পার্বত্য চট্টগ্রামের ভূমি বিরোধ : সমস্যা ও সম্ভাবনা
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন
(গতকালের পর)
সুজার সামরিক প্রধান ফতেহ খান সপরিবারে সুজা হত্যার দুঃসংবাদ নিয়ে আলীকদম থেকে দিল্লি যান। এ খবর শুনে আওরঙ্গজেব ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সুবেদার শায়েস্তা খানকে আরাকান রাজ্য আক্রমণের জন্য পাঠান। শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ খানও আরাকান জয়ে তার সঙ্গী হন। মোগল গভর্নর শায়েস্তা খান বাংলায় আগমনের পর উপজাতি বিদ্রোহীদের পরাস্ত করার জন্য আত্মনিয়োগ করেন। তিনি আরাকান বাহিনীর হুমকি পর্যালোচনা করে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার ওপর মনোনিবেশ করেন। ধীরে ধীরে তিনি জাহাজের সংখ্যা বাড়িয়ে নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।
অপরদিকে তিনি সৈন্য ও রসদ দিয়ে আরাকান বাহিনীকে সাহায্য প্রদানকারী ডাচ ও পর্তুগিজ বাহিনীর সমর্থন লাভের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। আরাকান ও পর্তুগিজদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরলে শায়েস্তা খান বেশ লাভবান হন। ওই বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে শায়েস্তা খানের নেতৃত্বাধীন মোগলবাহিনী আরাকানের দখল থেকে প্রথমে সন্দ্বীপ মুক্ত করে। ১৬৬৫ সালের ডিসেম্বরে শায়েস্তা খান আরাকান বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামে সামরিক অভিযান শুরু করে। এ সময় তিনি সীমান্তে নিরাপত্তার জন্য রাঙ্গামাটি শহরসহ পুরানঘর (রাঙ্গামাটির প্রাণকেন্দ্র) এবং কাঠগর (দোহাজারীর সন্নিকটে) এলাকায় সেনা ছাউনি স্থাপন করেন। এ সেনা ছাউনির আশপাশে প্রচুর বাঙালি বসতি স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে, যাদের স্থানীয় উপজাতিরা আদিবাসী বাঙালি বলে জানে। তখন এ অঞ্চল ছিল হিংস্র জীবজন্তুর অভয়ারণ্য, যেখানে সুদূর চীনের পার্বত্য এলাকা থেকে কুকিরা আসত। কুকিরা ছিল বন্যপ্রাণীদের মতোই ভবঘুরে প্রকৃতির এবং তারা ফলমূল সংগ্রহ ও পশু শিকার করে জীবনধারণ করত। পরে আরাকান, মগ ও পর্তুগিজ দস্যুরা চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে আস্তানা গেড়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় লুটতরাজ শুরু করে। শায়েস্তা খানের ঐকান্তিক চেষ্টায় এ দস্যুদের নির্মূল করা হয়।
চট্টগ্রাম বিজয়ের পর উমেদ খান চট্টগ্রামের নবাব হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সেই সময়ে আলী কদমে অবস্থিত মোগল সৈন্যরা উমেদ খানের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে নিয়মিত তুলা কর প্রদান করত। যদিও ১৬৬৬ থেকে ১৭২৪ সাল পর্যন্ত মোগল সেনাপতিরা জমিদারি পরিচালনা করেছে, কিন্তু এদের মধ্যে জালাল খান চট্টগ্রামের নবাবের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে কর দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাই চট্টগ্রামের নওয়াব দ্রুত জালাল খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ফলে জালাল খান আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং মগদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে এক পর্যায়ে মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধের ১৩ বছর পর ১৭৩৭ সালে জালাল খানের সহযোদ্ধা শের মস্ত খান চট্টগ্রামের নবাবের সঙ্গে দেখা করে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেন এবং পদুয়া কোদালা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তিনি সেখানে একটি খামারবাড়ি স্থাপন করলে অনেক মগ ও চাকমা জনগোষ্ঠী এসে বসবাস শুরু করে। সেই সময়ে বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার ভিত্তিতে মোগলরা