আগ্রাসী ভূমিকায় ব্যাংকিং খাত : করণীয় by ড. আর এম দেবনাথ
‘আগ্রাসী ভূমিকায় ব্যাংকিং খাত’- এই
শিরোনামে যুগান্তরে ২২ জুলাই একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়েছে। এ ধরনের খবর ঘন ঘন
পাঠ করে আমার মনে হয়েছে, কেউ বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে না। না দিচ্ছে
অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ, না দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদি দিত,
তাহলে এদ্দিনে একটা সমাধান নিশ্চয়ই পাওয়া যেত। অথচ প্রতিবেদন মোতাবেক
ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের সংগঠনগুলো প্রায়ই ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ করে
যাচ্ছে। বলা হয়েছে, তারা প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত গিয়েছেন। কিন্তু কোনো ফলোদয়
হচ্ছে না। এ অবস্থায় দেখা দরকার কী সেসব দাবি, যার কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
আমি প্রতিবেদনটি পড়ে নিজের মতো করে একটা সারসংক্ষেপ করেছি। তাতে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঋণের ওপর সুদের হার বেশি। এর ওপর সুদ তো আছেই। তার ওপর চার্জ হয় নানা ধরনের ফি। এর ফলে প্রকৃত সুদের হার ৩ থেকে ৪ শতাংশ বেশি হয়। সব মিলিয়ে তা হয় ২০ থেকে ২৪ শতাংশ। মজার ঘটনা হচ্ছে, কেউ ঋণের টাকা ফেরত দিতে চাইলেও নাকি চার্জ দিতে হয় চার শতাংশ। দ্বিতীয় অভিযোগটি হচ্ছে ব্যাংকের ‘স্প্রেড’ নিয়ে। ‘স্প্রেড’ হচ্ছে আমানত ও ঋণের সুদের তারতম্য। তা পাঁচ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। অনেক ক্ষেত্রে তা নাকি বেশি। অর্থাৎ ব্যাংক আমানত নিচ্ছে কম সুদে, বিপরীতে ঋণ দিচ্ছে বেশি হারে যাতে ‘স্প্রেড’ অর্থাৎ মুনাফা বাড়ে। তৃতীয় অভিযোগটি ‘সার্ভিস চার্জ’ সম্পর্কিত। ব্যাংকগুলো নতুন নতুন সার্ভিস চার্জ আবিষ্কার করছে এবং তা আদায় করছে। এসব চার্জের তালিকা প্রকাশিত হওয়ার কথা, যেমন প্রকাশিত থাকার কথা আমানত ও সুদের হার। বলা হয়েছে, ‘সার্ভিস চার্জের’ পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করে না ব্যাংক। প্রতিবছর দু’বার গ্রাহকদের ‘হিসাবের বিবরণী’ (অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট) পাঠানো বাধ্যতামূলক। তা পাঠানো হয় না। বিপরীতে কেউ তা চাইলে এর জন্য গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ‘ডেবিট’ করা হয় অর্থাৎ চার্জ আদায় করা হয়। সব শেষে বলা হয়েছে, দেশের ২৩টি ব্যাংক এ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা লংঘন করেছে।
