বিভাজনের রাজনীতির অবসান জরুরি by মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন
একটি
পারিবারিক গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই। একজন মা তার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে
বললেন, ‘যথাযথ মূল্যবোধ সহকারে প্রাপ্তবয়স্ক লোক হিসেবে এসব শিশুর
দেখাশোনার চেয়ে অন্য আর কিছু শ্রেয় হতে পারে না। রাত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে
শিশুরা ভীত হয়ে পড়ল। মা তাদের কাছে টেনে নিলেন। শিশুরা বলল, ‘যতক্ষণ তুমি
আমাদের সঙ্গে আছ, ততক্ষণ আমরা কোনো কিছুকেই ভয় পাই না।’ পরদিন মা তাদের
সঙ্গে নিয়ে একটি পাহাড়ে উঠলেন। তিনি শিশুদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন, ‘ধৈর্য
সহকারে আর সামান্য একটু চেষ্টা করলে আমরা ওপরে উঠে যাব।’ শিশুরা বলল, ‘মা
তুমি না থাকলে আমরা শিখরে উঠতে পারতাম না।’ সে রাতে মা তারকারাজির দিকে
তাকিয়ে বললেন, ‘আমার সন্তানরা জীবনে বিপর্যয় মোকাবেলা করতে দৃঢ় সিদ্ধান্ত
নিতে শিখেছে।’ পরদিন এক ঝড় এলো, মা তার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘মেঘের বিপরীত দিকে তাকাও এবং উজ্জ্বল সূর্যরশ্মি দেখ।’ সন্তানরা ওপরের
দিকে অন্ধকারের অপর দিক দেখতে পেল। সে রাতে মা প্রার্থনা করল, ‘আজকের দিনের
চেয়ে শ্রেয় কিছু হতে পারে না। কারণ অন্ধকারের অপর দিক দেখার ক্ষমতা আমি
আমার সন্তানদের দিতে পেরেছি।’ বছর চলতে থাকল। তার সন্তানরা দীর্ঘদেহী ও
বলিষ্ঠ হয়ে উঠল এবং তাদের চরিত্র ও সাহসিকতা উজ্জ্বল হয়ে প্রকাশ পেল।
অবশেষে যখন মায়ের ইহজগৎ ত্যাগ করার সময় হয়ে এলো, মা বললেন, ‘‘আমি আমার
ভ্রমণের শেষপ্রান্তে পৌঁছেছি। এখন আমি বুঝতে পারছি ‘প্রারম্ভের চেয়ে শেষ
শ্রেয়’, কারণ আমার সন্তানরা একাই পথ চলতে পারে এবং তোমাদের পর তাদের
সন্তানরাও একাই চলতে পারবে।’’
বিএনপি-আওয়ামী লীগের যৌথ আন্দোলনে ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি পক্ষপাতহীন, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপিই দেশ শাসন করে আসছে। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া- দুজনেই দুবার করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। তাদের নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীল আচরণেই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিদের মুখে এটা প্রকাশ পাচ্ছে; বিশ্ব মিডিয়ায়ও আলোচিত হচ্ছে। ১৯৯১ সাল থেকে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার একটা সুফল বাংলাদেশ পাচ্ছে। দেশে শিল্পোৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। রফতানি আয় বেড়েছে ঈর্ষনীয়ভাবে। বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে প্রায় ১ কোটি মানুষের, যা কল্পনাতীত। কয়েক হাজার কোটি ডলার বিদেশ থেকে আসছে রেমিটেন্স ও রফতানি আয় থেকে। যারা মানুষ নিয়ে ভাবেন, রাজনীতি করেন বা নেতৃত্ব দেন- এখান থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রফতানি আয় নিয়ে কয়েকদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, রফতানি আয়ের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের পরে স্থান হবে বাংলাদেশের। এর জন্য তিনি শিক্ষা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিয়েছেন।
দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার হার বাড়ছে চোখে পড়ার মতো। এ প্রসঙ্গে ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাংলাদেশের নারী শিক্ষার অগ্রগতি ভারতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাছাড়া এনজিওর কর্মকাণ্ড ব্যাপক প্রসারিত হয়েছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। এতে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে উল্লেখ করার মতো। এসব অত্যন্ত জটিল ও কঠিন কাজ; যারা সমাজ ও মানুষ নিয়ে কাজ করেন- কেবল তারা ছাড়া অন্যদের এটা উপলব্ধিতে আসার কথা নয়। সামরিক বা অন্য কোনো শক্তির হাতে রাজনীতি বন্দি থাকলে মানুষ এতকিছুর মুখ দেখত কি-না সন্দেহ। রাজনীতি তৃণমূলে পৌঁছেছে বলেই সব ক্ষেত্রে মানুষ পরিবর্তন অনুভব করছে। এ ব্যাপারে পুরোপুরি বুঝতে হলে মইন-ফখরুদ্দীনের দু’বছরের জরুরি শাসন উপলব্ধিতে আনা প্রয়োজন। কারণ এটি সমসাময়িক একটি ঘটনা। বিভিন্ন কারণে প্রথম অবস্থায় মইন-ফখরুদ্দীনের জরুরি শাসনের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল। কিছুদিন যাওয়ার পর জরুরি শাসন আর গণতান্ত্রিক শাসনের তুলনামূলক দিক মানুষ যখন বুঝতে অনুভব করল, তখন জরুরি শাসন একপর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। জরুরি শাসনের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল জনগণের বিরুদ্ধে। দু’বছরের ওই শাসনে মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অনেকের রুটি-রুজির ওপর আঘাত এসেছে দানবের মতো। সবাই ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় মুক্তির প্রহর গুনেছে। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। মানুষ উপলব্ধি করেছে, জরুরি শাসনে বাংলাদেশ ক্রমেই পেছনে পড়ে যাচ্ছে। ফলে বন্দি শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়ে দেশে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় জরুরি সরকার।