উপজাতীয়দের ‘দেওয়ান’, ‘তালুকদার’ ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত করেন, যা তাদের বংশধররা এখনও ব্যবহার করে থাকে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক দিনের দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা ছিল। সেই লক্ষ্যে কোম্পানি চট্টগ্রামে দু-দু’বার যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে কারখানা স্থাপনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৭১০ সালে বাংলার নবাব অন্যান্য এলাকার মতো চট্টগ্রাম জেলাকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়। যদিও কোম্পানি দিল্লির বাদশা শাহ আলমের কাছ থেকে ১৭৬৫ সালের পর রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। অতঃপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের জন্য দু’জন রাজা নিয়োগ দেয়। তারা হলেন- চাকমা রাজা শের দৌলত খান এবং আরাকান বংশোদ্ভূত বোমাং রাজা পোয়াং। মগ ও খুমি উপজাতিরা বোমাং রাজার অধীনে থাকে। এ রাজারা রাজস্ব আদায়ের জন্য নিজস্ব পদ্ধতি চালু করেন। যতই দিন যাচ্ছিল, জনগণের ওপর কোম্পানির করের বোঝা ততই বেড়ে যাচ্ছিল যা পরে জনগণের অসন্তোষের কারণ হয়। মোগল বাহিনীর চট্টগ্রাম জয়ের পর সীমান্তের ওপারে অস্থিতিশীলতা ও পুনঃ পুনঃ সিংহাসন পরিবর্তনের কারণে আরাকানের শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরই সুযোগ নিয়ে ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোধপায়া আরাকান জয় করেন। ঠিক এ সময় অনেক মারমা জনগণ নাফ নদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে। এদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন কক্সকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, যার নামানুসারে কক্সবাজারের নামকরণ করা হয়। বোধপায়া কর্তৃক ঐতিহাসিক আরাকান রাজ্য দখলের পর পৃথিবীর মানচিত্র থেকে এ রাজ্যটি একেবারে হারিয়ে যায়। অতঃপর বার্মার সৈন্যরা ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে যা ১৭৮৫ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। পরিণামে অনেক চাকমা জনগণ আরাকান ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় নেয়।
১৮৫৯ থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত কুকি উপজাতীয় সম্প্রদায় বহিরাগতদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে বিপুল লোকজন হতাহত হয়। ১৮৬০ সালে প্রশাসনিক সুবিধাসহ সফলভাবে উপজাতীয় আন্দোলন দমনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে পৃথক করা হয়। ১৮৮১ সালের শেষের দিকে রাঙ্গামাটি শহরের ১৬৫৮ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে চাকমা সার্কেল, বান্দরবানের ১৪৪৪ বর্গমাইল নিয়ে বোমাং সার্কেল এবং ৬৫৩ বর্গমাইল নিয়ে রামগড়ে মং সার্কেল গঠিত হয়। চাকমা সম্প্রদায়ের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মং সার্কেল গঠন করেন বলে জানা যায়। উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য ১৯০০ সালের মে মাসে CHT Regulation 1 of 1900 কার্যকর করার মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলার সার্কেলপ্রধানদের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু এই রেগুলেশনের ৩৪নং ধারা অনুযায়ী যে কোনো ধরনের জমি বন্ধক, বিক্রি, পরিবর্তন ও অধিগ্রহণ জেলা প্রশাসকের এখতিয়ারভুক্ত। যার অর্থ, জেলা প্রশাসকই হচ্ছে জমির প্রকৃত মালিক। ম্যানুয়াল অনুযায়ী সার্কেলপ্রধানের অধীনস্থ হেডম্যান ও কারবারিরা মৌজা ও পাড়ায় রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত, যা সংগ্রহের পর সার্কেলপ্রধান কর্তৃক জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রকৃতপক্ষে তিন সার্কেল প্রধান এবং তাদের অধীনস্থ হেডম্যান ও কারবারিরা হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারের নির্দিষ্ট প্রতিনিধি। ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক সার্কেলপ্রধানদের ওপর কর্তৃত্ব করে থাকেন। আরও পরে ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে, তখন চাকমারা নিজেদের পাকিস্তানি মুসলমানদের চেয়ে ভারতীয় হিন্দুদের নৈকট্য প্রত্যাশা করে এবং উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ভূমির স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সীমানা নির্ধারণী কমিশন চাকমাদের এ সুপ্ত বাসনার মূল্যায়ন করেনি। যাই হোক, ১৯৫৬ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের জন্য তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলী লেকের জমি অধিগ্রহণ করে, যার ফলে প্রায় ৫৪ হাজার একর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়াও সংরক্ষিত বনাঞ্চল বিস্তারের জন্য পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল থেগামুখ, সুবলং ও রাইংখিয়াং এলাকা থেকে ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে উল্লিখিত এলাকার অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে, যা এ এলাকার জনগোষ্ঠীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এসব এলাকার জনগণ এখনও বিশ্বাস করে, তাদের নিজস্ব ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক জটিলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ওই বছরের মার্চে এক রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়সহ কিছু চাকমা জনগণ এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করেন। পরে রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের প্রতি সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করে আমৃত্যু পাকিস্তানে বসবাস করেন। তাই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেক উপজাতি জনগণ ভারতে পলায়ন করে। আর সে সুযোগে দেশে রয়ে যাওয়া উপজাতীয়রা এ অঞ্চলের জমা-জমির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তরুণ প্রতিবাদী পাহাড়ি নেতা এমএন লারমা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন, যা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গৃহীত হয়নি। অতঃপর ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হলে সাংবিধানিক উপায়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে। তাই ১৯৭৬ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ওই সময়ে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। তখন সরকার কিছু ভূমিহীন বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য এলাকায় বসবাসের সুযোগ করে দেয়। পুনর্বাসিত প্রতিটি বাঙালি পরিবারকে ৫ একর করে খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়, যা উপজাতীয়রা আজও নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। যাই হোক, সশস্ত্র আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে বাঙালি পরিবারগুলোকে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে এনে বসবাস করতে দেয়া হয়। এ সুযোগে উপজাতি জনগণ বাঙালিদের ছেড়ে যাওয়া জায়গা-জমি দখল করে বসবাস শুরু করে। এভাবেই পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে।
‘Hill District Council Act 1989’ কার্যকর হওয়ার পর পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে ভূমি সংক্রান্ত যে কোনো ক্রয়-বিক্রয় পরিবর্তন বা অধিগ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়। একই সঙ্গে ‘হিলট্রাক্টস ম্যানুয়েল ১৯০০’ কার্যকর থাকায় ভূমি সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এ এলাকার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় এবং ভূমি সমস্যাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য সবাই নিজ জমা-জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে অগ্রণী হলে বিভিন্ন জায়গায় জাতিগত সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
