অমীমাংসিত দায়বদ্ধতা : লক্ষ্য যখন যৌনকর্মী by সাকিলা মতিন মৃদুলা
অসম্পূর্ণ
গর্ভপাতের রেশ মেয়েটাকে ভীষণ কষ্ট দিচ্ছে। ব্যথায় কাতরাচ্ছে রীতিমত।
কাউকে বলতেও পারছেনা। কি করে বলবে? পেশায় যে সে একজন যৌনকর্মী। 'অসম্পূর্ণ
গর্ভপাত'- একবার নয়, কয়েকবার। অথচ কীইবা এমন বয়স? বড়জোর বিশ কিংবা
একুশ?
যে পেশায় এতটা কষ্ট পেতে হয়, যে পেশায় সমাজের ভোগ্য হয়েও সমাজ থেকে মুখ লুকাতে হয়, সেখানে কি কেবল শখের বশে আসা? কিংবা শুধুই উচ্চ বিলাসিতা? তাই কি সম্ভব?
বিবেকের কাছে সেই থেকে দায়বদ্ধতা। হাসপাতালে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আর তাই নিজেরাই কোনরকমে হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে চিকিৎসা সেরে নেয়! কোনরকমে বেঁচে থাকা যাকে বলে!
পেশা হিসেবে যৌনকর্ম ভাল কি মন্দ? গ্রহণযোগ্য কিংবা অগ্রহণযোগ্য? স্বীকৃতিযোগ্য অথবা পরিত্যাজ্য? সব জল্পনা কল্পনা- তর্ক বিতর্কের ঊর্ধ্বে বিবেচ্য বিষয় কতটুকু স্বাস্থ্যকর? কতটুকু ক্ষতিকর? নিজের জন্য, পরিবার, পরিবেশ, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য?
সর্বত্র স্ববিরোধীতা। একদিকে ২০০০ সালের হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বাংলাদেশে যৌন ব্যবসা আইনত বৈধ। অথচ বাংলাদেশের আইন ও সংবিধান এর বিরোধিতা করছে।
তাহলে আমরা চাইছি কী? করছিই বা কী? চাওয়া এবং পাওয়ার ভেতর কোন ফাঁক-ফোঁকর থাকছেনা তো? যা কিছুই করেছি বা করছি সুস্পষ্টতা থাকছে তো? বোধের কাছে বিবেকের সুস্পষ্টতা দূরদর্শী করে। কার্য-কারণ সুস্পষ্ট হলে ফলাফলে গুনগত স্থায়িত্ব আসে।
পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশার একটি যৌন ব্যবসা। যদিও যৌনকর্মী শব্দটির ব্যবহার অপেক্ষাকৃত নতুন। ধারণা করা হয়, 'পতিতাবৃত্তি'র বদলে 'যৌন ব্যবসা' এবং 'পতিতা'/'বেশ্যা' শব্দটির পরিবর্তে 'যৌনকর্মী'র ব্যবহারে মানুষ হিসেবে সংশ্লিষ্টদের অপেক্ষাকৃতভাবে সম্মানিত করা হয়।
এই পেশা এবং সংশ্লিষ্টদের জন্য করণীয় সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক শুরু থেকে আজ অবধি সারা বিশ্বেই বিদ্যমান। বলা যায় বিশ্বব্যাপী দুটো ভাগ আছে। কেউ কেউ এই পেশাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে। অন্যদিকে কেওবা চান চিরতরে বন্ধ হয়ে যাক এই ব্যবসা।
আঠারো বছর আগে বাংলাদেশে টানবাজার- নিমতলী যৌনপল্লী উচ্ছেদের প্রতিবাদে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। এই পিটিশনের রায়ে বলা হয়, নারী যৌনকর্মী অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের হলে এবং যৌন ব্যবসাই তার একমাত্র আয়ের উৎস হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে তিনি বৈধভাবে এই ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনের ফলাফল যৌনকর্মীদের সাংগঠনিক সংঘবদ্ধতা। উদ্দেশ্য - ক্ষমতায়ন? কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এই ক্ষমতায়ন? প্রত্যাশা কী ছিল? পতিতা থেকে যৌনকর্মী- ব্যস! এতটুকুই? নাম সর্বস্ব পরিবর্তিত পরিচয়? নাকি উন্নয়ন প্রকল্পের লক্ষ্যবস্তু?