প্রতিবেদন পাঠ করে বোঝা গেল না, যে ২৩টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা লংঘন করছে এর মধ্যে কয়টি সরকারি আর কয়টি বেসরকারি ব্যাংক। আমার মনে হয়, এ বিষয়টি পরিষ্কার না হলে অভিযোগটি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হয়। আমার ধারণা, ২৩টি ব্যাংকের প্রায় সবই বেসরকারি খাতের। বেসরকারি ব্যাংকের যখন অনুমোদন দেয়া হয়, তখন যুক্তি ছিল প্রতিযোগিতার। সরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ‘অত্যাচার’ করে। এখন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ আমলে নিলে বলতে হয়, প্রতিযোগিতার যুক্তিটা অকার্যকর। বেসরকারি ব্যাংক সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতা করছে না। তারা অতিরিক্ত মুনাফার যন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এখানেও কথা আছে। ২৩টি ব্যাংকই সব ব্যাংক নয়। রিপোর্টের সময়কে ভিত্তি করে বলতে হয় মে পর্যন্ত দেশে ব্যাংক ছিল ৪৭টি। তার অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক ২৪টি ব্যাংক ঠিক পথেই ছিল। কাজেই ঢালাও অভিযোগ করা যাবে না। ব্যাংকিং খাতের একাংশ বাংলাদেশ ব্যাংককে মানছে না, বৃহত্তর অংশ মানছে। প্রশ্ন, যে অভিযোগগুলো ব্যবসায়ীরা উত্থাপন করেছেন তা কি নতুন? আমার মতে এসব অভিযোগ নতুন নয়। ঋণের ওপর সুদের হার বেশি। এর কারণে ব্যবসার খরচ হচ্ছে বেশি। এতে ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস পায় আন্তর্জাতিক বাজারে। এসব অভিমতের কোনো ভিত্তি নেই তা বলা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য অনেকগুলো বিষয়। ‘কস্ট অব ফান্ড’ কত অথবা আমানতের সুদ কত? ব্যাংকের প্রশাসনিক ব্যয় কত? মূল্যস্ফীতি কত? সুদের হার নির্ণয়ে এগুলোও বিবেচ্য বিষয়। এক বছর আগের ঘটনা ভিন্ন ছিল। কিন্তু এখন মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশ। আমানতের ওপর সুদের হারও ব্যাংক কমাচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই সুদের হার পুনর্বিবেচনা করতে হবে। পুরনো যুক্তিতে চলবে না। ‘স্প্রেড’ ৫ শতাংশের বেশি রাখা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ মুহূর্তে এ কথা বলতেই হবে। যদি ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফা ঠিক রাখার জন্য আমানতকারীদের সুদ কমায় অথচ ঋণের ওপর সুদ না কমায় তাহলে অবশ্যই এটা আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতা উভয়ের প্রতি অবিচার হবে।
একথা বললেই সমস্যা শেষ হয় না। আমাকে বলতেই হয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিক বাংলাদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী। তারা আবার আমদানি-রফতানি ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ব্যবসা করেন। এ অবস্থায় বোঝা যাচ্ছে, লড়াইটা ব্যবসায়ী বনাম ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরাই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখছেন না। অথচ সরকারি ব্যাংক ‘অত্যাচার’ এতটা করে না। করলে বেসরকারি ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউট থেকে অনেক গ্রাহক সরকারি ব্যাংকে আসতে চাইত না। এখন প্রশ্ন, ব্যবসায়ীদের এ সমস্যার সমাধান কে করবে? আরেকটা প্রশ্ন। ব্যবসার মোট খরচে ‘সুদ খরচ’ কত শতাংশ? ১০০ টাকার মধ্যে ব্যবসায় সুদ বাবদ কত খরচ হয়? আমার ধারণা, ব্যবসায়ীরা