ইতিমধ্যে সরকার শান্তিচুক্তির আওতায় বেশিরভাগ দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে লক্ষণীয় যে, শান্তি চুক্তির পর পৃথিবীর অনেক দেশেই যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ হয়নি, যেমন সুদান (১৯৭২), সোমালিয়া (১৯৯০), এঙ্গোলা ১ ও ২ (১৯৯১ ও ১৯৯৪) এবং রুয়ান্ডা (১৯৯৩)। এমনকি পার্বত্য চুক্তির বহু বছর আগে স্বাক্ষরিত অ্যাংলো-আইরিশ চুক্তি বাস্তবায়নের দিক থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি অনুযায়ী সব ধরনের মামলা প্রত্যাহারসহ সব বিদ্রোহীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। সর্বমোট ১ হাজার ৯৮৯ জনকে আর্থিক অনুদান প্রদানসহ ৭০৫ জনকে পুলিশ বিভাগে চাকরি দেয়া হয়েছে। ১২ হাজার ২২২টি উপজাতি পরিবারকে ত্রিপুরা থেকে দেশে এনে পুনর্বাসিত করা হয়। ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বর্তমানে জনাব দীপঙ্কর তালুকদার এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সন্তু লারমার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হলেও মহামান্য হাইকোর্টে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে একটি মামলা চলমান থাকায় পরিষদ কার্যত স্থবির। মহামান্য হাইকোর্টে পার্বত্য শান্তিচুক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে মামলা হয়েছে এবং এ জন্য হাইকোর্ট সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা চেয়েছেন। অবশ্য মহামান্য হাইকোর্ট আঞ্চলিক পরিষদ ও সার্কেলপ্রধানদের কতিপয় ক্ষমতা অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সরকার হাইকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করলেও মহামান্য হাইকোর্টে তা স্থগিত করা হয়েছে। এ বিষয়টিসহ আঞ্চলিক নির্বাচনের জন্য আলাদা ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টির স্থায়ী সুরাহা হলেই চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নির্বাচনসহ সবার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যুর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৩২টি বিষয়ের মধ্যে ২২টি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকায় উপজাতি পুলিশদের বদলির বিষয়টি যখন প্রক্রিয়াধীন ছিল, ঠিক তখনই ঢাকায় কতিপয় উপজাতীয় পুলিশ সদস্যের গোলাবারুদ চুরির ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে, যার ফলে বিষয়টি আর এগোয়নি।
ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৯৯ সালে ভূমি কমিশন গঠন করা হয় এবং ‘CHT Land Dispute Settlement Commission Act 2001’ প্রণয়ন করা হয়। ইতিমধ্যে পার্বত্য এলাকা থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ২৩৮টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় জেলা বিচারিক আদালত স্থাপিত হয়েছে। সংসদ সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্যের পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন এবং পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। সরকার ১৯৯৭-এর শান্তি চুক্তির মাধ্যমে উপজাতি সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণসহ সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। (চলবে)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন, এইচডিএমসি, পিএসসি : পার্বত্য এলাকায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কর্মরত