সভ্য সমাজের সভ্য মানুষগুলোই তো যায় তাদের কাছে। অথচ সভ্যতা তাদের ঘৃণা করে। অস্বীকার করে! এটা অন্যায়। মুখোশের আড়ালের মুখস্থ আচরণ। একদা অস্পৃশ্য যৌন পেশায় নিয়োজিত নারীরা এখন তুলনামূলকভাবে দৃশ্যমান। মৃত্যুর পর নিজ নিজ ধর্মে দাফন প্রক্রিয়া তারা দাবি করতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশে যৌনপল্লী, ভ্রাম্যমাণ, আবাসিক এলাকা ও হোটেল-ভিত্তিক যৌনকর্মী রয়েছে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই পেশায় যারা নিয়োজিত তারা শ্রমই বিক্রি করছেন। অস্বাস্থ্যকর এবং ক্ষতিকর বিধায় শ্রমের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু, শ্রমিককে নিয়ে নয়।
এই পেশাকে কেন্দ্র করেও দুটি পক্ষ বিদ্যমান। একটি শ্রমিক পক্ষ, অন্যটি মালিক পক্ষ। এখানেও শোষিত ও শাসিত বিষয়টি প্রযোজ্য।
অনেকেই মনে করেন, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা বৃথা। অস্বীকার করছিনা। হতেই পারে। কিন্তু, কেন? সেটাও তো ভাবতে হবে! দায়ী কে?
'পুনর্বাসনের আগ্রহ নেই যৌনকর্মীদের', 'টাকার লোভ পেয়ে বসেছে,' 'এত সহজে /আরামে টাকার গন্ধ পেলে অন্য কাজ দিলেও করবে কেন?'- ঢালাও এবং একতরফা এই মন্তব্যগুলো কতটুকু প্রযোজ্য?
একজন খদ্দেরের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে যখন জোরপূর্বক দলগতভাবে ভোগের শিকার হন? ব্যথায় কাতরাতে থাকেন একজন যৌনকর্মী! অথচ কিচ্ছুটি বলার সুযোগ নেই।
ধর্ষিত হয়েও ধর্ষকের নাম প্রকাশের উপায় থাকেনা। ধর্ষিতা হিসেবেও বিচার চাইবার অধিকার নেই! সমাজের ভেতরে থেকেও সামাজিক জীব হিসেবে স্বীকৃতি নেই! বিকৃত রুচির খদ্দেরের বিকৃত চাহিদা মেটাতে বাধ্য সে!
কী করে আরামদায়ক হতে পারে এই পেশা?
পুনর্বাসন করলেই অথবা পুনর্বাসন চাইলেই পুনর্বাসিত হওয়া যায়না। অন্তত যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা এত সহজ নয়। চাইলেই কি সমাজ তাকে গ্রহণ করবে? কে দেবে সেই নিশ্চয়তা?
বোধের একেবারে গভীরে স্পর্শের প্রয়োজন। প্রশ্ন করতে হবে নিজেকে -'ভান করছি নাতো?' প্রশ্ন করতে হবে চারপাশকে। সংশ্লিষ্ট সকলকে। প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবে প্রতিটি উদ্যোগ এবং সাফল্য।
কথার সাথে কাজের, কাজের সাথে কথার আত্মিক সম্পর্ক থাকা জরুরী। কথা এবং কাজের সাথে চিন্তার গভীরতাও প্রয়োজন। তবেই না স্ববিরোধী উপাদানগুলো খোলস খুলবে। সমাধানও তখন হবে গতিশীল এবং সময়োপযোগী।
এইচআইভি এইডস সংক্রমণে যৌনকর্মীরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এক্ষেত্রেও কিছুটা অস্পষ্টতা এবং স্ববিরোধিতা রয়েছে। যৌনকর্মীরা ঝুঁকির ফলাফল, নাকি ঝুঁকির কারণ? নাকি দুটোই?
