা। ওই শাখা ক্যাম্পাসের মালিকানা বা কর্তৃত্ব নিয়ে আবার মারামারি, কামড়া-কামড়ি, কোর্ট-কাচারি। সব মিলিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে যখন চূড়ান্ত নৈরাজ্য, তখন ২০১০ সালে এসে ১৯৯২ সালের আইনটা বাতিল করা হল। করা হল নতুন আইন। তাতেও অবস্থার খুব একটা হেরফের হল না। ততদিনে পাস করে বেরিয়েছে হাজার হাজার আইন গ্র্যাজুয়েট। কারও হাতে চার বছরের অনার্স সার্টিফিকেট। কারও হাতে ২ বছরের পাস কোর্সের সার্টিফিকেট। হাতেগোনা কয়েকটা ছাড়া বেশিরভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়তে যোগ্যতার পরীক্ষা দিতে হয় না। অর্থই এখানে প্রধান যোগ্যতা। টাকার বিনিময়ে এখানে যে কেউ আইনের স্নাতক/স্নাতকোত্তর কোর্সে ভর্তি হতে পারে। শিক্ষার এ অবাধ বাণিজ্যিকীকরণে বিচ্ছিন্নভাবে কোথাও কোথাও বাণিজ্যের সঙ্গে গুণগত মানের সংযোগ যে ঘটেনি, তা নয়। কিন্তু দুর্বল অবকাঠামো, কম যোগ্যতাসম্পন্ন স্থায়ী শিক্ষক, অনুন্নত পাঠদান-সব মিলিয়ে সিংহভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষার মান ছিল বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। তাছাড়া, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমিত সংখ্যক আইনে স্নাতক/স্নাতকোত্তরের বিপরীতে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত আইন কলেজ থেকে বছর বছর বের হচ্ছে বিপুলসংখ্যক স্নাতক/স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী।
তাতে দেশের আইন শিক্ষার সামগ্রিক চিত্রটা দিন দিন রুগ্ন থেকে রুগ্নতর হবে- এটাই তো স্বাভাবিক। তবে হালে এ চিত্র বদলের একটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে; দেশের জরাগ্রস্ত আইন শিক্ষাব্যবস্থা আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা জাগাচ্ছে। তার কারণ সম্প্রতি হাইকোর্টের দেয়া একটি যুগান্তকারী রায়। দারুল ইহসান প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিকে কেন্দ্র করে ২০০৬-২০১৩ পর্যন্ত সময়ে ১৩টি রিট করা হয়। রিটগুলোর চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি মো. রেজাউল হক ও বিচারপতি খুরশীদ আলম সরকার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ১৩ এপ্রিল রায় ঘোষণা করেন। তবে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পায় কয়েকদিন আগে। ১২৬ পৃষ্ঠার ওই মাইলফলক রায়ে দারুল ইহসানসহ সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও আইন কলেজে আইন শিক্ষাকার্যক্রম বিষয়ে আদালত ৩৩টি নির্দেশনা দেন। রায়ে পাঁচটি ডিগ্রিকে বৈধ আইনের ডিগ্রি ('A degree in law') হিসেবে ঘোষণা করা হয়- ১. পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি (অনার্স) কোর্স, ২. বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ পাওয়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি (অনার্স) কোর্স, ৩. বাংলাদেশ বার কাউন্সিল অনুমোদিত বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি (অনার্স) কোর্স, ৪. ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য কোনো বিদেশী এলএলবি (অনার্স) বা আইনের ওপর অন্য কোনো বিদেশী কোর্স এবং ৫. ২০২০ সাল পর্যন্ত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ২ বছরের এলএলবি (পাস) কোর্স। ২০২০ সালের পর এ ডিগ্রি অবৈধ। আবার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে করা ২ বছরের এলএলবি (পাস) কোর্সও কোনো ‘আইনের ডিগ্রি’ নয়। দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় (সব শাখাসহ) ও অন্যান্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আউটার ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন শিক্ষাকার্যক্রম সম্পর্কে রায়ে বলা হয়, এখন থেকে বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের (সংক্ষেপে ‘বার’) ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ ছাড়া কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এলএলবি (অনার্স) কোর্স চালাতে পারবে না। তজ্জন্য বারের অ্যাকাউন্টে অফেরতযোগ্য ১০ লাখ টাকা এবং ১০ জন পূর্ণকালীন স্থায়ী শিক্ষকের সিভি (একাডেমিক সনদসহ) জমা দিয়ে আবেদন করতে হবে। আবেদনের সঙ্গে ‘বারের ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের বাইরে কাউকে আইন কোর্সে ভর্তি করাবে না’ মর্মে একটা লিখিত অঙ্গীকারনামা দিতে হবে।