(গতকালের পর)
সুজার সামরিক প্রধান ফতেহ খান সপরিবারে সুজা হত্যার দুঃসংবাদ নিয়ে আলীকদম থেকে দিল্লি যান। এ খবর শুনে আওরঙ্গজেব ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং সুবেদার শায়েস্তা খানকে আরাকান রাজ্য আক্রমণের জন্য পাঠান। শায়েস্তা খানের পুত্র উমেদ খানও আরাকান জয়ে তার সঙ্গী হন। মোগল গভর্নর শায়েস্তা খান বাংলায় আগমনের পর উপজাতি বিদ্রোহীদের পরাস্ত করার জন্য আত্মনিয়োগ করেন। তিনি আরাকান বাহিনীর হুমকি পর্যালোচনা করে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার ওপর মনোনিবেশ করেন। ধীরে ধীরে তিনি জাহাজের সংখ্যা বাড়িয়ে নৌবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি করেন।
অপরদিকে তিনি সৈন্য ও রসদ দিয়ে আরাকান বাহিনীকে সাহায্য প্রদানকারী ডাচ ও পর্তুগিজ বাহিনীর সমর্থন লাভের জন্য প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। আরাকান ও পর্তুগিজদের মধ্যে সম্পর্কের ফাটল ধরলে শায়েস্তা খান বেশ লাভবান হন। ওই বাহিনীর সমর্থনপুষ্ট হয়ে শায়েস্তা খানের নেতৃত্বাধীন মোগলবাহিনী আরাকানের দখল থেকে প্রথমে সন্দ্বীপ মুক্ত করে। ১৬৬৫ সালের ডিসেম্বরে শায়েস্তা খান আরাকান বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামে সামরিক অভিযান শুরু করে। এ সময় তিনি সীমান্তে নিরাপত্তার জন্য রাঙ্গামাটি শহরসহ পুরানঘর (রাঙ্গামাটির প্রাণকেন্দ্র) এবং কাঠগর (দোহাজারীর সন্নিকটে) এলাকায় সেনা ছাউনি স্থাপন করেন। এ সেনা ছাউনির আশপাশে প্রচুর বাঙালি বসতি স্থাপন করে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করে, যাদের স্থানীয় উপজাতিরা আদিবাসী বাঙালি বলে জানে। তখন এ অঞ্চল ছিল হিংস্র জীবজন্তুর অভয়ারণ্য, যেখানে সুদূর চীনের পার্বত্য এলাকা থেকে কুকিরা আসত। কুকিরা ছিল বন্যপ্রাণীদের মতোই ভবঘুরে প্রকৃতির এবং তারা ফলমূল সংগ্রহ ও পশু শিকার করে জীবনধারণ করত। পরে আরাকান, মগ ও পর্তুগিজ দস্যুরা চট্টগ্রাম বন্দরের আশপাশে আস্তানা গেড়ে সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় লুটতরাজ শুরু করে। শায়েস্তা খানের ঐকান্তিক চেষ্টায় এ দস্যুদের নির্মূল করা হয়।
চট্টগ্রাম বিজয়ের পর উমেদ খান চট্টগ্রামের নবাব হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। সেই সময়ে আলী কদমে অবস্থিত মোগল সৈন্যরা উমেদ খানের প্রতি বিশ্বস্ত থেকে নিয়মিত তুলা কর প্রদান করত। যদিও ১৬৬৬ থেকে ১৭২৪ সাল পর্যন্ত মোগল সেনাপতিরা জমিদারি পরিচালনা করেছে, কিন্তু এদের মধ্যে জালাল খান চট্টগ্রামের নবাবের সঙ্গে ঝামেলায় জড়িয়ে কর দিতে অস্বীকৃতি জানান। তাই চট্টগ্রামের নওয়াব দ্রুত জালাল খানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। ফলে জালাল খান আরাকানে আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং মগদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে এক পর্যায়ে মৃত্যুবরণ করেন। যুদ্ধের ১৩ বছর পর ১৭৩৭ সালে জালাল খানের সহযোদ্ধা শের মস্ত খান চট্টগ্রামের নবাবের সঙ্গে দেখা করে সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করেন এবং পদুয়া কোদালা এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন। তিনি সেখানে একটি খামারবাড়ি স্থাপন করলে অনেক মগ ও চাকমা জনগোষ্ঠী এসে বসবাস শুরু করে। সেই সময়ে বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার ভিত্তিতে মোগলরা উপজাতীয়দের ‘দেওয়ান’, ‘তালুকদার’ ইত্যাদি খেতাবে ভূষিত করেন, যা তাদের বংশধররা এখনও ব্যবহার করে থাকে।