এখনও বলতে শোনা যায়, 'খারাপ জায়গা', 'খারাপ মেয়ে' । যেখানে গেলে অনিরাপদ (কনডম বিহীন) যৌন সম্পর্কের ফলে এইচআইভি/ এইডস সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
'বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক' নিয়ে এখনও আমরা কথা বলছি কম। এই সম্পর্ক হতে পারে যে কারও সাথে। শুধুমাত্র যৌন কর্মীর সাথে যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেই যে তথাকথিত সভ্য সমাজ ভেস্তে যাবে, তা তো নয়! যৌন কর্মী ছাড়াও যৌন সম্পর্ক হতে পারে।
আবার যৌন কর্মী মাত্রই যে পেশাদার হবে তাও কিন্তু নয়। সুতরাং যৌনবাহিত রোগ সংক্রমণের জন্য যৌন কর্মী কিংবা যৌনপল্লীই কেবল উৎস নয়। বরং যৌন কর্মীরাও শিকার হতে পারেন। সচেতন সমাজ থেকে এই ধারণা সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়াতে হবে।
খদ্দের গ্রুপের চাইতে যৌন কর্মীদের কাছে পৌঁছানো সহজ। আর তাই এইচআইভি প্রোগ্রামে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যৌন কর্মীদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সরবরাহ করা হয় কনডম। কখনও খদ্দের হারানোর ভয়, আবার কখনও অসচেতনতা, কখনওবা পুরুষত্ব কিংবা অর্থের জোর - বিভিন্ন কারণে কনডম ব্যবহার করা সম্ভব হয়না যৌন কর্মীর পক্ষে। সেক্ষেত্রে ধীরে ধীরে খদ্দের এর কাছে পৌঁছানোর জন্য সুচিন্তিত কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে।
জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক, অন্যায়ভাবে বিকৃত যৌনাচার, বলপূর্বক দলীয় যৌন সম্পর্ক নীরবে সয়ে যেতে হয় যৌনকর্মীদের। অথচ প্রতিটি সূত্র থেকেই ছড়াতে পারে যৌনরোগ। পরবর্তীতে বেড়ে যায় এইচআইভি/এইডসের সম্ভাবনা।
উল্লেখিত বিষয়গুলো নারী নির্যাতনের অধীনে আসবার কথা। অথচ যৌন কর্মী হবার অপরাধে ওরা নির্যাতনের আওতায় আসার অধিকার রাখে না।
এমনি অসংখ্য অমীমাংসিত টুকরো টুকরো করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে। অগ্রগতির পথে কিছুটা সময়ের জন্য থামা জরুরী । পেছনে তাকিয়ে স্ববিরোধী উপাদানগুলোকে গুছিয়ে সামনের দায়বদ্ধতায় স্পষ্ট হতে হবে। বিদ্যা, বুদ্ধি, বিবেক আর হৃদয়ের সংস্পর্শ থাকাটা বাঞ্ছনীয়। কিছুই তবে অমীমাংসিত থাকবেনা আর।
যে পেশায় এতটা কষ্ট পেতে হয়, যে পেশায় সমাজের ভোগ্য হয়েও সমাজ থেকে মুখ লুকাতে হয়, সেখানে কি কেবল শখের বশে আসা? কিংবা শুধুই উচ্চ বিলাসিতা? তাই কি সম্ভব?
বিবেকের কাছে সেই থেকে দায়বদ্ধতা। হাসপাতালে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। আর তাই নিজেরাই কোনরকমে হাতুড়ে ডাক্তারের সাহায্যে চিকিৎসা সেরে নেয়! কোনরকমে বেঁচে থাকা যাকে বলে!
পেশা হিসেবে যৌনকর্ম ভাল কি মন্দ? গ্রহণযোগ্য কিংবা অগ্রহণযোগ্য? স্বীকৃতিযোগ্য অথবা পরিত্যাজ্য? সব জল্পনা কল্পনা- তর্ক বিতর্কের ঊর্ধ্বে বিবেচ্য বিষয় কতটুকু স্বাস্থ্যকর? কতটুকু ক্ষতিকর? নিজের জন্য, পরিবার, পরিবেশ, সমাজ তথা রাষ্ট্রের জন্য?