বলতে দ্বিধা নেই, গণতন্ত্রের জন্য একটি সংকটময় সময় এখন বাংলাদেশ অতিক্রম করছে। এই সংকট এখন প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছে। দেশে এক অশান্ত ও বেদনাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে বড় দুই দলের মধ্যে ঐক্যের বিকল্প নেই, বিশেষ করে দুই নেত্রীর মধ্যে ঐক্য জরুরি বলে মানুষ মনে করছে। কারণ, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত হলে দেশ ও জনগণ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে, যা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া বিএনপি-আওয়ামী লীগের দুই যুগের শাসনে ধর্মীয় মোড়কে দেশে একটি বিপজ্জনক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই শক্তি দেশের জন্য হুমকি, গণতন্ত্রের জন্য হুমকি; সর্বোপরি উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্যও হুমকি। কাজেই এই শক্তিকে কৌশলে দমাতে দুই নেত্রীর মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য। ধর্মীয় উগ্রতার কারণে আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও মিসরসহ আরও অনেক সম্ভাবনাময় দেশ। এ অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছে, যা চূড়ান্তভাবে দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। জাতীয় জীবনের এই বিভক্তি কমিয়ে আনতে রাজনৈতিক ঐক্যের বিকল্প নেই। রাজনীতিতে অশুভ শক্তির উত্থানের পথ প্রশস্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়। খোদ রাজনীতিকদের জন্যই তা ক্ষতিকর হবে। রাজনীতিতে যদি পরমতসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে কোনোভাবেই দেশে শান্তি বিরাজ করবে না। রাজনৈতিক সংকট দূর করতে তথা সামনের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে অস্পষ্টতা দূর করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বিরোধী জোট মেনে নেবে না, এটি এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। একতরফা কোনো নির্বাচনের দিকে পা বাড়ালে দেশে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। এই সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তা রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সর্বস্তরের মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে বিপদ ডেকে আনবে। এমনটি হলে মাথায় হাত দেয়া ছাড়া রাজনীতিকদের সামনে আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। কাজেই অপশক্তির হাতকে প্রশস্ত করা রাজনীতিকদের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতি কারও জন্যই ভালো ফল বয়ে আনে না। অনৈক্যের রাজনীতি অর্থনীতির জন্য মারাত্মক অন্তরায়। বিভাজনের রাজনীতির কারণে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠছে না, দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের পথ দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। কাজেই দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে বিভক্তির রাজনীতির অবসান জরুরি। অন্যসব দাবি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিরোধী দলের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি নিরেট গণতান্ত্রিক একটি দাবি। এ দাবির সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষের একাÍতা রয়েছে। মানুষ চায় সব দলের অংশগ্রহণে আগামীতে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু দেখতে দেখতে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে পার্লামেন্টেরও। কিন্তু মানুষের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মানুষের শংকা দূর হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে রাজনীতি ঘোর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তবে আশার কথা হল, বিরোধী দল সরকারের এই শেষ সময়েও তাদের ন্যায্য দাবির ব্যাপারে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের এই দায়িত্বশীলতা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। পরিশেষে বলতে চাই, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া চাইলে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই হতে পারে। এটা তাদের একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার মাত্র। মানুষ দুই নেত্রীকে অনেক কিছু দিয়েছে। গত ২০ বছরে ঘুরেফিরে তারাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। মানুষকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে তারা এক হয়ে কাজ করবেন, এটিই কাম্য। এর ব্যত্যয় ঘটানো কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। দুই শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে ঐক্য তৈরি হলে রাজনীতিতে সৃষ্টি হতে পারে ইতিহাস, তারা স্থান করে নিতে পারেন ইতিহাসের সোনালি পাতায়।