চট্টগ্রাম অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তারের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেক দিনের দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা ছিল। সেই লক্ষ্যে কোম্পানি চট্টগ্রামে দু-দু’বার যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে কারখানা স্থাপনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। ১৭১০ সালে বাংলার নবাব অন্যান্য এলাকার মতো চট্টগ্রাম জেলাকেও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়। যদিও কোম্পানি দিল্লির বাদশা শাহ আলমের কাছ থেকে ১৭৬৫ সালের পর রাজস্ব আদায়ের অধিকার লাভ করে। অতঃপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি রাজস্ব আদায়ের জন্য দু’জন রাজা নিয়োগ দেয়। তারা হলেন- চাকমা রাজা শের দৌলত খান এবং আরাকান বংশোদ্ভূত বোমাং রাজা পোয়াং। মগ ও খুমি উপজাতিরা বোমাং রাজার অধীনে থাকে। এ রাজারা রাজস্ব আদায়ের জন্য নিজস্ব পদ্ধতি চালু করেন। যতই দিন যাচ্ছিল, জনগণের ওপর কোম্পানির করের বোঝা ততই বেড়ে যাচ্ছিল যা পরে জনগণের অসন্তোষের কারণ হয়। মোগল বাহিনীর চট্টগ্রাম জয়ের পর সীমান্তের ওপারে অস্থিতিশীলতা ও পুনঃ পুনঃ সিংহাসন পরিবর্তনের কারণে আরাকানের শাসন ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। এরই সুযোগ নিয়ে ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোধপায়া আরাকান জয় করেন। ঠিক এ সময় অনেক মারমা জনগণ নাফ নদী পাড়ি দিয়ে কক্সবাজার এলাকায় এসে বসবাস শুরু করে। এদের বসবাসের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন কক্সকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল, যার নামানুসারে কক্সবাজারের নামকরণ করা হয়। বোধপায়া কর্তৃক ঐতিহাসিক আরাকান রাজ্য দখলের পর পৃথিবীর মানচিত্র থেকে এ রাজ্যটি একেবারে হারিয়ে যায়। অতঃপর বার্মার সৈন্যরা ব্যাপক গণহত্যা শুরু করে যা ১৭৮৫ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত বলবৎ ছিল। পরিণামে অনেক চাকমা জনগণ আরাকান ত্যাগ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে এসে আশ্রয় নেয়।
১৮৫৯ থেকে ১৮৯৯ সাল পর্যন্ত কুকি উপজাতীয় সম্প্রদায় বহিরাগতদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলে বিপুল লোকজন হতাহত হয়। ১৮৬০ সালে প্রশাসনিক সুবিধাসহ সফলভাবে উপজাতীয় আন্দোলন দমনের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলকে বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে পৃথক করা হয়। ১৮৮১ সালের শেষের দিকে রাঙ্গামাটি শহরের ১৬৫৮ বর্গমাইল এলাকা নিয়ে চাকমা সার্কেল, বান্দরবানের ১৪৪৪ বর্গমাইল নিয়ে বোমাং সার্কেল এবং ৬৫৩ বর্গমাইল নিয়ে রামগড়ে মং সার্কেল গঠিত হয়। চাকমা সম্প্রদায়ের ক্ষমতা খর্ব করার উদ্দেশ্যে তৎকালীন জেলা প্রশাসক মং সার্কেল গঠন করেন বলে জানা যায়। উপজাতীয় জনগোষ্ঠীকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের জন্য ১৯০০ সালের মে মাসে CHT Regulation 1 of 1900 কার্যকর করার মাধ্যমে তিন পার্বত্য জেলার সার্কেলপ্রধানদের রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব দেয়া হয়। কিন্তু এই রেগুলেশনের ৩৪নং ধারা অনুযায়ী যে কোনো ধরনের জমি বন্ধক, বিক্রি, পরিবর্তন ও অধিগ্রহণ জেলা প্রশাসকের এখতিয়ারভুক্ত। যার অর্থ, জেলা প্রশাসকই হচ্ছে জমির প্রকৃত মালিক। ম্যানুয়াল অনুযায়ী সার্কেলপ্রধানের অধীনস্থ হেডম্যান ও কারবারিরা মৌজা ও পাড়ায় রাজস্ব আদায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত, যা সংগ্রহের পর সার্কেলপ্রধান কর্তৃক জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করা হয়। প্রকৃতপক্ষে তিন সার্কেল প্রধান এবং তাদের অধীনস্থ হেডম্যান ও কারবারিরা হচ্ছে রাজস্ব আদায়ের জন্য সরকারের নির্দিষ্ট প্রতিনিধি। ভূমি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক সার্কেলপ্রধানদের ওপর কর্তৃত্ব করে