সর্বত্র স্ববিরোধীতা। একদিকে ২০০০ সালের হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বাংলাদেশে যৌন ব্যবসা আইনত বৈধ। অথচ বাংলাদেশের আইন ও সংবিধান এর বিরোধিতা করছে।
তাহলে আমরা চাইছি কী? করছিই বা কী? চাওয়া এবং পাওয়ার ভেতর কোন ফাঁক-ফোঁকর থাকছেনা তো? যা কিছুই করেছি বা করছি সুস্পষ্টতা থাকছে তো? বোধের কাছে বিবেকের সুস্পষ্টতা দূরদর্শী করে। কার্য-কারণ সুস্পষ্ট হলে ফলাফলে গুনগত স্থায়িত্ব আসে।
পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশার একটি যৌন ব্যবসা। যদিও যৌনকর্মী শব্দটির ব্যবহার অপেক্ষাকৃত নতুন। ধারণা করা হয়, 'পতিতাবৃত্তি'র বদলে 'যৌন ব্যবসা' এবং 'পতিতা'/'বেশ্যা' শব্দটির পরিবর্তে 'যৌনকর্মী'র ব্যবহারে মানুষ হিসেবে সংশ্লিষ্টদের অপেক্ষাকৃতভাবে সম্মানিত করা হয়।
এই পেশা এবং সংশ্লিষ্টদের জন্য করণীয় সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক শুরু থেকে আজ অবধি সারা বিশ্বেই বিদ্যমান। বলা যায় বিশ্বব্যাপী দুটো ভাগ আছে। কেউ কেউ এই পেশাকে টিকিয়ে রাখার পক্ষে। অন্যদিকে কেওবা চান চিরতরে বন্ধ হয়ে যাক এই ব্যবসা।
আঠারো বছর আগে বাংলাদেশে টানবাজার- নিমতলী যৌনপল্লী উচ্ছেদের প্রতিবাদে হাইকোর্টে একটি রিট পিটিশন দাখিল করা হয়। এই পিটিশনের রায়ে বলা হয়, নারী যৌনকর্মী অনূর্ধ্ব ১৮ বছরের হলে এবং যৌন ব্যবসাই তার একমাত্র আয়ের উৎস হিসেবে প্রমাণ করতে পারলে তিনি বৈধভাবে এই ব্যবসায় অংশগ্রহণ করতে পারবেন।
দীর্ঘমেয়াদী আন্দোলনের ফলাফল যৌনকর্মীদের সাংগঠনিক সংঘবদ্ধতা। উদ্দেশ্য - ক্ষমতায়ন? কিন্তু প্রশ্ন হলো কেন এই ক্ষমতায়ন? প্রত্যাশা কী ছিল? পতিতা থেকে যৌনকর্মী- ব্যস! এতটুকুই? নাম সর্বস্ব পরিবর্তিত পরিচয়? নাকি উন্নয়ন প্রকল্পের লক্ষ্যবস্তু?
সভ্য সমাজের সভ্য মানুষগুলোই তো যায় তাদের কাছে। অথচ সভ্যতা তাদের ঘৃণা করে। অস্বীকার করে! এটা অন্যায়। মুখোশের আড়ালের মুখস্থ আচরণ। একদা অস্পৃশ্য যৌন পেশায় নিয়োজিত নারীরা এখন তুলনামূলকভাবে দৃশ্যমান। মৃত্যুর পর নিজ নিজ ধর্মে দাফন প্রক্রিয়া তারা দাবি করতে পারে।
বর্তমানে বাংলাদেশে যৌনপল্লী, ভ্রাম্যমাণ, আবাসিক এলাকা ও হোটেল-ভিত্তিক যৌনকর্মী রয়েছে। প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এই পেশায় যারা নিয়োজিত তারা শ্রমই বিক্রি করছেন। অস্বাস্থ্যকর এবং ক্ষতিকর বিধায় শ্রমের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু, শ্রমিককে নিয়ে নয়।
এই পেশাকে কেন্দ্র করেও দুটি পক্ষ বিদ্যমান। একটি শ্রমিক পক্ষ, অন্যটি মালিক পক্ষ। এখানেও শোষিত ও শাসিত বিষয়টি প্রযোজ্য।
অনেকেই মনে করেন, যৌনকর্মীদের পুনর্বাসনের চেষ্টা বৃথা। অস্বীকার করছিনা। হতেই পারে। কিন্তু, কেন? সেটাও তো ভাবতে হবে! দায়ী কে?
'পুনর্বাসনের আগ্রহ নেই যৌনকর্মীদের', 'টাকার লোভ পেয়ে বসেছে,' 'এত সহজে /আরামে টাকার গন্ধ পেলে অন্য কাজ দিলেও করবে কেন?'- ঢালাও এবং একতরফা এই মন্তব্যগুলো কতটুকু প্রযোজ্য?
একজন খদ্দেরের ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে যখন জোরপূর্বক দলগতভাবে ভোগের শিকার হন? ব্যথায় কাতরাতে থাকেন একজন যৌনকর্মী! অথচ কিচ্ছুটি বলার সুযোগ নেই।
ধর্ষিত হয়েও ধর্ষকের নাম প্রকাশের উপায় থাকেনা। ধর্ষিতা হিসেবেও বিচার চাইবার অধিকার নেই! সমাজের ভেতরে থেকেও সামাজিক জীব হিসেবে স্বীকৃতি নেই! বিকৃত রুচির খদ্দেরের বিকৃত চাহিদা মেটাতে বাধ্য সে!
কী করে আরামদায়ক হতে পারে এই পেশা?
