শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম্: দক্ষিণ এশিয়ায় ‘জাতি-রাষ্ট্র’-এর সংকট
দক্ষিণ-পূর্ব
এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশ আয়তনে খুব ছোটই বলা যায়। কিন্তু
এইরূপ ছোট বড় সকল দেশের সমস্যা ও সম্ভাবনা বর্তমানে আঞ্চলিক পরিস্থিতির
সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। গত কয়েক দশকে আমরা বিশ্বায়নের ব্যাপকতা
দেখেছি। গত এক দশক ধরে দেখছি বাংলাদেশে আঞ্চলিক পরিস্থিতির লক্ষ্যণীয়
প্রভাব। দক্ষিণ এশিয়ার কোন দেশই এইরূপ প্রভাব অগ্রাহ্য করে এককভাবে এগোতে
পারবে না আর। পাশাপাশি, বৈশ্বিক ভূ-রাজনীতির অন্যতম কেন্দ্র এখন
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। আবার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ধুঁকছে পারস্পরিক বিবাদ ও
এথনো পলিটিকস্-এর অন্ত:কলহেও। ফলে বর্মা থেকে আফগানিস্তান পর্যন্ত জনপদগুলো
রক্তপাতপূর্ণ এক পরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে, যদিও খুব ধীর লয়ে। সেই
‘পরিবর্তন’ও অনিশ্চয়তায় ভরা।
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই আসন্ন উত্থান-পতনের অনিবার্যতায় কাজ করছে তার বিবিধ জাতীয়তাবাদের বৈরিতা। আলতাফ পারভেজের ‘শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম্ : দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিরাষ্ট্রের সংকট’ সেই জাতীয়তাবাদী টানাপোড়েনের একটি বড় কেস স্টাডি। এখানে মূলত শ্রীলঙ্কার তামিল জাতীয়তাবাদের পূর্বাপর আলোচিত হলেও তা ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে জাতীয়তাবাদী দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক পটভূমিতে। লেখক ‘এথনো-পলিটিক্স’ বলে একটি নতুন ধারণা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মূল সংকটটি বুঝবার ওপর জোর দিচ্ছেন। ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী’ শীর্ষক সাড়া জাগানো গ্রন্থের পর এবার এই লেখক অনুসন্ধানী আলো ফেলেছেন নৃতাত্ত্বিক রাজনীতির উপর।
আমরা জানি, উপনিবেশিক শক্তি প্রায় ৭০ বছর আগে ভারত, পাকিস্তান, বর্মা, শ্রীলঙ্কাকে একই সময় ‘স্বাধীনতা’ দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সেক্যুলার ‘জাতি-রাষ্ট্র’ গঠনের সুপারিশ ও চ্যালেঞ্জও দিয়ে গিয়েছিল। সেই চ্যালেঞ্জের পরিণতি এই হয়েছে যে, আরকান, পার্বত্য চট্টগ্রাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, পাঞ্জাব, আসাম, কাশ্মীর, বালুচিস্থান, মধেস, জাফনাসহ অনেক জনপদ আজও জ্বলছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ‘জাতি-রাষ্ট্র’ – এর মডেল কিভাবে এবং কেন ব্যর্থ হলো এবং তার সম্ভাব্য পরিণতি কি তারই গভীর অনুসন্ধান এই গ্রন্থ। লেখক কেবল যে, সিংহলি ও তামিলদের সংঘাতের ঐতিহাসিক পূর্বাপর নিয়ে তথ্য-উপাত্ত হাজির করেছেন তাই নয়, একই সঙ্গে ২৬ বছর স্থায়ী ঐ সংঘাতে ভারতের প্রায় তিন দশক পুরানো সর্বগ্রাসী হস্তক্ষেপেরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে অনুসন্ধানের উপসংহার হলো, এথনো পলিটিক্সে বহির্দেশীয় হস্তক্ষেপ সেই সংকটকে আরও জটিল ও বিপথগামী করে। লেখক এই বার্তা হাজির করেছেন পাকিস্তান, বর্মা, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাসহ সকলের জন্য।
জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগকে ব্যবহার করে শুরু হলেও এথনো-পলিটিক্স কীভাবে অস্ত্র ব্যবসা, সামরিক আমলাতন্ত্র, ন্যায়বিচারহীন মানবিক বিপর্যয় এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের পুষ্টি সাধন করে চলে তারও বিস্তর তথ্য দিচ্ছে এই গ্রন্থ। তামিল ইলম্- এর সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা ছাড়াও শ্রীলঙ্কাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উদীয়মান বিবাদের পর্যালোচনাও রয়েছে অনুসন্ধানে। আগামীতে দক্ষিণ এশিয়া নৃতাত্ত্বিক ঘৃণাকে উপজীব্য করে কীভাবে ভূ-রাজনীতির উত্তপ্ত কড়াই হতে চলেছে তার ইশারা-ইঙ্গিত গ্রন্থটির বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে। রয়েছে জাতীয়তাবাদী ঘৃণা-বিদ্বেষ থেকে নিষ্কৃতির মৃদু পথনির্দেশও। তবে লেখক বলেছেন, জাতি-রাষ্ট্র’র টানাপোড়েন থেকে দক্ষিণ এশিয়ার আপাত মুক্তি নেই এবং ঐরূপ রাষ্ট্র কায়েম সম্ভবও নয়। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র ধারণার মৃত্যু ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ায়। জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ থেকে বের হয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে একক পলিটিক্যাল কমিউনিটি হওয়ার তাগিদ রয়েছে লেখকের ভাবনায়। তবে মূল আলোচনায় লেখক নৈর্ব্যক্তিক।
৩৩৫ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে সাতটি অধ্যায়জুড়ে মূলত ৪-৫টি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এগুলো হলো শ্রীলঙ্কায় সিংহলি বনাম তামিল বিবাদের ঐতিহাসিক আর্থ-সামাজিক বিবরণ, তামিল জাতীয়তাবাদের উত্থানের ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি হিসেবে বিশেষভাবে তামিল নাড়ু, দিল্লি ও অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা এবং সিংহলি শাসক এলিটদের কাছ থেকে ‘হোমল্যান্ড’ আদায়ে এলটিটিই ও প্রভাকরণের ভূমিকা। যদিও এলটিটিই’র সঙ্গে শ্রীলঙ্কার শাসকদের যুদ্ধ চলেছে ২৬ বছর, তবে এই গ্রন্থের শুরু আরও পূর্বে এবং শেষও হয়েছে অতিসাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় শ্রীলঙ্কাচর্চা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই এ গ্রন্থকে বলা যায় বাংলা ভাষায় শ্রীলঙ্কা বিষয়ক প্রথম গবেষণা গ্রন্থ। কৌতূহল উদ্দীপক দিক হলো লেখক শুরুতে দেখিয়েছেন, কীভাবে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ বার বার আলোচিত এবং দেশটির ইতিহাসে বাংলাদেশ কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এই গ্রন্থ বাংলা ভাষায় দক্ষিণ এশিয়ায় এথনো-পলিটিক্স-এর আলোচনার পরিসর বাড়াবে। বাংলাদেশেও যে আলোচনা জরুরি।
এটা এইরূপ সিরিজের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে দাবি করা হয়েছে প্রকাশকের তরফ থেকে।
শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম্: দক্ষিণ এশিয়ায় ‘জাতি-রাষ্ট্র’-এর সংকট আলতাফ পারভেজ
ঐতিহ্য, ২০১৭ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৩৫ মূল্য : ৭২০ টাকা
>>সেলিম সারোয়ার
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই আসন্ন উত্থান-পতনের অনিবার্যতায় কাজ করছে তার বিবিধ জাতীয়তাবাদের বৈরিতা। আলতাফ পারভেজের ‘শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম্ : দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিরাষ্ট্রের সংকট’ সেই জাতীয়তাবাদী টানাপোড়েনের একটি বড় কেস স্টাডি। এখানে মূলত শ্রীলঙ্কার তামিল জাতীয়তাবাদের পূর্বাপর আলোচিত হলেও তা ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে জাতীয়তাবাদী দ্বন্দ্বের ঐতিহাসিক পটভূমিতে। লেখক ‘এথনো-পলিটিক্স’ বলে একটি নতুন ধারণা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার মূল সংকটটি বুঝবার ওপর জোর দিচ্ছেন। ‘মুজিব বাহিনী থেকে গণবাহিনী’ শীর্ষক সাড়া জাগানো গ্রন্থের পর এবার এই লেখক অনুসন্ধানী আলো ফেলেছেন নৃতাত্ত্বিক রাজনীতির উপর।