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
বিএনপি-আওয়ামী লীগের যৌথ আন্দোলনে ১৯৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে একটি পক্ষপাতহীন, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে দেশে গণতন্ত্রের যাত্রা শুরু হয়। সেই থেকে ঘুরেফিরে আওয়ামী লীগ-বিএনপিই দেশ শাসন করে আসছে। শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়া- দুজনেই দুবার করে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। তাদের নেতৃত্ব ও দায়িত্বশীল আচরণেই বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছে। বিশ্বের বরেণ্য ব্যক্তিদের মুখে এটা প্রকাশ পাচ্ছে; বিশ্ব মিডিয়ায়ও আলোচিত হচ্ছে। ১৯৯১ সাল থেকে গণতন্ত্রের ধারাবাহিকতার একটা সুফল বাংলাদেশ পাচ্ছে। দেশে শিল্পোৎপাদন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। রফতানি আয় বেড়েছে ঈর্ষনীয়ভাবে। বিদেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে প্রায় ১ কোটি মানুষের, যা কল্পনাতীত। কয়েক হাজার কোটি ডলার বিদেশ থেকে আসছে রেমিটেন্স ও রফতানি আয় থেকে। যারা মানুষ নিয়ে ভাবেন, রাজনীতি করেন বা নেতৃত্ব দেন- এখান থেকে তাদের অনেক কিছু শেখার আছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের রফতানি আয় নিয়ে কয়েকদিন আগে মার্কিন রাষ্ট্রদূত বলেছেন, রফতানি আয়ের দিক থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীনের পরে স্থান হবে বাংলাদেশের। এর জন্য তিনি শিক্ষা ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর জোর দিয়েছেন।
দেশে শিক্ষার হার বাড়ছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার হার বাড়ছে চোখে পড়ার মতো। এ প্রসঙ্গে ভারতের নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বলেছেন, বাংলাদেশের নারী শিক্ষার অগ্রগতি ভারতের চেয়ে বহুগুণ বেশি। তাছাড়া এনজিওর কর্মকাণ্ড ব্যাপক প্রসারিত হয়েছে। ফলে স্বাস্থ্যসেবা, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন সুবিধা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে। এতে মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে উল্লেখ করার মতো। এসব অত্যন্ত জটিল ও কঠিন কাজ; যারা সমাজ ও মানুষ নিয়ে কাজ করেন- কেবল তারা ছাড়া অন্যদের এটা উপলব্ধিতে আসার কথা নয়। সামরিক বা অন্য কোনো শক্তির হাতে রাজনীতি বন্দি থাকলে মানুষ এতকিছুর মুখ দেখত কি-না সন্দেহ। রাজনীতি তৃণমূলে পৌঁছেছে বলেই সব ক্ষেত্রে মানুষ পরিবর্তন অনুভব করছে। এ ব্যাপারে পুরোপুরি বুঝতে হলে মইন-ফখরুদ্দীনের দু’বছরের জরুরি শাসন উপলব্ধিতে আনা প্রয়োজন। কারণ এটি সমসাময়িক একটি ঘটনা। বিভিন্ন কারণে প্রথম অবস্থায় মইন-ফখরুদ্দীনের জরুরি শাসনের প্রতি জনগণের সমর্থন ছিল। কিছুদিন যাওয়ার পর জরুরি শাসন আর গণতান্ত্রিক শাসনের তুলনামূলক দিক মানুষ যখন বুঝতে অনুভব করল, তখন জরুরি শাসন একপর্যায়ে মুখ থুবড়ে পড়ল। জরুরি শাসনের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল জনগণের বিরুদ্ধে। দু’বছরের ওই শাসনে মানুষের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অনেকের রুটি-রুজির ওপর আঘাত এসেছে দানবের মতো। সবাই ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় মুক্তির প্রহর গুনেছে। দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির চাকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। মানুষ উপলব্ধি করেছে, জরুরি শাসনে বাংলাদেশ ক্রমেই পেছনে পড়ে যাচ্ছে। ফলে বন্দি শেখ হাসিনা ও বেগম খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। তাদের সসম্মানে মুক্তি দিয়ে দেশে নির্বাচন দিতে বাধ্য হয় জরুরি সরকার।