পুনর্বাসন করলেই অথবা পুনর্বাসন চাইলেই পুনর্বাসিত হওয়া যায়না। অন্তত যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রে বিষয়টা এত সহজ নয়। চাইলেই কি সমাজ তাকে গ্রহণ করবে? কে দেবে সেই নিশ্চয়তা?
বোধের একেবারে গভীরে স্পর্শের প্রয়োজন। প্রশ্ন করতে হবে নিজেকে -'ভান করছি নাতো?' প্রশ্ন করতে হবে চারপাশকে। সংশ্লিষ্ট সকলকে। প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবে প্রতিটি উদ্যোগ এবং সাফল্য।
কথার সাথে কাজের, কাজের সাথে কথার আত্মিক সম্পর্ক থাকা জরুরী। কথা এবং কাজের সাথে চিন্তার গভীরতাও প্রয়োজন। তবেই না স্ববিরোধী উপাদানগুলো খোলস খুলবে। সমাধানও তখন হবে গতিশীল এবং সময়োপযোগী।
এইচআইভি এইডস সংক্রমণে যৌনকর্মীরা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। এক্ষেত্রেও কিছুটা অস্পষ্টতা এবং স্ববিরোধিতা রয়েছে। যৌনকর্মীরা ঝুঁকির ফলাফল, নাকি ঝুঁকির কারণ? নাকি দুটোই?
এখনও বলতে শোনা যায়, 'খারাপ জায়গা', 'খারাপ মেয়ে' । যেখানে গেলে অনিরাপদ (কনডম বিহীন) যৌন সম্পর্কের ফলে এইচআইভি/ এইডস সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে।
'বিবাহ বহির্ভূত যৌন সম্পর্ক' নিয়ে এখনও আমরা কথা বলছি কম। এই সম্পর্ক হতে পারে যে কারও সাথে। শুধুমাত্র যৌন কর্মীর সাথে যৌন সম্পর্কের মাধ্যমেই যে তথাকথিত সভ্য সমাজ ভেস্তে যাবে, তা তো নয়! যৌন কর্মী ছাড়াও যৌন সম্পর্ক হতে পারে।
আবার যৌন কর্মী মাত্রই যে পেশাদার হবে তাও কিন্তু নয়। সুতরাং যৌনবাহিত রোগ সংক্রমণের জন্য যৌন কর্মী কিংবা যৌনপল্লীই কেবল উৎস নয়। বরং যৌন কর্মীরাও শিকার হতে পারেন। সচেতন সমাজ থেকে এই ধারণা সাধারণ মানুষের মাঝে ছড়াতে হবে।
খদ্দের গ্রুপের চাইতে যৌন কর্মীদের কাছে পৌঁছানো সহজ। আর তাই এইচআইভি প্রোগ্রামে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যৌন কর্মীদের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সরবরাহ করা হয় কনডম। কখনও খদ্দের হারানোর ভয়, আবার কখনও অসচেতনতা, কখনওবা পুরুষত্ব কিংবা অর্থের জোর - বিভিন্ন কারণে কনডম ব্যবহার করা সম্ভব হয়না যৌন কর্মীর পক্ষে। সেক্ষেত্রে ধীরে ধীরে খদ্দের এর কাছে পৌঁছানোর জন্য সুচিন্তিত কৌশলগত পরিকল্পনা নিয়ে ভাবতে হবে।
জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক, অন্যায়ভাবে বিকৃত যৌনাচার, বলপূর্বক দলীয় যৌন সম্পর্ক নীরবে সয়ে যেতে হয় যৌনকর্মীদের। অথচ প্রতিটি সূত্র থেকেই ছড়াতে পারে যৌনরোগ। পরবর্তীতে বেড়ে যায় এইচআইভি/এইডসের সম্ভাবনা।
উল্লেখিত বিষয়গুলো নারী নির্যাতনের অধীনে আসবার কথা। অথচ যৌন কর্মী হবার অপরাধে ওরা নির্যাতনের আওতায় আসার অধিকার রাখে না।
এমনি অসংখ্য অমীমাংসিত টুকরো টুকরো করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে। অগ্রগতির পথে কিছুটা সময়ের জন্য থামা জরুরী । পেছনে তাকিয়ে স্ববিরোধী উপাদানগুলোকে গুছিয়ে সামনের দায়বদ্ধতায় স্পষ্ট হতে হবে। বিদ্যা, বুদ্ধি, বিবেক আর হৃদয়ের সংস্পর্শ থাকাটা বাঞ্ছনীয়। কিছুই তবে অমীমাংসিত থাকবেনা আর।
সাকিলা মতিন মৃদুলা : লেখক ও উন্নয়ন কর্মী |
No comments