থাকেন। আরও পরে ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে, তখন চাকমারা নিজেদের পাকিস্তানি মুসলমানদের চেয়ে ভারতীয় হিন্দুদের নৈকট্য প্রত্যাশা করে এবং উপজাতি অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একটি স্বতন্ত্র ভূমির স্বপ্ন দেখে। কিন্তু সীমানা নির্ধারণী কমিশন চাকমাদের এ সুপ্ত বাসনার মূল্যায়ন করেনি। যাই হোক, ১৯৫৬ সালে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের জন্য তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার কর্ণফুলী লেকের জমি অধিগ্রহণ করে, যার ফলে প্রায় ৫৪ হাজার একর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে যায়। এছাড়াও সংরক্ষিত বনাঞ্চল বিস্তারের জন্য পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল থেগামুখ, সুবলং ও রাইংখিয়াং এলাকা থেকে ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে উল্লিখিত এলাকার অধিবাসীদের উচ্ছেদ করে, যা এ এলাকার জনগোষ্ঠীকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এসব এলাকার জনগণ এখনও বিশ্বাস করে, তাদের নিজস্ব ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে সৃষ্ট রাজনৈতিক জটিলতার চূড়ান্ত পর্যায়ে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান ওই বছরের মার্চে এক রক্তাক্ত স্বাধীনতা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায়সহ কিছু চাকমা জনগণ এ মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করেন। পরে রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানের প্রতি সংহতি ও একাত্মতা প্রকাশ করে আমৃত্যু পাকিস্তানে বসবাস করেন। তাই ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে অনেক উপজাতি জনগণ ভারতে পলায়ন করে। আর সে সুযোগে দেশে রয়ে যাওয়া উপজাতীয়রা এ অঞ্চলের জমা-জমির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে তরুণ প্রতিবাদী পাহাড়ি নেতা এমএন লারমা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন, যা জাতির বৃহত্তর স্বার্থে গৃহীত হয়নি। অতঃপর ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা সপরিবারে নিহত হলে সাংবিধানিক উপায়ে স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসে। তাই ১৯৭৬ সাল থেকে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র বিদ্রোহের পথ বেছে নেয়। ওই সময়ে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ নানা সমস্যায় জর্জরিত ছিল। তখন সরকার কিছু ভূমিহীন বাঙালি পরিবারকে পার্বত্য এলাকায় বসবাসের সুযোগ করে দেয়। পুনর্বাসিত প্রতিটি বাঙালি পরিবারকে ৫ একর করে খাসজমি বন্দোবস্ত দেয়া হয়, যা উপজাতীয়রা আজও নিজেদের বলে দাবি করে আসছে। যাই হোক, সশস্ত্র আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে বাঙালি পরিবারগুলোকে নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে এনে বসবাস করতে দেয়া হয়। এ সুযোগে উপজাতি জনগণ বাঙালিদের ছেড়ে যাওয়া জায়গা-জমি দখল করে বসবাস শুরু করে। এভাবেই পার্বত্য এলাকার ভূমি সমস্যা জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকে।
‘Hill District Council Act 1989’ কার্যকর হওয়ার পর পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানকে ভূমি সংক্রান্ত যে কোনো ক্রয়-বিক্রয় পরিবর্তন বা অধিগ্রহণের পূর্ণ ক্ষমতা দেয়া হয়। একই সঙ্গে ‘হিলট্রাক্টস ম্যানুয়েল ১৯০০’ কার্যকর থাকায় ভূমি সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করে। ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে এ এলাকার আইন-শৃংখলা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয় এবং ভূমি সমস্যাটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পরিস্থিতির সার্বিক উন্নয়নের জন্য সবাই নিজ জমা-জমির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে অগ্রণী হলে বিভিন্ন জায়গায় জাতিগত সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।