বলতে দ্বিধা নেই, গণতন্ত্রের জন্য একটি সংকটময় সময় এখন বাংলাদেশ অতিক্রম করছে। এই সংকট এখন প্রান্তসীমায় এসে পৌঁছেছে। দেশে এক অশান্ত ও বেদনাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে বড় দুই দলের মধ্যে ঐক্যের বিকল্প নেই, বিশেষ করে দুই নেত্রীর মধ্যে ঐক্য জরুরি বলে মানুষ মনে করছে। কারণ, গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ব্যাহত হলে দেশ ও জনগণ অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখীন হবে, যা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া বিএনপি-আওয়ামী লীগের দুই যুগের শাসনে ধর্মীয় মোড়কে দেশে একটি বিপজ্জনক শক্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। এই শক্তি দেশের জন্য হুমকি, গণতন্ত্রের জন্য হুমকি; সর্বোপরি উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্যও হুমকি। কাজেই এই শক্তিকে কৌশলে দমাতে দুই নেত্রীর মধ্যে ঐক্য অপরিহার্য। ধর্মীয় উগ্রতার কারণে আমাদের চোখের সামনে ধ্বংস হচ্ছে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া ও মিসরসহ আরও অনেক সম্ভাবনাময় দেশ। এ অভিজ্ঞতা থেকে বাংলাদেশ শিক্ষা নিতে পারে। দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজ বিভক্তি ছড়িয়ে পড়েছে, যা চূড়ান্তভাবে দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাবে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। জাতীয় জীবনের এই বিভক্তি কমিয়ে আনতে রাজনৈতিক ঐক্যের বিকল্প নেই। রাজনীতিতে অশুভ শক্তির উত্থানের পথ প্রশস্ত করা বাঞ্ছনীয় নয়। খোদ রাজনীতিকদের জন্যই তা ক্ষতিকর হবে। রাজনীতিতে যদি পরমতসহিষ্ণুতা ও গণতান্ত্রিক মনোভাব প্রতিষ্ঠিত না হয়, তাহলে কোনোভাবেই দেশে শান্তি বিরাজ করবে না। রাজনৈতিক সংকট দূর করতে তথা সামনের নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার নিয়ে অস্পষ্টতা দূর করতে হবে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বিরোধী জোট মেনে নেবে না, এটি এক রকম নিশ্চিত করেই বলা যায়। একতরফা কোনো নির্বাচনের দিকে পা বাড়ালে দেশে ভয়াবহ রাজনৈতিক সংকট অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠবে। এই সংকট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সমূহ আশংকা রয়েছে। রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে তা রাজনীতিক, ব্যবসায়ী ও সর্বস্তরের মানুষের জন্য নিঃসন্দেহে বিপদ ডেকে আনবে। এমনটি হলে মাথায় হাত দেয়া ছাড়া রাজনীতিকদের সামনে আর কোনো গত্যন্তর থাকবে না। কাজেই অপশক্তির হাতকে প্রশস্ত করা রাজনীতিকদের জন্য কোনোভাবেই কাম্য নয়। অনৈক্য ও বিভাজনের রাজনীতি কারও জন্যই ভালো ফল বয়ে আনে না। অনৈক্যের রাজনীতি অর্থনীতির জন্য মারাত্মক অন্তরায়। বিভাজনের রাজনীতির কারণে অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম মন্দাভাব বিরাজ করছে, দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ প্রায় বন্ধ। নতুন শিল্প-কলকারখানা গড়ে উঠছে না, দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থানের পথ দিন দিন সঙ্কুচিত হচ্ছে। কাজেই দেশ ও গণতন্ত্রের স্বার্থে বিভক্তির রাজনীতির অবসান জরুরি। অন্যসব দাবি নিয়ে বিতর্ক থাকলেও বিরোধী দলের নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবি নিরেট গণতান্ত্রিক একটি দাবি। এ দাবির সঙ্গে সর্বস্তরের মানুষের একাÍতা রয়েছে। মানুষ চায় সব দলের অংশগ্রহণে আগামীতে দেশে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক। কিন্তু দেখতে দেখতে সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে। মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে পার্লামেন্টেরও। কিন্তু মানুষের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। মানুষের শংকা দূর হচ্ছে না। যুদ্ধাপরাধের বিচার ও নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে রাজনীতি ঘোর অন্ধকারের দিকে ধাবিত হচ্ছে। তবে আশার কথা হল, বিরোধী দল সরকারের এই শেষ সময়েও তাদের ন্যায্য দাবির ব্যাপারে রাজনৈতিক কর্মসূচি দেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। তাদের এই দায়িত্বশীলতা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। পরিশেষে বলতে চাই, শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়া চাইলে দেশে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অবশ্যই হতে পারে। এটা তাদের একটা সিদ্ধান্তের ব্যাপার মাত্র। মানুষ দুই নেত্রীকে অনেক কিছু দিয়েছে। গত ২০ বছরে ঘুরেফিরে তারাই দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছেন। মানুষকে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে তারা এক হয়ে কাজ করবেন, এটিই কাম্য। এর ব্যত্যয় ঘটানো কোনোভাবেই সমীচীন হবে না। দুই শীর্ষ নেত্রীর মধ্যে ঐক্য তৈরি হলে রাজনীতিতে সৃষ্টি হতে পারে ইতিহাস, তারা স্থান করে নিতে পারেন ইতিহাসের সোনালি পাতায়।
মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন : রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments