শান্তি হারানো এক দেশ by উইলিয়াম বি মাইলাম
আমার বন্ধু আলী রীয়াজ কারেন্ট হিস্টরির
এপ্রিল সংখ্যায় ‘বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সংকট’বিষয়ক এক চমৎকার নিবন্ধ
লিখেছেন। এটা আমাকে মনে করিয়ে দেয় হারানো বা ক্ষতি বিষয়ে এ ই হাউসম্যানের
লেখা এক স্মৃতিকাতর কবিতার কথা। কবিতাটি হয়তো সুখের স্মৃতির, কিন্তু আরও
বেশি করে তা দুঃখের। সুযোগ হারানো বা ভুল সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তৃপ্তির
বোধ হারানো। রীয়াজ এর সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের অর্থনৈতিক ও
সামাজিক অগ্রগতির যোগসূত্র স্থাপনের মাধ্যমে পরেরটির কথাই বলেছেন।
এটাই হলো বিষয়টার মূল। দেশের রাজনীতিকে যে খোপের মধ্যে রাজনীতিকেরা ঠেসে ঢুকিয়েছেন, তাতে বাংলাদেশের গত দুই দশকের অর্থনৈতিক অর্জন নিঃসন্দেহে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। অংশত, এটা সম্পন্ন হবে কয়েক দশক ধরে আটকে থাকা একটি রাজনৈতিক শক্তিকে অবমুক্ত করার মধ্য দিয়ে। একদলীয় সরকার (বিরোধী দলকে কেনাবেচা করা য়ায়, রীয়াজ এই প্রহসনের কথা ভালোভাবেই বলেন) অনেক কিছুই ছুড়ে ফেলেছে, অধিকাংশ মানুষের চোখে যা ছিল সরকারের ম্যান্ডেট। দুটি কাজ সম্পন্ন করা এবং আরেকটি নির্বাচন আহ্বান করা এই মারাত্মক হানাহানির অবসান ঘটাবে। কাজ দুটি হলো: ১. বিশ্বাসযোগ্য দ্বিতীয় নির্বাচন আয়োজনে বিরোধী দলের সঙ্গে সমঝোতায় আসা, ২. স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর (বিজেআই) যেসব সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানকে সহযোগিতা করেছেন, তাঁদের বিচার সম্পন্ন করা।
আওয়ামী লীগ সরকার জনপ্রিয় দাবিকে উপেক্ষা করে কোনো নির্বাচন ছাড়াই ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার পরিকল্পনা করছে। এর লক্ষণও দেখা যাচ্ছে। প্রধান বিরোধী দলকে কোণঠাসা করতে এর কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করেই যাচ্ছে সরকার। কোনো বিরোধী পক্ষকেই শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করতে দিচ্ছে না (বিরোধী দলের সমর্থনকারী মিডিয়াগুলোকেও ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে কিংবা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে)। সরকারপন্থী বুদ্ধিজীবীরা গণতান্ত্রিক একনায়কত্বের সুর তুলছেন। এটা এক সোনার পাথরবাটি। এর আগেও স্বৈরাচারী শাসকদের মুখ থেকে এমন কথা আমরা শুনেছি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা, বিশেষত, জোর করে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। আর আওয়ামী লীগের নেতারা স্থানীয় নির্বাচনের শেষ ধাপে নিজেদের বিজয়ে বুক ফোলাচ্ছেন; যদিও প্রকাশ্যেই তাঁদের ব্যালটে সিল মারতে দেখা গেছে।
এসব প্রক্রিয়া যে গতিতে এগোচ্ছে, তাতে ২০১৯ সালের মধ্যে শক্তিশালী আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে কোনো নিয়মিত বিরোধী দলই থাকবে না। আবার সুশীল সমাজ বা তৃতীয় শক্তি, ডানঘেঁষা উদারপন্থীদের বহুকথিত ও প্রত্যাশিত এই মহৌষধও তখন পাওয়া যাবে না। ঝুঁকি দেখলে আওয়ামী লীগ আরও কঠিন পদক্ষেপ পরে নিতে পারে, আর তা হলো একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম। বিরোধী দলের কোনো নাম-নিশানাই সেখানে থাকবে না।
কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার হচ্ছে, আওয়ামী লীগ (এবং ভারত সমর্থন করেছিল) ক্ষমতায় এসেছিল চরমপন্থা দমনের কথা বলে। কিন্তু রীয়াজসহ অন্য পর্যবেক্ষকেরা বিশ্বাস করেন, সরকারের কর্তৃত্ববাদী মানসিকতা ও ক্রমবর্ধমান স্বৈরাচারী কার্যক্রম ‘চরমপন্থীদের উসকে দেবে’। তিনি সঠিক; আমি জানি, তিনি ‘চরমপন্থী’ শব্দটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে ব্যবহার করেছেন। হ্যাঁ, বাংলাদেশে কিছু চরমপন্থী (জঙ্গি) আছেন, সরকারের কার্যক্রম তাঁদের আরও আন্দোলিত করবে এবং এতে তাঁদের দলের সদস্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া গতি পাবে। কিন্তু কিছু চরমপন্থী আছেন, যাঁরা জঙ্গি নন। তাঁদের সংখ্যা শুধু বেশিই নয়, তাঁরা অধিকতর বিপজ্জনকও বটে। তাঁরা হচ্ছেন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যকার চরমপন্থী। দুই প্রধান দলের মধ্যেই তাঁরা আছেন, তাঁরা তাঁদের নেত্রীদ্বয়কে সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে বা ক্ষমতা থেকে টেনে নামাতে আরও কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করতে বাধ্য করবেন (বিরোধী দলের চরমপন্থীরা আত্মগোপনে চলে যেতেও বাধ্য হতে পারেন)। অন্য কোনো উপায় না পেয়ে তাঁরা আরও বেশি মারমুখী হতে পারেন।
পরিহাস হচ্ছে, যে দলকে আওয়ামী লীগ ধ্বংস করতে চায়, সেই দলটিই হয়ে উঠতে পারে তাদের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী পর্দার আড়ালে অপেক্ষা করছে। বড় দুই দলের দুর্নীতি ও দলবাজিতে ত্যক্ত-বিরক্ত মানুষ জামায়াতের দিকে ঝুঁকছে। ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের আগে স্থানীয় নির্বাচনের প্রথম ভাগে জামায়াত অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে। লোকের মনে শঙ্কা আছে, নবজন্ম পেয়ে ও নবনামে পুনর্গঠিত জামায়াত যুদ্ধাপরাধের কলঙ্ক মোচন করতে পারলে প্রধান বিরোধী দলেও পরিণত হতে পারে। আমার মনে হয় না জামায়াতের ধর্মীয় দর্শন এই দেশের অধিকাংশ ভোটারের মন জয় করতে পারবে। কিন্তু এই পুনর্গঠিত দল যদি সৎ নেতৃত্বের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে গণেশ উল্টে যেতে পারে। আমি শুনেছি, আওয়ামী সরকারকে অপছন্দ করে এমন বাংলাদেশিরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন: ‘এ ছাড়া আমরা আর কোথায় যেতে পারি?’
এক্সপ্রেস ট্রিবিউন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
উইলিয়াম বি মাইলাম: বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত।
No comments