ইতিমধ্যে সরকার শান্তিচুক্তির আওতায় বেশিরভাগ দাবি-দাওয়া বাস্তবায়ন নিশ্চিত করেছে। ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে লক্ষণীয় যে, শান্তি চুক্তির পর পৃথিবীর অনেক দেশেই যুদ্ধ-বিগ্রহ বন্ধ হয়নি, যেমন সুদান (১৯৭২), সোমালিয়া (১৯৯০), এঙ্গোলা ১ ও ২ (১৯৯১ ও ১৯৯৪) এবং রুয়ান্ডা (১৯৯৩)। এমনকি পার্বত্য চুক্তির বহু বছর আগে স্বাক্ষরিত অ্যাংলো-আইরিশ চুক্তি বাস্তবায়নের দিক থেকে এখনও অনেক পিছিয়ে আছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তি অনুযায়ী সব ধরনের মামলা প্রত্যাহারসহ সব বিদ্রোহীকে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। সর্বমোট ১ হাজার ৯৮৯ জনকে আর্থিক অনুদান প্রদানসহ ৭০৫ জনকে পুলিশ বিভাগে চাকরি দেয়া হয়েছে। ১২ হাজার ২২২টি উপজাতি পরিবারকে ত্রিপুরা থেকে দেশে এনে পুনর্বাসিত করা হয়। ১৯৯৮ সালে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং বর্তমানে জনাব দীপঙ্কর তালুকদার এ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সন্তু লারমার নেতৃত্বে ১৯৯৮ সালে আঞ্চলিক পরিষদ গঠিত হলেও মহামান্য হাইকোর্টে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে একটি মামলা চলমান থাকায় পরিষদ কার্যত স্থবির। মহামান্য হাইকোর্টে পার্বত্য শান্তিচুক্তির যৌক্তিকতা নিয়ে মামলা হয়েছে এবং এ জন্য হাইকোর্ট সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় ব্যাখ্যা চেয়েছেন। অবশ্য মহামান্য হাইকোর্ট আঞ্চলিক পরিষদ ও সার্কেলপ্রধানদের কতিপয় ক্ষমতা অবৈধ ঘোষণা করেছেন। সরকার হাইকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল করলেও মহামান্য হাইকোর্টে তা স্থগিত করা হয়েছে। এ বিষয়টিসহ আঞ্চলিক নির্বাচনের জন্য আলাদা ভোটাধিকার প্রয়োগের বিষয়টির স্থায়ী সুরাহা হলেই চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের নির্বাচনসহ সবার জন্য জাতীয় পরিচয়পত্র ইস্যুর ব্যবস্থা গ্রহণ সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ৩২টি বিষয়ের মধ্যে ২২টি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অধীনে ন্যস্ত করা হয়েছে। পার্বত্য এলাকায় উপজাতি পুলিশদের বদলির বিষয়টি যখন প্রক্রিয়াধীন ছিল, ঠিক তখনই ঢাকায় কতিপয় উপজাতীয় পুলিশ সদস্যের গোলাবারুদ চুরির ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে, যার ফলে বিষয়টি আর এগোয়নি।
ভূমি সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৯৯ সালে ভূমি কমিশন গঠন করা হয় এবং ‘CHT Land Dispute Settlement Commission Act 2001’ প্রণয়ন করা হয়। ইতিমধ্যে পার্বত্য এলাকা থেকে নিরাপত্তা বাহিনীর ২৩৮টি ক্যাম্প প্রত্যাহার করা হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় জেলা বিচারিক আদালত স্থাপিত হয়েছে। সংসদ সদস্য সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীকে প্রধান করে তিন সদস্যের পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তবায়ন এবং পর্যালোচনা কমিটি গঠন করা হয়। সরকার ১৯৯৭-এর শান্তি চুক্তির মাধ্যমে উপজাতি সম্প্রদায়ের অধিকার সংরক্ষণসহ সংবিধানের ১৫তম সংশোধনীর মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর স্বীকৃতি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। (চলবে)
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোঃ সরোয়ার হোসেন, এইচডিএমসি, পিএসসি : পার্বত্য এলাকায় ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে কর্মরত
No comments