টমাস আলভা এডিসনঃ বধিরতা যার জন্য ছিল আশীর্বাদ… by সাইকা তাসনিম

বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবন অনেকটা খোলা বইয়ের মত। তাদের ব্যর্থতা-সফলতা অনেক কিছুই আমাদের জানা থাকে। কিন্তু তাদের জীবনে এমন আরো অনেক কিছুর উপস্থিতি আছে যা থেক যায় আমাদের সম্পূর্ণ অজানা। তেমনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ও বিজ্ঞানী হলেন টমাস আলভা এডিসন। হয়ত আমরা অনেকেই টমাস আলভা এডিসনের ব্যাপারে জানি। তার আবিষ্কার, সফলতা সব ব্যাপারেই জানি কিন্তু তার জীবনের এমন কিছু জিনিস রয়েছে যেগুলো আমাদের অজানা। নিচে সেগুলো দেওয়া হল-
টিচারদের অনাগ্রহ
সাত ভাইবোনের মধ্যে টমাস আলভা এডিসন ছিলেন সবার ছোট। তার স্কুলের শিক্ষকরা তাকে খুবই দুর্বল ছাত্র ভেবেছিল। পড়ায় মন বসতো না বিধায় প্রায় সময়ই শিক্ষকরা প্রায় সময়ই তাকে বাসায় পাঠিয়ে দিত। কিন্তু এডিসন তার সাফল্যের জন্য তার সম্পূর্ণ কৃ্তিত্ব তার মাকে দিয়েছেন। তার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তার পাশে তার মাকে পেয়েছেন। তার প্রতি শিক্ষকদের অনীহার কারণে তার মা তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে আনেন। তার প্রতি তার মায়ের পুরো আস্থা ছিল। তিনি নিজেই পরবর্তিতে এডিসনের পড়ানোর দায়িত্ব নেন।
প্রথম ল্যাব
ছোটবেলা থেকে এডিসনের তার চারপাশের জিনিসের প্রতি আগ্রহ ছিল অসীম। ৯ বছর বয়স থেকেই তিনি বাসায় ছোট ছোট এক্সিপেরিমেন্ট চালান। তিনি তার হাত খরচের পুরোটাই এক্সপেরিমেন্টের জন্য বিভিন্ন কেমিক্যাল কেনার জন্য ব্যয় করতেন। তিনি এমন কিছু কেমিক্যাল কিনেছিলেন যেগুলো ছিল অমূল্য। তিনি সেগুলোকে সাবধানে একটি বোতলে সংরক্ষন করতেন। বোতলগুলোকে সবার কাছ থেকে দূরে রাখার জন্য সেগুলোকে “বিষ” নামে লিখে রেখেছিলেন। ১০ বছর বয়সে বাড়ির বেজমেন্টে তিনি তার প্রথম ল্যাবরেটরি বানান।
বধিরতা,আশীর্বাদ নাকি অভিশাপ
এডিসনের কানে শোনায় সমস্যা ছিল। তিনি কানে শুনতে পেতেন না। অনেকের ধারনা তিনি তার বাবার কাছ থেকে বধিরতা পেয়েছেন কারণ তার বাবাও শুনতে পেতেন না। কিন্তু বধিরতার ফলে তার বেশ সুবিধাও হয়েছে। যেহেতু তিনি শুনতে পেতেন না তাই মনযোগ সহকারে কাজ করতে পারতেন। কোন শব্দই তার কানে যেত না যার কারণে তার কাজে কোন বিঘ্ন ঘটতো না। এছাড়াও তিনি কাজপাগল বিজ্ঞানী ছিলেন। বধিরতার কারণে তিনি বেশি সময় ধরে কাজ করতে পারতেন। বস্তুতই বধিরতা তার জন্য আশীর্বাদ ছিল।
প্রথমবার চাকরিচ্যুত হওয়া
১৪ বছর বয়সে এডিসন ওয়েস্টার্ন ইউনিয়নে টেলিগ্রাফ অপারেটর হিসেবে কাজ করা শুরু করেন। তিনি দিনের বেলা কাজ না করে রাতের বেলা কাজ করতেন যাতে করে তিনি তার এক্সপেরিমেন্ট গুলো করতে পারতেন। কিন্তু পরবর্তীতে এই চাকরি রক্ষা করা সম্ভব হয় নি। ব্যাটারিতে সালফিউরিক এসিডের উপর পরীক্ষা চালানোর সময় আগুন ধরে যায়। আগুনে টেলিগ্রাফ অফিস ক্ষতিগ্রস্থ হয়। আর এই ঘটনার পরেই তার চাকরি চলে যায়।
প্রথম প্যাটেন্ট
নিবার্চনের সময় ভোটিং রেকর্ড করার জন্য এডিসন একটি যন্ত্র আবিষ্কার করে। সেই সময়ে তার বয়স ছিল ২২ বছর। তিনি সেই আবিষ্কারের জন্য প্যাটেন্ট ও নেন। ভোট রেকর্ড করার জন্য ব্যবস্থাপককে প্রত্যেকবার সুইচ পরিবর্তন করতে হত। কিন্তু মেম্বাররা সঠিক ভাবে যন্ত্রটি ব্যবহার করতে পারেনি। ভোট ঠিকমত রেকর্ড করা যায়নি কারণ মেম্বাররা বারবার তাদের ভোট চেঞ্জ করছিল। পরবর্তীতে গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান যন্ত্রটি বাতিল করে দেন ও প্যাটেন্ট ও বাতিল হয়ে যায়।