এ বিষয়টি সম্বন্ধে ভাবেন না। চার্জ নিয়ে কথা থাকতে পারে, বস্তুত আছেও। অবশ্য এ প্রশ্নটির সঙ্গে বৃহত্তর একটা বিষয় জড়িত যার প্রতি কেউ নজর দেয় না। ব্যবসায়ীরা যদি ২০-২৪ শতাংশ সুদ দিয়ে ব্যবসা করতে না পারেন, তাহলে ৩০-৩৫ এমনকি ৪০ শতাংশ সুদ দিয়ে গ্রামের গরিব মানুষ, কৃষক, প্রান্তিক চাষী, ভূমিহীনরা কিভাবে টিকবে? ব্যবসায়ীদের ওপর ধার্যকৃত সুদের হার যদি অসহনীয় হয়, যদি তা ‘অত্যাচার’ হয়, তাহলে কৃষকদের ওপর কী হচ্ছে? আমার ধারণা, ঋণের ওপর সুদের হারের বিষয়টি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা দরকার। অবিচার কারও প্রতি কাম্য নয়- ব্যবসায়ীদের প্রতিও নয়, কৃষকদের প্রতিও নয়। আরেকটি কথা। ব্যবসার খরচ কমানোর অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে শেয়ারবাজার। ব্যবসায়ীদের উচিত পুঁজির জন্য শেয়ার বিক্রি করা। এতে খরচ কমবে। অন্তত সুদের হিসাব করতে হবে না।
বড় প্রশ্ন বোধহয় সার্ভিস চার্জ নিয়ে। যুগান্তরের প্রতিবেদনের মূল কথা মনে হচ্ছে তাই। প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে সুদের হার। একথা আমি মানি, ব্যাংকগুলো সার্ভিস চার্জের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। নানা ধরনের নাম দিয়ে ব্যাংক সার্ভিস চার্জ আদায় করছে। এটা কেমন কথা, একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট পাঠাবে না, অথচ তা চাইতে গেলে ‘চার্জ’ দিতে হবে? এটা তো অন্যায়, অবিচার। অন্যায় অনেক ধরনের। হিসাব খোলা হয়েছে, তখন ‘ভোটার আইডি’ ছিল না। পাসপোর্টের কপি দেয়া হয়েছে, যথারীতি ছবি দেয়া হয়েছে। ট্রানজেকশন প্রোফাইল ইত্যাদিও করা হয়েছে। নমিনির ছবিও দেয়া হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘ভোটার আইডি’ না দিলে অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দেয়া হবে। নিয়ম হচ্ছে ‘ভোটার আইডি’ অথবা পাসপোর্টের কপি অথবা ওয়ার্ড কমিশনারের সার্টিফিকেট দিতে হবে। অথচ কোনো কোনো ব্যাংকের ‘অতিশিক্ষিত’ ম্যানেজমেন্ট স্বেচ্ছাচারিতা করছে। কে দেখবে এসব?
সুদের হারই হোক, সার্ভিস চার্জই হোক, অথবা হোক অন্য বিষয়ের ওপর অভিযোগ, তা দেখার মালিক কে? স্পষ্টতই বাংলাদেশ ব্যাংক। দু’দিন পরপর খবরের কাগজের রিপোর্ট পড়ে আমার ধারণা হচ্ছে, গ্রাহকদের অভিযোগ দেখার দায়িত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুবই ‘ক্যাজুয়েল’। তারা বলেছে, ব্যাংকে ব্যাংকে অভিযোগ কেন্দ্র খুলবে। তারা নিজেরাও অভিযোগ নেয়। অথচ অভিযোগ বাড়ছেই। একটি বড় অভিযোগ আন্তঃব্যাংক দাবি-সংক্রান্ত। এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের ‘একসেপটেন্সের’ বিপরীতে টাকা দিয়েছে। ‘বিল’ পরিশোধের সময় হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নানা কথা বলে টাকা দিচ্ছে না। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আন্তঃব্যাংক সমস্যা। এর সমাধান কে করবে? স্পষ্টতই তা করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। আইনি জটিলতা থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই তার সমাধান খুঁজতে হবে। অথচ এটা হচ্ছে না। সমস্যাটা ‘হলমার্ক’ সমস্যা থেকে উদ্ভূত। এক্ষেত্রে দুদক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। শত হোক সমস্যার সমাধান করতে হবে। সমস্যা ঝুলিয়ে রাখা যায় না। এটা ব্যাংকিং রীতি-নীতির বাইরে। এতে স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম বিঘিœত হয়।
কয়েক দিন আগে কাগজে দেখলাম, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি প্রতিষ্ঠানে, এমনকি দুদককে পর্যন্ত নাকি তথ্য দিতে অস্বীকৃত হচ্ছে। খবরটি সত্য কি-না জানি না। আমরা ব্যাংকারদের কাছে শুনেছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা কোনো ব্যাংক বাইরের কাউকে তথ্য দেবে না। দেবে কোর্টের মাধ্যমে। দীর্ঘদিনের এ রীতি ভাঙা হচ্ছে কি? এতে আইনি বিষয় আছে কি? আমি নিশ্চিত নই। অথচ এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে সমস্যা বাড়ছে। কে সমাধান করবে এসব সমস্যার? অবশ্যই এর সমাধান বের করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এ কাজটি হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের হুকুম মানতেই ব্যস্ত। অন্য কাজ সে কখন করবে? এ অবস্থায় আমার একটা প্রস্তাব আছে। ঋণগ্রহীতা, আমানতকারী ও অন্যান্য সেবা গ্রহণকারীদের অনেক অভিযোগ আছে। অনেকেই সুদের হারের কারণে, অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জের কারণে, নিুমানের সেবার কারণে, বিলম্বে সেবা প্রাপ্তির কারণে, সর্বনিু সেবাপ্রাপ্তিতে বিলম্বের কারণে হরহামেশা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছে। প্রতিকার নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়ে ফল হচ্ছে না। ব্যাংকে অভিযোগ করে লাভ হচ্ছে না। এমতাবস্থায় ‘কাস্টমার রাইটস প্রটেকশন কমিশন’ গঠিত হোক। অন্য নামও হতে পারে, যারা শুধু ব্যাংকের অভিযোগ শুনবে এবং দ্রুত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে। এ ব্যাপারে নেতারা, নীতি-নির্ধারক, আমলা, ব্যাংকাররা একটু ভাববেন কি? এটা হলে দুদিন পরপর ‘আগ্রাসী ভূমিকায় ব্যাংকিং খাত’ ধরনের খবরের পাঠক আমাদের আর হতে হবে না।
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
আমি প্রতিবেদনটি পড়ে নিজের মতো করে একটা সারসংক্ষেপ করেছি। তাতে দেখা যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা বলছেন, ঋণের ওপর সুদের হার বেশি। এর ওপর সুদ তো আছেই। তার ওপর চার্জ হয় নানা ধরনের ফি। এর ফলে প্রকৃত সুদের হার ৩ থেকে ৪ শতাংশ বেশি হয়। সব মিলিয়ে তা হয় ২০ থেকে ২৪ শতাংশ। মজার ঘটনা হচ্ছে, কেউ ঋণের টাকা ফেরত দিতে চাইলেও নাকি চার্জ দিতে হয় চার শতাংশ। দ্বিতীয় অভিযোগটি হচ্ছে ব্যাংকের ‘স্প্রেড’ নিয়ে। ‘স্প্রেড’ হচ্ছে আমানত ও ঋণের সুদের তারতম্য। তা পাঁচ শতাংশের বেশি হওয়ার কথা নয়। অনেক ক্ষেত্রে তা নাকি বেশি। অর্থাৎ ব্যাংক আমানত নিচ্ছে