আবেদনের তিন মাসের মধ্যে ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ দেয়া হবে। অবশ্য তার আগে সুপ্রিমকোর্টের দু’জন মাননীয় বিচারক ওই বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনে যাবেন। পরিদর্শনকালে তারা আইনের ছাত্রদের জন্য পাঁচটি উপযুক্ত রুম, ১০ জন পূর্ণকালীন, স্থায়ী এবং দক্ষ শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্ট আইন বিভাগের সার্বিক পরিবেশ আইনের স্নাতক তৈরির জন্য আদর্শ কিনা ইত্যাদি খতিয়ে দেখবেন। পরিদর্শনের পর তারা ইতিবাচক প্রতিবেদন দিলে, তবেই কেবল ওই সার্টিফিকেট মিলবে। যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে এ কোর্স চালু আছে, তাদেরও ১ সেপ্টেম্বরের মধ্যে একই প্রক্রিয়ায় ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেটের’ জন্য আবেদন করতে হবে। ভবিষ্যতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এ কোর্স চালাতে চাইলে আগেই এ সার্টিফিকেট নিতে হবে। নইলে ইউজিসি (বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন) ওই বিশ্ববিদ্যালয়কে আইন কোর্স চালানোর অনুমতি দেবে না। তাছাড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখন থেকে সরাসরি এলএলবি (অনার্স) কোর্সে কাউকে ভর্তি করাতে পারবে না। তজ্জন্য বার কাউন্সিল প্রতিবছর সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভর্তি পরীক্ষা নেবে। পরীক্ষার ধরন হবে অ্যাডভোকেটশিপ পরীক্ষার মতো। গঈছ থাকবে। সঙ্গে লিখিত পরীক্ষাও হবে। এইচএসসিতে যারা জিপিএ-৫ এবং ইংরেজিতে ৭০ নম্বর বা ওঊখঞঝ-এ ৬ ব্যান্ড পেয়েছে কিংবা ইংলিশ মিডিয়ামে বি-গ্রেডে অ লেভেল পাস করেছে, তারাই কেবল এ পরীক্ষায় আবেদন করতে পারবে। পরীক্ষা শেষে বার একটি মেধা তালিকা প্রকাশ করবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ওই তালিকা থেকেই শিক্ষার্থী ভর্তি করাবে। ভর্তি পরীক্ষা শেষে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে এলএলবি (অনার্স) প্রথম বর্ষের ছাত্র তালিকা বারে পাঠাতে হবে। তাছাড়া রায়ে বলা হয়, এক শিক্ষাবর্ষে ১০০’র বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করানো যাবে না। ২ বছর মেয়াদি কোর্স চালানো যাবে না। রায়ে ২০২০ সালের পর ২ বছর মেয়াদি এলএলবি পাস কোর্স বন্ধ করতে নির্দেশ দিয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে বলা হয়; তার পরিবর্তে ৪ বছর মেয়াদি এলএলবি (অনার্স) চালু করতে হবে। যেসব কলেজে এখনও ওই ২ বছরের কোর্স চলছে, সেখানে কমপক্ষে ১০ জন স্থায়ী পূর্ণকালীন শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তজ্জন্য প্রয়োজনে ওখানকার স্থায়ী শিক্ষকদের শিক্ষা সনদসহ সিভি তলব করা হবে। অনলাইন ভর্তি সিস্টেম চালু করতে হবে।
কোনো আইন কলেজে বছরে ১০০’র বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা যাবে না। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ১ মাসের মধ্যে হাইকোর্টের এ নির্দেশনার বিষয়টি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রত্যেক আইন কলেজকে জানাবে। রায়ে ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ ছাড়া এলএলবি (অনার্স) কোর্সের অনুমোদন না দিতে ইউজিসিকে নির্দেশ দেয়া হয়। আরও বলা হয়, ইউজিসি এ আদেশপ্রাপ্তির তিন দিনের মধ্যে ‘ক্লিয়ারেন্স সার্টিফিকেট’ গ্রহণের বিষয়টি জানিয়ে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে নোটিশ ইস্যু করবে। রায়ে সরকারকে অনতিবিলম্বে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় (সব শাখাসহ) এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব আউটার ক্যাম্পাস বন্ধের নির্দেশ দেয়া হয়। এ রায় বাস্তবায়িত হলে নিশ্চিতভাবে আইন শিক্ষার গুণগত মান বহুলাংশে বাড়বে। আইন পেশা ও আইন সংশ্লিষ্ট সবার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে। জানি না, বাস্তবায়নটা পুরোপুরি হবে কিনা। তবে আশার আলো দেখছি। ইতিমধ্যে সরকার দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। বার কাউন্সিল ‘আইন বিষয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিসংক্রান্ত সতর্কতামূলক ’ বিশেষ গণবিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। আমাদের প্রত্যাশা, মহামান্য আপিল বিভাগও জনস্বার্থে এ রায় বহাল রাখবেন।
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
aftabragib@yahoo.com
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী রাগিব : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
aftabragib@yahoo.com
No comments