আমরা জানি, উপনিবেশিক শক্তি প্রায় ৭০ বছর আগে ভারত, পাকিস্তান, বর্মা, শ্রীলঙ্কাকে একই সময় ‘স্বাধীনতা’ দিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সেক্যুলার ‘জাতি-রাষ্ট্র’ গঠনের সুপারিশ ও চ্যালেঞ্জও দিয়ে গিয়েছিল। সেই চ্যালেঞ্জের পরিণতি এই হয়েছে যে, আরকান, পার্বত্য চট্টগ্রাম, মণিপুর, নাগাল্যান্ড, পাঞ্জাব, আসাম, কাশ্মীর, বালুচিস্থান, মধেস, জাফনাসহ অনেক জনপদ আজও জ্বলছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ‘জাতি-রাষ্ট্র’ – এর মডেল কিভাবে এবং কেন ব্যর্থ হলো এবং তার সম্ভাব্য পরিণতি কি তারই গভীর অনুসন্ধান এই গ্রন্থ। লেখক কেবল যে, সিংহলি ও তামিলদের সংঘাতের ঐতিহাসিক পূর্বাপর নিয়ে তথ্য-উপাত্ত হাজির করেছেন তাই নয়, একই সঙ্গে ২৬ বছর স্থায়ী ঐ সংঘাতে ভারতের প্রায় তিন দশক পুরানো সর্বগ্রাসী হস্তক্ষেপেরও বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে অনুসন্ধানের উপসংহার হলো, এথনো পলিটিক্সে বহির্দেশীয় হস্তক্ষেপ সেই সংকটকে আরও জটিল ও বিপথগামী করে। লেখক এই বার্তা হাজির করেছেন পাকিস্তান, বর্মা, ভারত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কাসহ সকলের জন্য।
জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগকে ব্যবহার করে শুরু হলেও এথনো-পলিটিক্স কীভাবে অস্ত্র ব্যবসা, সামরিক আমলাতন্ত্র, ন্যায়বিচারহীন মানবিক বিপর্যয় এবং ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের পুষ্টি সাধন করে চলে তারও বিস্তর তথ্য দিচ্ছে এই গ্রন্থ। তামিল ইলম্- এর সংগ্রামে ভারতের ভূমিকা ছাড়াও শ্রীলঙ্কাকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উদীয়মান বিবাদের পর্যালোচনাও রয়েছে অনুসন্ধানে। আগামীতে দক্ষিণ এশিয়া নৃতাত্ত্বিক ঘৃণাকে উপজীব্য করে কীভাবে ভূ-রাজনীতির উত্তপ্ত কড়াই হতে চলেছে তার ইশারা-ইঙ্গিত গ্রন্থটির বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে। রয়েছে জাতীয়তাবাদী ঘৃণা-বিদ্বেষ থেকে নিষ্কৃতির মৃদু পথনির্দেশও। তবে লেখক বলেছেন, জাতি-রাষ্ট্র’র টানাপোড়েন থেকে দক্ষিণ এশিয়ার আপাত মুক্তি নেই এবং ঐরূপ রাষ্ট্র কায়েম সম্ভবও নয়। অর্থাৎ পাশ্চাত্যের রাষ্ট্র ধারণার মৃত্যু ঘটেছে দক্ষিণ এশিয়ায়। জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ থেকে বের হয়ে দক্ষিণ এশিয়াকে একক পলিটিক্যাল কমিউনিটি হওয়ার তাগিদ রয়েছে লেখকের ভাবনায়। তবে মূল আলোচনায় লেখক নৈর্ব্যক্তিক।
৩৩৫ পৃষ্ঠার গ্রন্থটিতে সাতটি অধ্যায়জুড়ে মূলত ৪-৫টি বিষয় আলোচিত হয়েছে। এগুলো হলো শ্রীলঙ্কায় সিংহলি বনাম তামিল বিবাদের ঐতিহাসিক আর্থ-সামাজিক বিবরণ, তামিল জাতীয়তাবাদের উত্থানের ভূ-রাজনৈতিক পটভূমি হিসেবে বিশেষভাবে তামিল নাড়ু, দিল্লি ও অন্যান্য দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা এবং সিংহলি শাসক এলিটদের কাছ থেকে ‘হোমল্যান্ড’ আদায়ে এলটিটিই ও প্রভাকরণের ভূমিকা। যদিও এলটিটিই’র সঙ্গে শ্রীলঙ্কার শাসকদের যুদ্ধ চলেছে ২৬ বছর, তবে এই গ্রন্থের শুরু আরও পূর্বে এবং শেষও হয়েছে অতিসাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহে। বাংলাদেশে বাংলা ভাষায় শ্রীলঙ্কাচর্চা প্রায় নেই বললেই চলে। তাই এ গ্রন্থকে বলা যায় বাংলা ভাষায় শ্রীলঙ্কা বিষয়ক প্রথম গবেষণা গ্রন্থ। কৌতূহল উদ্দীপক দিক হলো লেখক শুরুতে দেখিয়েছেন, কীভাবে শ্রীলঙ্কার গৃহযুদ্ধে বাংলাদেশ বার বার আলোচিত এবং দেশটির ইতিহাসে বাংলাদেশ কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।
এই গ্রন্থ বাংলা ভাষায় দক্ষিণ এশিয়ায় এথনো-পলিটিক্স-এর আলোচনার পরিসর বাড়াবে। বাংলাদেশেও যে আলোচনা জরুরি।
এটা এইরূপ সিরিজের প্রথম গ্রন্থ হিসেবে দাবি করা হয়েছে প্রকাশকের তরফ থেকে।
শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম্: দক্ষিণ এশিয়ায় ‘জাতি-রাষ্ট্র’-এর সংকট আলতাফ পারভেজ
ঐতিহ্য, ২০১৭ পৃষ্ঠা সংখ্যা ৩৩৫ মূল্য : ৭২০ টাকা
>>সেলিম সারোয়ার
No comments