কম সুদে, বিপরীতে ঋণ দিচ্ছে বেশি হারে যাতে ‘স্প্রেড’ অর্থাৎ মুনাফা বাড়ে। তৃতীয় অভিযোগটি ‘সার্ভিস চার্জ’ সম্পর্কিত। ব্যাংকগুলো নতুন নতুন সার্ভিস চার্জ আবিষ্কার করছে এবং তা আদায় করছে। এসব চার্জের তালিকা প্রকাশিত হওয়ার কথা, যেমন প্রকাশিত থাকার কথা আমানত ও সুদের হার। বলা হয়েছে, ‘সার্ভিস চার্জের’ পূর্ণ তালিকা প্রকাশ করে না ব্যাংক। প্রতিবছর দু’বার গ্রাহকদের ‘হিসাবের বিবরণী’ (অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট) পাঠানো বাধ্যতামূলক। তা পাঠানো হয় না। বিপরীতে কেউ তা চাইলে এর জন্য গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট ‘ডেবিট’ করা হয় অর্থাৎ চার্জ আদায় করা হয়। সব শেষে বলা হয়েছে, দেশের ২৩টি ব্যাংক এ-সংক্রান্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা লংঘন করেছে।
প্রতিবেদন পাঠ করে বোঝা গেল না, যে ২৩টি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা লংঘন করছে এর মধ্যে কয়টি সরকারি আর কয়টি বেসরকারি ব্যাংক। আমার মনে হয়, এ বিষয়টি পরিষ্কার না হলে অভিযোগটি সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের ক্ষেত্রে সমভাবে প্রযোজ্য হয়। আমার ধারণা, ২৩টি ব্যাংকের প্রায় সবই বেসরকারি খাতের। বেসরকারি ব্যাংকের যখন অনুমোদন দেয়া হয়, তখন যুক্তি ছিল প্রতিযোগিতার। সরকারি ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের ‘অত্যাচার’ করে। এখন ব্যবসায়ীদের অভিযোগ আমলে নিলে বলতে হয়, প্রতিযোগিতার যুক্তিটা অকার্যকর। বেসরকারি ব্যাংক সত্যিকার অর্থে প্রতিযোগিতা করছে না। তারা অতিরিক্ত মুনাফার যন্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এখানেও কথা আছে। ২৩টি ব্যাংকই সব ব্যাংক নয়। রিপোর্টের সময়কে ভিত্তি করে বলতে হয় মে পর্যন্ত দেশে ব্যাংক ছিল ৪৭টি। তার অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মোতাবেক ২৪টি ব্যাংক ঠিক পথেই ছিল। কাজেই ঢালাও অভিযোগ করা যাবে না। ব্যাংকিং খাতের একাংশ বাংলাদেশ ব্যাংককে মানছে না, বৃহত্তর অংশ মানছে। প্রশ্ন, যে অভিযোগগুলো ব্যবসায়ীরা উত্থাপন করেছেন তা কি নতুন? আমার মতে এসব অভিযোগ নতুন নয়। ঋণের ওপর সুদের হার বেশি। এর কারণে ব্যবসার খরচ হচ্ছে বেশি। এতে ব্যবসায়ীদের প্রতিযোগিতার ক্ষমতা হ্রাস পায় আন্তর্জাতিক বাজারে। এসব অভিমতের কোনো ভিত্তি নেই তা বলা যাবে না। তবে এ ক্ষেত্রে বিবেচ্য অনেকগুলো বিষয়। ‘কস্ট অব ফান্ড’ কত অথবা আমানতের সুদ কত? ব্যাংকের প্রশাসনিক ব্যয় কত? মূল্যস্ফীতি কত? সুদের হার নির্ণয়ে এগুলোও বিবেচ্য বিষয়। এক বছর আগের ঘটনা ভিন্ন ছিল। কিন্তু এখন মূল্যস্ফীতি ৭-৮ শতাংশ। আমানতের ওপর সুদের হারও ব্যাংক কমাচ্ছে। এ অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই সুদের হার পুনর্বিবেচনা করতে হবে। পুরনো যুক্তিতে চলবে না। ‘স্প্রেড’ ৫ শতাংশের বেশি রাখা কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয়। এ মুহূর্তে এ কথা বলতেই হবে। যদি ব্যাংকগুলো তাদের মুনাফা ঠিক রাখার জন্য আমানতকারীদের সুদ কমায় অথচ ঋণের ওপর সুদ না কমায় তাহলে অবশ্যই এটা আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতা উভয়ের প্রতি অবিচার হবে।