মিনাকে গোপন কোডের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব
এডিসনের স্ত্রী মেরি মারা যাওয়ার ২ বছর পর তার সাথে সুদর্শন মিনা মিলারের সাথে দেখা হয়। এটি উভয়ের জন্যই প্রথম দর্শনে প্রেমে পড়ে যাওয়া ছিল। তারা একসাথে সময় কাটাতো। এডিসন তাকে মোর্স কোড ট্যাপিং ভাষাও শিখিয়েছিল। তারা যখন অন্যান্য মানুষদের সাথে থাকতো তখন মোর্স কোড ট্যাপিং এর মাধ্যমে কথা বলত। একদিন এডিসন মিনাকে মোর্স কোডের মাধ্যমে “. – — ..- .-.. -.. -.– — ..- — .- .-. .-. -.– — .” ম্যাসেজ পাঠায় ও মিনাও তাকে “-.– .” লিখে ফিরতি বার্তা দেয়। এর কিছুদিন পরেই তারা বিয়ে করে।
রহস্যজনক ট্যাটু
মিচুয়াল লাইফ ইন্সুরেন্সের রেজিস্টার মতে এডিসনের বাম হাতে ট্যাটু আঁকা ছিল। ট্যাটুতে মাত্র ৫ টি ডট ছিল। ট্যাটুর ব্যাপারটি সম্পূর্ণই রহস্যজনক ছিল কারণ কেউই এই ট্যাটুর মানে জানতো না। এডিসনই প্রথম আনঅফিসিয়ালি stencil-pen ব্যবহার করে ট্যাটু মেশিন বানায়। ১৮৭৬ সালে তিনি stencil-pen এর জন্য প্যাটেন্ট গ্রহন করেন। পরবর্তীতে Samuel O’Reilly এডিসনের ট্যাটু মেশিনকে কিছুটা পরিবর্তন করেন।
এক্সরে
হাসপাতালগুলিতে ব্যবহৃত আধুনিক ফ্লোরোস্কোপ আবিষ্কারের জন্য এডিসন এক্স-রে ব্যবহার করেছিলেন। সেই সময় এক্স-রে গুলি অনিরাপদ বলে বিবেচিত হতো না। এডিসন তার কর্মচারী ক্লারেন্স ড্যালিকে একটি ফ্লোরোস্কোপ তৈরি করতে নির্দেশ দেন। ক্লারেন্স তার হাতে এক্স-রে টিউব পরীক্ষা করেন এবং এর ফলে তার হাতে সংক্রমণ তৈরি হয়। এই সংক্রামনের ফলে ড্যালিকে শুধু তার হাত নয় বরং তার জীবন ও হারাতে হয়েছিল। এডিসন ড্যালির মৃত্যুর ব্যাপারে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন ও হতাশ হয়ে পড়েন। পরে তিনি এক্সরে গবেষনা বন্ধ করে দেন।
কংক্রিটের বাসা
এডিসন এক সময়ে সিমেন্ট ব্যবসা শুরু করার কথা ভেবেছিলেন। তিনি নিই ইয়র্ক শহরের বাসস্থানের সমস্যা সমাধানের করতে চেয়েছিলেন। তিনি ছাচের মাধ্যমে শুধু সিমেন্ট দিয়ে বাড়ি বানাতে চেয়েছিলেন। তিনি বিভিন্ন সাইজের জানালা,সিড়ি ও বাথটাব বানানোর কথাও ভেবেছিলেন ছাচের মাধ্যমে। কিন্তু তার এই পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত ছিল না। তাই এই পরিকল্পনা থেকে তাকে সরে আসতে হয়। যদিও তিনি নিজের জন্য এরকম একটি বাড়ি বানিয়েছিলেন। তিনি কংক্রিটের পিয়ানো ও আসবাবপত্রও বানিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলো জনসাধারনের মনযোগ আকর্ষন করতে ব্যর্থ হয়।
হাতি ও এডিসন
একশতের ও বেশি পাওয়ার স্টেশনের মাধ্যমে এডিসন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিদুৎ সরবরাহ করত কিন্তু তিনি DC ব্যবস্থায় বিদুৎ সরবরাহের পক্ষপাতিত্ব ছিলেন না। এমন সময়ে তিনি DC ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রমানের জন্য একটি সুযোগ পেয়ে যান। হুট করে সার্কাসের একটি হাতি বন্য হয়ে ওঠে। এই বুনো হাতির আক্রমনে বেশ কিছু মানুষ মারাও যান। হাতিটি একটি হুমকি হয়ে দাড়িয়েছিল ও সার্কাস মালিক একে মেরে ফেলতে চান। যদিও এডিসন হাতিটি মারার পক্ষে ছিলেন না তাও তিনি এটির দায়িত্ব নেন প্রমানের জন্য। তিনি হাতিটির উপর ৬০০০ ভোল্টের বৈদ্যুতিক AC current ব্যবহার করেন ও কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই হাতিটি মারা যান।

No comments

Powered by Blogger.