একথা বললেই সমস্যা শেষ হয় না। আমাকে বলতেই হয়, বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মালিক বাংলাদেশের বড় বড় ব্যবসায়ী। তারা আবার আমদানি-রফতানি ব্যবসা থেকে শুরু করে সব ব্যবসা করেন। এ অবস্থায় বোঝা যাচ্ছে, লড়াইটা ব্যবসায়ী বনাম ব্যবসায়ী। ব্যবসায়ীরাই ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখছেন না। অথচ সরকারি ব্যাংক ‘অত্যাচার’ এতটা করে না। করলে বেসরকারি ব্যাংক এবং নন-ব্যাংক ফিনান্সিয়াল ইন্সটিটিউট থেকে অনেক গ্রাহক সরকারি ব্যাংকে আসতে চাইত না। এখন প্রশ্ন, ব্যবসায়ীদের এ সমস্যার সমাধান কে করবে? আরেকটা প্রশ্ন। ব্যবসার মোট খরচে ‘সুদ খরচ’ কত শতাংশ? ১০০ টাকার মধ্যে ব্যবসায় সুদ বাবদ কত খরচ হয়? আমার ধারণা, ব্যবসায়ীরা এ বিষয়টি সম্বন্ধে ভাবেন না। চার্জ নিয়ে কথা থাকতে পারে, বস্তুত আছেও। অবশ্য এ প্রশ্নটির সঙ্গে বৃহত্তর একটা বিষয় জড়িত যার প্রতি কেউ নজর দেয় না। ব্যবসায়ীরা যদি ২০-২৪ শতাংশ সুদ দিয়ে ব্যবসা করতে না পারেন, তাহলে ৩০-৩৫ এমনকি ৪০ শতাংশ সুদ দিয়ে গ্রামের গরিব মানুষ, কৃষক, প্রান্তিক চাষী, ভূমিহীনরা কিভাবে টিকবে? ব্যবসায়ীদের ওপর ধার্যকৃত সুদের হার যদি অসহনীয় হয়, যদি তা ‘অত্যাচার’ হয়, তাহলে কৃষকদের ওপর কী হচ্ছে? আমার ধারণা, ঋণের ওপর সুদের হারের বিষয়টি নির্মোহ দৃষ্টিতে দেখা দরকার। অবিচার কারও প্রতি কাম্য নয়- ব্যবসায়ীদের প্রতিও নয়, কৃষকদের প্রতিও নয়। আরেকটি কথা। ব্যবসার খরচ কমানোর অন্যতম প্রধান উপায় হচ্ছে শেয়ারবাজার। ব্যবসায়ীদের উচিত পুঁজির জন্য শেয়ার বিক্রি করা। এতে খরচ কমবে। অন্তত সুদের হিসাব করতে হবে না।
বড় প্রশ্ন বোধহয় সার্ভিস চার্জ নিয়ে। যুগান্তরের প্রতিবেদনের মূল কথা মনে হচ্ছে তাই। প্রাসঙ্গিকভাবে এসেছে সুদের হার। একথা আমি মানি, ব্যাংকগুলো সার্ভিস চার্জের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করছে। নানা ধরনের নাম দিয়ে ব্যাংক সার্ভিস চার্জ আদায় করছে। এটা কেমন কথা, একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট পাঠাবে না, অথচ তা চাইতে গেলে ‘চার্জ’ দিতে হবে? এটা তো অন্যায়, অবিচার। অন্যায় অনেক ধরনের। হিসাব খোলা হয়েছে, তখন ‘ভোটার আইডি’ ছিল না। পাসপোর্টের কপি দেয়া হয়েছে, যথারীতি ছবি দেয়া হয়েছে। ট্রানজেকশন প্রোফাইল ইত্যাদিও করা হয়েছে। নমিনির ছবিও দেয়া হয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘ভোটার আইডি’ না দিলে অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করে দেয়া হবে। নিয়ম হচ্ছে ‘ভোটার আইডি’ অথবা পাসপোর্টের কপি অথবা ওয়ার্ড কমিশনারের সার্টিফিকেট দিতে হবে। অথচ কোনো কোনো ব্যাংকের ‘অতিশিক্ষিত’ ম্যানেজমেন্ট স্বেচ্ছাচারিতা করছে। কে দেখবে এসব?
সুদের হারই হোক, সার্ভিস চার্জই হোক, অথবা হোক অন্য বিষয়ের ওপর অভিযোগ, তা দেখার মালিক কে? স্পষ্টতই বাংলাদেশ ব্যাংক। দু’দিন পরপর খবরের কাগজের রিপোর্ট পড়ে আমার ধারণা হচ্ছে, গ্রাহকদের অভিযোগ দেখার দায়িত্বে কেন্দ্রীয় ব্যাংক খুবই ‘ক্যাজুয়েল’। তারা বলেছে, ব্যাংকে ব্যাংকে অভিযোগ কেন্দ্র খুলবে। তারা নিজেরাও অভিযোগ নেয়। অথচ অভিযোগ বাড়ছেই। একটি বড় অভিযোগ আন্তঃব্যাংক দাবি-সংক্রান্ত। এক ব্যাংক অন্য ব্যাংকের ‘একসেপটেন্সের’ বিপরীতে টাকা দিয়েছে। ‘বিল’ পরিশোধের সময় হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাংক নানা কথা বলে টাকা দিচ্ছে না। ফলে সৃষ্টি হয়েছে আন্তঃব্যাংক সমস্যা। এর সমাধান কে করবে? স্পষ্টতই তা করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। আইনি জটিলতা থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই তার সমাধান খুঁজতে হবে। অথচ এটা হচ্ছে না। সমস্যাটা ‘হলমার্ক’ সমস্যা থেকে উদ্ভূত। এক্ষেত্রে দুদক, কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। শত হোক সমস্যার সমাধান করতে হবে। সমস্যা ঝুলিয়ে রাখা যায় না। এটা ব্যাংকিং রীতি-নীতির বাইরে। এতে স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম বিঘিœত হয়।
কয়েক দিন আগে কাগজে দেখলাম, বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারি প্রতিষ্ঠানে, এমনকি দুদককে পর্যন্ত নাকি তথ্য দিতে অস্বীকৃত হচ্ছে। খবরটি সত্য কি-না জানি না। আমরা ব্যাংকারদের কাছে শুনেছি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক অথবা কোনো ব্যাংক বাইরের কাউকে তথ্য দেবে না। দেবে কোর্টের মাধ্যমে। দীর্ঘদিনের এ রীতি ভাঙা হচ্ছে কি? এতে আইনি বিষয় আছে কি? আমি নিশ্চিত নই। অথচ এসব কারণে ব্যাংকিং খাতে সমস্যা বাড়ছে। কে সমাধান করবে এসব সমস্যার? অবশ্যই এর সমাধান বের করতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই। অত্যন্ত দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এ কাজটি হচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক আইএমএফের হুকুম মানতেই ব্যস্ত। অন্য কাজ সে কখন করবে? এ অবস্থায় আমার একটা প্রস্তাব আছে। ঋণগ্রহীতা, আমানতকারী ও অন্যান্য সেবা গ্রহণকারীদের অনেক অভিযোগ আছে। অনেকেই সুদের হারের কারণে, অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জের কারণে, নিুমানের সেবার কারণে, বিলম্বে সেবা প্রাপ্তির কারণে, সর্বনিু সেবাপ্রাপ্তিতে বিলম্বের কারণে হরহামেশা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছে। প্রতিকার নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গিয়ে ফল হচ্ছে না। ব্যাংকে অভিযোগ করে লাভ হচ্ছে না। এমতাবস্থায় ‘কাস্টমার রাইটস প্রটেকশন কমিশন’ গঠিত হোক। অন্য নামও হতে পারে, যারা শুধু ব্যাংকের অভিযোগ শুনবে এবং দ্রুত ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করবে। এ ব্যাপারে নেতারা, নীতি-নির্ধারক, আমলা, ব্যাংকাররা একটু ভাববেন কি? এটা হলে দুদিন পরপর ‘আগ্রাসী ভূমিকায় ব্যাংকিং খাত’ ধরনের খবরের পাঠক আমাদের আর হতে হবে না।
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম
No comments